Monday, May 1, 2023

প্লেটোনিক - কবিতাবুড়ো || Pletonik - Kobita Buro || Bengali Poem || Poetry || Kobita || কবিতা

 প্লেটোনিক 

কবিতাবুড়ো



মধ্যরাতে উশ্রী নদীর ধারে 

কেউ কি ভীষণ একলা হতে পারে? 

একলা, সে তো একলা থাকা নয়

অন্ধকারে মন খারাপের জয়।। 


মধ্যরাতের উশ্রী নদীর ঢেউ

বড্ড গভীর, তল পেলো না কেউ

গভীর, আর‌ও গভীর নদীর বুকে

ভীষণ গভীর কয়েকটা ভুলচুকে,


উশ্রী তখন বয়ঃসন্ধি পার

মধ্যরাতের স্বপ্ন হারাবার

স্বপ্ন, সে তো স্বপ্ন দেখা নয়

অজান্তে এক হারিয়ে যাবার ভয়! 


উশ্রী, সে তো অন্য কারো জানি

বুকের বাঁদিক চিনচিনে হয়রানি

অতল নদী, অদৃশ্য এক প্রেম, 

আজকে না হয় পদ্য‌ই লিখলেম!!


যে কবিতার ছন্দ সবার জানা

মধ্যরাতের গন্ধে হাসনুহানা 

ফুল নদী আর পদ্য নিয়ে সাথে, 


উশ্রী না হয় প্রেমেই থাকুক

স্পর্শ নিয়ে, ঘুমভাঙা মাঝরাতে.....


পাথেয় - রমা খাঁ || Patheyo - Roma Kha || Bengali Poem || Poetry || Kobita || কবিতা

 পাথেয় 

   রমা খাঁ 


জীবনের একটুকরো ভালোলাগা 

লেখা রইল মনের পাতায় 

জানি উজানের পলি 

ঢেকে দেবে এই ক্ষণটুকু

চিরতরে মুছতে নয় -

ভাটার টানে কখনো বা 

চিক চিক করে উঠবে অক্ষরমালা 

প্রাপ্তির ঝুলিতে পাথেয় রূপে। 



                 

বৃক্ষের প্রতিবাদ - বাপী নাগ || Brikker Pratibad - Bapi nag || Bengali Poem || Poetry || Kobita || কবিতা

 বৃক্ষের প্রতিবাদ

    বাপী নাগ 



সবুজ গাছপালা আমি আজ 

কেন হারিয়ে গেছি?

তোমাদের অযত্নে অবহেলায়

আমি ধ্বংস হচ্ছি।


মাঠের পর মাঠ ছিলাম আমি

ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে।

ঘরের নানা ফার্নিচার তৈরিতে 

আমায় বলি দিয়েছে।


আদিম যুগ থেকে চিরসবুজ 

বাঁচিয়েছি সবার প্রাণ।

কেন আমার প্রতি অত্যাচার

নেই যে আমার সম্মান।


পৃথিবী রবে না আমায় ছাড়া

পারবে না তো বাঁচতে।

কষ্ট দিয়ে কেটে ফেল মরতে

চাই না তোমার হাতে।


বৃক্ষ নেই প্রাণের অস্তিত্ব নেই

ফলবে না সোনার ফসল।

বৃক্ষহীন মানে,প্রাণহীন শ্মশান

জীবন হবে সবার অচল।


প্রতিবাদের সুরে বলতে চাই

বাঁচিয়ে রাখো আমায়।

আলো বাতাস ফলমূল দিয়ে 

বাঁচিয়ে রাখবো তোমায়।


অক্সিজেন দিয়ে প্রাণ বাঁচাই

তবু কেন বলিদান?

ভালোবেসে যত্ন করে রেখো 

আমাদের এই প্রাণ।


আগুন পিয়াসি প্রভাত - গাজী সাইফুল ইসলাম || Agun piyasi Pravat - Gaji Saiful Islam || Bengali Poem || Poetry || Kobita || কবিতা

 আগুন পিয়াসি প্রভাত

গাজী সাইফুল ইসলাম



বুকের অতল গহ্বরে কোথাও

ফুটে আছে ফুল গনগন আগুনের

আসবে না জানি তুমি এখনই 

বৃথাই অপেক্ষা ওই মধু ফাল্গুনের।


আমি দেখি ও মুখে জলন্ত সূর্য 

ভিসুভিয়াসের নগ্নিকা অগ্নুৎপাত

তবুও জাগি যে রক্তহিম শপথে

আগুন পিয়াসি উত্তপ্ত প্রভাত।


হিমালয় ঝড় জাপানি সুনামি

হাতের তালুতে নিয়ে নাচুক দৈত্যরা

বহু আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রভূমি তুমি

প্রিয়তমা তোমাকে যাবে না পর করা।

খোকার স্বপ্ন - মহুয়া হাজরা || Khokar Swapno - Mohua Hazra || ছড়া || Bengali Poem || Poetry || Kobita || কবিতা

 খোকার স্বপ্ন

মহুয়া হাজরা


রাতের বেলা আঁধার করে

বৃষ্টি নামে অঝোর ঝরে,

সারারাতই মেঘের ডাকে

যাচ্ছে তন্দ্রা টুটি।


ঘুমটি ভাঙে ভোরের বেলা

উঠোন জুড়ে জলের মেলা,

নৌকা গড়ে কাগজ দিয়ে

 সবাই বেঁধে জুটি।


এমন সময় যায় যে দেখা

দূর গগনে রবির রেখা,

হাসছে কেমন খিলখিলিয়ে

মেঘের ফাঁকে ফাঁকে।


সকাল ফুরায় সন্ধ্যা আসে

শেষ বিকেলের ছায়া ভাসে,

আকাশ জুড়ে তারার আলো

পূর্ণিমা চাঁদ ঢাকে।


ঘুমায় খোকা স্বপ্ন দেখে

জাদুর কাঠি গেছে রেখে,

পরীর রানী চুপটি করে

পূর্ণ হবে আশা।


ঘুমের রেশে পরীর দেশে

যায় চলে সে ভেসে ভেসে,

নীল পরীটি ডেকে কাছে

দেয় যে ভালোবাসা।।

বিষণ্নতা - সায়ন তরফদার || Bisonnata - Sayan Tarafdar || Bengali Poem || Poetry || Kobita || কবিতা

 বিষণ্নতা

সায়ন তরফদার



এই নক্ষত্রখচিত রাত্রি থেকে

          নেমে আসে বিষণ্নতার লেখচিত্র

চাঁদের গায়ে লেগেছে মিথ্যে অবসাদ।


বৃষ্টি এলে ঠোঁটে ঠোঁট আটকে যায়

 পুরোনো অভ্যেসে

        মাপা হয়না দূরত্বের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ

শরীর থামতে জানে না

তাই খুঁজে নেয় মিথ্যে সুখ।


অপ্রকাশিত প্রেমের মধ্যে 

        জমতে থাকে এক হাঁটু জল

আকাশের দিকে চেয়ে থেকে

জড়িয়ে ধরি রাতের নিস্তব্ধতাকে

কথা বলি নক্ষত্রের সাথে, তোর সাথে,

                         নিজের সাথে–

আমি তোকে হারানোর ভয়ে

                 কখনো নিজের কাছে পাইনি।

চ্যাপলিন - সমাজ বসু || Chaplin - Somaj bosu || অনুগল্প || Onugolpo

 চ্যাপলিন

সমাজ বসু



অফিস সেরে বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতে বেশ রাত হলো। বন্ধুর ছেলের জন্মদিন। অনুষ্ঠান বাড়ির বাইরে পার্টি ক্লাউন,চ্যাপলিন তখন একা দাঁড়িয়ে। শীতের রাত। ছোটরা সবাই চলে গেছে।

 

অফিসের পরিশ্রমের পর খাওয়ার ইচ্ছে এতটুকু ছিল না। তবু অনেক আপত্তিসত্ত্বেও, বন্ধুর অনুরোধে খাবারের পার্সেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একেবারে ফাঁকা বড় রাস্তায় তখনো দু একটা দোকান খোলা। হঠাৎ একটা দোকানে চোখ পড়ল। দোকানের স্বল্প আলোয় দেখি, সেই চ্যাপলিনবেশী ছেলেটা বিস্কুট কিনে খাচ্ছে। সেই কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তারপর ছ ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছোটদের আনন্দ দিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান বাড়ীতে এত কিছু খাবারের আয়োজনে হয়তো চা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।

--- আরে,আমি তো তোমাকেই খুঁজছি। তোমার জন্য খাবারের এই পার্সেলটা ওরা পাঠিয়েছে। নাও ধরো। 

--- সত্যি ওরা আমার জন্য খাবার পাঠিয়েছে?

--- অত প্রশ্ন কোর না। অনেক রাত হয়েছে, সোজা বাড়ি চলে যাও।

পঞ্চুদার পুকুরে পল্টু পুরকাইত - তপন তরফদার || Ponchudar pukure poltu purkaite - Tapan Tarafdar || ছোটগল্প || Short Story

 পঞ্চুদার পুকুরে পল্টু পুরকাইত

       তপন তরফদার   

 


 


      ভূতের ভয় অনেকেই পায়না তা গর্ব করে বলতে পিছপাও হয়না। তারাই আবার একটু রাত করে কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় মনে মনে সেই মন্ত্রটাই আওড়ায় “ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি, রাম লক্ষণ বুকে আছে করবে আমার কি।“ কবরস্থানের ভূতেরা রাম-লক্ষণের নাম শুনেনি। ওরা অন্য ধর্মকে মান্যতা কেন দেবে? অবশ্য এখনো প্রমাণিত হয়নি ভূতরা অন্য ধর্মকর্মে দীক্ষিত হতে পারে কি? ভূতে বিশ্বাস না করলেও সবাই জীবনে শয়নে অথবা স্বপনে ভূতের দেখা পেয়েছে।


        এখনো সমাজে বেশ কিছু লোক আছে, যেমন পল্টু পুরাকাইত যারা ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে মাথা ঘামায় না। ভূত একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ অতীত বা সত্তা বুঝায়। আমাদের পল্টু বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত। পল্টু নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে। পল্টু এখানকার অম্বিকা জুট মিলের মেকানিক। যে কোনো মেশিনের গন্ডোগোল হলে পল্টু ছাড়া গতি নেই। ওকেই সারাই করতে হয়। পল্টু অচল মেশিনটা পরীক্ষা করার সময় প্রায়শই বলে, ভূতের মতো কাজ করলে মেশিন বিগড়ে যাবেই। এখানে লক্ষণীয় ভূতের মতো কথাটি বলে কি বোঝতে চাইছে তা কেউ বুঝতে পারেনা। ভুতরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে পারে, আবার ভূতেরা কোনো নিয়মকানুন না মেনে কাজ করে। এই মেশিন খারাপ কি কারণে হয়েছে, পল্টু কোনদিন খোলসা করে বলেনি। এই পল্টু যেমন মেশিন সারাতে ওস্তাদ তেমনি মাছ ধরতে ওস্তাদ। ছোটবেলার থেকেই জেঠার নেওটা হয়ে মাছ ধরতে যেত। কবে যে এই মাছ ধরার নেশা রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে বুঝতে পারেনি। বোঝা গেল হরেন জেঠা মরার পর। আগে মাছ ধরতে যেত জেঠার সেন র‍্যালে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে। এখন যায় জেঠার সাইকেলটাই চালিয়ে।


        কলকাতায় পুরানো গাড়ি চলাচলের প্রদর্শনী হয়, যাকে “ভিন্টেজ র‍্যালি” বলা হয়, পুরস্কার দেওয়া হয়। যদি পুরানো সাইকেলের প্রদর্শনী রেস করা হয় আমারা নিশ্চিত পল্টুর সাইকেল পুরস্কৃত হবেই। নতুন সাইকেলের থেকেও পল্টুর সাইকেল ঝকঝকে। কোন ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ নেই। সাইকেলের পিছনের চাকায় ছোট্ট ডায়নামো লাগান আছে। প্রয়োজনে আলো জ্বালিয়ে নিতে পারে। নিজেই সব যন্ত্রপাতিতে সঠিক তেল দিয়ে যত্ন করে। হবেই না কেন। নিজে একজন দক্ষ মেকানিক, তার নিজের সাইকেল যদি ঠিক না থাকে লোকে মেকানিক বলে মান্যতা দেবে কি?


