Friday, May 3, 2024

আল মাহমুদ - শংকর ব্রহ্ম || Aal mahamud - Sankarbrahama || প্রবন্ধ || Article || নিবন্ধ

আল মাহমুদ 


(আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি)


শংকর ব্রহ্ম




                         আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ই জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তাঁর দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা; যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন।


                          বাবা মীর আবদুর রব। মা রওশন আরা মীর। রব ও রওশন পরস্পর চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন। মীর আবদুর রব সংগীত-অনুরাগী ছিলেন। পিতামহ মীর আবদুল ওহাব ছিলেন কবি। জারি গান লিখতেন। আরবি-ফার্সি ভাষায় সুণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃত ভাষাও জানতেন। আবদুল ওহাব স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা ও কেরানির চাকরি করতেন।


                           ১৯৪২ সালে দাদি বেগম হাসিনা বানু মীরের কাছে বর্ণপাঠ দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। তাঁর কাছ থেকেই বিশাল বৈচিত্র্যময় আকাশের বিস্তার অবলোকনের প্রথম পাঠ গ্রহণ। ওই সময়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ধর্মীয় শিক্ষা। ১৯৪৩-৪৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম.ই স্কুলে ২য় থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ১৯৪৮ সালে ৬ষ্ঠ জর্জ হাইস্কুলে পড়েছেন ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত। ৮ম শ্রেণিতে পড়েছেন কুমিল্লার দাউদকান্দির জগতপুরে সাধনা হাইস্কুলে। তারপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।


                             ১৯৫৪ সালে কবি আল মাহমুদ দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৭-৬২ সালে তিনি ড্রেজার ডিভিশনে গেজ রিডার পদে এবং লাইফবয় সাবানের সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৬৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রুফ রিডার পদে যোগ দেন। পরে তাঁকে জুনিয়র সাব এডিটর এবং মফস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে ইত্তেফাক প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে আর্ট প্রেসে প্রকাশনা তদারকির কাজ করেন এবং চট্টগ্রামের প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা 'বইঘর'-এর প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে পুনরায় ইত্তেফাক চালু হলে তিনি সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইত্তেফাক কার্যালয় গুড়িয়ে দিলে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের জুনিয়র স্টাফ অফিসার পদে যোগ দেন। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাসদ-এর মুখপত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালের মার্চে কারাবরণ করেন। প্রায় এক বছর কারাভোগের পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালে মুক্তি পান। কারামুক্তির কয়েকদিন পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করেন। কারাবাসের সময়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পঠন-পাঠনের ফলে তাঁর চিন্তাজগতে পরিবর্তন ঘটে। নাস্তিকতার পথ থেকে আস্তিকতার দিকে ফিরে আসেন। ১৯৯৩ সালের ১০ই জুলাই তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ওই বছরই তিনি দৈনিক সংগ্রাম-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় প্রত্যাবর্তন করেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক কর্ণফুলি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।


                 আল মাহমুদের প্রথম প্রকাশিত রচনা ছিল একটি ছোটগল্প। তারপর ভাষা-আন্দোলন কমিটির একটি লিফলেটে ৪ পংক্তির কবিতা ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে তাঁর ১৮ বছর বয়স থেকে ঢাকা ও কলকাতার স্বনামধন্য পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ুখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়।


                           আল মাহমুদ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু।


আল মাহমুদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাকিস্তান-আন্দোলন, ভারত উপমহাদেশের বিভাজন এবং নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাষা-আন্দোলনের প্রবল প্রবাহের সময়ে শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করেছেন। নতুন দেশের জন্য অফুরন্ত আশা আর আশাভঙ্গের দারুণ হতাশার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। শৈশবে পারিবারিক ইসলামি ঐতিহ্যে লালিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাগরিক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আবহ, বিশেষ করে, লালমোহন পাঠাগার কেন্দ্রিক বামচিন্তাধারা ও বৈপ্লবিক চেতনা এবং জগতপুরের স্কুলজীবনে নির্মল প্রকৃতির প্রভাব তাঁর কল্পনা ভুবনে সৃজনশীলতার বীজ বপন করে। যৌবনের শুরুতে দেখেছেন স্বাধিকারের স্বপ্ন-ঘেরা এটি জাতির প্রস্তুতিকাল।


 আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাটের দশকেই কবি স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন।


                        সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে মাহমুদ ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র/পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলা পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।


                   ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন একজন। লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল), কালের কলস (১৯৬৬ সাল), সোনালী কাবিন (১৯৭৩সাল), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য গল্প ও উপন্যাসের জন্যও খ্যতি অর্জন করেছিলেন।


                   আল মাহমুদ ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪ সাল) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।


সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে সমাজতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে আস্থাশীল ছিলেন। ৪০ বছরের কাছাকাছি বয়সে তাঁর কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রকাশিত সরকারবিরোধী একমাত্র পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর সম্পাদক হন তিনি ।


                  ১৯৭১ সালে তিনি ভারত গমন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধের পরে দৈনিক গণকণ্ঠ নামক পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।


                  ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক পদ থেকে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।


                        ১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬ সাল), সোনালি কাবিন (১৯৭৩ সাল), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬ সাল) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল।


                           তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।


                        ১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম 'সোনালি কাবিন'। ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধ তার কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'কবি ও কোলাহল'। কোনও কোনও তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বাসগ্রস্ততার কারণে তার বেশকিছু কবিতা লোকায়তিক সাহিত্যদর্শন দৃষ্টান্তবাদ দ্বারা অগ্রহণযোগ্য। তবে একথাও সত্য, কবিতায় দর্শন থাকে, কিন্তু দর্শন দ্বারা কবিতা নিয়ন্ত্রিত নয়, কবিতা আবেগের কারবার। 


                     তিনি নিউমোনিয়া সহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ঢাকায় ধানমণ্ডির ইবনে সিনা হাসপাতা‌লে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। 



(তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ)



লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল), 


কালের কলস (১৯৬৬ সাল), 


সোনালী কাবিন (১৯৭৩ সাল), 


মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬ সাল), 


অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০ সাল), 


বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫ সাল), 


আরব্য রজনীর রাজহাঁস (১৯৮৭ সাল), 


প্রহরান্তে পাশফেরা (১৯৮৮ সাল), 


একচক্ষু হরিণ (১৯৮৯ সাল), 


মিথ্যাবাদী রাখাল, (১৯৯৩ সাল), 


আমি দূরগামী (১৯৯৪ সাল), 


হৃদয়পুর (১৯৯৫ সাল), 


দোয়েল ও দয়িতা, (১৯৯৬ সাল), 


দ্বিতীয় ভাঙন (২০০০ সাল), 


নদীর ভিতরে নদী (২০০১ সাল), 


উড়ালকাব্য (২০০৩ সাল), 


না কোনো শূন্যতা মানি না (২০০৪ সাল), 


বিরামপুরের যাত্রী (২০০৫ সাল), 


তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী (২০০৫ সাল), 


তুমিই তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল (২০০৭ সাল), 


সেলাই করা মুখ (২০০৮ সাল), 


পিপাসার বালুচরে (২০০৮ সাল), 


প্রেমপত্র পল্লবে (২০০৯ সাল), 


তোমার রক্তে তোমার গন্ধে (২০১১ সাল), 


পাখির কথায় পাখা মেললাম (২০১২ সাল),


তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫ সাল)


ইতিহাস দেখো বাঁক ঘুরে গেছে ফের ইতিহাসে (২০২০ সাল); 


মহাকাব্য'- এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না (২০২০ সাল); 


ত্রিশেরা


প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা


প্রেমের কবিতা সমগ্র


প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা


কবিতাসমগ্র


কবিতাসমগ্র-২


Selected Poems - Al Mahmud (১৯৮১ সাল)



(শিশু-কিশোর সাহিত্য [ছড়া/কবিতা])



পাখির কাছে ফুলের কাছে (১৯৮০ সাল), 


একটি পাখি লেজ ঝোলা (২০০০ সাল), মোল্লাবাড়ীর ছড়া (২০০৫ সাল), 


ফড়িং ধরার গল্প (২০১১ সাল), 


নেবু ফুলের গন্ধে (২০২০ সাল), 


আমার নামে ডাকছে পাখি (২০২০ সাল); 



