Thursday, June 16, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -6

 



ছয়


সানন্দায় ছাপা হয়েছিল ঋজুর ‘বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল’। সেই গল্পটার নাট্যরূপ দিয়ে এর আগে শিশির মঞ্চে নাটক করেছিল বিশ্ব ও শিল্পী সাংস্কৃতিক সংস্থার সর্বময়কর্তা সত্যজিৎ কোটাল। একদিন সে এসে জানাল, তারা আবার ওই নাটকটা করছে। স্টেজ রিহার্সালের জন্য বুক করা হয়ে গেছে মুক্তাঙ্গন। আগের শো-টার স্ক্রিপ্ট একটু অদলবদল করা হয়েছে। ওই দিন আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে...

ঋজু জিজ্ঞেস করল, কখন?

সে বলল, আমরা তো বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে ঢুকে পড়ব। ওই দিন কোনও শো নেই। আমরা সারা দিনই থাকব।

ঋজু বলল, সারা দিন!


রিহার্সালের জন্য আর কতক্ষণ লাগে! বিকেলের মধ্যে যদি ওটা সেরে নেওয়া যায়, তা হলে তো সন্ধে থেকে একটা অনুষ্ঠান করা যায়। তাই না? কিন্তু কী অনুষ্ঠান! কী অনুষ্ঠান! কী অনুষ্ঠান! ঋজু নিজেই বলল, ধরো, আমার একটা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে দিলে তুমি। সেটা মঞ্চস্থ হল...

— এত তাড়াতাড়ি নাটক তোলা যাবে না দাদা...

— তা হলে... তা হলে... তা হলে... একটা কাজ করো, নাটক না তুলতে পারো, শ্রুতিনাটক তো তুলতে পারবে, না কি?

— হ্যাঁ, সেটা পারব।

— তা হলে শ্রুতিনাটকই করো। তার পর ধরো, কয়েকটা বাচ্চা আমার কিছু কবিতা আবৃত্তি করল। আমার উপরে দু’-একজন কিছু বলল...

— কে বলবে?

— বিখ্যাত কেউ। যেমন ধরো প্রদীপ ঘোষ...

— কোন প্রদীপ ঘোষ? আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ?

— হ্যাঁ।

— আসবেন?

— ওটা আমার উপরে ছেড়ে দাও।

— আর?

— পি সি সরকার।

— উনি তো মারা গেছেন।

— না না, তিনি নন। জুনিয়ার পি সি সরকার।

— আনতে পারবেন?

— চেষ্টা করে দেখি।

— আর?

— আর ধরো পবিত্র সরকার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, দিব্যেন্দু পালিত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও বলব। তার পর তুমি বলবে।

সত্যজিত্‌ বলল, আপনি যদি পাশে থাকেন, সে তো করাই যায়। কিন্তু অনুষ্ঠানের নাম কী দেবো?

— সেটা ভেবেচিন্তে ঠিক করা যাবেখ’ন।

— না, আসলে দলের সবাইকে বলতে হবে তো...

— আমি জানি। দলটল নয়, তোমার কথাই শেষ কথা।

— তাও।


তিন চারটে নাম লিখে রেখেছিল ঋজু। সত্যজিত্‌ও ভেবে রেখেছিল দুটো নাম। অবশেষে ঠিক হল, অনুষ্ঠানটার নাম দেওয়া হবে ঊষা উত্থুপ নাইট, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কিংবা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার অনুকরণে— ঋজু সন্ধ্যা।

ঠিক হয়ে গেল কী কী হবে। কাকে কাকে বলা হবে। সমস্ত মিডিয়াগুলিতে অন্তত এক সপ্তাহ আগেই আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিতে হবে। তার ম্যাটার কী হবে, মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ড জুড়ে থার্মোকল কেটে বড় বড় অক্ষরে যে ‘ঋজু সন্ধ্যা’ লেখা হবে, সেটা স্পনসরড করার জন্য ঋজুই বলে দিল কমলকে। কমল ওর ছোটবেলাকার বন্ধু। কুলিশ নামে একটি অনিয়মিত ছোট্ট পত্রিকা বার করে। পোস্টার করার জন্য বৈঠকখানা বাজার থেকে ওজন দরে এ ফোর সাইজের মতো রঙিন কাগজের ছাট আনার দায়িত্ব নিয়ে নিল সত্যজিৎ নিজেই। ও-সব জায়গা ও খুব ভাল করে চেনে। ওর বাবার একটা ছোট প্রেস আছে। সেই সূত্রে ওকে প্রায়ই ওখানে যেতে হয়। ওরা দু’ভাই এখন ওটা চালায়। ওর ভাইও নাটক করে। এটা নাকি ওরা পেয়েছে ওদের বাবার কাছ থেকে। ওদের বাবাও নাটক করতেন।

— ওই অনুষ্ঠানে আসার জন্য ঋজু সবাইকে ফোন করে করে বলছে। ফোন করল কণিকাকেও।


ওই ঘটনার ক’দিন পরেই সানন্দায় ছাপা হয়েছিল— মণিপর্ব ২৫। কণিকার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে ওকে নিয়ে অনেকগুলি কবিতা লিখেছিল ঋজু। কণিকা ছিল ওর চোখের মণি, আবার মণিমাণিক্যের মতোই মূল্যবান। তাই ওকে নিয়ে লেখা কবিতা সিরিজটার নাম দিয়েছিল— মণিপর্ব।

ঋজুদের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে একটা মন্দির আছে। ত্রিমাতৃ মন্দির। ওর মায়ের তৈরি। সেই মন্দিরে কালী, মনসা আর শেতলার মূর্তি আছে। মহাধুমধাম করে পুজো হয়। শেতলা পুজোতে আসার জন্য কণিকাকে নেমন্ত্রন্ন করেছিল ও। কণিকাও বলেছিল, আসবে। কিন্তু শিয়ালদহ থেকে যে ট্রেন ধরে ওর আসার কথা, তার পরের ট্রেনেও ও না-আসায় বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল ঋজু। লিখে ফেলেছিল পঁচিশতম কবিতা— মণিপর্ব ২৫।

সেটাই সানন্দায় ছাপার জন্য মল্লিকা সেনগুপ্তকে দিয়েছিল ও। কণিকা শুনে বলেছিল, যে দিন মণিপর্ব প্রথম বেরোবে, সে দিন আমি সেলিব্রেট করব। তোমাকে বড় কোনও হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব।

অথচ সেই কবিতাটা বেরিয়েছে তিন দিন হয়ে গেছে। ও কি দেখেনি! না, জানে না! অফিস থেকে বেরোবার সময় দেখে, দেয়াল ঘড়িতে বারোটা কুড়ি। ড্রপ কার দিতে দিতে আরও দশ মিনিট। প্রথমে সব লং রুটের দেবে। তার পরে শর্ট রুটের। একদম শেষের দিকে দেয় বেহালার গাড়ি। ও ওই গাড়িতেই ওঠে। ওকে চেতলায় নামিয়ে দিয়ে যায়। হাতে এখনও প্রচুর সময়! ও কি জেগে আছে! এক বার দেখব! বেরোতে গিয়েও, কী এক অমোঘ টানে ও টপাটপ বোতাম টিপল ফোনের। কণিকাই ধরল। বুঝতে পেরেই ঋজু বলল— মণিপর্ব বেরিয়েছে তিন দিন হয়ে গেছে। যাকে নিয়ে মণিপর্ব লেখা, সেই মেয়েটি বলেছিল, প্রথম যে দিন মণিপর্ব বেরোবে সে আমাকে খাওয়াবে। অন্য কিছু না খাওয়াক, এক কাপ চা তো খাওয়াতে পারে। সে কি খাওয়াবে?

কোনও কথা নয়। ঋজু শুধু শুনেছিল, টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে কণিকার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। সে দিন সাড়ে বারোটা নয়, একটা পনেরোরও নয়, আড়াইটের গাড়ি ধরেছিল ঋজু। তাও দৌড়ে গিয়ে। আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে ওই গাড়িটাও বেরিয়ে যেত।

পর দিন তিনটের সময় ঋজু চলে গিয়েছিল ওর অফিসে। টেলিফোন ভবনের উল্টো দিকে লাইম লাইট রেস্টুরেন্টে ওরা বসেছিল । চা খেতে খেতে কণিকা বলেছিল, আমি অরুণকে বলে দিয়েছি, ঋজু আমাকে ভীষণ ভালবাসে। আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। আমি ওকে ফেরাতে পারব না। 


তার পর থেকে আবার যাতায়াত। এখানে যাওয়া। সেখানে যাওয়া। কোথায় সুন্দরবনের জ্যোতিষপুর হাইস্কুলের হীরক জয়ন্তী উত্‌সব, কোথায় ঝাড়খন্ডের সেরাইকেলায় বিশাল অনুষ্ঠান, কোথায় বাঁকুড়ার সোনামুখীতে লগ্নঊষার বার্ষিক বনভোজন, সব জায়গাতেই ওরা। একদিন কফি হাউসের সামনে ওর পুরোনো বন্ধু ভাস্কর দেবের সঙ্গে দেখা। সে নাকি নতুন একটা ট্যুর এজেন্সি খুলেছে। সামনের মাসেই সাংস্কৃতিক দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছে। সে বলল, যাবি? ঋজু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। দু’জনের জন্য পাঁচ-পাঁচ দশ হাজার টাকা দিয়ে কণিকাকে নিয়ে ও চলে গেল ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার।

এর মধ্যে কণিকা একদিন বলেছিল, বহু দিন আগে প্রতিদিন-এ একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম। কী হল, খবর পেলাম না। ওখানে তোমার কোনও জানাশোনা আছে?

ঋজু বলেছিল, কোন পাতায়?

— শনিবারে যে গল্প বেরোয়, সেখানে।

— কপি আছে?

— জেরক্স আছে।

— তা হলে নিয়ে এসো। কাল তোমার অফিস ছুটির পর তোমাকে নিয়ে প্রতিদিনে যাব।


ওই পাতার বিভাগীয় সম্পাদক সুদেষ্ণা রায়। যিনি এক সময় সানন্দায় ছিলেন। পরে প্রতিদিন-এ যান। কণিকাকে দেখিয়ে ঋজু বলল, ওর একটা গল্প দিয়ে গেলাম, একটু দেখো তো।

সুদেষ্ণা জিজ্ঞেস করলেন, তুই পড়েছিস?

— হ্যাঁ।

— ঠিক আছে?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভাল গল্প। ঋজু কথা বলছে ঠিকই। কিন্তু ওর চোখ সুদেষ্ণার হাতের দিকে। লেখাটার উপরে গল্পের নাম, লেখকের নাম এবং বডি পয়েন্ট মার্ক করতে করতেই সুদেষ্ণা বললেন, এই নামেই চেক হবে তো?

ঋজু বলল, হ্যাঁ।


সেই শনিবারেই কণিকার গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। এর ক’দিন পরেই কণিকা বলল, তোমাদের অফিসে যে সুমন চট্টোপাধ্যায় আছেন না, তাঁর সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দেবে?

— সুমন চট্টোপাধ্যায়! ঋজু আমতা আমতা করতে লাগল। অনেকেই মহাধন্দে। কে বড়? আনন্দবাজার না সুমন চট্টোপাধ্যায়! যাঁর নামে এক ঘাটে বাঘে আর হরিণে জল খায়, সেই সুমন চট্টোপাধ্যায়!

— দাও না গো, খুব দরকার।

— কী দরকার বলো না, আমি আগে এক বার বলে দেখি...