       এখন একটা প্রশ্ন আমাদের পাড়ায় ঘোরা ফেরা করে পল্টু কোনটায় বেশি পারদর্শী মেকানিক না মৎসশিকারী। মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়। টিকিট কেটে মাছ ধরতে গিয়ে সুদে মূলে উশুল করে আনে। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন জলাশয় থেকে মাছ ধরে আনাই এখন মুখ্য নেশা। জুট মিলের ম্যানেজার সত্য কিঙ্কর সাহেব পল্টুকে বলে বামনগাছিতে সাহেবদের বানানো আদ্যিকালের পোড়ো নীলকুঠি আছে। চারদিক ঘেরা নীলকুঠির পিছনে বিরাট এক পুকুর আছে যাকে সরোবর ও বলা যেতে পারে। পুকুরে অনেক মাছ আছে জানা সত্বেও ভয়ে কেউ মাছ ধরেনা। পুকুরে ভূত আছে বলে মাছ ধরতে কেউ যায়না। পল্টু বলে এত ভূতের খারাপ করে দেওয়া মেশিন ঠিক করছি ওই ভূতদের ও ঠিক করে দেব।


      পল্টু যে পাক্কা মৎস শিকারি তা সবাই স্বীকার করে। পল্টু তার খেল দেখিয়ে ধুরন্ধর মাছদের খেলিয়ে খেলিয়ে কেরামতি দেখিয়ে মাছকে বশে এনে ধরতে ভালোবাসে। বেশ কয়েক মাস ওই ত্যাঁদোড় বুদ্ধিমান মাছের সঙ্গে মোলাকাত হয়নি। পল্টু চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাছ ধরতে গেল একাই। সঙ্গে কেউ নেই। পল্টুর উপরে বিশ্বাস রাখা যায়, ও বাজার থেকে মাছ কিনে দাবি করবেনা এই মাছটা আমি ধরেছি।


      মোরম দেওয়া রাস্তা কাঠের গেটে এসে শেষ হয়েছে। দুপাল্লার গেট। গেটে সাইকেলের লোহার চেন দিয়ে বাঁধা। ফাঁস দেওয়া চেনে পিতলের তালা লাগানো। গেট থেকেই দেখা যাচ্ছে জীর্ণ দেওয়ালের পাশেই দর্মার ছোট্ট ঘর। এই ঘরেই থাকে পঞ্চু। পঞ্চুর বয়সের গাছ পাথর নেই। পঞ্চুর গড়ন চিনাম্যানদের মত হলদেটে। উচ্চতা মেরে কেটে সাড়ে চার ফুট। মার্বেল গুলির মত কুতকুতে চোখ। নাক নেই বললেও চলে। গলার আওয়াজ কাকের মত। পঞ্চুরা কয়েক পুরুষ ধরে এইখানেই সেবা করে আসছে। শোনা যায় পঞ্চুর প্রপিতামহ কোনো এক সাহেবর খানসামা হয়ে সপরিবারে বার্মা থেকে এখানে এসেছিল। পঞ্চুর প্রকৃত নাম ছিল ওয়াঁচু পাবলিক নাম দিয়েছে পঞ্চু।


       পল্টু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকে, কি বলে ডাকবে। একটু সময় নিয়ে ডাকতে শুরু করলো- পঞ্চুদা, পঞ্চুদা। একটা চাবিকাঠি হাতে নিয়ে থপ থপ করে পঞ্চুদা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দিয়ে আপাদমস্তক ছানবিন করে বাজখাঁই কর্কশ গলায় বললো, মছলি পাকড়াতে এসেছেন। ঢুকে পড়ুন আমি গেটে তালা লাগাবো। পল্টু ঢুকতেই তালায় চাবি দিয়ে বলে, হুঁশিয়ার হয়ে মছলি পাকড়াবে। কথাটা ঠিক কাক যেমন কা কা করে সাবধান করে দেয়, সেই রকমই শোনালো। পল্টুদা একটা এঁটো হাসি হেসে সাইকেলকে সঙ্গী করে পায়ে চলার রাস্তা ধরে হেঁটেই এগিয়ে যায়। এগাতে এগাতে ঝোপের মাঝে দেখে ইটালিয়ান মার্বেলের তৈরি এক পরির ডানদিকের ডানাটা কাটা, হেলে রয়েছে বেলগাছের গায়ে। বাগানের পথ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলতে চলতে আরও ভগ্ন পরিদের দেখা পেল। গাদাগাদি করা ঝরাপাতারা মাটিতে শুয়ে থাকার ফলে মাটি দেখা যাচ্ছেনা। পাতার পাচার তীব্র উৎকট গন্ধ। সব বড়গাছকে জড়িয়ে রয়েছে পরগাছা এককালের সাজানো বাগান এখন জঙ্গল। যত্ন না করলে মানুষকে অমানুষিক দেখায়, সেই রকমই সাজানো বাগান জঙ্গলে পরিনত হয়। চারিদিকে ভুতুড়ে পরিবেশ। ভূতদের সংসার পাতার উপযুক্ত জায়গা। ভুতদের দেখা না পেলেও নানান রকমের পাখির দেখা গেল। তারা শিস দিয়ে পল্টুকে আহ্বান করছে না সাবধান করছে বোঝা গেলনা। দুর্বঘাষ পিশে পিশে পায়ে চলার রাস্তা। ওই রাষ্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পারে পৌঁছল পল্টু। পুকুরটা একসময়ে সৌখিন পুকুর ছিল। আগেকার দিনে ধনীরা নদীতে ভাসমান বজরায় স্ফুর্তীর ফোয়ারা বসাতো। আবার অনেকেই এই পুকুরকে সাজিয়ে গুজিয়ে পুকুরের ধারেই নন্দন কাননের আসর বসাতো। পুকুরের ধারে বাঁধানো ঘাট এখন ভাঙা চোরা হয়ে পড়ে আছে। আশ্চর্য জনক ভাবে ঘাটের দুদিকের লাল সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চি অটুট আছে। মাঝখানে ধ্বসে গেছে। মনে হচ্ছে ভূমিকম্পের ফলে ধ্বসে গেছে। ইটের সিঁড়ি ধাপে ধাপে জলের গভীরে নেমে গেছে।


      পুকুরের চারিধারেই প্রাচীন গাছেরা গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো বড়ো গাছের পাতার ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো কয়েকটি জায়গায় গোল ফোকাস হয়ে পড়ছে। পুকুরের মাঝখানের জল ঘন সবুজ ঝাঁজি জমে আরও জমাট সবুজের সমারোহ। পুকুরের নৈঋত কোনে এক আশ্যাওড়া গাছের ডাল পুকুরের জলকে ছুঁয়ে রয়েছে। রোদের দাপটে জল থেকে এক ভাপ উঠছে। পুকুরে গাছের পাতার ছায়া নড়ছে শিরশির করে আওয়াজ উঠলো



স্বয়ংপ্রভা - পিনাকী দত্ত || Soyomprova - Pinaki Dutta || ছোটগল্প || Short Story

স্বয়ংপ্রভা

পিনাকী দত্ত 



একবুক অভিমান নিয়ে আকাশ যেন আজ কাঁদতে বসেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা সাদা জলকণা।প্রকৃতি নিজ হাতে সর্বাঙ্গে যেন সাদা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে।কাল রাত থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি ।মনে হচ্ছে কেউ যেন আকাশটাকে ফুটো করে দিয়েছে ।মাঠগুলো জলে থই-থই করছে ।কোথাও কোথাও ঘাসের সবুজ ডগাগুলো নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পা উচিয়ে একটু উঁকি মারছে ।জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো স্বয়ংপ্রভা।এখনো হস্টেলের কেউ সেইভাবে জেগে উঠেনি।যে করিডর সারাদিন গমগম করে তা এখন ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাওয়া প্যাণ্ডেলের মতই ফাঁকা।ওর রুমমেট রূপসাদি গভীর ঘুমে মগ্ন ।কী গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে ওর চোখে-মুখে।


স্বয়ংপ্রভার মনটা খারাপ হয়ে গেল।আজও বুঝি যাওয়া হবে না ।অথচ সারা মাস সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে এই দিনটার জন্য । গতমাসেও এক্সাম এর জন্য সে যেতে পারেনি।মাও অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে এই দিনটার দিকে।মা দূর থেকেই যেন তার শরীরের ঘ্রাণ পায়

আর সেই ঘ্রাণকে জাপটে ধরে অপেক্ষা করে পরের মাসের।

আর তো কয়েকটা মাস।তারপরই তো তার কলেজ জীবন শেষ।হস্টেলটাও তাকে ছেড়ে দিতে হবে।এরপর কোথায় দাঁড়াবে সে ?এই ভাবনাটা ভাবতে বসলেই তার হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়।এতবড় পৃথিবী অথচ তার মাথা গোঁজার এতটুকু জায়গা নেই।


মামারা যদিও তার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। তবু তার সঙ্গে এমন একটা দেওয়াল তুলে দিয়েছে যে, সেখানে ঠিক যাওয়া যায় না।তবে স্বয়ংপ্রভা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ ।নবম শ্রেণী থেকেই তো সে হস্টেলে।ঐ দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পরেই তো ছোটমামা স্কুল চেঞ্জ করে বহুদূরে এখানকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে ।কারণ এখানে মেয়েদের হস্টেল আছে ।দ্বিতীয়ত ঐ ভয়ানক রাতের স্মৃতি যেন তাকে তাড়া না করে।আর এখন তো স্কুল টপকে সে কলেজে ।


কিন্তু সত্যিই কি সে সব ভুলতে পেরেছে?না সমাজ তাকে ভুলতে দেবে ?কারও গায়ে একবার দাগ লেগে গেলে সমাজ তো তুলতে দেয়ই না বরং তার গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দেয়।আর মেয়ে মানুষ হলে তো কথাই নেই ।


যত নষ্টের গোড়া এই শরীরটা।সে আড়চোখে একবার দেখে নেয় নিজের শরীরটাকে ।যেন বর্ষার ভরা নদীর ঢল নেমেছে তার শরীরে।যেমন একমাথা ঘন চুল তেমনি উদ্ধত বুক আর তার সাথে লাবণ্যমণ্ডিত মুখশ্রী। ব্যাস ! আর যায় কোথায়?এমনিতেই অরক্ষণীয়া মেয়েদের প্রতি পদে পদে বিপদ।তার উপর ভরা যৌবন । সমাজে রসিক পুরুষের তো অভাব নেই ।এক এক সময় স্বয়ংপ্রভার মনে পড়ে চর্যাপদের সেই প্রবাদটির কথা --'অপণা মাসেঁ হরিণা বৈরী'।


স্বয়ংপ্রভা লক্ষ করেছে কলেজে,হাটে-বাজারে সমস্ত পুরুষের দৃষ্টি তার বুকের দিকে ফেভিকলের মত সাঁটা থাকে ।অথচ প্রতিটি নারীর বুকের ভিতরেই চড়ুইপাখির মতই ভীরু ভীরু নরম তুলতুলে একটা মন থাকে-সেটা কয়জন পুরুষ বোঝার চেষ্টা করে ।প্রায় প্রতিটা পুরুষের মধ্যেই শরীরটাকে পাওয়ার জন্য কেমন যেন একটা হ্যাংলামো থাকে।ভাবে ওতেই বুঝি সব পেয়ে গেলাম ।শরীরের সাথে মনেরও যে একটা গভীর যোগ রয়েছে তা তাদের কে বোঝাবে? এসব দেখে ঘেন্না ধরে গেছে ওর পুরুষজাতটার উপর।তার উপর সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তো আছেই ।


শুধু রাতুলকেই একটু অন্যরকম লেগেছিল।ঘন কালো চুলের সদা হাস্যময় এক সহজ -সরল যুবক।যে বলে কম হাসে বেশি ।কলেজের প্রথম দিন, ম্যাম নাম ডাকতে গিয়ে তার নামের কাছে এসে থমকে গিয়েছিল।তারপর শ্যাওলা ধরা পুরানো প্রাচীরের মত মুখটা করে বিরক্তির সাথে উচ্চারণ করেছিলেন-'স্বয়ংপ্রভা সরস্বতীপুত্রী'। অ্যা ! এ আবার কিরকম নাম?বাপের জন্মে তো শুনিনি!