(ছোটগল্প)



পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫ সাল), 


সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮২ সাল), গন্ধবণিক (১৯৮৮ সাল), 


ময়ূরীর মুখ (১৯৯৪ সাল), 


নদীর সতীন (২০০৪ সাল), 


ছোট-বড় (২০০৫ সাল), 


চারপাতার প্রেম (২০০৯ সাল), 


সপ্তর্ষী (২০১৪ সাল), 


জলবেশ্যা ও তাহারা (২০১৫ সাল), 


প্রিয় পঞ্চমী (২০১৬ সাল)


আল মাহমুদের গল্প


গল্পসমগ্র


প্রেমের গল্প



(উপন্যাস)



ডাহুক (১৯৯২ সাল), 


কাবিলের বোন (১৯৯৩ সাল), 


উপমহাদেশ (১৯৯৩ সাল), 


কবি ও কোলাহল (১৯৯৩ সাল), 


পুরুষ সুন্দর (১৯৯৪ সাল), 


নিশিন্দা নারী (১৯৯৫ সাল), 


আগুনের মেয়ে (১৯৯৫ সাল), 


যে পারো ভুলিয়ে দাও (১৯৯৫ সাল), 


পুত্র (২০০০ সাল), 


চেহারার চতুরঙ্গ (২০০১ সাল), 


কলঙ্কিনী জ্যোতির্বলয় (২০০৩ সাল), 


ধীরে খাও অজগরী (২০০৪ সাল), 


যে যুদ্ধে কেউ জেতেনি (২০০৬ সাল), 


তুহিন তামান্না উপাখ্যান (২০০৭ সাল), 


তুষের আগুন (২০০৮ সাল), 


জীবন যখন বাঁক ঘোরে (২০১৮ সাল), 


সহোদরা (২০২০ সাল), 


রাগিনী (২০২০ সাল)


কাবিলের বোন (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস)


উপন্যাস সমগ্র-১


উপন্যাস সমগ্র-২


উপন্যাস সমগ্র-৩



(কিশোর গল্প-উপন্যাস)



মরু মুষিকের উপত্যকা (১৯৯৫ সাল);


আরব্য রজনীর রাজহাঁস


বখতিয়ারের ঘোড়া


অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না


একটি পাখি লেজ ঝোলা


পাখির কাছে ফুলের কাছে


কিশোর সমগ্র


ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা)



 (আত্মজীবনী)



যেভাবে বেড়ে উঠি (১৯৯৭ সাল), 


বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ (২০০৭ সাল)


কবির আত্নবিশ্বাস



(প্রবন্ধ)



 দিনযাপন (১৯৯০ সাল), 


কবির আত্মবিশ্বাস (১৯৯১ সাল), 


নারী নিগ্রহ (১৯৯৭ সাল), 


কবিতার জন্য বহুদূর (১৯৯৭ সাল), 


কবিতার জন্য সাত সমুদ্র (১৯৯৯ সাল), 


কবির সৃজন বেদনা (২০০৫ সাল), 


সময়ের সাক্ষী (২০০৫ সাল), 


মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) (১৯৮৯ সাল), 


দশ দিগন্তে উড়াল (২০০৯ সাল), 


কবির কররেখা (২০০৯ সাল), 


বারো মাস তেরো পার্বন (২০০৮ সাল), 


কবির মুখ (২০১৫ সাল)



 (সম্পাদনা)



কাফেলা (১৯৫৫-৫৬ সাল), 


দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-৭৫ সাল), 


আহত কোকিল (১৯৭৭ সাল), 


শিল্পকলা (১৯৮০ সাল), 


আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা (১৯৮৩ সাল), 


দৈনিক কর্ণফুলী (১৯৯৫-২০০৪ সাল), 


সঙ্গীত সিরিজ-১ (গুল মোহাম্মদ খানা, কানাইলাল শীল, ফুলঝুরি খান), 


লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল)



                           আল মাহমুদ ১৯৮০ সালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় কবিতা সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় নাগরিক ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া প্রায় ৭ দশক ধরে তিনি সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি বিষয়ক সভা-সমিতি-সেমিনারে নিয়মিতভাবে যোগদান করে বক্তৃতা ও মতামত প্রকাশ করে জাতীয় ভাবধারা ও অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন।


                            ১৯৭৮ সালে কবি আল মাহমুদ তৃতীয় বিশ্বগ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। আশির দশকে ভারতের ভূপালে এশীয় কবিতা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি একাধিকবার ভারতের দিল্লি এবং কলকাতার আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে ওল্ডহ্যাম সিটিতে একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৫ সালে PEN International-এর বাংলাদেশের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর রচনা ইংরেজি, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।



 (তাঁর পুরস্কার ও সম্মাননা)



 ১). 'বাংলা একাডেমি' পুরস্কার (১৯৬৮ সাল), 


২). 'জয়বাংলা সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৭২ সাল), ৩). 'হুমায়ুন কবির স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৭৪ সাল), ৪). 'জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৭৪ সাল), 


৫). 'সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য' স্বর্ণপদক (১৯৭৬ সাল), 


৬) 'বাংলাদেশ লেখক সংঘ' পুরস্কার (১৯৮০ সাল), 


৭). 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ' পুরস্কার (১৯৮১ সাল), 


৮). 'শিশু একাডেমি' (অগ্রণী ব্যাংক) পুরস্কার (১৯৮১ সাল), 


৯). 'আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৮৩ সাল), 


১০). 'অলক্ত সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৮৩ সাল), 


১১). 'কাফেলা সাহিত্য' পুরস্কার (কলকাতা, ১৯৮৪), 


১২). 'হুমায়ুন কাদির স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৮৪ সাল), 


১৩). 'একুশে পদক' (১৯৮৬ সাল), 


১৪). 'ফিলিপ্স সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৮৭ সাল), ১৫). 'নাসিরউদ্দিন' স্বর্ণপদক (১৯৯০ সাল), 


১৬). 'ফররুখ স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৯৫ সাল), 


১৭). 'মুক্তিযুদ্ধ পদক' (১৯৯৭ সাল), 


১৮). BJWA of America (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯৮ সাল), 


১৯). 'কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য' পুরস্কার (২০০২ সাল), 


২০). 'অগ্রদূত গুণীজন' পুরস্কার (২০০২ সাল), ২১). 'নতুনগতি সাহিত্য' পুরস্কার (কলকাতা, ২০০৩ সাল), 


২২). 'জাতীয় মঙ্গলপদক' (২০০৩ সাল), 


২৩). 'ঢাকা পোস্ট' স্বর্ণপদক (২০০৪ সাল), 


২৪)


 'শিশু একাডেমি' পুরস্কার (২০০৫ সাল) 


প্রভৃতি।



                           তাঁর সমালোচনা অনেকেই সমালোচনা করেন যে, আল মাহমুদ ১৯৯০’র দশকে ইসলামী ধর্মীয় বোধের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার কবিতায় ইসলামী চেতনার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। যদিও তিনি বিভিন্ন সময় তা অস্বীকার করেছেন।



(আল মাহমুদকে নিয়ে গবেষণা)



কবি খোরশেদ মুকুল আল মাহমুদকে নিয়ে লিখেছেন গবেষণামূলক গ্রন্থ 'দ্রোহের কবি আল মাহমুদ'।



কমরুদ্দিন আহমেদ প্রকাশ করেছেন গবে

ষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আল মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী’।



ড. ফজলুল হক তুহিন; আল মাহমুদের কবিতা : বিষয় ও শিল্পরূপ, মাওলা বাদ্রার্স , ঢাকা।



---------------------------------------------------------------------------------------------


[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত। সূত্র - অন্তর্জাল ]






কুমুদ কথায় অজয় - তন্ময় কবিরাজ || Kumud Kothay Ajay - Tanmay Kabiraj || প্রবন্ধ || Article || নিবন্ধ