— না না, তুমি বললে হবে না। তুমি আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, যা বলার আমিই বলব।

ঋজু জানে, ও যা চায়। তা না করলেই ওর মুখ ভারী হয়ে যায়। ঠিক মতো কথা বলে না। ফোন করলে ধরে না। ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে মেয়েরা বলে, মা নেই। কিংবা বলে, ও দিকে কাজ করছে।


সে দিনই সন্ধেবেলায় করিডর দিয়ে যেতে যেতে সুমন বললেন, কাকে নিয়ে এসেছিলি? ওর অফিসের কোন এক বসের ছেলে নাকি এখানে গ্রুপ ফোরে কাজ করে। তার হয়ে বলতে এসেছিল। তাকে যাতে আনন্দবাজারে নিয়ে নিই। এ ভাবে হয় নাকি? তুই জানিস না?

তার ক’দিন পরেই কণিকা বলল, তোমার সঙ্গে কে এম ডি-র কারও সঙ্গে যোগাযোগ আছে গো?

— কেন? প্রশ্ন করতেই ও বলল, রাজারহাটে যদি একটা প্লট পাওয়া যায়, দেখো না, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে থাকব...


ঋজু দেখেছে, দূরে কোথাও যাবার কথা হলে কিংবা রবিবার খাওয়াদাওয়ার পরেই শুতে যাবার আগে কণিকা কোনও না কোনও আবদার করে। ঋজু আমতা আমতা করলেই, তক্ষুনি কোনও মেয়েকে এ ঘরে ডেকে নেয় কণিকা। কিংবা টিভিতে কোনও সিনেমা চালিয়ে দেয়। আদর করতে গেলেই বলে, বিরক্ত কোরো না। সিনেমা দেখছি।

কিছু দিন আগে ‘চলমান শিল্প আন্দোলন’-এর তরফ থেকে কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের পেছনে, নিউ মার্কেটের চ্যাপলিন স্কোয়ারে আয়োজন করা হয়েছিল তিন দিন ব্যাপি এক চিত্রপ্রদর্শনী। তার সঙ্গে ছিল কবিতা পাঠের আসর। সেখানে যেমন বিভিন্ন নামী-অনামী শিল্পীরা যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন নানান বয়সের কবিরাও।

ওখানে আমন্ত্রিত হয়েছিল ঋজু। চিঠি পাওয়ামাত্র উদ্যোক্তাদের বলে-কয়ে কণিকার নামটাও কবিদের তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আজকাল যেখানেই ওদের কবিতা ছাপা হয়, একই পাতায় পাশাপাশি ছাপা হয়। লেখালিখির জগতের প্রায় সকলেই ওদের কথা জেনে গেছে।

লক্ষ্মণ শেঠের বউ তমালিকা পন্ডা শেঠ কয়েক বছর ধরে হলদিয়ায় যে বিশ্ব বাংলা কবিতা উত্‌সব করছে, সেখানে প্রথম বছর থেকেই ঋজু যায়। উত্‌সব কমিটির সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশকে ধরে সেখানেও ওর কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ঋজু। ওখানে পৌঁছনোর পরে ও ছুঁক ছুঁক করছিল কোথাও ঘর পাওয়া যায় কি না। কিন্তু কাকে বলবে সে! রিসেপশন কাউন্টারে খুব মাতব্বরি করছিল একটি ছেলে। আশিস মিশ্র। তাকে বলতে যাবার আগেই দেখে, উদ্যোক্তারা ওদের থাকার জন্য আকাশদ্বীপ হোটেলে একটা ঘর বরাদ্দ করে রেখেছে।


চলমান শিল্প আন্দোলন-এর অনুষ্ঠানেও একই দিনে ওদের দু’জনের কবিতা পড়ার কথা। কণিকাকে নিয়ে ঢুকতেই ঋজু দেখল, মাঠের এক পাশে কিছু চেয়ার নিয়ে মিহির, গণেশ, রফিক, দিশা ছাড়াও আরও কয়েক জন দল বেঁধে আড্ডা মারছে। ওরাও ওদের সঙ্গে বসে পড়ল। হঠাৎ একজন এসে ঋজুকে বলল, আপনাকে অভিজিৎদা ডাকছে। অভিজিৎদা মানে অভিজিৎ ঘোষ। যার সম্পাদিত সৈনিকের ডায়েরিতে ওর প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনিই। সঙ্গে সঙ্গে ঋজু চলে গেল সেখানে। জড়িয়ে ধরল অভিজিৎকে। দু’-চার কথার পরেই উনি বললেন, তোর সঙ্গে যে মেয়েটি ঢুকল, কণিকা না?

— হ্যাঁ, তুমি চেনো নাকি?

— ও তো আগে আবৃত্তি-টাবৃত্তি করত।

— তাই নাকি?

— হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। আমার বেশ কিছু কবিতা ক্যাসেটে তুলে আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। আমার বন্ধুবান্ধবরা যে সব অনুষ্ঠান করে, সে সব জায়গায় যাতে ওকে আবৃত্তি করার সুযোগ করে দিই, সেই জন্য। কয়েক জায়গায় করেও দিয়েছিলাম। 

— তোমার বন্ধু?

— বন্ধু মানে কি, আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমরা দাদা ডাকতাম। টেলিফোনে কাজ করত। খুব বড় পোস্টে। ফোন খারাপ হলেই ওকে বলতাম। ও সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে দিত। ও তো কণিকার বস ছিল। কণিকা তো ওর সঙ্গেই থাকত।

— থাকত! মানে?

— মানে বুঝিস না? বয়স কত হল? তখনও ও সল্টলেকের ফ্ল্যাটটা পায়নি। মানিকতলার কাছে আমার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ছিল। আমার সেই বন্ধু ওটা কিনতে চেয়েছিল কণিকাকে নিয়ে থাকবে বলে। আমি বিক্রি করিনি। পরে শুনলাম, আমার সেই বন্ধুকে ধরেই নাকি ও অনেক কিছু বাগিয়েছে।

— তাই, কী নাম তার?

— ওই তো, সল্টলেকের ডি এন ব্লকে থাকত... কী নাম যেন... কী নাম... ও হ্যাঁ, অপূর্বকুমার সরকার। বহু দিন যোগাযোগ নেই তো... কলকাতা টেলিফোনের সবাই চেনে। কণিকার দুটো মেয়ে ছিল না! যমজ। কী যেন নাম! রুনু ঝুনু, না?

— রুনু ঝুনু!

— হ্যাঁ, ও তো তাই বলত, আমার তিন মেয়ে রুনু ঝুনু বুনু।

— বুনু!

— আসলে আমার ওই বন্ধুর মেয়ের নাম ছিল বুনু। ওর এক ছেলে এক মেয়ে। ওদের দাদু-দিদারা ওর ছেলেকে দাদুভাই আর ওর মেয়েকে বুনু বলে ডাকত। তাঁদের দেখাদেখি বাড়ির সবাই ওকে বুনু বলে ডাকতে শুরু করে। এমনকী, আমার সেই বন্ধুও।

— সে কী!

— ও যখন কণিকাকে অফিসের থ্রু দিয়ে সল্টলেকের ফ্ল্যাটটা পাইয়ে দিল, তখন আমার সেই বন্ধু তো ওই ফ্ল্যাটে গিয়েই থাকত। ওর মেয়েদের ইংরেজি শেখাত। মাঝে মাঝে স্কুটারে করে চিড়িয়াখানা, দক্ষিণেশ্বর, ডায়মন্ড হারবার, কত জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেত। ওই বাড়িতেই তো ওর প্রথম হার্ট অ্যাটাকটা হয়।

— তাই নাকি?

— শুনেছিলাম, উত্তেজনা থেকে নাকি ওটা হয়েছিল। সেটা ঝগড়ার কারণেও হতে পারে। আবার সেক্স করতে গিয়েও হতে পারে। হঠাত্‌ করেই নাকি ওর হার্টবিট খুব বেড়ে গিয়েছিল। কণিকা খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। তখন যদি ওর কিছু হয়ে যেত, কণিকা কেস খেয়ে যেত। ওর বউ খুব জাঁদরেল মহিলা। চেনে না তো...

— উনি এখনও আছেন?

— জানি না বেঁচে আছেন কি না, বহু দিন কোনও যোগাযোগ নেই তো, তুই কিন্তু আবার বলিস না, আমি তোকে এ সব কথা বলেছি।

আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ঋজুর। মনটা কেমন খিচ মেরে গেছে। আগের জায়গায় ফিরে এসে কণিকাকে ডেকে নিয়ে ওদের থেকে একটু দূরে সরে গেল ও। তুমি অপূর্বকুমার সরকারকে চেনো?

প্রশ্ন নয়, ঋজুর মুখে ওই নামটা শুনে ও যেন ভূত দেখল। কে বলল তোমাকে?

— যে-ই বলুক। তুমি চেনো?

— হ্যাঁ। উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন।

— আমি তো অন্য কথা শুনলাম।

— কী শুনেছ?

— উনি নাকি তোমাকে নিয়ে থাকতেন?

— একদম বাজে কথা। উনি যখন আমার বস হয়ে এলেন, তার সাত দিন পরেই তো রিটায়ার হয়ে গেলেন।

— তোমার সঙ্গে ওঁর কী সম্পর্ক ছিল?

— বললাম তো। তুমি আমাকে একদম বিশ্বাস করো না, না? বলেই, সারা মুখ ঘন মেঘে ঢেকে ফেলল। চোখ ছলছল হয়ে উঠল। ‘আমি কবিতা পড়ব না’ বলেই, হনহন করে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। পিছু পিছু ঋজুও। ওদের দু’জনের কারওরই সে দিন কবিতা পাঠ করা হল না।


মা আর আঙ্কেলের মন কষাকষি দেখে ছোট বাবি দু’কাপ কফি বানিয়ে দিয়ে যাবার সময় দরজা টেনে, ও পাশ থেকে টানটান করে পর্দা দিয়ে দিল।

শেষ চা খেয়ে রাত এগারোটা নাগাদ যখন ঋজু ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, টা টা করার জন্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কণিকা, তখন ছোট বাবি এসে বলল, আঙ্কেল, সে দিন আপনি বলছিলেন না, আজকাল পুজো সংখ্যায় আপনি কবিতা দেবেন? তা, মা’র এই কবিতাটা আমি কপি করে রেখেছি, আপনারটা যখন দেবেন, এটা দিয়ে দেবেন?

আজকাল পুজো সংখ্যা দেখেন সুব্রত সেনগুপ্ত। তাঁকে নিজের কবিতা দেওয়ার সময় ওই একই খামের ভিতরে কণিকার কবিতাটাও দিয়ে দিয়েছিল ঋজু। কিন্তু আজকাল যখন বেরোল, তাতে কণিকার কবিতা নেই। সকালেই ফোন করল ছোট বাবি— আঙ্কেল, এটা কী হল? মা’র কবিতা আজকালে নেই কেন?

ঋজু মনে মনে বলল, কী করে বলব, আমি তো ওই কাগজের সম্পাদক নই, হলে শুধু কবিতা নয়, তোমার মায়ের উপন্যাস, এমনকী জীবনীও ছেপে দিতাম। কিন্তু মুখে বলল, তাই নাকি? ঠিক আছে, আমি দেখছি। 

— আর কী দেখবেন? কাগজ তো বেরিয়ে গেছে। লেখাটা আপনি দিয়েছিলেন তো?