স্বয়ংপ্রভাও উঠে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠকন্ঠেই বলেছিল -'সরস্বতী আমার মায়ের নাম আর আমি তার কন্যা'।

'কেন তোর বাপ নেই বুঝি?'-সবাই হেসে উঠেছিল ।শুধু রাতুল ছাড়া ।

দ্বিধাহীন কন্ঠে বলেছিল -না ,নেই।

যদিও এর জন্য ছোটমামাকে কম লড়তে হয়নি।তবে তিনি হাল ছাড়েননি।স্বয়ংপ্রভা শুনেছে- মা ছোটমামাকে একটাই অনুরোধ করেছিল -তার মেয়ে যেন তার নামেই বড় হয়। তার নামেই পরিচিতি পায়।নামের শেষে কোন পুরুষের পদবী বসুক তিনি চাননি ।পুরুষমানুষের জন্যই যখন সে এই বিরাট পৃথিবীতে একা হয়ে গেল তখন তাদেরই দেওয়া কোন পদবী তার মেয়ের গায়ে সেঁটে থাক তিনি চাননি ।


স্বয়ংপ্রভা প্রথম থেকেই নিজের চারপাশে একটা দেওয়াল তুলে দিয়েছিল ।সেখানে সে নিজেই রানি।কাউকে কৈফিয়ত্ দেওয়ারও নেই,কারো হুকুম তামিল করার দায়ও নেই।এজন্য হস্টেলে অবশ্য তাকে কম বাঁকা কথা শুনতে হয়নি।কেউ বলেছিল 'ঢং দেখে আর বাঁচি নে' ,কেউবা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল -'রূপের দেমাক।দেখি কতদিন থাকে'?

আসলে ওর ভেতরটা কেউ উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেনি।ভেতরে ভেতরে যে সে কতটা নিঃস্ব, তা কাকে বলবে?

হ্যাঁ ।রাতুল, রাতুল হয়তো তার দুঃখ বুঝতে পারত।কিন্তু সে-ই তো রাতুলকে মনের দরজাতেই আটকে দিয়েছে।সেবার নবীনবরণে গ্রিনরুমে ওকে একা পেয়ে রাতুল সাহস করে বলেছিল-


'ঐচোখে চোখ যদি মেলাতে না পারি

তবে বৃথা এ জনম, একবার নয়, শতবার মরি'।


প্রভার মন-কলস চলকে উঠেছিল। কিন্তু উপুড় হতে দেয়নি ।তার আগেই সামলে নিয়েছিল।কারণ ও জানে এসব চুটকো চাটকো প্রেম - ভালোবাসা ওর জন্য নয়।ওর সামনে একটাই লক্ষ্য।


পুরুষদের ওর বড্ড ভয়।সে জানে, চুন খেয়ে যদি মুখ পুড়ে তবে দই দেখলেও ভয় করে।ওর হাতে আর মাত্র পাঁচটা বছর আছে ।যা করার তা এই পাঁচ বছরেই করতে হবে ।মাকে শেষ জীবনটা একটু সুখে রাখতে হবে।

রাতুল বলেছিল -' আমরা দুজনে কি মাকে সুখে রাখতে পারি না'?

আৎকে উঠেছিল প্রভা।না,এসব কথা শুনতে চায় না সে।এসব কথা শুনলেই তার ভয় হয় ।পাছে লোভ হয় ।এতদিনের সাধনা কি বিফলে যেতে দিতে পারে?মন যে মাঝে-মাঝে বিদ্রোহ করেনি তা নয়।শত হলেও সেও তো রক্ত মাংসের মানুষ ।আর হস্টেলের মেয়েদের মুখে তো প্রায়ই তাদের নূতন নূতন প্রেমের কথা ,বয়ফ্রেন্ড্ এর সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনতে পায়।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন য়েছিল ।হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তেই সে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল।দেখল রূপসাদি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ।

রূপসাদি বলল-কিরে ,এখনো বের হোসনি?যা ,আমার রেনকোটটা নিয়ে যা।এরপর বেরিয়ে তো আর লাভ হবে না ।

স্বয়ংপ্রভা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রূপসাদি নিজেই চুপ করিয়ে দিল।বলল-না, এখন না ,পরে কথা হবে ।তুই ফিরে আয় আগে ।

রূপসা আজ প্রায় দুবছর ধরেই দেখছে যে,স্বয়ংপ্রভা প্রতি মাসেই মায়ের সাথে দেখা করতে যায়।কিন্তু কোথাও যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে তা তার নজর এড়ায়নি ।স্বয়ংপ্রভা যেহেতু বিষয়টা গোপন করতে চেয়েছে সেহেতু রূপসাও কৌতূহল না দেখিয়ে সম্মান জানিয়েছে।

রূপসাদির আরেকটা কথাও খুব মনে পড়ে-'ঠিক একদিন তুই নিজে থেকেই বলবি ।প্রতিটি মানুষেরই একটা অবলম্বন দরকার হয়।সেই অবলম্বন মানুষ ঠিক খুঁজে পায়।যেদিন পায় সেদিন তার সব বাঁধন খুলে যায় ।একদিন আসবে যেদিন ঝর্ণার মতই সব কথা তোর ভেতর থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসবে ।তুই কিছুতেই তার গতি রোধ করতে পারবি না।


আরও বলেছিল, প্রতিটি মানুষের মনেই একটা গোপন চোরকুঠুরি আছে।যা তার একান্ত নিজস্ব।এখানে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে না ।আর এখানকার লুক্কায়িত সম্পদ হল - দুঃখ,যন্ত্রণা, কষ্ট। যা তোর -শুধুমাত্রই তোর।


সে যখন হস্টেলে এসেছিল তখন এই রূপসাদিই তাকে দুহাতে আগলেছে।অথচ একটিবারের জন্যও তার পারিবারিক জীবনের প্রতি অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশ করে নি।শুধু নামটাই জেনে নিয়েছিল ।হেসে বলেছিল-'বাবারে! অতবড় নাম আমি বলতে পারব না ।শুধু প্রভা-ই বলব।তোর আপত্তি নেই তো?'

বড় ভালো লেগেছিল রূপসাদির এই আপন করে নেওয়ার ক্ষমতাকে।সে ঘাড় নেড়ে শুধু হ্যাঁ বলেছিল।সেই রূপসাদিও কাল চলে যাবে।ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ।


রূপসাদিকে দেখলে কে বলবে, ওর ভেতরেও একটা গভীর ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি লুকিয়ে আছে।ওর জামা -কাপড় ,কসমেটিক্স, দেশি-বিদেশি পারফিউম ,রিস্টওয়াচ ,জুতোর কালেকশন্ দেখলেই বোঝা যায় কতটা অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে।ওর বাবা একটা নামী কলেজের অধ্যাপক ।মাও নামকরা স্কুলের শিক্ষিকা ।যথেষ্ট সুন্দরী ।বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কোথাও কোন অসংগতি নেই। অথচ বাবা -মা দুই মেরুর বাসিন্দা ।বাবা তার বিশেষ ছাত্রীর উন্নতি নিয়ে চিন্তিত আর মাও তার স্কুলের কলিগকে নিয়ে ভাবিত ।এর মধ্যে রূপসা কোথায় ?


রাত নটা বাজতেই হস্টেলের খাবার ঘন্টি বেজে গেল ।সবাই হুড়মুড় করে নামতে শুরু করল।আজ বিশেষ খাবার দাবারের বন্দোবস্ত হয়েছে ।সব জুনিয়র মেয়েরাই করেছে ।কাল 6th sem এর দিদিরা চলে যাবে।তাই ফেয়ারওয়েল পার্টি আর কি।স্বয়ংপ্রভা নামেনি।ওর এসব হৈ- হুল্লোড় কোনদিনই ভালো লাগে না। পরে এক ফাঁকে গিয়ে খেয়ে আসবে ।


যদিও আজ মেনুতে যা-যা হচ্ছে তার মধ্যে মাটনকষা ওর খুবই প্রিয় ।সন্ধ্যার সময় ও একবার কি দরকারে যেন কিচেনে গিয়েছিল। দেখেছে খাসির মাংসের সাথে প্রচুর চর্বি এসেছে ।এখানে তো চর্বিগুলো ঝোলে দিয়ে একরকম নষ্টই করবে ।মা হলে চর্বির বড়া করত। চর্বির বড়া ওর খুবই প্রিয় ।মায়ের হাতে চর্বির বড়া হতোও ফাটাফাটি ।মা প্রথমেই চর্বিগুলোকে আলাদা করে নিয়ে একটু গরম জলে ভাপিয়ে পিস পিস করে নিত।তারপর আতপচাল বেটে তার সাথে পরিমাণ মত নুন-হলুদ ও মিষ্টি মিশিয়ে বড়া করত।গরম ভাতের সাথে কাঁচালংকা আর নুন মাখিয়ে খেতে যা লাগত না ! স্বয়ংপ্রভার জিভে জল চলে এল।যদিও হস্টেলে এই সব ভাবা বিলাসিতা ।হস্টেলের সেই একঘেয়েমি রান্না ।

রূপসাদি অবশ্য অনেক আগেই নেমে গেছে ।ওর যাওয়াটাই স্বাভাবিক।কলেজ লাইফের শেষদিন বলে কথা।তার উপর জুনিয়র মেয়েরা কি সব নাচ গানের ব্যবস্থা করেছে।সবাই তো আর ওর মত কুড়িতে বুড়ি নয়।


ঘুম আসছে না।কেবল থেকে থেকে মায়ের কান্না ভেজা মুখটাই ভেসে উঠছে ।স্বয়ংপ্রভা বুঝল ,ঐমুখ আজ আর তাকে ঘুমাতে দেবে না।সে একটা বই টেনে নিল।

এমন সময় রূপসাদি ঘরে ঢুকেই ছো মেরে বইটা তুলে নিল।তারপর সেটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা হাত কাঁধে রেখে ও একটা হাত দিয়ে থুতনিটা তুলে ধরে গুনগুন করে গেয়ে উঠল-

'

'এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি, কেন একা বয়ে- বেড়াও

আমায় যদি তুমি বন্ধু মান,কিছু জ্বালা আমায় দাও'।


তারপরই টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। বলল-'আজ সারা রাত ঘুমাব না।তোর কথা শুনব'।


জান রূপসাদি ,মায়ের বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে,-প্রবাসী বাঙালি পরিবারে।কানপুরের কাছাকাছি কোন জায়গায় ।আমার ঠাকুমা বাঙালি ছিলেন না ।কিন্তু বৌ হয়ে এসে বাংলাটা মোটামুটি শিখে নিয়েছিলেন।ঐ হিন্দী টানে বাংলা বলতেন আর কি।মাকে দারুণ ভালোবাসতেন।একদিনের ঘটনা তো মা খুব বলতেন।

'বহু, এ বহু ,জলদি ইধার আ।দেখ্ তোর জন্যে হামি কি লিয়ে এসেছি '- বলে এমন হাঁক পাড়তে লাগল যে, মা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।মা ছুটে গিয়ে দেখে ,ঠাকুমা মিটিমিটি হাসছে আর চোখে খুশি ঝিলিক মারছে ।

'খোল তো বহু '।বৌ বলতে চাইলেও ঠাকুমার মুখ দিয়ে 'বহু'বের হত।কিন্তু তিনি ভাবতেন বাঙালির মতই তিনি বৌ বলেছেন-এইভেবে খুশি হতেন ।

মা সাবধানে প্যাকেটটা খুলে দেখে কয়েক পিস মাছ।মা মুখ তুলতেই ঠাকুমা খুশি খুশি মুখে বলে উঠল- 'রুহি মছলি।আচ্ছাসে পাকাবি কেমন।'অথচ মা জানে পুরো পরিবারটিই নিরামিষাশী।শাশুড়ি তো কোনদিন মাছ ধরেনইনি।অথচ সেই শাশুড়ি আজ তার জন্য মাছ নিয়ে এসেছে।এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠেছিল।

আমি তখন পেটে।বাবা-মা যখন তাদের আগত সন্তান নিয়ে খুশিতে মশগুল তখন মাঝরাতে একদিন বাবার কাছে এল সেই কালান্তক ফোন-'সাবজী ,কারখানামে আগ লগ গ্যায়া'।বাবা গিয়ে দেখল সব শেষ।

ধাক্কাটা সামলাতে পারল না।সারাদিন কোন কথা বলত না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত।হা-হা-হা করে হাসতে হাসতে কান্নায় ভেঙে পড়ত।প্রথম প্রথম মা খাবার দিতে গেলে চিনতে পারত ও খাবার খেত।ধীরে ধীরে খাবার খাওয়ায় বন্ধ করে দিল।আর চিনতেও পারত না কাউকে ।কেউ সামনে গেলেই আঁচড়ে কামড়ে দিত।বদ্ধপাগল হয়ে গেল।শেষ পর্যন্ত পাগলা গারদে রেখে আসতে হল।

আমি হলাম ।ঠাকুমাই সব করলেন ।আমাকে পেয়ে ঠাকুমার খুশি আর ধরে না।বলতেন-' হামার ঘরে লকসমী এসেছে ।বহু তুই এর যতন করবি ।'তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন 'মেরে অরবিন্দ্ দেখে যেতে পারল না।হায় রামজী!'