 কুমুদ কথায় অজয়

        তন্ময় কবিরাজ



"ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বলো কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কি চলার শেষ ও নদীরে..."হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী গানের কথাই মনে এলো কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের সঙ্গে অজয় নদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। কারন কবি কুমুদ রঞ্জনের জীবনে মিশে গেছে অজয়ের স্রোত। রূপসী বাংলার মাধুর্য্য খুঁজতে গিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ পেয়েছিলেন গাঙ্গুর- বেহুলা, জীবন সংগ্রামের ইতিকথার জীবন্ত দলিল হয়ে রয়েছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা, বা কখনও তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কাছে নদী কেবল চলমান স্রোতের গতিধারা নয়,তিনি অজয়ের মধ্যেই গ্রামীণ জীবনের উঠানামার গল্প রচনা করেছেন। অজয় কবি কুমুদ রঞ্জনের সুখের কাব্যিক মেটাফরে সীমাবন্ধ থাকেনি, বরং পথচলতি জীবনের সাক্ষ্য বহন করা বন্ধু। তাই হাজার বিপত্তি কাটিয়ে তিনি বলেন,"অভয় মাগি মনের কথা বলতে পারি কি/উজানি আর অজয় আমার প্রাণের সামগ্রী।"কবিতায় আমার শব্দের অর্থ শুধু ব্যক্তি কবিই নন, বরং তার সঙ্গে জড়িত নদী তীরবর্তী জীবন। নদীর বাধা থাকলেও নদী মাত্রিক বাংলাদেশে নদীকে ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। আয়ারল্যান্ডের "রাইডার্স টু দ্যা সী" নাটকে মরিয়া নদীতে তাঁর সব সন্তানদের তিনি হারিয়েছেন, আবার নদীই তাঁর জীবিকার উৎস। নিয়তির এই দেওয়া নেওয়ার মধ্যেই এক স্বতন্ত্র জীবন বয়ে চলে যাকে যুক্তি বুদ্ধিতে সবসময় গ্রহণ করা অসম্ভব। কবি কুমুদ রঞ্জন তাঁর প্রিয় অজয়ের উদ্দেশ্যে লিখছেন,"অজয় আমার ভাঙবে গৃহ, হয়তো দুদিন বই/তবু তাহার প্রীতির বাঁধন টুটতে পারি কই?/সে তো কেবল নদ নহেক, নয়ক সে জল/সে তরল গীতগোবিন্দ চৈতন্যমঙ্গল।"অজয়ের বানের ভাঙন আসবেই। জীবনের দুর্দশার কাছে মানুষের কি করার আছে? নিয়তির কাছে সব সঁপে দিলেই সবাইকে ভালবাসা যায়। কারন কবি জানেন,এই অজয়ের তীরে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, আবার এই অজয়ের কৃপায় "বনকে করে শ্যামল এবং মনকে করে সমৃদ্ধি।"কবি অজয়ের তীরে যেমন গ্রাম্য জীবনকে উপভোগ করেছেন, তেমনই অজয়ের ধারে তিনি খুজেঁ বেড়িয়েছেন ইতিহাসের গলিপথ। অজয় যেনো কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের বারানসির গঙ্গা , যার তীরে কাশী বিশ্বনাথ থেকে মনিকর্নিকার চির আগুনে মিশে গেছে পুরাণের সঙ্গে বিশ্বাস যা আজও প্রবাহমান। অজয়ই হয়ে উঠেছে কবির কাব্য প্রেরণা, মঙ্গল বৈষ্ণব কাব্যের আঁতুড়ঘর।তিনি তাঁর "লোচনদাস" কবিতায় লিখেছিলেন,"অজয়ের তীরে রহিতেন কবি পর্ণকুটিরবাসী/লোষ্ট্র সমান দূরে কত ত্যক্ত বিভর রাশি।"শুধু অজয়কে ভালোবেসে তিনি তাঁর কবিতায় ছন্দে এনেছেন পরিবর্তন, উপমা হয়েছে সহজ সরল, আরোও শ্রুতিমধুর। বক্তব্যের বিষয়কে কবি একই রেখে দিয়েছেন, শুধু পরিবেশনে এনেছেন নতুনত্ব। তাই কুমুদ রঞ্জনের কবিতায় ক্লান্তি নেই। বরং নতুনের স্বাদে আরোও কিছুটা সময় অজয়ে ডুবে থাকা যায় অরূপ রতনের আশায়। "আমাদের সঙ্গী" কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"অজয়ের ভাঙনেতে করে বাড়ি ভঙ্গ/তবু নিতি নিতি হেরি নব নব রঙ্গ।"কবিতায় উঠে এসেছে কবির নিজের কথা। নদীর সঙ্গে লড়াই করার ইতি বৃত্তান্ত।' আমার বাড়ি "কবিতায় সেই কথাই প্রতিফলিত হয়েছে,"বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদীর বাঁকে/জল সেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।"আবার কখনও ভাঙনের গল্প ভুলে কবি হারিয়ে যায় হারান দিনের নস্টালজিয়াতে। অজয় নদের অ্যালবামে সযত্নে লালিত শৈশবের ফেলে আসা দিনলিপি। তাই "বকুল তরু "কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"পাঁচশো বছর হেতাই ছিল প্রাচীণ বকুলগাছ/অজয় নদের ভাঙনেতে পড়লে ভেঙ্গে যায়।"শৈশব যেমন অজয়কে দেখেছে, তেমনই অজয়ও আসতে আসতে মুছে দিচ্ছে ছেলেবেলার সব স্মৃতি।অভিমান যন্ত্রণার মধ্যে নদী বড়োই নীরব। দুজন দুজনের সমান্তরালে হেঁটে গেলেও কেউ কারো খবর রাখে না। তবু জীবন আর নদীর নিবিড় সম্পর্কের যে দর্শন রচিত হয় তার টানেই সভ্যতার ভীত গড়ে উঠে এই নদের তীরে।বড়ো বিচিত্র। বড়ো মোহময় নিজেকে জানা, নিজেকে চেনা।যাকে দেখে অভিমান বাসা বাঁধে, আবার তার জীর্ণ রুগ্ন অবস্থায় মন খারাপ করে।" শীতের অজয়' কবিতায় কবি সমব্যাথী হয়েছেন কারন শুকনো অজয়ের আজ জলধারা স্থিমিত। তাঁর কল্পনায় অজয় তো শিশু যার বিকাশে দরকার মায়ের স্নেহ ভালবাসার পরশ। অনাহারে জীর্ণ অজয়কে দেখে কবির হৃদয় আন্দোলিত হয় কারন অজয় তাঁর প্রানের প্রতিবেশী।কবি স্বার্থপর নয়।প্রতিবেশীর কষ্টে তাঁর মন কাঁদে।তিনি লেখেন,"সিকতায় লীন শীর্ণ সলিল ধারা/আজ জননীর স্নেহ হতে যেন হারা।"কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক মনে করেন,তিনি তাঁর ভাবনায় সুখী।তিনি তো কবি। আর চিন্তা মননের পথেই তো একজন কবি হেঁটে বেড়ান, আনন্দ উপভোগ করেন যা পরবর্তীকালে পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।" কবিতার সুখ "কবিতায় তাই কুমুদ রঞ্জন স্বীকার করেন,"কবিতা লিখিয়া পাইনি অর্থ, পাইনি নি কোনো খ্যাতি ভাই/হয়েছি স্বপ্ন বিলাসী অলস অনিযোগ দিবারাতি তাই।"কবি প্রাসঙ্গিক দ্বন্দ্ব বা বিষয়কে তুলেছেন - খ্যাতি বনাম সুখ।তিনি অর্থের মধ্যে জীবনকে দেখতে পাননি। নীরব বস্তুতে পরখ করেছেন প্রাণের স্পন্দন, যেখানে চলে হৃদয়ের দেওয়া নেওয়া। কবি কুমুদ রঞ্জনের সৃষ্টিতে রয়েছে সংশয়।তিনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর কবিতা পাঠযোগ্য। "কবিমানস" কবিতায় তিনি প্রশ্ন তোলেন,"বন্ধুরা কন আমার কবিতা কেহই পড়ে না শুনি/পড়িবার মত কি আছে তাহাতে কেন পড়িবেন শুনি।"টু বি আর নোট টু বি এর শ্বাশত দ্বন্দ্বের প্রতিমূর্তি তিনি।মনের ভেতরে অবিরাম কনফ্লিক্ট এর গতিতে সৃষ্টি হয় একের পর এক অনবদ্য সব কবিতা। থেমে যাওয়া নয়, প্রতিদিন জীবনকে শুধরে নিয়ে এগিয়ে যাবার কথাই বলতে ভালোবাসেন কবি কুমুদ রঞ্জন। কবি দেখেছেন, নদীকে ঘিরে রাজনীতি,সামাজিক শোষণ। বন্যার কবলে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান যখন শাসকের রাজধর্ম তখন সেই শাসকই তার প্রজাকে অনুগত ভৃতে পরিনত করে, যাতে সে তার মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। বারবার বন্যা হয়েছে। অতি বৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক। দরকার নদী সংস্কার।কবি বলছেন,"বন্যা হয়েছে হয়েছে এবং প্রতিকার নাই যবে।"বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা কবি তাই নিজেই বলে দিচ্ছেন,"ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে বন্যা ব্রিগেড গড়িতে হবে।"কারন কবি মনে করেন, গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামই সভ্যতার সোপান। শাসককে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।"পল্লী হতেছে অবাসযোগ্য রুক্ষ হে ভগবান/শহর বাঁচুক সঙ্গে তাহার পল্লীকে বাঁচাইও/.. রিলিফ আসিছে ভিক্ষা আলিছে কম্বল পিছু পিছু।"বন্যতে জীবন দুর্বিষহ, গৃহহীন, ভেসে গেছে বসতবাড়ি। "অজয়ের প্রতি" কবিতায় কবি প্রতিবাদ করেন তাঁর প্রিয় অজয়ের বিরূদ্ধে,"তোমার এ বারি নয় তো অজয় - এ বারি গরল ভরা/তোমার স্নেহের কনা নাই এতে এ শুধু বিষের ছড়া।"কবি বিশ্বাস করতে পারছেন না ভালবাসা এতো নির্মম।প্রেম যেমন গড়তে জানে তেমনই ভাঙতেও জানে। শূন্যতায় যে যাত্রার শুরু শূন্যতাতেই তার ইতি। দর্শন সরণে এ পদার্থবিদ্যা বড্ড জটিল অথচ মৌলিক। তাই আক্ষেপের মধ্যেও ত্যাগের বার্তা লুকিয়ে,"কতো বার বাড়ী ভাঙ্গিলে তুমি হে - গড়ি বা আমি কত/বিপদ যে তোমার দুর্দমনীয় - বড়োই অসংগত।"কবি কুমুদ রঞ্জনের কবিতায় তাই পল্লীজীবনের সাহিত্য ভাবনায় যেমন প্রাণের বাংলার প্রতি তাঁর স্নেহ ভালবাসাকে উজার করে দিয়েছেন আবার কখনও সমাজজীবনে তিনিই রচনা করেছেন ব্যঙ্গ কাব্য।রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যের স্বাদে ফিরে যান সাবেক বাংলার তুলসিমঞ্চ, সন্ধ্যা প্রদীপ,মঙ্গল শঙ্খর ইতিহাসে। তবে এতো কথা,এতো গল্পের আড়ালে বয়ে গেছে অজয়, এ যেন ব্রিটিশ কবি ওয়ার্দওয়ার্থের টেমসের রূপকথা। কবি কুমুদ রঞ্জনের আর অজয় সমার্থক। অজয়ের পাড়েই বসেই তার জেগে উঠে বাঙালি সত্তা। তিনি লেখেন,"আমরা বাঙালি হয়তো বা বটি দুষি/মোদের নিন্দাকে যার যত খুশী।"অজয়কেই তিনি তাঁর সব অব্যাক্ত ব্যাক্ত করেছেন। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কাছে অজয়ই সেই ক্ষুধিত পাষাণ বা জসীমউদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ যা আজও প্রবাহের স্রোতে কথা বলে যায়।