— মা উঠেছে? মাকে দাও।

— মা’র মনমেজাজ ভাল নেই। কারও ফোন ধরছে না।

— বলো, আমি করেছি।

— এখানে নেই। বলেই, রিসিভার নামিয়ে রাখল। ছোট বাবি যে এ রকম ব্যবহার করতে পারে, ঋজু ভাবতেই পারেনি। অথচ এই সে দিনও পুরো ব্যাপারটাই ছিল উল্টো। মনে মনে ঋজু ভাবল, ভাগ্যিস সে দিন ও রকম একটা রিস্ক নিয়েছিল সে।


পুজো সংখ্যার লাস্ট ফর্মা রেডি করে রমাপদবাবু বেরিয়ে গেছেন। লেখক তালিকা দিয়ে বিজ্ঞাপনও ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। সন্ধের দিকে লেখার পুলআউটগুলি আর্টিস্ট দিয়ে পাতায় পেস্ট করাচ্ছিল ঋজু। হঠাৎ ছোট বাবির ফোন— আঙ্কেল, মা’র কবিতাটা আনন্দবাজারে যাচ্ছে তো?

আগের দিনই কথায় কথায় ছোট বাবিকে ও বলে ফেলেছিল, কাল লাস্ট ফর্মা ছাড়া হবে। লাস্ট ফর্মা মানে সূচিপত্র, দু’-চারটে বিজ্ঞাপন আর কবিতার পাতা। সব কাগজেরই ফাস্ট ফর্মাটা সবার শেষে ছাড়া হয়। এ দিন না হলে আর হবে না। যে-ভাবেই হোক, রমাপদবাবুকে ম্যানেজ করে তোমার মা’র কবিতাটা কাল ঢুকিয়ে দিতে হবে।

কিন্তু আজ রমাপদবাবুর মেজাজ একেবারে তুঙ্গে। ফলে ওনাকে কিছুই বলতে পারেনি ও। এখন ছোট বাবিকে ও কী বলবে! ওদের আঙ্কেল আমতা আমতা করছে দেখে ছোট বাবি বলল, কবিতাটা না বেরোলে কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার চিরজীবনের জন্য কাট্টি। আর মাকেও বলে দেব, যাতে আপনার সঙ্গে কথা না বলে...

শব্দ নয়, ওর মাথার উপরে কেউ যেন একটা পাহাড় চাপিয়ে দিল। কী করবে ও! কী করবে! একমাত্র উপায় যেটা, ও সেটাই করল। কিছু দিন আগে দেওয়া কণিকার কবিতাটা ওর ব্যাগেই ছিল। ও সেটা পি টি এস থেকে তড়িঘড়ি কম্পোজ করিয়ে একেবারে পুলআউট বার করে আনল। কিন্তু ঢোকাবে কোথায়! একমাত্র আনন্দবাজার পুজো সংখ্যাতেই সবচেয়ে কম কবিতা ছাপা হয়। আর যাঁদের কবিতা ছাপা হয়, তাঁরা প্রত্যেকেই বিখ্যাত। কার লেখা বাদ দেবে ও? কার? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ দেওয়া যাবে না। সমরেন্দ্র সেনগুপ্তও তাই। কমল দে সিকদার আবার খোদ আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসুর ক্যান্ডিডেট, ফলে ভুল করেও ওটায় হাত দেওয়া যাবে না। শক্তিপদ মুখোপাধ্যায় ওর কলিগ। বিজ্ঞাপনে কাজ করে। সকালে-বিকালে দেখা হয়। ওর লেখা ছাপা না হলে রমাপদবাবুকে ও জ্বালিয়ে মারবে। বছরে এই একটাই কবিতা লেখে ও। এবং সেটা এখানে। তা হলে! হঠাৎ চকচক করে উঠল ঋজুর মুখ। এই তো পেয়েছি। ও দেখল, একমাত্র রত্নেশ্বর হাজরারই দাঁত নেই। নোখ নেই। সামান্যতম ক্ষতি করারও কোনও ক্ষমতা নেই তাঁর। আর তা ছাড়া, মাকে নিয়ে যে মানুষ অমন মর্মস্পর্শী কবিতার সিরিজ লিখতে পারেন, তাঁর পক্ষে কারও ক্ষতি করা তো দূরের কথা, কারও বিরুদ্ধে সামান্য অভিযোগ জানানোও সম্ভব নয়। ফলে কবিতার পাতা থেকে রত্নেশ্বর হাজরার কবিতাটা তুলে, সেখানে কণিকার কবিতাটা সেঁটে ও লাস্ট ফর্মা ছেড়ে দিল।

‘প্রকাশিত হচ্ছে’ বলে, পর দিন আনন্দবাজারে বিশাল বিজ্ঞাপন বেরোল। সকালেই ছোট বাবির ফোন— আঙ্কেল, আনন্দবাজার পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপন দেখলাম। সেখানে তো মা’র নাম নেই। কী হল?

— তুমি বিজ্ঞাপনে নাম দেখতে চাও, না পুজো সংখ্যায় লেখা দেখতে চাও?

— কবে বেরোবে?

— দু’-তিন দিনের মধ্যে।


যে দিন পুজো সংখ্যা বেরোল, সে দিন সকালেই রমাপদবাবুর ফোন। উনি মাঝে মাঝেই ঋজুকে ফোন করেন। এই তো ক’দিন আগে সকাল সাড়ে সাতটা কি আটটা হবে, হঠাৎ উনি ফোন করলেন। ঋজু তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ফোন ধরতেই উনি বললেন, উঠে গেছেন?

ঘুম-চোখে ঋজু বলল, হ্যাঁ, এই উঠলাম।

উনি বললেন, তা হলে ঠিক আছে, এক্ষুনি আসতে হবে না। একটু বেলা করেই আসুন। ন’টা নাগাদ এলেও চলবে।

ন’টা! ঋজু হতভম্ব। কারণ, ও যদি তখনই ওই অবস্থাতেই রওনা দেয়, তা হলেও ন’টা নাগাদ তাঁর বাড়িতে গিয়ে ও কিছুতেই পৌঁছতে পারবে না। কারণ, ওর বাড়ি থেকে রমাপদবাবুর বাড়িতে যেতে গেলে তিনটে বাস বদল করতে হয়। যত চেষ্টাই করুক না কেন, সওয়া এক ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টার কমে তাঁর বাড়িতে কিছুতেই যাওয়া যায় না।

তাড়াহুড়ো করে ও যখন তাঁর বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, রমাপদবাবু ওকে কিছুই বললেন না। এমনিই টুকটাক কথা বলতে লাগলেন। ও গেলে রমাপদবাবুর স্ত্রী ওকে ডিমপোছ করে দেন। চা করে দেন। সে সব করার জন্য উনি যখন রান্নাঘরে ঢুকলেন, রমাপদবাবু অমনি রান্নাঘরের দিকটা এক বার উঁকি মেরে দেখে নিয়ে ঋজুকে ফিসফিস করে বললেন, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। এক প্যাকেট এনে দেবেন? আমি বেরোতে গেলে আপনার বউদি আবার সন্দেহ করবে।

ঋজু অবাক। সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে শুধু এই জন্য উনি ডেকে এনেছেন!

ঋজু জানত, রমাপদবাবুর সিগারেট খাওয়া তাঁর স্ত্রী একদম পছন্দ করেন না। যেমন রমাপদবাবু মোটেই পছন্দ করেন না, তাঁর বউ ঋজুকে দিয়ে নিজেদের কোনও ব্যক্তিগত কাজ করান।

অথচ তাঁর স্ত্রী মাঝেমধ্যেই ঋজুকে ফোন করেন। এটা আনতে বলেন। ওটা আনতে বলেন। এবং সেটা যাতে রমাপদবাবুকে ও কথায় কথায় বলে না ফেলে, সেটাও বলে দেন। উনি ঋজুর মায়ের চেয়েও বয়সে বড়। তাই ক’দিন আগে উনি যখন ফোন করে ঋজুকে বললেন, কয়েক হাত শায়ার দড়ি নিয়ে আসতে পারবেন? এলে দাম দিয়ে দেবো।

ঋজু বলেছিল, কালকে নিয়ে গেলে হবে?

উনি বলেছিলেন, কাল কেন? পরশু, তরশু, তার পরের দিন আনলেও চলবে।

কিন্তু ঋজু আর পরশু তরশুর জন্য ফেলে রাখেনি। পর দিনই কয়েক হাত শায়ার দড়ি কিনে নিয়ে সোজা হাজির হয়েছিল রমাপদবাবুর বাড়িতে। দরজা খুলেই রমাপদবাবু বললেন, আপনি হঠাত্‌? কী ব্যাপার?

এ রকম বহু বার হয়েছে। উনি যেতে না বললে, ও তাঁর বাড়ি গেলেই, উনি এমন ভান করেন, যেন ওকে চেনেনই না। ও যেন কোনও কোম্পানির সেলসম্যান। মালপত্র গছাতে এসেছে। এ রকম অভিজ্ঞতা পুজোর পরে বিজয়া করতে গিয়েও ওর হয়েছে।

তাই ও বলেছিল, এ দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। যদি কোনও দরকার লাগে, তাই আর কি...

উনি দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বললেন, না না, এখন কোনও দরকার নেই। বলেই, দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, অমনি তাঁর স্ত্রী পেছন দিক থেকে এসে উঁকি মেরে বললেন, আরে ঋজু যে, আসুন আসুন। চা খেয়ে যান।

শুধু রমাপদবাবুই নন, তাঁর স্ত্রীও, বয়সে তাঁদের থেকে যত ছোটই হোক না কেন, সবাইকেই আপনি করে বলেন।

সে দিন যতক্ষণ না রমাপদবাবু বাথরুমে ঢুকলেন, বউদির হাতে ওই শায়ার দড়ি দেওয়ার জন্য ঋজুকে ততক্ষণ ওই বাড়িতে বসে থাকতে হয়েছিল।

কখন রিং হয়েছে ঋজু খেয়াল করেনি। ওর মা-ই বললেন, ঋজু, তোর ফোন। রমাপদবাবু করেছেন।

ফোনের কাছে যেতে যেতে ঋজুর মনে হল, আজও নিশ্চয়ই সিগারেট ফুরিয়ে গেছে! ফোন ধরতেই রমাপদবাবু বললেন, কী ব্যাপার, রত্নেশ্বর হাজরার কবিতা যায়নি?

— না মানে...

— একটু আগে রত্নেশ্বর আমাকে ফোন করেছিলেন। বললেন, বিজ্ঞাপনে নাম আছে, সূচিপত্রেও নাম আছে, কিন্তু বইতে তো লেখা দেখছি না। আমি খুলে দেখি, সত্যিই তাই। আর অন্য কার যেন একটা কবিতা দেখলাম, কার কবিতা? আমি তো দিইনি।

যাঃ। কবিতাটা ও পাল্টে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সূচিপত্রের কথাটা তো ওর মাথাতেই আসেনি। থতমত খেয়ে গেল ও। তবু বলল— ও, ওই কবিতাটা? ওটা তো কবিতার বাক্সে ছিল। রিকোয়েস্টের কবিতা। তা, পাতা মেক-আপ করতে গিয়ে দেখি, রত্নেশ্বরবাবুর কবিতাটা ওখানে ধরছে না। বড় হচ্ছে। অথচ পাতায় তখন ছবিটবি আঁকা হয়ে গেছে। জায়গাটা ফাঁকা যাবে! আপনি তো সব সময়ই বলেন, সবার কবিতাই সমান। উনিশ-বিশের তফাত। তাই ওই কবিতাটা কম্পোজ করে বসিয়ে দিয়েছিলাম।

— সেটা তো আমাকে বলবেন। ক’দিন ধরে পর পর এতগুলো বিজ্ঞাপন বেরোল, তা হলে সেটা কারেকশন করে দিতে পারতাম।

রমাপদবাবু ফোন রাখতেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ঋজুর। যাক্ বাবা, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ওনার জায়গায় আজ অন্য কেউ হলে চাকরি চলে যেত।

রমাপদবাবু এই রকমই। ওর মনে আছে, ওর ছেলে তখন খুব ছোট। সাত কি আট মাস বয়স। মুখেভাত দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। অথচ হাতে কোনও টাকা-পয়সা নেই। লিখে-টিখে যা পায়, তাতে টেনে-টুনে কোনও রকমে চলে। বউয়ের পেটে বাচ্চা আসার পর থেকেই ও প্রতি মাসে এক-দুশো করে জমাচ্ছে। বিয়ের পরে পরেই ওর বউ বলেছিল, ছেলে-মেয়ে যাই হোক, আমাদের বাচ্চাকে আমরা কিন্তু নবনালন্দায় পড়াব।

ওর বাপের বাড়ির ওখানকার সব অবস্থাপূর্ণ লোকেরাই নাকি তাদের বাচ্চাদের ওখানে পড়ায়। সেখানে পরীক্ষা-টরিক্ষা যা হয়, সবই নাকি লোক দেখানো। ভিতরে ভিতরে ডোনেশন নিয়ে ভর্তি করে। সেই ডোনেশনের জন্যই ও টাকা জমাচ্ছিল।

কিন্তু স্কুলে ভর্তির ব্যাপার তো অনেক পরে, তার আগে মুখেভাত। তাই যেখানে যা ছিল, সে-সব জড়ো করে, ঘট-টট ভেঙে দেখা গেল, সাকুল্যে দু’হাজার চারশো টাকা। খাতা-কলম নিয়ে হিসেব কষে ও দেখল, নমো নমো করে মুখেভাত দিতে গেলেও কম করে সাড়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। এত টাকা কোথায়! কার কাছে চাওয়া যায়! কার কাছে!