সেদিন গুমোট গরম। মা আমাকে নিয়ে বারান্দায় শুয়েছিল। এমন সময়-ঠাকুমা মাকে ডাকল।মা দেখল-ঠাকুমা কাঁদছেন।মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন-'বহু,তু হামার বিটিয়া আছিস ।ফিরসে নয়ি জিন্দগি শুরু কর।অরবিন্দ্ ঠিক নেহি হোগা।আপনা জিন্দগি কিউ বরবাদ করবি।মেরে ঘরমে আ কর তুঝে সুখ অর চ্যান কুছভি নেহি মিলা।হো সাকে তো মুঝে মাফ কর দেনা।' বলেই মায়ের হাত দুটো জ্ড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

মা-ও কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে নীরবেই কাঁদছিল ।ঠাকুমা হঠাৎই বাচ্চা মেয়ের মত মার কোলে মাথা দিয়ে শুতে চাইল।বলল- ' মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো।নিদ্ আসছে না'।

মা হাত বুলাতে লাগল ।ঠাকুমা পরম শান্তিতে ঘুমাতে লাগলেন ।কিন্তু কে জানত এই ঘুমই ঠাকুমার শেষ ঘুম।পরের দিন ঠাকুমাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল।

ছোটমামা আমাদের নিয়ে এল।স্বয়ংপ্রভা একটু থামল।আসলে এগুলো তো আর কথার কথা নয়,এগুলো হলো মনের সাথে এক একটা যুদ্ধ ।

কিছুদিন যাওয়ার পর মা কিছুতেই বসে থাকতে চাইলো না।ভাগ্যক্রমে বাড়ি থেকে একটু দূরে দুই বুড়ো-বুড়িকে দেখার দায়িত্ব পেল।দেখতে-দেখতে আমিও সাত- আটে পা দিলাম।মায়ের ব্যবহারে দুই বুড়ো-বুড়ি মাকে আপন করে নিল।মাকে ছাড়া তাদের একমুহূর্তও যেন চলে না।সবসময় মুখে সরস্বতী-সরস্বতী লেগেই আছে। সেবার বুড়ো মাকে বলল, -'চল্ সরস্বতী আমাদের দেশের বাড়ি।দেখবি বর্ধমানের চরকের মেলা কিরকম হয় ?তোর খুব ভালো লাগবে ।অনেক দিন তো কোথাও বের হোসনি।চল্। না করিস নে।'


এই প্রথম মাকে একটু সাজতে দেখলাম।সেরকম কিছুই না।চোখে হালকা একটু কাজল,মুখে একটু ক্রিম আর চুলটা খোপা করে বেঁধে তাতে একটা ফুলের মালা ।ব্যাস ।আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।আমার মা এত সুন্দরী!মা আমাকে অনেক আদর করে দিদার কাছে লক্ষ্মী হয়ে থাকতে বলে চলে গেল।যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেল-'আমার মামণির জন্য ইঅয়াব্বড় পুতুল আনব'।


সেখানেই মায়ের সাথে আমার নূতন বাবার (দ্বিতীয় স্বামী)প্রথম দেখা।চোখাচোখি, মন বিনিময়।কি যে এমন হল, মা পাগল হয়ে উঠল।নূতন বাবাও মাঝে মাঝে দেখা করার জন্য চলে আসতে লাগল ।ব্যাপারটা চাপা থাকল না।বুড়ো-বুড়িই দিদা, মামাদের সাথে কথা বলে উদ্যোগ নিয়ে মায়ের বিবাহ দিলেন।আমি দিদার কাছে রয়ে গেলাম ।

প্রথম থেকেই নূতন বাবাকে আমার কেন জানি ভালো লাগতো না।অবশ্য প্রথম প্রথম নূতন বাবা মামাবাড়িতে আসলেও শেষদিকে একদমই আসা বন্ধ করে দিয়েছিল।তাই খুব যে বেশি দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে এমন নয়।


এদিকে মামাদের বিয়ে হল।সংসারের কর্তৃত্বের সুতোটা ধীরে ধীরে দিদার হাত থেকে মামিদের হাতে চলে গেল।মামিদের ইচ্ছে অনিচ্ছেতে সংসারের চাকাটা ঘুরতে লাগল।মামিদের বক্তব্য-'এবার ঠাকুরঝি নিজের মেয়ের দায়িত্ব বুঝে নিক।তারা এতবড় মেয়ের দায়িত্ব নিতে আর রাজী নয়'।

মায়ের কাছে এসেই বুঝলাম, মা একদম ভালো নেই।আমার নূতন বাবা কেবল নেশাখোরই নয়,ওসব বাজে পাড়ায় যাওয়ার অভ্যাসও রয়েছে।আমি কলতলায় গেলে বিশ্রীভাবে উঁকি ঝুকি মারে।মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে ।


সেদিন সন্ধ্যা থেকেই শুরু হল ঝড় আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং ।আমারও পড়তে ভালো লাগছিল না।মা আমাকে ডেকে নিয়ে বলল-'ইশ্ ! চুলের কি অবস্থা করেছিস?আয় তো এদিকে চুলটা ভালো করে বেঁধে দিই।বহুদিন পর আমি মায়ের বুকে মাথা রাখলাম।মন কেমন করা একটা মা মা গন্ধ পেলাম।মা থুতনিটা আমার মাথার উপর রেখে কোন গভীর ভাবনায় যেন তলিয়ে গেল।বুঝলাম, মা বুঝি তার মন্দ ভাগ্যের কথাই ভাবছে ।


'মা' ( আমি ডাকলাম )

'হুমম্ '- বহুদূর থেকে যেন উত্তর ভেসে এল।

'তুমি ভালো নেই, না মা?' মা উত্তর দিল না।শুধু মাথাটা দুদিকে নাড়াল।আর আমার ঘাড়ের উপর কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়ল।

আমার খুব ভয় করে ।জান মা ?নূতন বাবার চাহনিটা কেমন যেন ।

মা আছে তো।কোন ভয় নেই।

বাইরে খুব জোরে একটা বাজ পড়ল।ভয়ে আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম।এমন সময় দরজায় দড়াম দড়াম শব্দ ।মা দরজা খুলতেই নূতন বাবা টলতে টলতে ভেতরে এসে দাঁড়ালো ।

জড়ানো কন্ঠে আমাকে বলল-'চল্ ,তোকে একটা ভালো জায়গায় রেখে আসার বন্দোবস্ত করেছি ।খুব ভালো থাকবি ওখানে।যত্ন-আত্তির কোন অভাব হবে না।'


মা বলল, খবরদার !আমার মেয়ের দিকে একপাও এগুবে না।আমাকে ছেড়ে কোথ্থাও যাবে না ও।


নূতন বাবার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল।মাকে এমন ধাক্কা মারল যে, মা ছিটকে গিয়ে তক্তার নীচে পড়ল।তক্তার নীচেই ছিল কাটারিটা।মা শক্ত করে ধরল ওটা।

নূতন বাবা আমার হাতটা ধরতে যাবে, এমন সময় মাটি ফুঁড়ে যেন উঠে এল মা। উঠেই গলা লক্ষ্য করে কাটারিটা চালিয়ে দিল।

আমি ছুটে গিয়ে মার পিছনে লুকোলাম।

রক্ত ছিটকে এসে মার কপালে পড়ল ।মা বা হাত দিয়ে আমাকে সামনে এনে বুকে জড়িয়ে নিল।তারপর পরম নিশ্চিন্তে ডানহাতটা দিয়ে শুধু রক্তই মুছলো না, সেইসঙ্গে নিজের সিঁদুরটাও মুছে দিল।

মায়ের জেল হয়ে গেল---এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামল স্বয়ংপ্রভা।

রূপসাদি আলতো করে তার হাতের উপর হাত রাখল ।

তখনো ভোরের আলো ফুটেনি।পূবাকাশ সবেমাত্র একটু একটু লালবর্ণ ধারণ করেছে।একটু পরেই অন্ধকারের বুক চিরে নূতন আলো পৃথিবীতে এসে পৌছাবে।বহুদিন ধরে এই আলোর খোঁজেই তো স্বয়ংপ্রভা রয়েছে ।যে করেই হোক, আলোর ঠিকানা তো তাকে খুঁজে বের করতেই হবে ।স্বয়ংপ্রভা দেখল -মাঠ-ঘাট,খাল ,বিল সমস্ত কিছুই তার কাছ থেকে ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছে ।আর আলোর সন্ধানে সে ছুটছে তো ছুটছেই।




প্রতিশোধ - পায়েল বিশ্বাস || Protisodh - Payel Biswas || ছোটগল্প || Short Story

 প্রতিশোধ 

পায়েল বিশ্বাস




"আমরা কোথায় যাচ্ছি রহিমচাচা?" 

গণ্ডোলাটাকে সংকীর্ণ খাঁড়িটার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে উমার দিকে তাকিয়ে বললাম," এক অজানা জগতে যাচ্ছি মা। যেখানে আর কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।"

দশ বছরের মেয়েটি আমার এই ছোট্ট ডিঙিটার মধ্যে আরও জড়োসড়ো হয়ে বসল। 

" চাচা, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে।" 

উমার কথায় কবেকার শুকিয়ে যাওয়া পিচুটি পড়া চোখে জল এসে গেল। শীর্ণ বক্ষ পিঞ্জরে বহু বছরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেন আবার জেগে উঠল।  

" না, ছাড়বি না মা, ওই নর পিশাচদের একদম ছাড়বি না। শেষ করে দিবি সবাইকে যারা তোর উপর অমানুষিক অত্যাচার করেছে।" 

উমা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল," আমি কি করে পারব চাচা? আমার বাবা মাও যে ওদের সাথে পারল না। সেই ওদের জমিটা লিখেই দিল। কিন্তু যদি আগেই লিখে দিত তবে.." 


এবার আমি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে প্রবেশ করলাম। অসংখ্য ঝাড়বাতি সাথে সাথে জ্বলে উঠল। বহু পুরনো পরিত্যক্ত প্রাসাদটি যেন সত্যি সত্যি দেবী উমার আগমনে প্রাণ ফিরে পেল। অসংখ্য বাদুর বিরক্ত হয়ে ডানা ঝাপটিয়ে অন্ধকারের গভীর থেকে তাদের রক্তচক্ষু মেলে আমাদের দিকে তাকাল। উমা চমকে গিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে একটু যেন ভয় পেয়ে আমার দিকে সরে এসে বলল," এ আমায় কোথায় নিয়ে এলে চাচা? আমাকে বাবা মার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।"

আমি স্মিত হেসে তাকে বললাম," এখানেই যে তোকে থাকতে হবে। তোর বাবা মা সমাজের ভয়ে, প্রাণের ভয়ে তোকে ত্যাগ করেছে। তাই হাসপাতাল থেকে লুকিয়ে আমি তোকে এখানে নিয়ে এসেছি। ওখানে ফিরে গেলে প্রমাণ লোপাটের জন্য তোকে ওরা শেষ করে দেবে। এখানে যে আছে সে তোকে শক্তি দেবেন। এক অলৌকিক শক্তি। "

" তিনি এমনিই দেবেন?" বাস্তববাদী মেয়ের প্রশ্ন।

" কোনো কিছু এমনিই হয় না। কয়েক ফোঁটা রক্ত নিবেদনের মাধ্যমে শুধু তাঁর তৃষ্ণা নিবারণ করিস মা। "

বলে আমি উমাকে প্রাসাদের ঘাটের সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলাম। এক্ষুণি সে আসবে। যাকে আমার মত কিছু অত্যাচারিত সন্তানহারা বাপ জাগ্রত করেছে তাকে উষ্ণ রক্তের মাধ্যমে অসংখ্য পিশাচকন্যা তৈরি করে চরম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।



অতলান্তে অন্তঃস্রোত - রানা জামান || Otolante Ontosrote - Rana Zaman || ছোটগল্প || Short Story

 অতলান্তে অন্তঃস্রোত

      রানা জামান


 



মনটা অনেক অনেক খারাপ হয়েছে খালেদ চৌধুরীর আজ। এভাবে প্রত্যাখাত হবেন ভাবেন নি কখনো। পঞ্চাশ বছরে এমনটা কখনো ঘটে নি। তাকিয়ে আছেন ছাদের দিকে। কক্ষে শূন্য ক্ষমতার বাল্ব জ্বলায় কক্ষের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাশে দ হয়ে শুয়ে আছেন নাফিসা তরফদার। বিয়ের পরে নাফিসা বাবার পদবি ছেড়ে স্বামীর পদবি নেন নি। ওদের দুটো সন্তান। নন্দিতা ও বিজয়। ওরা এখনো পড়ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গেলো ক'বছর যাবৎ বড়লোকদের সন্তানেরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারছে না। ওদের মেধা কম নাকি বাবা-মার টাকা বেশি থাকায় ঠাঁট দেখাবার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়? গবষেকগণ ভাবুক তা নিয়ে, আমরা গল্পে যাই!