বিষয়: রূপসী বাংলার জসীমউদ্দীন


ভালবাসা অন্ধ? এ প্রশ্নের উত্তর কি হবে তা আমার জানা নেই। তবে গ্রামবাংলাকে ভালোবেসে কবি জসীমউদ্দীন যে আবেগ উজাড় করে দিয়েছেন তাতে তিনি সত্যিই অন্ধ।তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত গ্রাম্য জীবনের জটিলতা, আর্থ সামাজিক অস্থিরতা কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় নেই।তিনি রূপসী বাংলার কাছে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে। বাংলার প্রতি তাঁর ভালবাসাই প্রধান হয়ে উঠেছে। তাঁর বর্ণনায় আড়ালে উঁকি দিয়েছে কিছু সাময়িক অস্থিরতা। কখনও কবিতায় শোনা যায়, লালনের মত বৈরাগী জীবনের কথা।কবি বাংলার অলিগলি হেঁটে গেছেন শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করবেন বলে। "মুসাফির "কবিতায় কবি জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন,"চলে মুসাফির গাহি/এ জীবন ব্যাথা আছে শুধু, ব্যাথার দোসর নাহি/... হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেউ নাই শুনিবার।"কাব্যিক অলঙ্কারে আলিটারেশন,কখনও অ্যন্টিথেসিসে মিশে গেছে "আছে - নাহি"শব্দের রসায়ন,

প্রকট হয়েছে দর্শন - সমস্যাময় জীবনে সমাধান নেই, কথা আছে অথচ কথা বলার বা শোনার মত মানুষ নেই। সৌন্দর্যে ডুবে থাকা কবি জসীমউদ্দীনের এইরূপ হৃদয় যন্ত্রণা হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত। সৌন্দর্য বোধ কবির চিন্তনে ভাবনার জন্ম দেয়। ব্যক্তি জসীমউদ্দীন থেকে তিনি হয়ে উঠেন দার্শনিক যার স্বাদ তখন সর্বজনীন। বাংলার মেয়েদের তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন, বর্ণনা করেছেন সহজ ভাষায়। যৌনতার প্রলেপ নেই, রয়েছে তাকিয়ে থাকার আনন্দ।তিনি তাঁর সৃষ্টিতে পাঠকের মনে উত্তেজনার বীজ বপন করেননি, বরং ভালোবাসার সহজপাঠ রচনা করেছেন। ব্রিটিশ কবি ওয়াডসওয়ার্থ যেমন প্রকৃতিকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান লুসিতে বা নির্জন উপত্যকায় গান গাওয়া মেয়েটির মধ্যে, কবি জসীমউদ্দীনও মনে করতেন, বাংলার মেয়েরাই অপরূপ বাংলার মানবিক প্রতিমূর্তি। কল্যানী কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়াছ জোছনায়/রাঙা অনুরাগ ছরায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়।"অপূর্ব শব্দের বাহারি যুগলবন্দিতে কবি মেয়েদের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। কখনও তিনি বলেছেন,"পড়শীরা কয় মেয়ে তো নয়, হলদে পাখির ছা /ডানা পালিয়ে যেতে ছেড়ে তাদের গাঁ।"মেয়েদের বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি মনখোলা, নিখুঁত।"ও গাঁর মেয়ে আসছিল নূপুর পরা পায়ে।"কবি কোনো পাউডার বিউটির কথা বলেননি। বরং বিভূতিভূষনের ভানুমতির মত নারী মিশে গেছে প্রকৃতির চেনা সোহাগে,যার ভালোবাসো অমলিন।কবি লিখছেন,"লাল মোরগের পাখার মত উড়ে তাহার শাড়ি।"অন্যদিকে গ্রাম্য জীবনের বিবাদও ধরা দিয়েছে তাঁর লেখায় মাঝেমধ্যে।"এ গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও গাঁর লোকের সনে/কাইজা ফ্যাসাদে করেছে যা জানেই জনে জনে।"বাংলার মেঠো আলপথে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। চলার পথে যখন যা দেখেছেন তখন তাই সংগ্রহ করে রেখেছেন মনের গোপন ঘরে। কারন তারাই কবির নীরব সময়ের আশীর্বাদ, কাব্যিকতার রসদ। চেনা জীবনকে আরোও সহজ সরস করে তুলতে তিনি তাঁর ছন্দ বর্ণনার রীতি ভেঙেছেন।পারিবারিক জীবনের মধ্যেও দেখেছেন শামুকের পায়ের অপূর্ব আলপনা।কবি লিখেছিলেন,"আমার বাড়ি ডালিম গাছে/ডালিম ফুলের হাসি/কাজলা দীঘির কালো জলে/হাঁসগুলো যায় ভাসি।"প্রকৃতির অলঙ্কারে সেজেছে মানুষ। মানুষ আর প্রকৃতি সব দ্বন্দ্ব ভুলে আনন্দের সংহতি রচনা করেছে। কাজল জলে হাঁসগুলো যখন ভেসে তখন কবি নস্টালজিক। অনেকেরই আবার কবি ইয়েটসের দ্যা উইল্ড সোয়ান অ্যাট কুলি কবিতার কথা মনে যায়।কবি জসীমউদ্দীন তো জীবনানন্দের রূপসী বাংলার প্রতিবেশী। জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে জীবনানন্দ আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন, কবিতায় এসেছিল চলমান জীবনের সব কথা,কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতা রয়ে গেছে হারানো সুরেই, ফার ফ্রম দ্যা মাডিং ক্রাউড।তাই জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়লে গ্রের এলিজির মত আমরাও হতভাগ্য গ্রাম্য জীবনের প্রতি সমব্যাথী হয়ে যাই।বনলতা সেন যদি জীবনানন্দকে শান্তি দিয়ে থাকে, তবে বাংলার অপার্থিব সৌন্দর্য কবি জসীমউদ্দীনকেও সেই শান্তি উপহার দিয়েছিল। কবি জন কিটসের টু ওয়ান হু হাস বিন লং ইন সিটি পেন্ট কবিতার আবেগ এসে ধরা দেয় জসীমউদ্দীনের ভালোবাসায়। তাঁর "নিমন্ত্রণ"এ সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না।"তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোটো গাঁয়।"