ওর প্রথমেই মনে হল, রাধানাথ মণ্ডলের কথা। ও চাকরি করে আবার ব্যবসাও করে। ওর কাছে চাইলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তাই, রাধানাথের কাছে ও দু’হাজার টাকা ধার চাইল। বলল, মাসে মাসে কিছু কিছু করে দিয়ে শোধ করে দেবো।

রাধানাথ বলল, ঠিক আছে, দেবো। দেরি আছে তো...

অন্নপ্রাশনের দিনক্ষণ সব ঠিক করে ফেলল ঋজু। যখন আর মাত্র চার দিন বাকি। রাধানাথের কাছে টাকার কথা বলতেই সে বলল, দেরি আছে তো...

মুখেভাতের দু’-দিন আগে যখন চাইল, তখনও সেই একই কথা, তোমার কাজ তো পরশু। কাল নিয়ে নিও।

পর দিন অফিসে যেতেই রাধানাথ ব্যাগট্যাগ ঘেঁটে বলল, এই রে, মারাত্মক একটা ভুল হয়ে গেছে গো। তোমার জন্য আলমারি থেকে দু’হাজার টাকা বার করে খামে ভরেছিলাম। ওটা মনে হচ্ছে বিছানার ওপরেই ফেলে এসেছি। একটা কাজ করো, আমি তো কাল বারোটার মধ্যে ঢুকে পড়ছি, তোমার সুযোগ-সুবিধে মতো এক ফাঁকে এসে তুমি টাকাটা নিয়ে যেও। না-হলে কারও কাছ থেকে নিয়ে চালিয়ে নাও। পরশু দিয়ে দেবো। বলেই, আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চার তলার ক্যান্টিংয়ে খেতে চলে গেল।

রাধানাথের কথা শুনে ওর মাথায় যেন বাজ পড়ল। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে লাগল। বলবে না বলবে না করেও ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জনকে ও নেমন্তন্ন করে ফেলেছে। এখন উপায়! পা অবশ হয়ে আসছে। ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। রাধানাথের পাশের চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়ল।

এই অফিসে এক-দেড় ঘণ্টা পর পরই ট্রলি করে চা আসে। এক কাপ চা পাঁচ পয়সা। রমাপদবাবু বসেন ঘরের একদম কোণের দিকে। এবং যত বার চা আসে, উনি প্রায় প্রতি বারই খান।

চাওয়ালা ঢুকতেই ঋজুকে দেখিয়ে রমাপদবাবু বললেন, ওখানে একটা দিন।

ছেলেটা ঋজুর সামনে চায়ের কাপ রাখতেই ঋজু সচকিত হল। বলল, না গো, এখন খাব না।

রমাপদবাবু বললেন, খান খান।

কিন্তু ঋজুর তখন যা মানসিক অবস্থা, গলা থেকে আর চা নামবে না। তাই বলল, না, থাক।

— থাক কেন? খান। রমাপদবাবুকে সবাই সমীহ করে চলে। যথেষ্ট ভয়ও পায়। ওঁর কথা অগ্রাহ্য করে, এমন লোক নেই। ঋজু অন্যমনস্ক ভাবে খুব ধীরে ধীরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। কাল ছেলের মুখেভাত। সাড়ে চার-পাঁচ হাজার টাকার ধাক্কা। অথচ হাতে আছে মাত্র আড়াই হাজার। এতে কী হবে! যে করেই হোক, আজকের মধ্যে তাকে কিছু টাকা জোগাড় করতেই হবে। কিন্তু কার কাছে চাইবে সে! কার কাছে!

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই রমাপদবাবু বললেন, বেরিয়ে যাচ্ছেন নাকি?

রমাপদবাবু বললেন ঠিকই, কিন্তু উনি কী বললেন, ওর কানে গেল না। ওর তখন একটাই চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে, কার কাছে টাকা চাওয়া যায়! কার কাছে!

রমাপদবাবু ফের বললেন, যাওয়ার সময় দেখা করে যাবেন।

ও আজ আর অন্য কোথাও যাবে না। কাল ছেলের অন্নপ্রাশন। আজও আসত না। শুধু টাকার জন্যই এসেছিল। ফলে ও এখন সোজা বাড়ি চলে যাবে। তাই গুটিগুটি পায়ে রমাপদবাবুর কাছে গিয়ে বলল, আমি আসছি।

— চলে যাচ্ছেন? বলেই, ড্রয়ার খুলে একটা মোটা খাম বার করে ওর দিকে এগিয়ে দিলেন, নিন।

— কী এটা?

— বাড়ি গিয়ে দেখবেন।

বাড়ি নয়, ওই ঘর থেকে বেরিয়েই একটু আড়ালে গিয়ে খাম খুলে ঋজু দেখে, ভিতরে কড়কড়ে পঞ্চাশখানা একশো টাকার নোট। এত টাকা! উনি ওকে দিয়ে মাঝে মধ্যে টুকিটাকি কাজ করান। ইলেকট্রিক বিল দিতে দেন। কলেজ স্ট্রিট পাড়া থেকে বই আনান। এ দিকে ও দিকে পাঠান। কিন্তু ওর হাত দিয়ে কাউকে কখনও টাকা পাঠিয়েছেন বলে ওর মনে পড়ল না। কাকে দিতে হবে এটা, উনি তো সেটা বললেন না! ও ফের ঘরে ঢুকল। বলল, এটা কাকে দেবো?

উনি বললেন, কাল তো আপনার ছেলের মুখেভাত?

ও বলল, হ্যাঁ।

— এটা রাখুন। এখন কাজ চালান। পারলে, পরে শোধ করে দেবেন। 

যে লোকটা লোহার মতো নিরস, সেই লোকটা ভিতরে ভিতরে এমন! ঋজুর দু’চোখ জলে ভরে উঠল।


যে দিন আনন্দবাজার পুজো সংখ্যা বেরোল, সে দিন সকালেই তিন কপি বই কিনে কণিকা তার সি জি এম-কে এক কপি দিল। মহাদেববাবুকে দিয়ে এক কপি পাঠিয়ে দিল বেলুড়ে। ওর বাপের বাড়িতে। আর এক কপি স্কুলছাত্রীদের মতো বুকের কাছে ধরে অফিস আর বাড়ি যাতায়াত করল টানা ক’দিন।

খুব খুশি হয়েছিল কণিকা। দুই বাবিও। অথচ তার মাত্র কয়েক দিন পরেই আজকালে লেখা ছাপা হয়নি দেখে এমন কথা! ঋজু আর ফোন করেনি। সে দিন না। তার পর দিনও না। কণিকাও করেনি।

কিন্তু ‘ঋজু সন্ধ্যা’ হচ্ছে, ওকে না বললে হয়! ও কণিকার অফিসে ফোন করে ওকে মুক্তাঙ্গনে আসার জন্য নেমন্তন্ন করল।

কণিকা বলল, ওখানে গিয়ে আমি কী করব?

— আমার অনুষ্ঠান। তুমি আসবে না? ওই দিন তো তোমার ছুটি। রবিবার পড়েছে।

— দেখি। অনুষ্ঠানের দিন সকালে একটা ফোন করে মনে করিয়ে দিও।


বারোটা নাগাদ ঋজু যখন ফোন করল, মহাদেববাবু বললেন, কণিকা তৈরি হচ্ছে।

— এত তাড়াতাড়ি? অনুষ্ঠান তো বিকেলে!

বিকেল গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যা নেমে এল। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। কিন্তু কণিকা এল না। রাতে যখন ও ফোন করল, ছোট বাবি ধরল, মা ঘুমোচ্ছে। আচ্ছা আঙ্কেল, ঋজু সন্ধ্যা হল। এটা কি ‘ঋজু-কণিকা সন্ধ্যা’ হতে পারত না!

ঋজু থ হয়ে গেল।



                                                ক্রমশ...

______________________________________________


পঞ্চম পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-

Click here


সপ্তম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন --

Click here 🔴

Wednesday, June 15, 2022

ছোট গল্প - কালো রঙের চাঁদ || লেখক - তৈমুর খান || Short story - Kalo Ronger Chand || Written by Taimur khan


 

কালো রঙের চাঁদ 

তৈমুর খান 



     এক. 


নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠল। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল এতটুকু চিড় ধরেনি মনে। নানা কাজে ভুলে গেছি হয়তো। সাংসারিক জটিলতা আর টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হয়েছি। কিন্তু যখনই একা হয়ে গেছি, যখনই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি তখনই মনে পড়েছে ওকে। ওই আমার প্রথম নির্বাচিত নারী। যাকে আমি আমার জীবনের সঙ্গী করতে চেয়েছিলাম। 


       উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও যখন চাকুরি পাচ্ছি না, শুধু টিউশানই একমাত্র ভরসা, তখন কোন্ মেয়ের বাপ আমার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেবে? সুতরাং বিয়ে করার ভাবনা মাথাতেই আসেনি। কোনও রকম দিন কেটে যাচ্ছে। কোথাও ঝিলিক দিচ্ছে নারীমুখ ।জ্যোৎস্না রাত হাতছানিও দিচ্ছে না তা নয়। মধ্যরাতে ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে । স্বপ্নের ভেতর কখনও কখনও ছাত্রীরাও উঁকি মারছে। তা মারুক, কেউকেই বেশি প্রশ্রয় দিতে পারছি না। এমন সময়ই কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করি আর জুটে যায় একটা কলেজের আংশিক শিক্ষকের চাকুরি। একে কি চাকুরি বলে! নিজেরই সন্দেহ হয়। মাস গেলে দেড় হাজার টাকা। তা হোক, টিউশানের বাজার বাড়তে থাকে। আয়ও প্রায় পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। 


        দিব্যি একটা সংসার চলবে, তুই বিয়ে কর! চা খেতে খেতে এক হাতুড়ে ডাক্তার বন্ধু পরামর্শ দেয়। নিজেও ভাবতে থাকি বয়স প্রায় তিরিশে পা দিতে চলেছে। এ সময় তো বিয়ে করা জরুরি বইকি! ভাবতে ভাবতে বলি, কিন্তু কাকে বিয়ে করব? 