খালেদ চৌধুরী স্ত্রীকে একবার দেখে বেরিয়ে এলেন শয্যাকক্ষ থেকে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে একটা একক সোফায় বসলেন। সোফাটা এল-প্যাটার্ণের; বামদিকে একটা ডিভান আছে। এটা ওঁর সোফা। ওঁ বরাবর এটায় বসে থাকেন। এই সোফার বাম বাহুর পাশে একটা দেরাজ আছে। ওখানে কিছু ব্যক্তিগত সরঞ্জাম থাকে ওঁর; যেমন সিগার বা সিগারেট, লাইটার, পানমশলা ইত্যাদি। খালেদ চৌধুরী বাম হাতে দেরাজ খুলে একটা সিগারেট ও লাইটার বের করে চলে গেলেন ব্যালকনিতে। সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে পদশব্দে পেছনে তাকিয়ে বিজয়কে দেখতে পেয়ে সিগারেটে একটা লম্বা দিলেন।


বিজয় জিজ্ঞেস করলো, বাবা, এতো রাতে এখানে সিগারেট টানছো কেনো? মার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে নাকি?

না রে! ঘুম আসছিলো না, তাই এখানে এসে সিগারেট টানছি।


আমি ভেবেছিলাম তুমি সিগারেট টানা ছেড়ে দিয়েছো!


মনটা বেশি এলোমেলো হলে মাঝে মধ্যে টানি।


আগামীকাল বাড়িতে একটা বড় প্রোগ্রাম হতে যাচ্ছে। তুমি নির্ঘুম রাত কাটালে কাকে নিয়ে প্রোগ্রামটা করবো!

খালেদ চৌধুরী বিজয়ের দিকে ফিরে বললেন, তুই জেগে আছিস কেনো? স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে? কেউ আছে নাকি স্বপ্নে এসে ডিস্টার্ব করার মতো?


লজ্জা পেয়ে বিজয় মাথা নিচু করে বললো, তেমন কিছু না বাবা! হাঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কেনো জানি না মনে হলো এদিকে আসি। ড্রয়িংরুমে এসে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে বুঝতে পারলাম তুমি ব্যালকনিতে আছো।

খালেদ চৌধুরী বিজয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুই শুতে যা! আমি সিগারেটটা শেষ করে যাচ্ছি।

না বাবা! তুমি সিগারেটটা শেষ করো। তোমাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার রুমে যাবো।


খালেদ চৌধুরী দ্রুত সিগারেট টানতে গিয়ে কেশে উঠলেন। বিজয় বাবার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিয়ে বললো, আর টানতে হবে না বাবা! যে কোনো কারণে তুমি অস্থির হয়ে আছো। এমনিতে ঘুম না আসলে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নাও। ঘুমের ট্যাবলেট আছে তোমাদের কাছে?


বলতে পারি না!


চলো, খুঁজে দিচ্ছি।


পিতার সাথে পুত্র শয্যাকক্ষে ঢুকতেই নাফিসা তরফদার চিৎ হয়ে ওদের দিকে তাকালে বিজয় বললো, বাবার ঘুম আসছে না। ঘুমের ঔষধ খুঁজতে এসেছি মা।


রহস্যময় হাসি ধরে নাফিসা তরফদার বললেন, তুই নিজ বেডরুমে যা। তোর বাবার ঘুমের ঔষধ আছে আমার কাছে!


বিজয় কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে। নাফিসা তরফদার বিছানা থেকে নেমে দরজার ছিটকিনি আটকে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, আমার কাছে তোমার ঘুমের ঔষধ আছে না?


খালেদ চৌধুরী তোতলিয়ে বললেন, আ-আছে তো!


নাফিসা তরফদার খালেদ চৌধুরীর একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন বিছানার দিকে।


আধাঘণ্টা পরে দিগম্বর নাফিসা তরফদার ঢুকলেন ওয়াশরুমে। দুই মিনিট পরে বারোটা বাজার সতর্ক সংকেত বাজলো। অর্থাৎ শুরু হলো আরেকটা দিনের, এই পরিবারের জন্য একটি বিশেষ দিনের। নাফিসা তরফদার ঝর্ণা অন করতে যাবেন তখন ম্যাসেজ টোন শুনতে পেয়ে মনে মনে বললেন: এসময় কে এসএমএস পাঠালো? নাফিসা তরফদার ঠোঁট উল্টে স্নান সমাপনে মনযোগ দিলেন। পাক গোসল করতে একটু সময় লাগে বৈকি! শরীরের সর্বত্র সাবান মাখাতে হয় যত্নের সাথে! তো নাফিসা তরফদার পনেরো মিনিট সময় নিয়ে গোসল সেরে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে শয্যাকক্ষে ঢুকে দেখতে পেলেন স্বামী প্রবর গোসল না করেই নাক ঢেকে ঘুমাচ্ছেন! মুখ টিপে হেসে আলমারির দিকে যাবার সময় মনে পড়লো এসএমএস-এর কথা। নাফিসা ঘুরে এগিয়ে গেলেন খাটের দিকে। খাটের পাশে পার্শ্বটেবিলে মোবাইল ফোনটা রাখা আছে।

একটি অচেনা নম্বর থেকে এসেছে এসএমএসটা: Congests for successful 50th anniversary!

ভ্রু কুচকে নাফিসা তরফদার ভাবছেন: কে? আজ আমাদের এনিভারসারি জানলো কিভাবে? সবার আগে ঠিক বারোটায় উইস করে এসএমএস পাঠালো! ওদিকে আমার স্বামী প্রবর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন! থ্যাঙ্ক ইউ জানাবো? না থাক!


নাফিসা তরফদার মোবাইল ফোনটা রেখে এগিয়ে গেলেন ওয়ারড্রবের দিকে। স্লিপিং স্যুট পরে হাই তুলতে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিছানায়। আরেকবার হাই তুলেই মুদে নিলেন চোখ। সকালে ঘুম ভাংলো খালেদ চৌধুরীর ডাকে। দেয়ালে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর ছাড়িয়ে গেছে। ফের হাই তুলে চোখ মুদতে গেলে খালেদ চৌধুরী বললেন, হ্যাপি এনিভার্সারি! আমি অফিসে গেলাম।


আরেকবার হাই তুলে নাফিসা বললেন, অফিসে যাচ্ছো মানে? তুমি না আজ ছুটি নিয়েছো?


সরি! ভুলেই গিয়েছিলাম!


নাক ডেকে ঘুমালে কি কিছু মনে থাকবে? ঠিক রাত বারোটায় অচেনা লোক আমাকে উইস করলো; কিন্তু তুমি পারলে না!


তখন মোবাইল ফোন থেকে এসএমএস আসার টোন শোনা গেলে হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটা তুলে নিলেন নাফিসা তরফদার। খালেদ চৌধুরী হলেন কক্ষান্তর। এসএমএসটা এরকম: ঘুম তো ভাংলো! এবার ফ্রেশ হয়ে পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন না!


যেনো মুখোমুখি বসে কথা বলছেন এমনভাবে বললেন নাফিসা তরফদার, কবিতা লিখবো আমি! জীবনে পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোনো কবিতা পড়ি নি!


যেনো এসএমএস প্রেরণকারি ওঁর কথা শুনে জবাব দিচ্ছে এমনভাবে এসএমএস পাঠালো: চেষ্টা করে দেখুন না! মানুষের অসাধ্য কিছু না! দুই লাইনের একটা কবিতা লিখবেন। গদ্য কবিতা। সময় এক ঘণ্টা। টাইম স্টার্ট নাও!

তখন বিজয়ের ছোট বোন নন্দিতার ডাক শোনা গেলো, মাম্মি, আমরা তোমার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছি।

আসছি! বলে মোবাইল ফোনটা রেখে এগিয়ে গেলেন ডাইনিং স্পেসের দিকে নাফিসা তরফদার। দুই সন্তান ও স্বামী পাতে নাস্তা উঠিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। নাফিসা চেয়ারে বসতেই ওরা শুরু করলো খাওয়া। নাফিসা পাতে রুটি ও ভাজি নিয়ে ভুলে গেলেন মুখে তুলতে। ওঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কবিতার শব্দরাশি!


মাকে খেতে না দেখে নন্দিতা বললো, মাম্মি, খাওয়া বাদ দিয়া কী ভাবছো?


খালেদ চৌধুরী টিটকারি কেটে বললেন, তোদের মাম্মি কবি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে!


নাফিসা তরফদার চমকে খালেদ চৌধুরীর দিকে তাকালেও কিছু বললেন না। ভাজি নিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে ঢুকিয়ে না চিবিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, গাছের পাতা যতই সবুজ থাকুক, ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে এক সময় ঝরে পড়ে।


এক টুকরো ডিমের ওমলেট মুখে পুড়ে নন্দিতা বললো, এটা কি তোমার কথা, নাকি কোনো কবির?


আমার হলে কেমন হয়?


খাবার চিবুতে চিবুতে বিজয় ও নন্দিতা হাততালি দিলো। আর খালেদ চৌধুরী মুচকি হেসে দ্রুত খাবার চিবুতে লাগলেন। এরপর চলতে থাকলো ভাইবোনের কথোপকথন মার কবিতা নিয়ে।



নাস্তা সেরে কফির কাপ নিয়ে নিজ কক্ষে চলে এলেন নাফিসা তরফদার। মূলত লাইন দুটো লিখে ফেলার জন্যই চলে এসেছেন। কফির কাপটা টেবিলে রেখে মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই ম্যাসেজ টোন এলো। ঐ অদেখা লোকের ম্যাসেজ!


নাস্তা খাওয়ার সময় নিশ্চয়ই চলে এসেছিলো ভাব? লিখেছেন লাইন দুটো?


নাফিসা তরফদার আগের মতোই বলে ফেললেন, লিখি নাই!


টেক্সট করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন এক্ষুণি!


তখনই এসএমএস করে লাইন দুটো পাঠিয়ে দিলেন নাফিসা তরফদার। তখন সিগারেট টানতে টানতে কক্ষে ঢুকলেন খালেদ চৌধুরী। বিছানায় উঠে স্ত্রীর পাশে আধশোয়া হয়ে সিগারেটে একটা লম্বা দম দিয়ে নাকেমুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমাদের ফিফটিন্থ এনিভার্সারি উপলক্ষে ছেলেমেয়েরা বিরাট আয়োজন করছে!

নাফিসা তরফদার মোবাইল ফোনটা টেবিলে রেখে বললেন, জানি!


আমিও তোমাকে রাতে একটা সারপ্রাইজ দেবো।


কী সেটা?


এখন বললে সেটা সারপ্রাইজ থাকে কিভাবে?


ও!

ছেলেমেয়েদের ঠেলায় সারাদিন ব্যস্ততায় কাটলেও নাফিসা তরফদারের মনটা পড়ে থাকলো এসএমএস পাবার প্রত্যাশায়। দুটো লাইন আসলেও কি কোন কবিতা হয়েছে কিনা, এর প্রত্যয়ন ঐ রহস্যময় এসএমএস-দাতার নিকট থেকে পাওয়া দরকার। আচ্ছা, লোকটা পুরুষ না মহিলা? পরক্ষণে ভাবলেন: মহিলা হয়ে এরকমভাবে উইস করে কবিতা লিখতে বলবে কেনো! সারাদিন কোন এসএমএস না আসায় বেশ হতাশ হয়ে সন্ধ্যার পরে বিউটি পার্লারে যাবার সিদ্ধান্তঃ নিলেন। পঞ্চাশতম বিয়ে বার্ষিকীতে একটু বিশেষ সাজগোজ করা দরকার! বুড়োত্বের ছাপ পড়তে থাকবে আরো। ছেলেমেয়ে দুটো তরতর করে বাড়ছে। বিশেষ করে মেয়েটা। আগের যমানা থাকলে এতোদিনে বিয়ে হয়ে কয়েক বাচ্চার মা হয়ে যেতো নন্দিতা। তখন মোবাইল ফোনে অচেনা নম্বর থেকে একটা কল এলো। নাফিসা অচেনা নম্বরের কল ধরে থাকেন। ওর তো কোন ক্ষতি হয় না! রং নম্বর হলে সরি! বলে কেটে দেন। কলটা গ্রহণ করে মোবাইল ফোনটা কানে ঠেকাতেই ওদিকের কবিতা আবৃত্তির সুর শোনে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো নাফিসার। এতো মধুর কণ্ঠ! আর এতো চমৎকার কবিতা আবৃত্তি এর আগে কখনো শোনেন নি! দুটো লাইন বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে: লাইন দুটো কোথায় যেনো শুনেছেন। তখন ওঁর মনে পড়লো: এ দুটো লাইন ওর-ই!