বাংলার প্রতি জসীমউদ্দীনের ছিল অহংকার।তিনি লিখেছিলেন,"চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।"প্রাক ব্রিটিশ রোমান্টিক কবিদের মত তিনি প্রকৃতির মধ্যে জীবনকে বোঝার চেস্টা করেছেন। কখনও মিশে গেছেন,তো কখনও আবার স্বতন্ত্র জীবনের সন্ধানে অন্যভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছেন।"চৈত্র গেলো ভীষণ খরায়, বোশেখে রোদ ফাটে।"মৌলিক ভাষার বানান তিনি ব্যবহার করেছেন। পাশপাশি, প্রকৃতির খামখেয়ালী চরিত্রেও তিনি সজাগ।"এই এক গাঁও মধ্যে ধু ধূ মাঠ/ধান কাউর লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।"ইতিহাসের মুখবন্ধে লেখা থাকবে এ কথা কারন সভ্যতা তখনও গ্রামীণ জীবনে অগ্রসর হতে পারেনি। চারদিকে মাঠ মাঝখানে গ্রাম। প্রকৃতির উদার যাতায়াতে নেই আধুনিকতার অনুপ্রবেশ।কবি প্রকৃতির অনাবিল সুখকে বিলিয়ে দিয়েছেন চেনা জীবনের স্রোতে।তিনি লিখেছিলেন,"কচি ধানের তুলতে চারা হয়তো কোনো চাষী/মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।"সুখের চাহিদাতে প্রকৃতির হাতছানি।কবি বাংলার জীবন প্রকৃতির মধ্যে সুর খুঁজেছেন। গান তাঁর অন্যতম ভালো লাগা। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে জারি গান, মুর্শিদা গান।তিনি মানুষ হিসাবে প্রগতিশীল। অস্থির সময় তিনি দেখেছেন।তবু পল্লীবাংলাকে ভালবেসে সব ভুলে শান্তি পেয়েছেন। নজরুলের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন,রবীন্দ্রনাথের কাব্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা তো পল্লীজীবনের অ্যালবাম। নন্দলাল বসু বলেছিলেন, শিল্পবোধ তৈরি করতে হলে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আরোও নিবিড় করতে হবে, তেমনি পল্লীবাংলার ইতিহাসের খোঁজ নিতে হলে আগামীতে চলে আসতে হবে জসীমউদ্দীনের কবিতার মিউজিয়ামে। সাবেক বাংলাই তো তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়।







অসহায় মা - প্রহ্লাদ কুমার প্রভাস || Osohay maa - Prohalad Kumar provas || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 অসহায় মা

প্রহ্লাদ কুমার প্রভাস 



রাহুলের মা সকালে খেতে বসলে তার বৌ দৌড়ে এসে খাবারের থালাটা কেড়ে নিয়ে বলে " এই যে তোমার মাকে কতবার বলেছি যে প্রতিদিন সকালে ছোটনের জামা কাপড় না ধুয়ে, ঘর বাড়ি না মুছে,ঝাট না দিয়ে খেতে না বসতে? বুড়ির কি কোন কান্ড জ্ঞান নেই নাকি? কতবার ভাত ফেলেও দিয়েছি তবু লজ্জা নাই?"

মা বলে " বৌমা শীতের দিন তো উঠতে দেরি হয়ে গেছে।ওষুধ খেতে হবে, তাই।"

রাহুলের বো বলে"ওতকিছু বুঝি না রাতেও তোমার খাওয়া বন্ধ। আর রাতে তুমি বারান্দায় শোবে। ঢাকা থেকে আমার ভাই আসবে"

রাহুল ও রাহুলের বৌ দুজনেই সরকারি চাকুরীজীবি।

 বৃদ্ধ মা বারান্দার এক কোণে বসে অঝোরে কানছে। একদিকে পেটে ক্ষুধা তার উপর চোখে ভালো দেখে না, পায়ে ঠিকমতো বল নাই। ঔষধ ও ঠিকঠাক কিনে দেয় না। স্বামী বেঁচে থাকলে হয়ত কষ্ট কিছুটা কমত। দুপুরেও খাওয়া হলো না। ঔষধ ও ফুরিয়ে গেছে। রাতে ছেলে অফিস থেকে ফিরলে "মা" দরজায় গিয়ে দাড়ায় এবং বলে" মাগো দুটো খেতে দিবি আর যে পারছি না সইতে। ঔষধ ও নাই বাবা আজ তিনদিন হলো। একটাই ছিল যেটা সপ্তাহে একটা খেতে হতো। ওটাই সকালে খেয়ে নিয়েছি ভাত না খেয়ে। দে না মা একমুঠো ভাত আমিও তো তোর মায়েরই মতো" । নির্দয়ী বৌ ঠাঁই দাড়িয়ে রইল পাষাণের মতো। ছেলেও কিছু বলছে না দেখে মা দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর চলে গেল।


রাতে বৌ এর ভাই এলো এবং মা খোলা বারান্দায়। ছেঁড়া হালকা একখান কাঁথার ভিতর মা কাঁপছে আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে।

" হায়রে ছেলে বৌ নিয়ে এলি, মাকে ভুলে গেলি এই কি সন্তান? 

মরে গেলে লোক খাওয়াবি ডাকবি ভগবান?"

বৃদ্ধ ৬৫ বছরের এই অসহায় জননী কানতে কানতে ঘুমিয়ে গেল কিন্তু সকালের রঙিন সূর্য আর দেখিনি। হারিয়ে গেল সমস্ত আলো তার জীবন থেকে। মুছে গেল সকল কান্না ঘুচে গেল সকল দুঃখ। আর কখনও কেউ তাকে খাওয়ার খোটা দিবে না। ঔষধ কেনার নামে কার ও কাছে হাত পাততে হবে না। ছেলে বৌ এবার তাদের নিজের রাজ‍্যে শান্তিতে রাজ‍্যত্ব করতে পারবে। কখনও আর কেউ ডাকবে না বাবা বলে কেউ বলবে না আর "মা আমায় একমুঠো ভাত দিবি?"