          বন্ধুটি দ্রুত উত্তর দেয়, আমারই মামা শ্বশুরের মেয়ে আছে, নোনাডাঙা বাড়ি। এবছরই বি এ পাস করেছে। আমাকে বর খুঁজতে বলেছে। আগামি রবিবারই চল্, দেখে আসি। 


         সম্মতি না দিয়ে পারিনি। একটা বয়সে বিয়ে করার ইচ্ছা সব নারী-পুরুষেরই থাকে। আমারও ছিল। একটা বি এ পাস মেয়ে, দেখতে ভালো হলে এবং আমাদের সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারে মানিয়ে নিলে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়? 


       কিন্তু সেই সপ্তাহে রবিবার দিনটি আসতে বড়োই দেরি করছে আমার মনে হল। প্রতিদিনই বারের হিসেব করি আর রাত দীর্ঘ হয়ে যায়। অবশেষে বহু নির্ঘুম রাত আর প্রতীক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত রবিবারটি এসে উপস্থিত হল। বুঝতে পারলাম, বাসনা তীব্র হলে সময় তখন দীর্ঘ মনে হয়। মুহূর্তগুলিও বছরে পরিণত হয়ে যেতে পারে। 


        সকাল সকাল স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম চুপচাপ। বন্ধুটিকে সঙ্গে নিতে হবে। ওরই পরামর্শ ছিল, কাউকে জানানোর দরকার নেই, আগে পছন্দ হোক, তারপর কথাবার্তা। বাড়ির লোকও জানবে না। 


         বাসে করে যাচ্ছি। সমস্ত রাস্তা কত রকম চিন্তা এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কী জিজ্ঞেস করব? হ্যাঁ, কোন্ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, ইসলাম সম্পর্কে কেমন ধারণা, সংসারে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে কিনা ইত্যাদি। কখনও আবার মনে আসছে, কী হবে ওসব জিজ্ঞেস করে? বরং মেয়েটি দেখতে কেমন হবে, কাজ করার ক্ষমতা আছে কিনা, সহিষ্ণু কিনা ইত্যাদি। বাস ছুটছে, যেন আমরা যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছি। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সেই রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি। কী আনন্দ! মনপ্রাণ যে নাচছে, কিন্তু কেউ দেখতে পাচ্ছে না। হাওয়া এসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। বারবার কল্পনায় দেখে নিচ্ছি মেয়েটির চোখ। কী উজ্জ্বল! কী স্নিগ্ধ! কী বিস্ময়! 

    
         


দুই. 


যথারীতি খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মেয়েটিকে আনা হল আমাদের সামনে। না, সাজপোশাকের কোনও বালাই নেই। যে শাড়িটি পরে সে এখানে ওখানে বের হয় কোনও অনুষ্ঠানে, সেই শাড়িটিই পরে এসে উপস্থিত হল। সকালের রোদ রং শাড়ি। অপূর্ব মানিয়েছে। সাদা সাদা বেলফুলের ছাপ সমস্ত শাড়ি জুড়ে। আরও পবিত্র ও স্নিগ্ধ করে তুলেছে ওকে। সামনে দাঁড়িয়েই সকলকে সালাম জানাল। যথারীতি সালামের উত্তরও দিলাম। তারপর বললাম, বসুন! 


     প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করল, আমাকে "তুমি" বলুন। 

   

      বেশ, তাই হবে। তারপর মুখ তুলে তাকাল। 

মুখটি খুব সুন্দর নয়, কিন্তু বড়ো সরল ও সতেজ মনে হল। নাকের নিচে ঠোঁটের বাঁ দিকে একটা কালো তিল, কালো রঙের চাঁদের মতো চনমন করছে দেখলাম। শ্যামবর্ণ ঠোঁটের লাল আভা অস্ফুট পদ্মের লাল পাপড়ির মতো। কপালের এক গোছা চুল যেন স্থির তরঙ্গের মতো। মুখটি গোল হতে হতে শেষ পর্যন্ত আর গোল হয়নি। আঁটসাঁট শরীরের সঙ্গে বেশ মানানসই। বন্ধুটি বলেছিল, ভালো ছেলে খুঁজছে, চাকুরি না হলেও হবে। ওর বাপের যা আছে তাতে বহু বড়োলোক জামাই ও পাবে। কিন্তু তা দেবে না। সৎ, শিক্ষিত ভালো ছেলে হলেই হবে। 


       আমি এই তথাকথিত ভালো ছেলের পর্যায়ে পড়ি কিনা সে কথাই ভাবছিলাম বারবার আর ভাবতে ভাবতেই প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু হয়েছিল। 

—তোমার নাম কী? 

—খালিদা রহমান। 

—পিতার নাম? 

—হাফিজুর রহমান। 

—কত দূর লেখাপড়া করেছ? 

—বি এ পাস। 

—কী কী বিষয় ছিল? 

—বাংলা, ইতিহাস, দর্শন। 

—কোন্ বিষয় পড়তে ভালো লাগে? 

—বাংলা। 

—আচ্ছা, একটা খুব অপ্রিয় কথা জানতে চাই, আমি তো চাকুরি করি না, টিউশান করি আর কলেজের আংশিক শিক্ষক, খুব সামান্য আয় করি। তুমি সব মানিয়ে নিতে পারবে তো? 


     এবার খালিদা মাথা নামিয়ে দেয়। এতক্ষণ যত দ্রুত উত্তর দিচ্ছিল এবার যেন থেমে যায়। আবার তাড়া দিয়ে বলি, বলো, কী হল? 


       মাথা ঝুঁকিয়ে সে নীরবে সম্মতি জানায়। 


  আমার পাশে থাকা বন্ধুটি বলতে থাকে, তা হলে যাও এবার। 

     

   ওকে থামিয়েই বলি, না থামো, এদিক ওদিক তাকিয়ে খুব নিচু গলায় খালিদার কাছে জানতে চাই, আমাকে তোমার পছন্দ তো? 


       এবার জোরে হেসে ওঠে খালিদা, চোখের ভেতর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালনা করে দেয় আর এক ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। এতগুলো প্রশ্ন-উত্তর চলেছে, তার ফাঁকে খুঁটে খুঁটে দেখেছি খালিদাকে। বাঁশঝাড়ে ঘেরা তাদের গ্রাম্য মাটির বাড়িতে এক মনোরম আনন্দ আমাকে সর্বদা আকৃষ্ট করেছে। চাষি পরিবার হলেও এদের রুচিবোধ আছে, শান্তি ও সৌন্দর্য আছে। খালিদার পিতা একটা জুনিয়র হাইস্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট মাস্টার মশাই। ছোটোখাটো চেহারার মানুষ। একদণ্ড এসেই দেখে চলে গেছেন। আমাদের মুরগি পোলাও ফলমূল খাবারেরও কত আয়োজন করেছেন। একে একে সব আসতে দেখে অবাক হয়ে গেছি। মনে হয়েছে, আহা এরা কী ভালো লোক! মানুষের কদরও বোঝেন! 


    সব বুঝেসুঝেই বন্ধুটিকে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। বারবার সে জিজ্ঞেস করেছে, রাজি তো? 


      আমিও বারবার বলেছি, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ! 


    তারপর সে সব দায়িত্ব নিয়ে একাই গেছে মেয়ের পিতা অর্থাৎ তার মামা শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলতে। আমাকে একটু দূরে সরে যেতে বলেছে। আমাদের তো বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে, যা বলার তা এখনই বলতে হবে।

       

তিন. 


—তুমি কত টাকা বেতন পাও? 

—দেড় হাজার। 

—দেড় হাজার টাকায় সংসার যাবে? 

—টিউশান করি, তাতেও হাজার পাঁচেক… 

—টিউশানের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? মেয়েকে ফেলে দেওয়া হবে! তোমার সঙ্গে… 

—আমি তো আসতেই চাইনি, আপনাদেরই জামাই বলেছিল, তাই… 

—থাক্ ওসব শুনব না, সরাসরি বলাই ভালো, তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। 


      তারপর জামাই অর্থাৎ আমার বন্ধুটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগলেন, সবই ভালো, একটা চাকুরি করা ছেলের খোঁজ এসেছে। এন ভি এফ পুলিশ। বাবার মৃত্যুর পর ডাইং হারনেসে চাকুরিটি পেয়েছে। পড়াশোনা একটু কম, ওই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তা হোক, চাকুরি করে তো! বিয়েটা ওখানেই দেবার ইচ্ছা আছে। কী গো, ভালো হবে না? 


     বন্ধুটি উদাসীন ভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। 


    লজ্জায় অপমানে আমার দুই কান রাঙা হয়ে উঠল। সেখানে আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। ঘটক বন্ধুটি অনেকক্ষণ পর ফিরে এল। শুকনো মুখে বলতে লাগল, মেয়েটির মা ও মেয়েটির খুব ইচ্ছা তোকে জামাই করার, কিন্তু ওর আব্বা চাইছে না। পাশের গাঁয়ের একটি লোক সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে ওই পুলিশ কর্মীর জন্য। 


      আমার আর কিছুই বলার নেই। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রির ওজন যে ভীষণ হাল্কা একজন অষ্টম শ্রেণি পাস পুলিশ কর্মীর তুলনায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতক্ষণ ধরে মাংস পোলাও যা খেয়েছি সবই বমি হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কোনও রকম ভাবে নিজেকে সামলে রাখছি। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। না, আর কোনওদিনও বিয়ে করতে চাইব না। বিয়ে করার জন্য আর কোনও মেয়েকে দেখতেও আসব না। তখনই হনহন করে ছুটছি। বন্ধুটি কী কথা বলছে পিছন থেকে বুঝতেও পারছি না, বোঝার প্রবৃত্তিও নেই। দুই কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। দুঃখী মায়ের মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাড়ি ফিরতে চাই, আমি দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাই। কিন্তু এ কী! বাঁশঝাড়ের অন্যপ্রান্তে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে খালিদা। সকরুণ চোখ দুটিতে মিনতি, ক্ষমা প্রার্থনা। চমকে উঠি। কেন ও এভাবে তাকাচ্ছে? হে আল্লাহ, যেখানে ওর আব্বা এত হিসেবি মানুষ, এত অহংকারের সঙ্গে আমার মুখের উপর কথাগুলি বলে আমাকে অপমান করলেন, সেখানে তারই কন্যা কেন এরকম ভাবে আমাকে হাতছানি দিচ্ছে? কোনও প্রশ্নেরই ঠিক উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমার অপমান, আমার পথহাঁটা যে অনেকটাই কমিয়ে দিতে পেরেছে সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। মনটা কীরকম উদাসীন হয়ে গেল। সারা রাস্তা চোখের সামনে ভাসতে লাগল সেই সকরুণ মুখটি। একটাও কথা বলতে পারিনি, নীরবে যেন বহুকথাই বলে দিয়েছি। 


   চার. 


আজ যে বাস থেকে নামছি সেই বাসেই উঠতে যাচ্ছে খালিদা। নাকের পাশের তিলটি তেমনই কালো রঙেই জ্বল্ জ্বল্ করছে চাঁদ হয়ে। নামতে নামতে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। সেই সকরুণ দৃষ্টি, সেই হাতছানি। কেমন আছ খালিদা? মুখে এনেও কথাটি বলতে পারলাম না। পেছনে জোর ধাক্কা, কী করছেন মশাই? রাস্তা ছাড়ুন! 


     মনে মনে বলতে লাগলাম, আমি তো রাস্তা কারও ঘিরে নেই, কেউ আমারই রাস্তা ঘিরে আছে! 