মন ভরে শোনার জন্য নিরিবিলি দরকার। একটু পরে মেয়েটা ওকে ডাকতে আসবে। স্বামী তো কক্ষে ঢুকেই আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ছেলেও আসতে পারে। সুনসান নিরবতা দরকার ওঁর। মোবাইল ফোন কানে জোরে চেপে ধরে উঠে এলেন ছাদে। ছাদে বেশ আলো-আঁধার অবস্থা এবং নিরিবিলিও। হঠাৎ আবৃত্তি থেমে মধুমাখা পুরুষ কণ্ঠটা বললো, আবৃত্তি কেমন হয়েছে বলবেন কী?


নাফিসা

অনুমেঘার মন - সৌমেন দেবনাথ || Onumeghar mon - Soumen Devnath || ছোটগল্প || Short Story

 অনুমেঘার মন

সৌমেন দেবনাথ 



মন অভুক্ত থাকলে অভুক্ত মনের মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে। মনের মধ্যে আঁধার থাকলে আঁধার আলয়ে বাস করা মানুষ অকর্ম করে ফেলে। মনের মধ্যে হাহাকার থাকলে, শূন্যতা থাকলে আকাশে মেঘদলের জমা হওয়া লাগে না, বিনা মেঘেই ঝড় বয়ে যায়। মনের মধ্যে একরাশ আঁধার থাকলে তার আঁধার রাতে ভয় লাগে না। খরা গাঙ এক ফোঁটা জলতৃষ্ণায় মরে, কিন্তু কেউ তা উপলব্ধি করতে পারে না। যে হৃদয় হৃদয়ের ছোঁয়া পায় না, সে হৃদয় হয়ে উঠে ঊষর; যে হৃদয় একটু প্রেমরস পায় না, সে হৃদয়ে বারো মাসেই চৈত্রের খরা। পথ না পেলে পথভ্রান্ত বিপথে যায়। পথের দিশা কেউ না দেখলে পথহারা মানুষ পথ পায় না, পথিক হয়ে উঠে না। ঘরে চাঁদ থাকলে মানুষ আকাশের চাঁদ দেখে না, ঘরমুখী হয়। সাথের সঙ্গীর সুন্দর সঙ্গ পেলে মন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে, রাতের কলির সন্ধানে কেউ বের হয় না, খোঁজে না নবকলি।



নিকষ আঁধার রাতের ভোর হয়েছে। নিয়তির নক্ষত্র নিয়মিত না জ্বললেও মিটিমিটি আলো ছড়ালো। বড়ো অনাড়ম্বরভাবে জীবনের কাঙ্ক্ষিত কাজটি সেরে নিলো স্বপ্নীল। অনাড়ম্বরতায় কেউ সোনার টুকরো পায় না। স্বপ্নীল খোঁজেনি বেশি স্বপ্নের সারথি হবে যে তাকে। সবদিক না ভেবেই ডুব দিয়েছিলো সে, কিন্তু মুক্তো নিয়েই উঠেছে ডাঙায়। অমূল্যকে, অতুল্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না, ধরা দেয়। খুঁত খুঁজতে গিয়েই নিখুঁত পাওয়া যায় না। মনে-প্রাণে সুন্দর চাইলে সুন্দর মেলে, স্বার্থ নিয়ে সুন্দর খুঁজতে গেলে সুন্দর মেলে না, হয়তো সৌন্দর্য মেলে। অনুমেঘাকে দেখে তার মুগ্ধতার শেষ নেই। প্রিয় মানুষটার মুখটা কেমন হবে এই ভাবতেই তার জীবনের ত্রিশ বসন্ত কেটে গিয়েছে। সেই প্রিয় মুখটি এত নিষ্কলুষ শান্ত, স্নিগ্ধ হবে ও কল্পনাও করেনি। একটি সুন্দর মুখের দিকে তাকালে এতটা প্রশান্তি মেলে সে জানতোই না। লোকের ভালোবাসা দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া স্বপ্নীলের জীবনেও যে একটি মায়াবিনী তন্বী নির্ঝরিণীর ছায়া পড়বে তা তার অকল্পনীয় ছিলো।



চাওয়ার চেয়ে বেশি পাওয়া হলে আলাদা করে আর কিছু চায় না কেউ। পাওয়াটাকে পরম প্রাপ্তি ভেবে নিলে সেই পাওয়াতে প্রচণ্ড তৃপ্তি আসে। পাওয়াটা পূর্ণতা পেলে মানুষ শুদ্ধতায় ফেরে। পাওয়ার ভেতর তৃপ্তির কথা থাকলেই কঠিন হৃদয়ের মানুষও কোমল হৃদয়ের হয়ে যায়। প্রতিটি হৃদয় ভালোবাসা কাতর। হৃদয় যদি ভালোবাসার কোমল স্পর্শ পায়, তবে পবিত্র হয়ে উঠে। অতীতের যেকোনো কর্মের গন্ধ-দুর্গন্ধ বিশ্লেষণ করে নতুন শপথে পথ চলে। অপ্রাপ্তির ঢেকুরে দুর্গন্ধ থাকলেও প্রাপ্তির ঢেকুরে থাকে কেবল সুগন্ধ। চুপসে যাওয়া একটি মনে বসন্ত সমীরণ বয়ে যায়। প্রাপ্তির আনন্দে আত্মহারা স্বপ্নীলের মনে কেবলই উচ্ছ্বাস, উল্লাস, উৎফুল্লতা। মনের ভেতর বয়ে যাওয়া প্রবাহ যেন নদীর বয়ে চলা প্রবাহের চেয়ে বেশি। বড়ো বিগলিত কণ্ঠে অনুমেঘাকে তাই সে বলে, আমার অনুভূতি জুড়ে তুমিই, আমার অনুভূতি তুমি, তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতির শেষ নেই।

অনুমেঘা মিষ্টি হেসে বলে, অনুভূতি তো প্রকাশ করো না। অনুভূতি, আবেগ এসব চেপে রাখতে নেই। তাতে দম বন্ধ হয়ে যায়। 

স্বপ্নীল নিষ্পলক চোখে অনুমেঘাকে দেখে। তার মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা আর কথা বলার ধরন পবন সেজে হৃদয়ে আলতো পরশ দিয়ে গেলো। কথার উত্তর না দিয়ে থমকে গিয়ে মানুষটার মুখাবয়বে চেয়ে থাকলো। তারুণ্যে ভরা টলমলে মুখে আলোর বিচ্ছুরণ। স্বচ্ছ উদ্ভাসিত টানাটানা দীঘল দুটি চোখে মায়ার বিচ্ছুরণ। কথা বলার ধরনে বিপুল আনন্দ পেলো স্বপ্নীল আর বললো, আমার বাড়তি কোনো চাওয়া নেই, তোমার সঙ্গ থেকে কখনো আমাকে বঞ্চিত করো না। আমি অঢেল কিছুই চাই না, আমার সামান্য একটু মায়া দরকার, সামান্য একটু আদর দরকার। আমার সামান্য কিছু আনন্দ চাই। 

অনুমেঘা ঠোঁটে একটু লজ্জিত হেসে বলে, হাত ধরার মানুষের অভাব নেই, হাত ধরে শেষ পর্যন্ত পথ চলা মানুষের বড়ো সংকট।


কথাটি শুনতেই স্বপ্নীল অনুমেঘার হাত শক্ত করে ধরলো। অনুমেঘা আবার একটু হেসে বললো, হাত শক্ত করে ধরা মানেই কিন্তু শক্ত বাঁধন নয়। হাত ধরার মধ্যে মমতা থাকতে হয়, দরদ থাকলে হয়, মায়া থাকতে হয়, সৌন্দর্য থাকতে হয়, মাধুর্য থাকতে হয়, বিশ্বাস থাকতে হয়, থাকতে হয় প্রতিশ্রুতিও।


এই কথা শুনতেই স্বপ্নীল হাত ছেড়ে দিলো। এবার অনুমেঘা স্বপ্নীলের হাত ধরলো আর বললো, হৃদয়ের খাদ্য হৃদয়। হৃদয় তার রশদ পাবে হৃদয়ের স্পর্শেই। হাত ধরতে ধরতেই তো হৃদয়ের ধরা মেলে। হৃদয়ে হৃদয় মিশে গেলে হাত কী ধরার প্রয়োজন পড়ে!


স্বপ্নীল নিশ্চল পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো তার মন মানসীর কথা শুনে। একটা মানুষের চেহারার চেয়ে একটা মানুষের কথা কত বেশি সুন্দর আর হৃদয়গ্রাহী হতে পারে সে বুঝতে পারছে। হৃদয়ে বিরাজ করা সত্য বাক্য মুখ দিয়ে না বললে অস্থির লাগে। তাই স্বপ্নীল বললো, তুমি ভীষণ সুন্দর!

অনুমেঘা কথাটি সহজে নিলো না। উত্তরে বললো, সুন্দর তো দেখার বিষয় না। সুন্দর উপলব্ধির বিষয়। বাহ্যিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিয়ে তো আমরা মনের সৌন্দর্যকে বড্ড অবহেলা করি। হয়তো প্রশংসায় ভাসাতে চাঁদের সাথে তুলনা দেবে, বাস্তবিকে মন রাঙাতে বাহুডোরে রাখলেই চলে। বাস্তবে আনন্দে ভাসাতে একটু মধুর খুঁনসুটি করলেই চলে।


অনুমেঘার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো স্বপ্নীল। বুঝে নিলো অনুমেঘাকে হৃদয় থেকে দখল করতে হলে কথায় না, কাজে পারঙ্গম হতে হবে। কথার কাব্যিক ফোয়ারায় অনুমেঘার হৃদয় জয় দুঃসাধ্য হবে। চলে যাচ্ছিলো সে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অনুমেঘা। একটা মানুষের সাথে দুই দিনের পরিচয়, অথচ কী মায়া জন্মে গিয়েছে তার প্রতি। রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে বলে লেপ্টে ধরতেও লজ্জা লাগলো না। ধীরকণ্ঠে বললো, ভালোবাসো না আমায়, বলো?

স্বপ্নীল বললো, না ভালোবাসার কারণ খুঁজলে কী আমি পাবো!

অনুমেঘা বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বললো, ভালোবাসলে যাকে তার কথায় বিরক্ত হচ্ছো কেন? হও তুমি রাগী কিংবা সাহসী, আমায় কেন রাগ দেখাবে? আমি না তোমার হৃদয়ের একটা অংশ! 