শেষ বিচার - চন্দন মিত্র || ses Bichar - Chandan Mitra || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 শেষ বিচার 

    চন্দন মিত্র




সালিশিসভা বসেছে হরিণপাড়া প্রাইমারি স্কুলে। বিচারক জয়ন্তবাবু, ওই স্কুলেরই হেডমাস্টার। সালিশিসভা এবং রাজনীতি করে করে চুল পাকিয়ে ফেলেছেন তিনি। যখন যে পার্টি ক্ষমতায় আসে তখন তিনি সেই পার্টির অবিসংবাদী গ্রামীণ নেতা। লালু, কালু, ভোলা, ঝুনো, হেপো নামের মারকুটে কয়েকজন চ্যালা তাঁর নিত্য সহচর। এরা আবার সালিশি সভারও অপরিহার্য অঙ্গ। পাড়ার জনছয়েক ছেলে মানিক মণ্ডলের পোড়ো বাঁশঝাড় থেকে খানকতক বাঁশ কেটে ভাস্করদের পুকুর পাড়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য কুঁড়ে বাঁধছিল। সে খবর জানাজানি হওয়ার সুবাদেই রোববার সকালের এই সালিশি সভার আয়োজন।


 


    ছেলেদের অভয় দিয়ে এগিয়ে যায় দলের পাণ্ডা মিন্টু। ছেলেরা বসে থাকে স্কুল লাগোয়া বটতলায়। তারা জানত জরিমানা তো হবেই, সঙ্গে জুটবে নাকে খত দেওয়ার মতো বিশ্রী সাজা। আর শেষপাতে লাথি-কিল-চড় তো থাকবেই। কিন্তু মিন্টু জানত অন্য কথা। সে সটান সভায় ঢুকে সপ্রতিভভাবে জানতে চায়, ‘আচ্ছা ! এই সভার বিচারক কে ?’


খেঁকিয়ে ওঠে যমদূতচেহারার ভোলা হালদার, ‘কেন রে নবাববাচ্ছা ! জয়ন্তবাবুকে চিনিস না বুঝি ?’ মিন্টু ঘাবড়ায় না। সে বেশ সরস ও উচ্চকণ্ঠে তারিয়ে তারিয়ে বলে, ‘ও জয়ন্তবাবু বিচারক! তা উনি যে নিজের বউছেলে ছেড়ে মিনুখুড়ির বাড়িতে রাতের পর রাত পড়ে থাকেন তার বিচার কে করবে ?’


     সালিশি দেখতে আসা ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মদ্দ হাসিতে ফেটে পড়ে। যে সত্যটা এতদিন কেউই উচ্চারণ করার সাহস পায়নি, সেই সত্যের ধাক্কায় ত্রাসের সভা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। মিন্টু হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে দেখে ছেলেরা যথেষ্ট অবাক হয়।

ছায়া - অভিষেক ঘোষ || Chaya - Abhishek Ghosh || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 ছায়া

অভিষেক ঘোষ



তমালিকা গত কয়েক মাসে ছায়ায় পরিণত হয়েছে, অন্তত তার বন্ধু-বান্ধব, কলিগদের তাই বক্তব্য । তমালিকা আর মানুষ নেই, শুধুই ছায়া !


কিছুকাল আগের কথা । দীঘায় অফিস ট্যুরে গিয়েছিল সে । সেদিন সৈকতে দেদার হাওয়া ছিল । ভেজা বালি উড়ছিল বাতাসে । একটা হেলে থাকা নৌকার আড়ালে দাঁড়িয়েও, মুখের উপর এলোমেলো চুলগুলো সামলাতে পারছিল না তমালিকা । তার মনে পড়ে যায়, বছর তিনেক আগে শৈবালের সঙ্গে এমনই একটা অফিস ট্যুরে এসে দীঘায় কাটানো মুহূর্তগুলি । তখুনি তার ভীষণ কান্না পায় । অফিস ট্যুরটা শৈবাল ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেল এবার, তমালিকার ছায়া মাড়াবে না বলে । একলা দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে আনমনে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে - তখনই খেয়াল করে, তার ছায়াটাও কাঁপছে !


সেদিন অপরিসীম দুঃখে তমালিকা স্থির করেছিল, এই ছায়াটাকে সে ত্যাগ করবে, নিজের ছায়াটাকেও এখন সে ঘেন্না করে ।


কিন্তু দু-দিন পর, রাতে বাড়ি ফেরার পথে সে দেখেছিল পাড়ার একটা তেতলা বাড়ির বন্ধ গেটের দুই পারে দুটি বিড়ালের বসে থাকা । দুজনের মাঝে ওই ব্যবধানটুকু তুচ্ছ করে তারা একে অপরকে ছুঁয়ে ছিল পরস্পরের ছায়া দিয়ে, বাড়ির আলো আর পথের আলো একটা অদ্ভুত জ্যামিতিতে বিড়ালদুটির ছায়া-রেখা মিলিয়ে দিয়েছে একটি বিন্দুতে, তৈরি হয়েছে একটা ছায়া-কোণ !


তমালিকা সেদিন শিখেছিল, বুঝেছিল তার ছায়ার গুরুত্ব । এরপর থেকে প্রায়ই সে গোটা অফিসে শৈবালের ছায়া খুঁজে বেড়াতো, ওর ছায়ায় নিজেকে মিলিয়ে দেবে বলে । তমালিকা নিজেকে নয়, ছায়াটাকে ভালোবাসতে শিখেছিল ।


মেঘের গর্জন - নীল মিত্র || Megher Garjan - Nil Mitra || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 মেঘের গর্জন 

      নীল মিত্র 



অমিত সরকার ডাক্তার, রাচীর মানসিক হাসপাতালে পোস্টিং। আজ ট্রেন ধরে কলকাতা থেকে ফিরছে। ওর পাশের সীটে অসিতবাবু, ওনার স্ত্রী শুক্লাদেবী আর ১৮ বছরের মেয়ে তনিমা যাচ্ছে। বাইরে ভীষণ মেঘলা করে রয়েছে, কাল থেকেই মেঘলা দিন বলা যায়। বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।


তনিমা খুব প্রাণবন্ত মেয়ে, হাসিখুশি স্বভাবের। কিছুক্ষণের মধ্যেই অমিত এর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অনেক রকমের গল্প করতে লাগল। বাইরে মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, হঠাৎ গর্জন করে উঠলো। মেঘের গর্জনে তনিমা চিৎকার করে উঠলো। অমিত দেখলো তনিমার সারা শরীর কাঁপছে। ও মাকে জড়িয়ে ধরলো ভয়ে।

সকাল হতেই ট্রেন পৌঁছালো, যে যার গন্তব্যে রওনা দিল। অমিত হাসপাতালে গিয়ে শুনলো একটি নতুন মানসিক রুগী এসেছে। কেবিনে গিয়ে দেখলো আরে এ তো কালকের ট্রেনের তনিমা। তারপর কেস স্টাডি করে জানতে পারলো যে তনিমা ছোটবেলায় একটা মেঘলা দিনে স্কুল থেকে ফিরছিল, তখন রাস্তায় দুটি যুবক তাকে তুলে নিয়ে যায় আর ওর শ্লীলতাহানি করে। তখন থেকেই ও মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েছে। মেঘের গর্জন শুনলেই তনিমার সেই ঘটনাটা মনে পড়ে যায় আর ও পাগলামি শুরু করে।

আস্থা যখন ভাঙে - পার্থ প্রতিম দাস || Aastha jokhon Vange - Partha pratim das || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