       বাস থেকে নেমে অনেকক্ষণ বাসের জানালায় চেয়ে থাকলাম বাসটা যতক্ষণ না ছাড়ল। খালিদাও জানালায় মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। তেমনই নির্বাক। তারই পাশের সিটে মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। মনে হল ওর স্বামী। আমি তো ওর কেউ নই, কেনই বা আমার সঙ্গে কথা বলবে? তাহলে এমন চোখে তাকায় কেন? কী যেন হারিয়ে গেল আমার! আর নিজের অজান্তেই খুঁজতে লাগলাম। চোখের পানিতে চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গেল। দূরে বা কাছে কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু একটা গোল শূন্য অস্বচ্ছ বল ওঠানামা করতে লাগল সামনের দিকে। 

Monday, June 13, 2022

ছোট গল্প - মরণকূপ || লেখক - ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী || Short story - Moronkup || Written by Isita Biswas Choudhary

 




মরণকূপ
 
             ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী
           



রথীনবাবুর ট্রান্সফারেবল জব। ব্যাংকের চাকরি, তাই প্রতি চার বছর অন্তর নানা প্রত্যন্ত প্রান্তে  এবং বেশ দুর্গম কিছু অঞ্চলে পোস্টিং হবার জন্য ফ্যামিলিকে সঙ্গে রাখতে পারেন না তিনি। কিছুদিন আগে প্রান্তিক অঞ্চলের একটি মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। তারপর চার বছর কেটে যাওয়ায় এবং একটি ব্রাঞ্চে তার প্রয়োজন পড়ায়, বীরভূমের 'সদরপুর'  বলে একটি জায়গায় বদলি হন তিনি। অবশ্য আজকাল এসব নিয়ে আর কিছু ভাবেন না রথীনবাবু। যেকোনো জায়গার সাথে এডজাস্ট করে নিতে তার আজকাল আর সেরকম সমস্যা হয় না। আগে বেশ সমস্যা হতো। চিরকাল কলকাতায় থাকার দরুন নিতান্ত গ্রাম্য পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হতো তার। তবে আজকাল ভালই লাগে। এক জায়গায় বেশিদিন তার আবার  মন বসেনা। বিভিন্ন স্থানে থাকার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর বলেই মনে হয় তার।এছাড়াও তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ভালোবাসেন। তাই যে অঞ্চলে পোস্টিং হয় শনি-রবিবার করে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে সেই অঞ্চলকে এক্সপ্লোর করতে। মাসে একবার বাড়ি যান। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে যাওয়ায়  সাংসারিক দায়িত্ব সেভাবে থাকে আর নিতে হয় না তাকে।  রিটায়রমেন্টের আর বেশি দিন বাকি নেই। জীবনটা এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাটাতে চান তিনি।

যথারীতি ব্যাংকের লোকেরা তাকে ফেয়ারওয়েল দিল। এতদিন থাকার দরুন মনটা একটু খারাপ লাগছিলো তবে নতুন জায়গায় যাবার কথা ভেবে তিনি মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।  শনিবার  গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নতুন ব্রাঞ্চ 'সদরপুর'।  আসতে আসতে  রাস্তায় দেখলেন লাল মাটির রাস্তা চারিপাশে বিভিন্ন রকম শাল-সেগুন এসবের জঙ্গল। ভীষণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চারিদিকে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ আসার পর তারা গ্রামে প্রবেশ করলেন।  অদূরে ছোট ছোট টিলা এবং ছোট ছোট মাটির বাড়ি, কোনটাতে টালির চাল বা খড়ের ছাউনি ।  গাড়ি এসে ব্যাংকের সামনে দাঁড়ালো। ছোট্ট একতলা বাড়ি। একটি ছোট গ্রামীণ ব্যাংক, অফিস আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ায় সুনসান। আজ শনিবারও তাই  সেরকম ভিড় নেই। রথীনবাবু  ভিতর প্রবেশ করলেন। একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল "আসুন স্যার, আমার নাম সুমন, আমি ব্যাংকের  কর্মী। আজ শনিবার অনেকেই বাড়ি চলে যায়, সোমবার সবাই ফিরে আসবে। আপনার জন্য বাড়ি ঠিক করাই আছে আগের ম্যানেজারবাবু যেখানে থাকতেন সেই বাড়িটি খালি আছে। চলুন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।" 
সুমন রথীন বাবুকে নিয়ে এলেন তার কোয়াটারে। গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট একতলা একটি বাড়ি। সামনে পেছনে অনেকটা জায়গা। সুমন তাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এসে বলল, "আসুন বাবু আমার নাম রঘু, আমি আপনার দেখাশোনা করবো।" সারাদিন ক্লান্ত রথীনবাবু ফ্রেশ হয়ে একটু জিরিয়ে নিলেন। উঠে দেখলেন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রঘু রান্নাঘর থেকে এসে বলল, "বাবু চা করছি, রাতের খাবার করে রেখে গেলাম। কাল সকালে আবার আসবো।"
রথীনবাবু বাইরে বেরিয়ে দেখলেন আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। বাইরে মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, দূরে গ্রামে মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে সন্ধ্যা দিচ্ছে। তিনি  বাড়ির চারপাশটা ভালো করে ঘুরে দেখলেন।  বাড়ির বেশ কিছুটা অংশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নানান রকম গাছে ভর্তি। পাঁচিলের পেছনে শাল, শিমুল,মহুয়া,পলাশের জঙ্গল শুরু হয়েছে। বাতাসের মর্মরধ্বনি কানে আসছে তার। জঙ্গলের মধ্যে দূরে কোথায় সমস্বরে শেয়াল ডেকে উঠল। রথীনবাবু হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের দিকে গেলেন। আশেপাশে বাড়িঘর সেরকম নেই বললেই চলে। তার বাড়িটি বেশ নিরিবিলিতে ফাঁকা জায়গায়। রথীনবাবুর একা থাকার অভ্যাস আছে, তার হয়তো খুব একটা সমস্যা হবে না। তাও  বিদেশ বিভুঁই জায়গা, মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো তার। রঘুর ডাকে সম্বিৎ ফিরলে ঘরে ফিরে এলেন। রঘু বলল, "বাবু আপনার খাবার রেডি করে রেখে গেলাম। আমার বাড়ির সামনেই গ্রামে কাল ভোর হতেই চলে আসব। কালতো রবিবার, একটা ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াবো।" তিনি বাজার করার কিছু পয়সা দিয়ে বললেন,"ঠিক আছে কাল সকালে চলে এসো।" কি মনে হতে তিনি রঘুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,"আচ্ছা এই জঙ্গলে কোন বন্য পশু নেই তো? রাত্রে জানলা খোলা রেখে শোবো তাই বলছি।" কথাটা শুনে একটু চমকে উঠলো রঘু। ফিসফিস করে বলল, "ভর সন্ধ্যেবেলা ওই জঙ্গলের নাম নেবেন না বাবু , আপনি এখানে নতুন তাই বলছি আপনার বাড়ির পাঁচিলের পেছনে জঙ্গল শুরু হয়েছে সেটিকে 'নাড়াবোরা'র জঙ্গল বলে। আপনি দয়া করে ওদিকে বিশেষ যাবেন না। ওই জঙ্গল ভালো জায়গা নয়। জঙ্গলের মধ্যে একটা কুয়া আছে যেটি খুব সাঙ্ঘাতিক। অনেক মানুষের প্রাণ গেছে ওই মরণ কুয়োর ধারে গিয়ে। আগের ম্যানেজার বাবুর তো ওখানে গিয়েই মৃত্যু হয় আপনি জানেননা?" রথীন বাবু একটু বিস্মিত হলেন। একথা তো তাকে কেউ আগে জানায়নি! রঘু বলল, "এখানে অবশ্য ঠাকুরের মূর্তি আছে। ভয়ের কোন কারণ নেই। বলে দূরে দেয়ালে টাঙ্গানো ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে প্রণাম করলো সে। এমনিতে ভয়ের কোন কারণ নেই তবে সাবধানে থাকবেন।" 
রঘু চলে গেলো। রাতে বাড়িতে ফোন করে গল্প করলেন অনেকক্ষণ। তারপর রাতের খাবার খেয়ে এসে শুলেন বিছানায়। চারদিকে মহুয়ার সুবাস নাকে আসছে। তবে ঘরের ভেতরে বেশ বদ্ধ গরম তাই জানলাগুলো খুলে দিলেন। আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলেন চুপ করে। নতুন জায়গা, ঘুম আসতে সময় লাগে তাই ফোন খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন।
চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু কানে আসছে না। এরকম একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে একা, ফাঁকা বাড়িতে থাকা সত্যিই বেশ দুরূহ ব্যাপার। তবে যারা একাকী থাকতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই জায়গা স্বর্গ বলেই মনে হয়। রঘুর কথাগুলো মনে পড়তে একটু চিন্তা হল। এমন একটা ঘটনা তাকে জানানো হলনা কেন? সে বিষয়ে তিনি বেশ ধন্দে রইলেন। হঠাৎ দূরে জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে একটা হালকা কমলা আলো আসছে। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার থাকায় আলো আরো বেশি দৃশ্যমান মনে হচ্ছে। এত রাতে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে কিসের আলো ? জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। সেরকম কিছু দেখতে পেলেননা। নিরাশ হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আগের ম্যানেজার অসীমবাবু কেন গেছিলেন জঙ্গলে? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালবেলা দরজায় করাঘাতের শব্দে  ঘুম ভাঙলো তার।  রঘু একগাল হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে, বাজার করে এনেছে সে। তারপর বলল,"দাঁড়ান বাবু আপনার জন্য জলখাবার বানাই।'
রথীনবাবু বললেন ,"সেই ভালো আমি ফ্রেশ হয়ে একটু হেঁটে আসছি। তুমি জলখাবার রেডি কর।"
রথীনবাবু ভাবলেন আশপাশ অঞ্চলটা একটু ঘুরে আসি। সকালের মিঠে রোদ, মৃদু হাওয়া বইছে বাতাসে। অনেক দূরে পাহাড়ের রেখা চোখে পড়ছে, দূর থেকে মনে হয় নীল মেঘের সারি । লাল মোরামের রাস্তা ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। চারপাশে জঙ্গল কোথাও বেশি কোথাও-কোথাও হালকা হয়ে এসেছে। সকালে গ্রামের লোকজন গবাদিপশু নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন উনি। রথীনবাবুকে দেখে বললেন, "আপনি বুঝি পুরনো ম্যানেজারবাবুর জায়গায় এসেছেন?" রথীনবাবু একটু অবাক হলেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন ,"হ্যাঁ, আপনি কি করে জানলেন ?"
"একটু আগে আপনাকে কোয়াটার থেকে বের হতে দেখলাম তো।'
তিনি বললেন, "ও আচ্ছা, আমি গত কালই এসেছি।"
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন," আমার নাম হরিহর দাস। আমি এই অঞ্চলের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আপনার সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। কালকে বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?"
রথীনবাবু বললেন,"  না সেরকম না। আমি তো বাইরে বাইরে সারাজীবন থেকে এসেছি তবে নতুন জায়গাতে ঘুম আসতে একটু সময় লাগে আর বাড়িটা একদম নিরিবিলিতে তাই একটু আর কি...."
" সেই। ভয় পাবেন না, আপনার বাড়িতে তো ভগবানের ছবি আছে, আর কোন কিছু মনে হলে ভগবান কে ডাকবেন।" 
রথীনবাবু একটু বিস্মিত হলেন। তাকে বললেন,"কি ব্যাপার বলুন তো? ওই বাড়িতে কি কোন সমস্যা আছে ? রঘু আমাকে বলছিল ভেতরে জঙ্গলের ব্যাপারে কিছু কথা... যদিও আমি ওসব  বিশ্বাস করিনি।"
হরিহরবাবু একটু থমকে বললেন ,"আপনি জানেন না, ও বাড়িতে কি হয়েছে? আপনার আগে যিনি ম্যানেজারবাবু ছিলেন অসীম বাবু, তিনি কিন্তু ও বাড়িতেই অপঘাতে  মারা যান।" 
"হ্যাঁ সে কথা আমি এখানে আসার পর জানতে পারি। তা বাড়িতে তো কেউ মারা যেতেই পারে সেখানে অসুবিধাটা কোথায় ?"
হরিহরবাবু আবার বললেন,"আপনি জানেন কিনা জানিনা তবে অসীমবাবুর মৃত্যুটা কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না। জঙ্গলের পেছনে একটি প্রাচীন কুয়ো আছে, সেটি অবশ্য বহুদিন অব্যবহৃত। আমাদের গ্রাম থেকে কেউ কোনদিনই জল নেয়না। স্থানীয় লোকদের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে, তারা বিশ্বাস করে ওই কূপের  ভেতরে কোন অশরীরীর বাস এবং ওই জঙ্গলের মধ্যে  মধ্যরাতে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। অসীমবাবুর মৃত্যু ওই কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার জন্যই হয়েছিল। রঘু সকালবেলায় কোথাও তাঁকে না পেয়ে গ্রামের লোকজন নিয়ে খুঁজে দেখে উনি কূপের  ভেতরেই মরে পড়ে আছেন। পুলিশও সেরম কিছু করতে পারেনি। আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা কিছুই বোঝা যায়নি। তবে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস নিশি ডেকে নিয়ে গেছিল ওনাকে সেদিন রাত্রিবেলা। যাই হোক, রঘু সারাদিন তো বাড়িতেই থাকে। রাত্রেবেলা ফিরে আসে। রাত্রিবেলা একটু সাবধানে থাকবেন আর ভুলেও জঙ্গলের দিকে যাবেন না।" এরকম আরও নানান রকম কথাবার্তা বলে হরিহরবাবু বিদায় নিলেন।