স্বপ্নীলের রাগের হৃদয়ে প্রস্রবণ বয়ে গেলো। গলে গেলো মোমের মতো। ভেতরে জমা ক্ষোভ উবে গেলো কর্পূরের মতো। রাগ জন্মাবে, ক্ষোভ জন্মাবে; রাগ-ক্ষোভ প্রিয় মানুষের কাছে কি বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায়? হৃদয়ে হৃদয়ে যে মিল তা তো অদৃশ্য সংযোগ। একটুতে টানাপোড়েন হবে, একটুতেই মিলে যাবে। অনুমেঘা হয়ে গেলো আরও সাবধান, বিশেষ করে কথা বলার ক্ষেত্রে। একটা মানুষের ভেতর তো সবকিছু থাকে না, তার ভেতর থেকে সব ভালো বেরও হবে না। অন্তরের সাথে অন্তরের মিল থাকলে ঐচ্ছিক কিছু বিষয়ে অমিল থাকলেও জীবনটা সুন্দর কেটে যাবে। আরেক জনের ভেতর সব সুন্দর না চেয়ে নিজের ভেতরের অতি সুন্দর কিছু বিষয়কে পাত্তা না দিলেই সম্পর্ক মধুর হয়ে উঠে৷ পৃথিবীতে তো সেই ধনী যার সুন্দর মন আছে। সুন্দর মন নিয়ে প্রিয় মানুষটির সামনে থাকলেই তো স্বর্গ নেমে আসে পৃথিবীতে। বৈষয়িক চিন্তা সম্পর্কে দ্বন্দ্ব ডাকে, দুর্গন্ধই ছড়ায়। ভালোবাসায় শুধু প্রিয় মানুষটির প্রতিনিয়ত উপস্থিতিই যথেষ্ট, আর অন্য কিছু না।


স্বপ্নীল গিয়েছে কাজে। খুব মেহনতের কাজ করে সে। সারাদিন পরিশ্রম করে। আর এদিকে বাসায় দুটি বিষয় নিয়ে খুব ভাবছে অনুমেঘা। তার অধিকাংশ সহপাঠিনীর বিবাহ হয়েছে জাঁকজমকভাবে, তারও খুব ইচ্ছা ছিলো তার বিবাহও হবে খুব জাঁকজমকভাবে। স্বপ্নীলের বাধার কারণে সেটা হয়নি। তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। প্রতিবেশিনীদের সাথে মিশতে দেওয়া হয় না। এই দুটো বিষয়ে তার খুব আক্ষেপ। তবে এসব বিষয়ে 'কেন' প্রশ্ন সে করে না। এইসব প্রশ্ন সম্পর্কের উত্থান পথে বাধা। ভালোবাসায় বেঁধে বেঁধে বেঁচে থাকতে অনেক প্রশ্নের উত্তর শুনতে হয় না। অন্যকে খুশি করার কারণ যেমন নিজেকে খুঁজতে হয়, তেমনি নিজেকেও খুশি রাখার কারণ নিজেকেই খুঁজতে হয়। অন্যের ভালোর সাথে তুলনা করতে গেলে নিজেদের ভেতরের অনেক ভালো বিষয়ও চোখে পড়ে না। সম্পর্কের উন্নতি কখনো কারও সাথে তুলনা করে সম্ভব নয়। সম্পর্কের উন্নতি হয় নিজেদের ভেতরের অনেক ত্রুটি দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও না দেখার ভান করে। নিজেদের মনের অনেক চাওয়াকে নির্মম হাতে ছেঁটে ফেলে দিলেই সম্পর্কের ভেতরের তিক্ততা কেটে যায়, এসে ভর করে মধুরতা।



দিন শেষে বাড়ি এলেই বাচ্চা শিশুর মতো দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে স্বপ্নীলকে অনুমেঘা৷ কী কী বলবে সব ভুলে যায়। বাসায় তৃতীয় ব্যক্তিটিও নেই, তাই লোকলজ্জার ভয় নেই। প্রাণপুরুষটাকে দেখলে হৃদয়ের সেতারা সপ্ত সুরে বেজে উঠে। জীবনের জন্য একটা সঠিক মানুষের খুব প্রয়োজন। সঠিক মানুষটা পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। অনুমেঘা ছাড়ে না স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।


চোখের মায়ায় চেয়ে যে সম্পর্কের উত্থান হয়, ধন-সম্পদেও সে সম্পর্ক হয় না। চোখের সেই ভাষা পড়ার জন্য মনে গভীর ভালোবাসারও দরকার। টাকা-পয়সা দিয়ে যা যা হয় না, মন বিনিময়ে তার চেয়ে বেশি কিছু হয়। যেখানে ভালোবাসা থাকে না সেখানে সম্পর্কও থাকে না। যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে দুঃখ-কষ্টেও আনন্দে বাস করা যায়। 


পুরুষ মানুষ মাত্রই বাসায় থাকলে শার্ট বা গেঞ্জি শরীরে রাখে না। কিন্তু স্বপ্নীল কখনো আগলা শরীরে থাকে না। এই বিষয়েও অনুমেঘার মনে 'কেন' প্রশ্ন জাগে। কিন্তু কেন যেন প্রিয় মানুষটাকে কোনো প্রশ্নই সে করতে চায় না। যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনোক্ষুণ্ণ হয় এই ভয়ে। যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কষ্ট পায় এই ভয়ে। কৌতূহল থেকে একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে যদি সম্পর্কের মধুরতায় প্রভাব পড়ে, তবে সে প্রশ্ন না করায় উত্তম।

কিন্তু একদিন অসতর্কতার কারণে শার্ট খুলে ফেলে স্বপ্নীল। অনুমেঘার চোখ আটকে যায় স্বপ্নীলের পিঠের কাটা দাগে। দৌড়ে এসে কাটা দাগে মমতাস্পর্শ দিয়ে বলে, কী করে কেটেছিলো? কত বড়ো ক্ষতের চিহ্ন! কত কষ্টই না পেয়েছিলো!

অনুমেঘার চোখে জল চলে এলো। প্রিয় মানুষের পিঠের একটা পুরাতন ক্ষত চিহ্ন দেখে কান্না করে দেয় যে মানুষটা, সে মানুষটা কী পরিমাণ ভালোবাসে প্রিয় সেই মানুষটাকে সহজেই অনুমেয়। বললো, তখন তোমার সাথে থাকলে আমি সেবায় কমতি রাখতাম না। বলো না গো, কীভাবে কেটেছিলো?


স্বপ্নীল অনুমেঘার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে, কান্না করছো কেন? কত আগে কেটেছিলো! ছোটোবেলায়। ছিলাম একটু ডানপিটে। পড়ে গিয়ে কেটেছিলো। চোখের জল ফেলো না। আমার কাছে তোমার চোখের জলের অনেক দাম।

নাকে কান্না করে অনুমেঘা বললো, তোমার সামনে ছাড়া কার সামনে কান্না করবো? তোমার সাফল্যে আমি কান্না করবো, তোমার কষ্টে আমি কান্না করবো। আর তুমি ব্যস্ত থাকবে আমার কান্না থামানোর জন্য। 

স্বপ্নীল একটু হাসে আর বলে, অল্পতেই চোখে জল আসা মানুষকে সবাই কষ্ট দিতে ভালোবাসে। 

অনুমেঘা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, আমাকে কষ্ট দিতে পারবে কি তুমি? আমি বিশ্বাসই করি না তুমি আমাকে কষ্ট দেবে! 

স্বপ্নীল বললো, যদি কষ্ট দিয়ে ফেলি, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?

অনুমেঘা চোখে চোখ রেখে বলে, তোমাকে ছেড়ে যাবো কেন আমি? মায়ায় আটকে গেলে কেউ সহজে বের হতে পারে? স্রষ্টার কাছে আমার কোনো চাওয়া নেই, তুমি আছো আমার তাই।


এই বলে অনুমেঘা স্বপ্নীলের দিকে নিষ্পলকে চেয়েই থাকলো। প্রিয় মানুষকে যতই দেখা হয়, ততই দেখতে মন চায়। প্রিয় মানুষের কোনো বহিরঙ্গের খুঁত তখন খুঁত থাকে না, বিউটি স্পট হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের অন্তরে কোনো খুঁত থাকলে তাও মিষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের মুদ্রাদোষও আর মুদ্রাদোষ থাকে না, হয়ে যায় একান্ত প্রিয় বিষয়। অনুমেঘা বললো, গ্রামের শংকর জেঠার ছেলে অক্ষর বিরক্ত করতো, উত্যক্ত করতো। কলেজে যাওয়ার পথে কেশব জেঠার ছেলে সৌপ্তিক বিরক্ত করতো, বাজে নজরে তাকাতো, অশ্লীল ইঙ্গিত দেখাতো, অনুসরণ করতো; খুব ভয় পেতাম। কলেজেও তিন চারটে ছেলে বিরক্ত করতো। দল বেঁধে তারা বদমাশি করে বেড়াতো। অন্য ছাত্রদের উপর টর্চার করতো। ওসব সন্ত্রাসদের দেখলেই ভয় পেতাম। যেদিন যেদিন কলেজে গণ্ডগোল হতো বাবাকে ডেকে নিয়ে তারপর বাবার সাথে বাড়ি ফিরতাম। এসব কারণে ছেলেদের সম্বন্ধে বাজে ধারণা ছিলো। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা করে বেড়ায় তাদের প্রতি আমার খুব ঘৃণা। কিন্তু তোমার ঘরে আসার পর ছেলেদের সম্বন্ধে আমার ধারণা একেবারেই বদলে গিয়েছে। উচ্ছন্নে যাওয়া পুরুষদেরই সামনে বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগই ভালো, তারা কাজ করে, মেহনত করে। প্রত্যেকটি কর্মঠ পুরুষ প্রত্যেকটি নারীর চোখে আইডলই। যদি জানতাম তুমিও ওমন বখাটেপনা করে সমাজের চোখে কীট হয়ে গিয়েছেো, তবে কবেই আত্মহত্যা করতাম!


চিন্তায় পড়ে গেলো স্বপ্নীল। বললো, মেঘা, এখানে রোজগারটা কমে গিয়েছে। দূর শহরে গেলে রোজগার বাড়তে পারে। আমার সাথে শহরে যাবে?

অনুমেঘা বললো, তুমি মানুষটা ভালো। তোমার সাথে নিরুদ্দেশে যেতেও আমার দ্বিধা নেই। তোমার সাথে হারাতেও আমার সংকোচ নেই। তোমার সাথে যমালয়েও যেতে পারি নিয়ে যদি যাও। তুমি থাকলে পাশে শত প্রতিকূল পরিবেশেও আমি নিরাপদ থাকবো।


অনুমেঘার কথা শুনে বিস্মিত হলো স্বপ্নীল। একটা মানুষ তার উপর কতই না নির্ভরশীল, তাকে কতই না বিশ্বাস করে, তাকে ঘিরেই কতই না স্বপ্নের জাল বোনে!


একসাথে থাকে সারাক্ষণই দুজন। তারপরও দুজনের মধ্যে মতভেদ হয় না। মতের সাথে মতের অনৈক্য নেই। স্বপ্নীলের পছন্দের খাবার রান্না করে, যদিও স্বপ্নীলের কিছু পছন্দে অনুমেঘার দ্বিমত আছে, তবুও তা প্রকাশ করে না। প্রিয় মানুষের পছন্দকে নিজের পছন্দ করে নিয়েছে। স্বপ্নীলের পছন্দের পোশাকই সে পরে। হাতের কাজ দুজনই মিলেমিশে করে। অনুমেঘার মতো শান্ত-নিরুদ্বিগ্ন সঙ্গিনী পেয়ে স্বপ্নীলেরও আনন্দের শেষ নেই। প্রাপ্তির প্রতি প্রচণ্ড সন্তুষ্টি তার। স্বপ্নীলের বুকে মুখ লুকিয়ে আছে অনুমেঘা। নিরাপদ আর পরম মমতার আশ্রয়। স্বপ্নীল বললো, আমাকে এত ভালোবাসো কেন?

অনুমেঘা বিরক্ত প্রকাশ করে বললো, ভালোবাসতে কারণ লাগে নাকি? ভালোবাসতে উপলক্ষ লাগে নাকি? মানুষটা তুমি তো সঠিক, ভালোবাসবো না কেন? এখন একটা সঠিক মানুষ খুঁজে পাওয়া বড্ড কঠিন।

স্বপ্নীল আবার বললো, আমার ভেতর বেঠিক কিছুই পাও না?

অনুমেঘা তদাপেক্ষা বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার ভেতর আমি বেঠিক কিছু খুঁজবো কেন? এসব প্রশ্ন করছো কেন? তোমার উষ্ণ ওম কী আমায় নিতে দেবে না! চুপ থাকো। আদর দাও, আদর খাবো, আমি আদরখেকো।

স্বপ্নীল আবার বললো, আমাকে এত ভালো লাগার কারণ কী?