   আস্থা যখন ভাঙে 
                 পার্থ প্রতিম দাস 


রুক্ষ লাল মাটির দেশ হলো সতেড়গড়। আশেপাশের ছয়টি ছোটো ছোটো গ্রাম নিয়ে এই সতেড়গড় গঠিত। এই সতেড়গড়ের মধ্যে সামন্ত পরিবারের নাম ডাক সবচে বেশী। বীর সামন্তের এখন তাঁর পাঁচ ছেলে আনন্দ, বলরাম, শ্রীদেব, অর্ণব ও ধনঞ্জয় বিয়ে করে আলাদা আলাদা আছে। তবে বীর সামন্তের বৌ অলকাসুন্দরী এখনও বেঁচে আছেন। 
    তাদের পুরাতন ঐতিহ্যের মধ্যে পাথর বাঁধানো ঘাট আর তার পাশের প্রকান্ড বকুল গাছ। বিরাট খামারটা শূন্য পড়ে আছে। বসন্ত পূর্ণিমার দুদিন আগে, ফুটফুটে জোছনা উঠেছে। বলরাম অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে দেখে, বকুল গাছ থেকে একটা সাদা জামা পরা লম্বা লোক মাটিতে নেমে ঘাটে পা ধুয়ে আবার গাছে উঠে মিলিয়ে গেল। 
     বলরাম সকালে উঠে ভয়ে ভয়ে অলকাসুন্দরীকে বলল। অলকাসুন্দরী বললেন, "এতো ঘোর অমঙ্গলকর কথা। বাড়িতে অমঙ্গল দেখা দিলে এভাবে মহাপুরুষ বের হয়।"
    তখন সবাই বলল, "তাহলে উপায় কি!!"
অলকাসুন্দরী বললেন, "পুজো করতে হবে ওই বকুল তলায়।"
     কথা শুনে আনন্দ বকুল তলা পাকা দিয়ে বাঁধিয়ে দিল। অর্ণব রেলে চাকরী করে। তাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাইরে থাকে। তাকেও ডেকে পাঠালো। 
      বসন্ত পূর্ণিমার দিন সকাল থেকে বিরাট আয়োজন করে পুজো আরম্ভ হয়ে গেল। সমস্ত সতেড়গড়কে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হলো। দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নামতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। 
     মাঝ রাতে ঝড়ের হাওয়া সহ্য করতে না পেরে বকুল গাছ ভেঙে পড়লো। সবাই সকালের অপেক্ষায় আছে। 
     ভোর থেকে শুরু হয়ে গেলো বকুল গাছের ভাগ নিয়ে পাঁচ ভাইর মধ্যে ভীষন ঝগড়া। অলকাসুন্দরী ঘাট থেকে বললেন, "ওরে, তোরা একটু থাম।"
     কথাটা শুনে অর্ণবের স্ত্রী রেগে ছুটে এসে অলকাসুন্দরীকে পাথর বাঁধানো ঘাটে ঠেলে ফেলে দিল।

সেই রাত - প্রদীপ সেনগুপ্ত || Sei Rat - Pradip Sengupta || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

সেই রাত 

প্রদীপ সেনগুপ্ত



বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল বীতশোক, কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সকাল থেকেই একটা অস্বস্তি ওকে চেপে ধরেছে -- কিছুতেই ভুলতে পারছে না লোকটার কথা। 

সকালে বীতশোক বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, উদ্দেশ্য তাড়াতাড়ি বাজারে পৌঁছানো। আজ বহুদিন পর ওর বড় শালা বিক্রম আসছে সপরিবারে, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করবে। বাজারে যেতে বেশ দেরি হয়ে গেছে বলেই ওই রাস্তায় যাওয়া। ওই রাস্তা পারতপক্ষে সবাই এড়িয়ে যায়, কারন - রাস্তাটা আদপেই চলার যোগ্য নয়। ফলে, চারিদিকে পরিত্যক্ত জঞ্জাল। তবে দিনের বেলায় তবু স্থানীয় দু'একজন যাতায়াত করে। 

বীতশোক রাস্তায় যেতে যেতে টের পেল  

পিছনে কেউ যেন আসছে। পিছনে তাকিয়ে দেখল, একটা রোগা লোক কেমন হন হন করে এগিয়ে আসছে। লোকটাকে আগে কখনো দেখে নি বীতশোক।

লোকটা কাছে এসে বিশ্রী রকম হেসে বলল, 

' বাড়িতে অতিথি আসছে বুঝি? '

এ' রকম গায়ে পরা লোক ও দেখে নি কখনো। বীতশোক বেশ ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিল, 

' আপনি কে বলুন তো? আগে কখনো দেখিনি তো! আর, আপনার দরকার কি জানার আমার বাড়িতে কে আসছে বা না আসছে? '

লোকটা আবার দেঁতো হাসি হেসে বলল, 

' আমাকে আগে দেখেছেন, বিলক্ষণ দেখেছেন -- মনে করতে পারছেন না। আমি বলছিলাম, সব মানুষই তো একবার না একবার চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকায়। আজকে কিন্তু আপনার সামনে বিরাট সুযোগ আসবে, আপনার ভিতরের কুঁকড়ে থাকা মানুষটাকে মুক্তি দিন। '

বীতশোক এবার সত্যিই রেগে গেল, 

' কি যা তা বলছেন বলুন তো? '

লোকটা বীতশোককে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল, জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, 

' ভালোর জন্যই বলেছিলাম, আপনার শ্বশুরমশায়ের গচ্ছিত জিনিস আসল লোককে ফিরিয়ে দিন। উপর থেকে কিন্তু একজন সব দেখে রাখেন, প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পেয়েও যদি আপনি তার সঠিক ব্যবহার না করেন তবে... '

' তবে কি? '

লোকটা আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, 

' সে'টা তো তিনিই জানেন! আর একটা কথা, আজই কিন্তু শেষ সুযোগ, না হলে কালকের সকাল দেখবেন কি না কে জানে! '

এই বলেই লোকটা অসম্ভব দ্রুত বেগে রাস্তার মুখে পৌঁছে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। 

বীতশোকের গলা কেমন শুকিয়ে এল। লোকটা এত গোপন একটা কথা কি করে জানল? ওর শ্বশুর মশায়ের সাথে বিক্রমের যোগাযোগ ছিল না বহুকাল, বলা যায় মুখ দেখাদেখি বন্ধই ছিল। বিক্রম বাবার উপর অভিমান করেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বাবা ছেলের বিরোধ কি নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি কেউ কখনো জানতে পারে নি। বীতশোকের বৌ জয়া বাবার বিশাল সম্পত্তির মালিকানা পাবে, এ'কথা সবাই জানতো। কিন্তু জয়ার বাবা ব্রজলাল বাবু একদিন বীতশোককে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন, 

' দেখো বাবাজীবন, বিক্রম আমার বংশের প্রদীপ। ও যদি অভিমান ভুলে কখনো ফিরে আসে তবে এই উইলটা ওকে দেখিও, ভাইবোনকে সব সমান ভাগ করে দিয়েছি '। 

এরপর বেশি দিন বাঁচেন নি ব্রজবাবু। বীতশোক সেই কাগজটা রাতারাতি নষ্ট করে ফেলে। 

এরপর বিক্রম আর ফিরে আসে নি। আজ দীর্ঘ কাল পর ও আসছে। 

বিক্রম বিকেলেই চলে গেল। জয়ার বেশ খুশি খুশি ভাব। ওরা যতক্ষণ ছিল - বীতশোকের সেই লোকটার কথা মনে হয় নি। কিন্তু বাড়ি খালি হতেই ওর মনে পরে গেলো সেই লোকটার কথা। একটা অজানা ভয় ওকে কেমন ঘিরে ধরল। রাতটা বীতশোকের কাছে একটা অভিশাপ মনে হতে লাগল। আর ভাবতে পারছে না ও। বুকের ভিতরটা ভারি হয়ে আসছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে। 

ডাক্তার মুখার্জী সব দেখে বললেন, 

' একটা ম্যাসিভ এট্যাক হয়েছিল, নিতে পারেন নি বীতশোক বাবু। ভোরের দিকেই মারা গেছেন। '





মার - দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় || Mar - Darpana Gangapadhyay || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 মার

  দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়



আধুনিক যুগে সবাই সবাইকে এত মারতে ব্যস্ত হাতে,--- ভাতে, --

বলার কথা নয়। একদিন পাঁচু ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে ,--- 

দেখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে ! পাঁচু একজন খেতাবি ব্যারিস্টার। তাঁর বাবা একজন গরুর গাড়ির কোচোয়ান ছিলেন। তিনি গরুকে জোর জোর পেটাতেন, গরু যন্ত্রণায় ছটফট করে ছুটে পালাতে চাইত, গরুর গাড়ি তত দ্রুত ছুটত।