রথীন বাবু হেটে বাড়ি ফিরে এলেন। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে।  অসীমবাবু কেন সেদিন  মাঝরাতে সেখানে গিয়েছিলেন আর কি করেই বা কুয়োর  ভেতর পড়ে মারা গেলেন সেটি বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার বটে। যাইহোক সেটা কোন কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে। তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রঘু সারাদিন থেকে তার ফাই ফরমাশ খেটে রাতে বাড়ি ফিরে গেল যথারীতি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলো, নিঝুম নিথর রাত্রি। অনেক কষ্টে এদিক ওদিক করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। হঠাৎ একটা আওয়াজে  ঘুম ভেঙে গেলো তার। মনে হল জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই আওয়াজটা আসছে। কেউ যেন অদুরে করুন স্বরে বিলাপ করছে। আধো অন্ধকারে ঘড়ির দিকে চোখ পরতে দেখলেন প্রায় তিনটে বাজে। এত রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে কে বিলাপ করছে তার জানার কৌতুহল হল কিন্তু সকলের বারণ উপেক্ষা করে জঙ্গলে যাবার তার সাহস হলো না। নানা কথা ভাবতে ভাবতে, এপাশ-ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। 
পরদিন সকালে ফ্রেশ হয়ে ব্রাঞ্চে পৌছলেন। সেখানে সকল কর্মচারীদের সাথে আলাপচারিতায় পর দৈনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তবে সারাদিন মনটা তার কেমন যেন খচখচ করছিল।   বিকেলবেলা কি মনে করে সুমনকে ডেকে পাঠালেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, এই ব্যাংকের আগের ম্যানেজারবাবু অসীমবাবু, তাঁর নাকি আমার বাংলোতে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাটা আমাকে এখনো ব্যাংকের কোন লোক জানায়নি। আমি এখানে আসার পর স্থানীয় লোকদের কাছে কথা জানতে পারি  কোন বিশেষ কারণ আছে কি?" 
সুমন বেশ অবাক হয়ে গেল বলল,"আপনি কি কিছুই জানতেন না? যদিও আমাদের এ ব্যাপারে কথা বলতে নিষেধ আছে। তাও আপনি যে একেবারেই জানতেন না এটা আমি জানতাম না। হ্যাঁ ওনার অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল, বাড়ির পেছনে একটি কুয়োর মধ্যে সকালবেলা ওনার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সেটি নেহাতই দুর্ঘটনা বলে  সবাই ধরে নিয়েছে কারণ আত্মহত্যা করার মত ব্যক্তি তিনি ছিলেননা। আর একটি পরিত্যক্ত কুয়োতে কেউ আত্মহত্যা করবেই বা কেন? সেটাও যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার। পুলিশ সেটাকে দুর্ঘটনা বলেই মনে করছে। কিন্তু অত রাতে উনি কেন ওই কুয়োর কাছে গেছিলেন সেটা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। তবে এখন সবকিছু আগের মতই চলছে। ব্যাংকের ভেতরে এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করতে কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেছেন কারণ গ্রাম্য জায়গায় এমনি লোকজন কুসংস্কারে জর্জরিত। এটা  নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হলে লোকে হয়ত ব্যাংকে আসতে চাইবে না, তাই আর কি।"
রথীনবাবু সব শুনে একটু আস্বস্ত হলেন। তিনি ভাবলেন হয়তো সত্যিই দূর্ঘটনাবশত ওনার মৃত্যু ঘটেছে। এরকম তো হতেই পারে। যেকোনো কারণে সেদিন অসাবধানতাবশত তিনি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছিলেন। যাই হোক তিনি নিজের কাজে মন দিলেন। অনেক অনেক কাজ পেন্ডিং রয়েছে আস্তে আস্তে তিনি সেখানে মন বসাতে শুরু করলেন।

কদিনপর থেকে কাজের চাপে এসব কথা তার আর মনে রইলনা। তবে রাত হলেই জঙ্গলের দিকে তাকালে তার যেন কেমন অস্বস্তি হয়। মনে হয় যেন ওই জঙ্গলের ভেতর কি রহস্য আছে তা তাকে উদ্ধার করতেই হবে, নাহলে যেন কোনোভাবে তার শান্তি হবে না। তবু সবার বারণ  বলে নিজেকে  আটকে রাখেন তিনি। আজকাল তিনি একটু বেশিই চুপচাপ থাকেন। কাজের পর ফিরে এসে চুপ করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কিসব যেন ভাবেন। শনিবার সন্ধ্যাবেলায় রঘু চা দিতে এসে তা লক্ষ্য করে সে বলে, "বাবু ওদিকে কি দেখছেন? আজকাল তেমন কথা বলেননা? একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন অনেকদিন তো যাননি। আর একটা কথা বলবো কিছু মনে করবেননা, এবাড়ীটা আপনি বদলে ফেলুন। ওরকম একটা ঘটনা ঘটলো সেদিন। এই জায়গাটা সুবিধার নয় রাত বাড়লে এমন সব কান্ড হয় আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না।"
রথীনবাবু হঠাৎ কিছুটা বিরক্তির সুরে রুক্ষ স্বরে বললেন, "আহ রঘু তোমার কাজ হয়ে গেলে তুমি এখন এস! আমি কোথাও যাবোনা।" রঘু মাথা নিচু করে  চলে গেল। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। সেদিন ছিল শনিবার, অফিসের সবাই বাড়ি যাবে বলে আগেই বেরিয়ে গেছে। রথীনবাবু একাই বসে কাজ করছিলেন। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল তার। রোজ তিনি বাড়িতে হেঁটেই ফেরেন। এতে তার একটু হাঁটা হয়ে যায়। আজ অমাবস্যা, আকাশে চাঁদের দেখা নেই। সন্ধ্যেবেলায় নক্ষত্রের  আলো এই জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের অন্ধকারকে দূর করতে অক্ষম । বাড়িতে ঢুকতেই  রঘুর সাথে দেখা। সে বেরিয়ে যাচ্ছিল তাকে দেখে বলল, "বাবু আজ এত দেরি করে এলেন? আপনার জন্যে চা জলখাবার রেখেছি। আর রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। আমার আজকে একটু কাজ আছে তাই যেতে হচ্ছে। ছেলেটার শরীরটা ভালো নেই।" বলে সে বিদায় নিল। ঘরে ঢুকে রথীনবাবু ফ্রেশ হলেন। তারপর চা খেতে খেতে ফোন করলেন বাড়িতে।  কথা বলার পর সংবাদপত্রে  মনোনিবেশ করলেন। আজসময় যেন কাটতে চায় না। হঠাৎ তার ভীষণ গরম অনুভূত হল। বাইরের পরিবেশটা আজ যেন অদ্ভুত। আকাশে জমাট মেঘ, সমগ্র পরিবেশকে আবদ্ধ করে রেখেছে। বারান্দায় এসে দেখলেন দূরে পাহাড়ের সীমারেখা বরাবর আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।আর মাঝে মাঝে কান বিদীর্ণ করা মেঘের আওয়াজ হচ্ছে। আজ  যা গরম তাতে কালবৈশাখী ঝড় উঠবে বলে মনে হচ্ছে। গ্রামের দিকে কারেন্ট গেলে সহজে আসবে না। তাই তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন তিনি।   

ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ প্রবল বাজ পড়ার শব্দে  উঠে দেখলেন ভীষণ ঝড় উঠেছে। চারিদিকে আকাশ কালো করে এসেছে। তার পশ্চিম দিকের অর্থাৎ জঙ্গলের দিকে জানলাটা ঝড়ের দাপটে বারবার খোলা-বন্ধ হচ্ছে। রথীন বাবু উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিতে সেখানে গিয়ে দেখলেন জঙ্গলের মধ্যে সেই অপার্থিব কমলা আলো আজ যেন অনেকটা অঞ্চল বিস্তার করে রয়েছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে চোখে যেন এক ধাঁধা  লেগে গেল রথীনবাবুর। ঝড়ের তান্ডব এবং আকাশে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ চমকানোর মধ্যেও তিনি দেখতে পেলেন জঙ্গলের সামনে অনতি দূরে একটি অদ্ভুত দর্শন  ছায়ামূর্তি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখে তার নারীমূর্তি বলেই মনে হলো। চমকে উঠলেন তিনি সেই মূর্তি দেখে। ঘোলাটে তার দৃষ্টি, বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে সম্মোহনের ঘোর লেগে যায়। রথীনবাবু সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টির কাছে তার জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তাভাবনা সবকিছু বিসর্জন দিলেন। ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। 
বাগান পেরিয়ে তিনি এসে উপস্থিত হলেন ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারে। পুরোনো পাঁচিলের একটি অংশ ভেঙে পড়েছে, তিনি সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে দুর্বার গতিতে হেঁটে চললেন সেই আলো লক্ষ্য করে। কিসের টানে তিনি ছুটে চললেন তা ভাবার মতন অবস্থায় তিনি ছিলেন না। তাঁর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি কিছু না ভেবে এগোতে থাকেন সেই মায়াবী আলোর টানে। কিছুদূর আসার পর তিনি দেখতে পেলেন একটি ভাঙা পরিত্যক্ত কূপ  এবং তার মধ্যে থেকেই অদ্ভুত এক আলো ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র জঙ্গলের প্রান্তর জুড়ে। সেই অদ্ভুত দর্শন নারীমূর্তিকে অবশ্য তিনি আর খুঁজে পেলেন না। তার মনে হলো তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যে আমরা কোন ঘটনার  কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করি কেন এরূপ ঘটনা ঘটছে তার ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করি, রথীনবাবু সেরকম মনে মনে ভাবলেন কেন আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? কিন্তু কোনো সদুত্তর তিনি পেলেননা। মনের কৌতূহল নিরসনের জন্য এবং কিছুটা সম্মোহনের কারণে তিনি এগিয়ে গেলেন সেই কূপের দিকে। তার পরিচিত সমস্ত মানুষ তাকে যে সেই কূপের কাছে যেতে নিষেধ করেছিল, কিছুদিন আগেই যেখানে তার পূর্বতন সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে সমস্ত কথা যেন তার মন থেকে উধাও হয়ে গেছে। সেই নিশির ডাক কে কোনভাবেই যেন তিনি অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। এগিয়ে এসে ওর মধ্যে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখলেন কূপের মধ্যে কোন জল নেই। তবে নিচে সুড়ঙ্গের মতন একটা অংশ বোঝা যাচ্ছে এবং সেখানে থেকেই আসছে সেই অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গলে। অনেকক্ষণ সেই মায়াবী আলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে রয়েছেন তিনি। হঠাৎ শুনতে পেলেন নারীকন্ঠে বিলাপের সুরে কেউ কাঁদছে। এত ঝড়ের আওয়াজ এর মধ্যেও সেই বিলাপ তার তার কানে এলো।  ধীরে ধীরে সেই বিলাপ পরিবর্তিত হলো কর্ণকুহর ভেদী হাহাকারে। যেন নরকের অতল থেকে ভেসে আসছে সেই চিৎকার। তারপর বিস্ফারিত নেত্রে তিনি দেখলেন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসছে ভয়াল দর্শন সেই মূর্তি যার আবছায়া একটু আগে তিনি দেখেছিলেন। বন্য পশু যেভাবে সন্তর্পণে সবার অলক্ষ্যে নিজের শিকারকে ধরার চেষ্টা করে, ঠিক সেইভাবে এক নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে যার চক্ষু রক্তবর্ণ, লালায়িত ঠোঁট এবং জিহ্বা,গায়ের চামড়া অনেকটা সাপের শরীরের মত আঁশযুক্ত,হাতে বড় বড় নখ। এই দৃশ্য  প্রত্যক্ষ করার পর রথীনবাবু মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং জ্ঞান হারালেন। কতক্ষন সেভাবে পড়ে ছিলেন জানেননা।