অনুমেঘা বললো, সবাই জীবনে একটা ভালো মানুষ চায়, পায় না। সবাই প্রিয় মানুষের কাছ থেকে প্রিয় মুহূর্ত চায়, পায় না। সবাই বিশ্বাসী মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে চায়, পারে না। আমি তোমার থেকে সব পেয়েছি। জীবনে তোমার মতোই একটা মানুষ চেয়েছিলাম, যে আমার সব কষ্ট দূর করে দেবে, শুধু স্বপ্ন দেখাবে, ভালোবাসা দেবে। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই আমার জন্য আনন্দদায়ক। 


স্বপ্নীল অনুমেঘাকে বুকে চেপে রাখলো। পোষা প্রাণীর মতো অনুমেঘাও স্বপ্নীলের বুকে লুকিয়ে থাকলো। স্বপ্নীল টুকটুক শব্দে বললো, আমার তো রোজগার কম।

অনুমেঘা উত্তরে বললো, আমার চাহিদা কম। পয়সায় সুখ মেলে না। 

স্বপ্নীল আবারও বললো, আমি তো দেখতেও সুন্দর না। 

অনুমেঘা বললো, পথচলার সঙ্গী সুন্দর যত না হতে হয়, তার চেয়ে বিশ্বাসী হতে হয় বেশি।

স্বপ্নীল বললো, যদি কখনো তোমার বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হই?

অনুমেঘা বললো, তুমি কত মিষ্টি মনের একটা মানুষ, ঠক হতে পারোই না। তোমার হৃদয়টা আমি পড়তে পারি। স্বচ্ছ কাচের মতো সুন্দর।

স্বপ্নীল আবার বললো, অতিরিক্ত সরল-সোজা মানুষ ধোকা খায় বেশি। নিজের সবটা দিয়ে অন্যকে ভালোবাসতে নেই। নিজেকে উজাড় করে নিজের চেয়ে কাউকে ভালোবাসলে ঠকতে হয়।

অনুমেঘা বললো, দিলে তুমিই তো ধোকা দেবে। দিও, ঐশ্বর্যের মতো উপভোগ করবো।

স্বপ্নীল বললো, তুমি কেমন যেন! যেমন তেমন না। আমার প্রতি কোনো ক্ষোভও নেই।

অনুমেঘা এবার বললো, ক্ষোভ আছে। আমাকে ঘোরাতে নিয়ে গেলে না কোনোদিন। এমনকি প্রতিবেশীদের সাথেও মিশতে দাও না। 

স্বপ্নীল যুক্তি দিয়ে বোঝাতে থাকলো, মেঘা, তুমি গ্রামের মেয়ে। সবার সাথে মিশতে আগ্রহী। শহরের মানুষ কেউ কারও সাথে মেশে না। এমনকি পাশের রুমের মানুষের সাথেও যোগাযোগ রাখে না। মানুষ কানপড়া দেয়, মন ভেঙে দেয়, বদ বুদ্ধি দেয়। 

অনুমেঘা বললো, ঠিক আছে, তুমি চাও না আমি কারও সাথে মিশি, মিশবো না। তুমিই আমার শতজনের সমষ্টি। শত উপায়ে তোমাকে দেখবো।

স্বপ্নীল বললো, অভিমান করে বললে?

অনুমেঘা বললো, তোমার উপর আমার অধিকার আছে। অধিকার না থাকলে তো অভিমানও করা যায় না। তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের সুন্দর সময়, শ্রেষ্ঠ সময়। জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি তুমি। আমাকে ধরে আছো, ধরে রেখেছো। তোমার থেকে এক চিমটি আদরও আমার কাছে ফেলনা নয়।


পরের দিনের কথা। স্বপ্নীল কাজে গিয়েছে। বাসায় নানান কাজে ব্যস্ত অনুমেঘা। এক প্রতিবেশিনী এলেন। এসে অনুমেঘাকে বেশক্ষণ মনোযোগ সহকারে দেখলেন। তারপর বললেন, সুন্দর নষ্ট করে যারা তারাই সুন্দরের ভাগিদার হয়। সমাজের আপদ যারা, সমাজের শ্বাপদ যারা তারাই আবার সব সুন্দর পায়। যার যোগ্য যে নয়, তার ঘরেই সে যায়। স্বপ্নীল কি তোমাকে উঠিয়ে এনে বিয়ে করেছে?

হঠাৎ এমন কথা শুনে অনুমেঘা বললো, কী বলছেন এসব?

মহিলা বললেন, স্বপ্নীলের সাথে থাকতে তোমার ভয় করে না?

ভীষণ চিন্তিত হয়ে অনুমেঘা বললো, ভয় লাগবে কেন? যেভাবে বলছেন আমার স্বামী যেন হিংস্র বা বিষাক্ত প্রাণী!

মহিলা বললেন, তারচেয়েও ভয়ংকর ছেলে। নষ্টরা মিষ্টি কথা বলে তাই বুঝতে পারছো না। কৌশলী ছেলে বলে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। তার আসল চেহারা সামনে ভাসলে বাঘ দেখার চেয়েও বেশি ভয় পাবে। 

অনুমেঘা থমকে গেলো। বিস্তারিত জানার জন্য বললো, পরিষ্কার করে বলবেন কী বলতে চাচ্ছেন? 

মহিলা বললেন, সাবধানে থেকো, তোমার বাবা-মা কবে না জানি সন্তানহারা হন। স্বপ্নীল তো সন্ত্রাস বাহিনীর লিডার। অনেকগুলি নারী কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত। কত মানুষকে মেরেছে তার ঠিক নেই। কত মানুষের বাসায় ডাকাতি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। নিজেও তো কোপ খেয়েছে! শোনো, স্বামীসুখের চেয়ে স্বীয় প্রাণ আগে। প্রাণ নিয়ে পালিও, নতুবা কবে মারা পড়বে। ইজ্জত তো গিয়েছেই, জানটাও যেন না যায়। 


মহিলা চলে যেতেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। আজ বুঝতে পারছে তার বাইরে যাওয়া নিষেধ কেন ছিলো? আজ বুঝতে পারছে অতি অনাড়ম্বরতায় কেন সে বিবাহ করেছিলো! সুখের সংসার ক্ষেত্রটা মুহূর্তের মধ্যেই শ্মশানের মতো ভূতুড়ে হয়ে গেলো। ভীষণ ভয় লাগছে তার, চার দেয়াল যেন তাকে চেপে ধরবে।


এমন সময়ই স্বপ্নীল বাসায় ফিরলো। অনুমেঘা দূরে সরে চলে গেলো। স্বপ্নীলকে দেখে আজ তার ভয় লাগছে। বাঘের মুখের আহার হয়েই এতকাল ছিলো ভাবতেই শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। নিজের চোখ দুটোও ভয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নীল অনুমেঘাকে সান্ত্বনা দিতে কাছে আসতে চাইলেই চিৎকার করে অনুমেঘা বললো, আমার ভয় লাগছে, কাছে আসবে না। তোমার শরীরে রক্তের গন্ধ। তুমি পাপী, তুমি দোষী। তুমি লম্পট, তুমি কামুক। তুমি নারীর শরীর চেনো, নারীর চরিত্র হরণ করো। তুমি অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করো। তুমি মানুষকে আঘাত করো। তোমার হৃদয় নেই। তুমি দূরে থাকো, তুমি মানুষ নও। তুমি জঘন্য, তুমি পশু অপেক্ষা নিকৃষ্ট। তুমি আমাকে ঠকিয়েছো, তুমি আমাকেও ভালোবাসোনি, তুমি আমাকেও ব্যবহার করেছো। সরে যাও সামনে থেকে, নতুবা মেরে ফেলো।


দিনশেষে ফেরা কর্মক্লান্ত স্বপ্নীল এসব কথা শুনবে প্রস্তুত ছিলো না। যে অব্যক্ত কথাগুলো বলবে বলবে করতে করতে বলতে পারেনি সেই কথাগুলোয় আজ মহীরুহ রূপ নিয়েছে। স্বপ্নীল বললো, তুমি জেনেছো সত্যটা, কিন্তু তুমি আছোও সত্যের সাথে। এভাবে আমাকে ভয় করো না। আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও না। আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। আমার কেউ নেই, আমি বড়ো একা। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না, তুমি আমার কাছে পবিত্রতম।


স্বপ্নীলের চোখে জল চলে এলো। সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই অনুমেঘার। সে গুছিয়ে নিলো। তারপর স্বপ্নীলের সামনে দিয়েই বের হয়ে চলে গেলো। পুরনো ক্ষত দেখে যার হৃদয় ক্ষত হয় সেই অনুমেঘাই একটা আস্ত মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলে যাচ্ছে। 


না জানলে মানুষ সন্ত্রাসীকেও ভালোবাসে, জানলে মানুষ ভালো হয়ে যাওয়া মানুষটিকেও ছেড়ে চলে যায়।

এপ্রিল সংখ্যা ২০২৩ || April Sonkha 2023






সম্পাদকীয়:

 বিচ্ছেদের সুর তুলে মাঝি নৌকার পাল তোলে। শুধু কবিতা দিয়ে এর রূপক ঘেঁটে দেখো, মাঝির হৃদয় অন্তরালে উত্তাল ঢেউ। এখানে ভয় আছে, ডুবে যাওয়ার কিংবা ভয় আছে দ্বীপ ছেড়ে অতল গহ্বর ছেড়ে কোনো এক অচীন প্রদেশের কিনারায় আটকে যাওয়ার। এ এক অমোঘ প্রেমের উচ্ছ্বাস ও বিকাশ। নীল সমুদ্রে সফেনের আগুনে বিষের জ্বালা ধিকিধিকি। মাঝি গান তোলে। সমুদ্রের রূপক, নদীর রূপক হারিয়ে যায় খাতার পাতায়। 


তবু কবি কবিতা লেখে। শুরু হয় নিরন্তর চাঞ্চল্যতা। কবিও শিকার হয় বিষ ভরা সফেনে। নদী শুধু চুমু দেয়। সহবাসের আশায় লিপ্ত সমুদ্রের মধ্যিক্ষাণের দ্বীপ। কবি এখান থেকে হেরে যায়। ভালো লাগা শেষ। প্রয়োজন মিটে গেছে। নদী দ্বীপ সমুদ্র সব এক , সবাই কবিকে ঠকায়। শোষিত হয় মাঝি। কবি শুরু করে একলা থাকার অভ্যেস। কবি এবার তার কলম তোলে , সুর তোলে মাঝি। 


এইরকম শুরু হোক কবির কলম। লিখে ফেলুন। আমরা আপনার পাশে আছি। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা সেই নৌকা। লিখুন, লেখাকে ভালো বাসুন, পড়তে থাকুন আমাদের সকলের প্রিয় পত্রিকা ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন।


                                     ধন্যবাদান্তে

                World sahitya adda সম্পাদকীয় বিভাগ 


___________________________________________________


                            -: বিজ্ঞাপন :-

১.


  

##প্রাপ্তিস্থান - কলেজ স্ট্রীট এ দেজ, দে বুক স্টোর, ধ্যানবিন্দু,ধানসিরি বইঘর (বরো অফিসের পাশের গলিতে) , রিড ইন (সন্তোষপুরে ) , বহরমপুরে বিশ্বাস বুক সটল,কৃষ্ণনগরে মুদ্রা, মালদায় পুনশ্চ


___________________________________________________

২.


মহাকাব্যিক সংলাপ(প্রথম খন্ড),আবৃত্তিযোগ্য কবিতা সংকলন

বিনিময়-১২৫/-


মহাকাব্যিক সংলাপ(দ্বিতীয় খন্ড),আবৃত্তিযোগ্য কবিতা সংকলন

বিনিময়-২০০/-

গ্রন্থগুলি মহাকাব্যিক ব্যতিক্রমী চরিত্রগুলির জীবন সংঘর্ষের কাহিনীগুলির কাব্যিকরূপে উপস্থাপিত এক আবৃত্তিযোগ্য কবিতা সংকলন৷

——————————————

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "সাঁঝবেলার সুর" একটি ভিন্ন স্বাদের কবিতা সংকলন৷

বিনিময়-৩০০/-


প্রকাশক-আনন্দ প্রকাশন(কলেজ স্ট্রীট,কোলকাতা)


বইগুলি প্রাপ্ত করার জন্য যোগাযোগ-

শ্রীঅচিন্ত্য সেনগুপ্ত

mob.no-9800841833


__________________________________________________

৩.



___________________________________________________


বি.দ্র:- সকল কবি ও লেখক তাদের লেখা এই সংখ্যাতে থাকছে তারা প্রত্যেকে এই হোম পেজে নীচের দিকে যান তারপর 'view web virsion' এ ক্লিক করুন । তারপর ঐ মেন পেজে ডানদিকে সূচিপত্রের লিস্ট পাবেন। সেই লিস্ট নিজের নামে ক্লিক করলেই লেখা গুলো দেখতে পাবেন। সেটাই আপনার লেখার লিংক। এই নিয়ম শুধু মাত্র স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের জন্য। যারা কম্পিউটার এ খুলবেন তারা সরাসরি মেন পেজ পাবেন সেখানে সূচিপত্র পাবেন।