 এভাবেই তিনি মাইলের পর মাইল ভারী জিনিসপত্র আনা নেওয়া করে টাকা রোজগার করতেন। ঘরে ফিরে গরুদের খাবার দিতেন, আদর করতেন, ফাঁকা মাঠে ছেড়ে আসতেন, সন্ধ্যেবেলা সময় মতো ঘরে তুলতেন ,স্নান করাাতেন ,পরিচ্ছন্ন জায়গায় থাকতে দিতেন ,----কিন্তু গাড়ি চালানোর সময় মানুষটা এমন আচরণ করতেন। 


আমি ছোটবেলায় পড়াশোনা করতে চাইতাম না। পড়া মুখস্ত হতো না। উনি সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে পড়া ধরতেন না পারলে প্রচুর মার পিঠে পড়তো। খাওয়া বন্ধ, অবশেষে পড়া দিয়ে তবেই মুক্তি। এভাবেই উনি আমার লেখাপড়ার নেগেটিভিটি কাটিয়ে পজিটিভিটি এনে মানুষ তৈরি করে গেছেন।


 আমি ভয়ের চোটে ওই গরুটার মতন পালাতে চেয়ে ব্যারিস্টার হয়েছি এবং গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে বিশাল একখানা বাড়ি হাঁকিয়ে ঝি চাকর ছেলে বউ নিয়ে বসবাস করি। 


আজ হঠাৎ আমার নাতি যখন কিছুতেই লেখাপড়া করতে রাজি নয় ওর মা মানে বৌমা চিৎকারে বাড়ির মাথায় করে তুলছে তখন হালটা ধরতে আমি অগ্রসর হলাম। অপরপক্ষে মারার পর সেই মার সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে কিনা , সে অন্য পথ অবলম্বন করবে কিনা ,---তা নিয়ে আমার স্ত্রী বেশ চিন্তিত কিন্তু আমি নাছোড়।


 আদরের নাতি গোপালকে সকালে নিজেই পড়াতে বসলাম আর শাস্তি দিয়ে একই কথা বলতে বললাম ,-----কেঁদে কেঁদে বলে যেতেই লাগলো তারপর ঘুম আসছে দেখে ,---এক ঘা কষিয়ে দিলাম! তারপর খাতা পেন্সিল দিয়ে বললাম লিখে যাও ,

থামবে না ---থামলেই আবার ----

প্রথমবারেই গোপাল না দেখে লিখে ফেলল। যা দেখে বৌমা অবাক হয়ে গেল! 


হায়রে পোড়া কপাল !এসব মিথ্যে স্বপ্ন! বাস্তবে এমনটা কিছুই হলো না, যৎপরনাস্তি সকালে উঠেই টিফিন খেয়ে কাঁধে ব্যাগ তুলে স্কুলের দিকে হাঁটা দেবে গোপাল, এমন সময় বললাম ব্যাগটাই ভারি। লেখাপড়া টা বড় হালকা হয়ে গেছে। গোপাল উত্তরে বলল তুমি আমার বয়সে কত কি পারতে ? হাউ টু ডেল ইউ ! স্পিক অ্যাবাউট মি ! বউমা নিরুত্তর ,ছেলেও নিরুত্তর, গিন্নি বললে আজকালকার ছেলে, কেন ওদের সঙ্গে মুখ লাগাতে যাও,--- 

আমি গুটিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে লজ্জিত অপমানিত হয়ে নীরব হলাম। তারপর ঘরে চলে গেলাম! এইটাই কি শিক্ষা !

টাই কি সংস্কৃতি---।।

সাগরবেলায় - সমর আচার্য্য || Sagorbelai - Samar Acharya || Bengali poem || Kobita || বাংলা কবিতা || কবিতা || poetry || Bengali poetry

 সাগরবেলায়

সমর আচার্য্য



সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজার ছলে
ঘুরছি যে মরে তোমায় দেখবো বলে
তোমার ঐ অপরূপ রূপখানি হেরি
মন মাঝে বাজে প্রেমের দুন্দুভি ভেরি।

একের পর এক ঢেউ আসছে ধেয়ে
উত্তাল বারিধি  সবেগে উঠছে গেয়ে
নিয়েছিল যা নিজের বক্ষ মাঝে ধরে
দিচ্ছে ফিরিয়ে সবকিছু শোধিত করে।

ঝিনুকের বুকে যেমন মুকুতা থাকে
মাতা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে
তেমনই করে ভালোবাসবো তোমায়
এই সাধটুকু ছিল  মনের কোণায়।

এসো হে প্রিয় এসো আমার বাহুপাশে
বাঁধি সুখ নীড় আছি এই মনো আশে
তোমার ঐ প্রসারিত নীল বক্ষ পরে
থাকতে পারি যেন চির জনম ধরে।

জীবনের এই শেষের বেলায় এসে
দাঁড়িয়েছি তোমার পদপ্রান্তেতে হেসে
পার করে দাও ওগো  প্রভু কৃপাময়
ঠাঁই দিয়ে আমায় তোমার রাঙা পা'য়।

যাযাবরি কথায় আশাবরী সুর - গৌতম ঘোষ-দস্তিদার || Jajabari kothay Asabori surr - Goutam Ghosh dastidar || Bengali poem || Kobita || বাংলা কবিতা || কবিতা || poetry || Bengali poetry

 যাযাবরি কথায় আশাবরী সুর

        গৌতম ঘোষ-দস্তিদার


 


নদির বুকে ভিজবো ভেবে গেলাম,


নদিতো আমায় সিক্ত করেনি


পাহাড়ের কাছে মাথা নিচু করেছিলাম,


কই সে-ও তো আমায় রিক্ত করেনি


 


অরণ্য যেদিন ডেকে নিয়ে গ্যালো


মুখ জুড়ে টোল এঁকে দিয়ে গ্যালো


সিক্ত শরীর ঢেকে দিয়ে গ্যালো


চুমুতে দুগাল মেখে দিয়ে গ্যালো…  


 


কথা তো কতো না বলার ছিলো


যাযাবর আমি কইতে পারিনি


ভাঙা ফ্রেম জুড়ে প্রেম পড়েছিলো,



আশাবরী তবু গাইতে পারিনি...


হাইফেন - গোবিন্দ মোদক || Hifen - Gobinda modak || Bengali poem || Kobita || বাংলা কবিতা || কবিতা || poetry || Bengali poetry

 হাইফেন!

গোবিন্দ মোদক



প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে কতোটুকু দূরত্ব থাকলে 


সম্পর্কের রসায়নে বালি চিকচিক করে, 


তার কোনও সর্বজনগ্রাহ্য হিসাব হয় না।


তবুও যখন ফুলদানির বাসিফুল পরিবর্তনের অছিলায় 


ঘরে নিয়ে আসা হয় কৃত্রিম ফুলসম্ভার,


তখন কাঁটার আঁচড়ের গায়েও অভিমান জাগে,


আর তাজা ফুল শুকিয়ে যাবার অবকাশে 


তৈরি হয় যোজন-দূরত্ব ....!


তখন নৈঃশব্দের প্রহর শুধু মালা জপে যায় —


এক .... দুই .... তিন .... চার ….


শত .... সহস্র .... অযুত .... নিযুত বার ....;


সম্পর্কের ফাটল ক্রমশ: বলশালী হতে থাকে 


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।


অথচ হে প্রেমের ঈশ্বর!


তুমি রচনা করেছো সমূহ সম্ভাবনা 


যেখানে প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে


চিরকাল অবস্থান করে অনিবার্য একটি হাইফেন!

অনন্ত - পূর্বিতা পুরকায়স্থ || Ononta - Purbita Purakaystha || Bengali poem || Kobita || বাংলা কবিতা || কবিতা || poetry || Bengali poetry

   অনন্ত

          পূর্বিতা পুরকায়স্থ


পূর্ণিমার চাঁদ দেখে

জীবনের ঢেউ । আমি দেখি,

ঢেউ মেশে সাগরের জলে ।

এক একটা ঢেউ যেন এক একটা জীবন।

হর্ষ বিষাদ, সুখ দুঃখের নুন ছড়িয়ে

পাড়ি দেয় অনন্তের দিকে।

জল শেখায় কি করে 

ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। কি করে

মাটী থেকে আকাশ।

জীবন চলে মহাজীবনের দিকে।