বৃষ্টির ধারায় জ্ঞান ফিরে পেতে তিনি আধো -অন্ধকারে দেখলেন ভয়ালদর্শন নারীমূর্তি যে কোনোভাবেই মনুষ্য প্রজাতি সদস্য নয়, শ্বাপদ প্রাণীর মত চারপায়ে জঙ্গলে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। বিদ্যুতের ঝিলিকে তার স্বদন্ত  চকচক করছে। রথীনবাবুর মনে পড়ে গেলো অসীমবাবুর মর্মান্তিক পরিণতির কথা। হয়তো এই মায়াবীনি তাকে ডেকে নিয়ে এসে নিজের সম্মোহনের মাধ্যমে তাকে কূপের মধ্যে ফেলে তার জীবনহানি ঘটিয়েছে। মুহূর্তে মনে আসে রঘুর কথা, সে বলেছিলো বাড়িতে ভগবানের মূর্তি থাকলে তিনি বিপদ মুক্ত হবেন। তিনি মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকেন এবং সেই প্রেতনীর অলক্ষ্যে অতিকষ্টে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করেন বাড়ি লক্ষ্য করে। তিনি শুনতে পেলেন সেই ভয়ঙ্কর পিশাচিনীর রক্ত জল করা খলখল অট্টহাসি। তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন নরকের শয়তানের দাস  সেই পিশাচিনি, পলায়নরত শিকারকে নিজের কুক্ষিগত করতে তার করালদন্ত বিস্তার করে ধেয়ে আসছে। ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে প্রানপনে ছুটতে ছুটতে তিনি এসে পড়েন তার বাড়ির মধ্যে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একমনে ভগবানকে ডাকতে থাকেন। সারারাত সেই প্রেতনীর পৈশাচিক হাসি তিনি শুনতে পান। সেই ভয়ানক অমানুষিক আর্তনাদ উপেক্ষা করে কোনোক্রমে রাত্রিটা কাটান রথীনবাবু। ভোর হতেই রথিনবাবু গ্রামের দু একজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে যান হরিহর মাস্টারের বাড়ি। তিনি এত ভোরে রথীনবাবুকে দেখে অবাক। রথিনবাবু সবিস্তারে তার সাথে গতরাতে ঘটে যাওয়া অপার্থিব ঘটনাটি বর্ণনা করেন। সব শুনে আতঙ্কিত হরিহরবাবু বলেন ,"চলুন আপনাকে একজনের কাছে নিয়ে যাই, তিনি হয়ত আপনার মনের অন্ধকার কিছুটা দূর করতে পারবেন।"

তারপর তাকে গ্রামের আদিবাসিন্দা বৃদ্ধ ভোলানাথবাবুর কাছে নিয়ে আসেন হরিহরবাবু। রথীনবাবু   গতরাতের সমস্ত ঘটনা জানাতে তিনি বললেন, "অনেক বছর আগে এই গ্রামে ওই জঙ্গলে বসবাসকারী এক মহিলাকে একবার গ্রামবাসীদের ওপর ডাকিনি বিদ্যা প্রয়োগ ও সম্মোহনের মাধম্যে গ্রামের মানুষের ক্ষতিসাধন করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়লে, ডাইনি সন্দেহে  তাকে  পিটিয়ে মেরে  ওই পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দেয়া হয়। তবে সে মারা যাবার আগে অভিশাপ দিয়ে যায়, যে তার বিচরণক্ষেত্রে আসবে তার মৃত্যু ঘটবে তারপর থেকে আমরা কেউ আর ঐ জঙ্গলে যাই না। ওই বাড়িতেও রাত্রি বাস করি না কারণ ওই পিশাচিনী একমাত্র মধ্যরাতে সক্রিয় রূপ ধারণ করতে পারে। অজান্তে অনেকের বেঘোরে প্রাণ গেছে ওই মরণকূপের মধ্যে। আগের ম্যানেজারবাবুকে বাড়িটি ভাড়া নেবার আগে গ্রামবাসীরা সতর্ক করেছিল ওখানে না থাকতে, কিন্তু  কথা শোনেনি তার ফলস্বরূপ তাকে প্রাণ দিতে হয়। আপনাকেও হয়তো অনেকে সচেতন করে থাকবে তার পরেও আপনি সেই অভিশপ্ত স্থানে গেলেন।" 
এতক্ষণে রথীনবাবু মুখ খুললেন,"তিনি বললেন কাল রাত্রে যা ঘটেছে তা সবটাই আমার অনিচ্ছাকৃত। আমি সব শুনেছিলাম, কখনোই ওই জঙ্গলে যেতাম না তবে ওই মায়াবী আলোর সম্মোহন এবং ওই পিশাচিনী নিশ্চয়ই কোন জাদু জানে যার মাধ্যমে সে আমাকে ওই মরণকূপের  কাছে টেনে নিয়ে যায়। বহুকষ্টে এবং অতর্কিতে ওর নজর এড়িয়ে আমি সেখান থেকে ভগবানের দয়ায় পালিয়ে আসতে পারি। ও হয়তো আমায় মৃত ভেবে ভুল করেছিল। না হলে কালকে কি হতো আমি নিজেই জানিনা।"
"আপনি সত্ত্বর ঐ বাড়ি পরিত্যাগ করুন।" 
ভোলানাথ বাবু তাকে  সবিনয়ে অনুরোধ করলেন। রথীনবাবু সেদিনই রঘুকে সঙ্গে করে  সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ওই অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে অনেক দূরে তিনি অন্যত্র একটি বাড়িতে চলে গেলেন।

 রোজ মধ্যরাত্রিতে 'নাড়াবোড়ার জঙ্গলে  '  পরিত্যক্ত মরণকূপের মধ্যে দিয়ে   নরকের পাতাল সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা সেই  বীভৎস দেহের ডাইনির অতৃপ্ত প্রেতাত্মা ওৎ পেতে থাকে তার নতুন শিকারের  অনন্ত অপেক্ষায়।

Sunday, June 12, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -6


 

রন্টুনা মায়ের মন্দিরে গিয়ে আমায় বলল, জানিস রমা অনেক দিন পর গ্রামে এজুম পূজো দেখতে। তোদের অবস্থা সুমন্তর কাছে শুনেছিলুম প্রথমত আমি বিশ্বাস। করতে পারিনি ওর কথা। কোন মানুষ যে এই অবস্থায় পড়ে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন। জামার কল্পনাতীত। তোর বাবার মতো ব্যক্তি এদেশে বিরল। শত কষ্ট স্বীকার করে। ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে প্রয়াসী হয়েছেন। বলতো রমা এইরূপ ত্যাগ স্বীকার। করে ক'জনই করতে পারেন। তোদের এইরূপ অবস্থা দেখে সংকল্প করেছি তোদের এই দুঃখের আমি অংশীদার হতে চাই। এই মায়ের মন্দিরে শপথ করছি তোকে আমি নিজের বোনের মতো দেখবো। রন্টুদার চোখের সামনে করুণ ছায়া নেমে এলো। পুনরায় আর্দ্র গলায় বলতে শুরু করলো, তোর দাদার সাথে মাত্র একটি বছর ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়েছিলুম, কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য সব কিছু হারিয়ে ফেললুম, অর্থাৎ নিজস্ব অর্থ না থাকলে এই বর্তমান যুগে কোন কাজেই সম্ভব নয়। মাসীমার অপার করুণায় ডাক্তারী পড়লুম। তাও কপালে সইলো না। এক বৎসর পরেই ডাক্তারী পড়ায় ইস্তফা দিতেও হলো। 


রন্টুদা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, সে অনেকবারে। তবে তোর মতো বোনকে লাভ করে আমি ধন্য হয়েছি। কারণ, দেখলাম রন্টুদার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হয়ে গেলো। বার কয়েক ঢোক গিলে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ওর ঐরূপ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কেমন যেন হয়ে গেলাম। মনটা বড় আকূল হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠলো, হঠাৎ রন্টুদার এ অবস্থা হবার কারণ কি! 


আমি জিজ্ঞাসা করার আগে বলল, আজ বহুদিন পর আমার হারানো বোনকে ফিরে পেলাম। 


ওকথা শুনে আরো কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি।


 বলল, জানিস রমা, দেখতে সে তোর মতই ছিলো। তোর চেহারার মধ্যে অনেকটা সাদৃশ্য ছিলো। ওকে বড় ভালোবাসতাম রে। কিন্তু হতভাগী যে অকালেই চলে যাবে ভাবতে পারিনি। তার অকাল বিয়োগ আমাকে পাগল করে তুলেছিলো ও বিধাতার এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহী হয়েছিলুম। 


স্থির হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। দাদা অনেক আগে আমাদের কাছ হতে সরে গিয়ে পাড়ারই এক ছেলের সাথে গল্পে মেতেছিলো। আমার তার দিকে মোটেই খেয়াল ছিল না। রন্টুদার মলিন মুখ দেখে বেদনায় আকূল হয়েছিলাম। রন্টুদা বলে চলেছে। তখন হতে কোন পল্লী অঞ্চলে যেতে চাই না। কারণ পল্লী অঞ্চলেই হারিয়েছিলুম বোনকে। এখানে না আছে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র না আছে কোন চিকিৎসার সুব্যবস্থা। এমনকি একটা ডাক্তার পর্যন্ত থাকে না। যদি সে ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে মনে হয় বোনকে হারাতাম না। তোর বাবা উপযুক্ত কাজ করেছেন। সুমন্ত ডাক্তারী পড়ার কারণ আমি সব শুনেছি। সুমন্ত ডাক্তারী পাশ করলে তোদের গ্রামে অনেক উপকার হবে। পল্লী গ্রামের চিকিৎসা অপ্রতুলতায় আমার বোনের জীবনদ্বীপ যে অকালে নির্বাপিত করে দিয়েছে। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমার, 


কি করে হারালো রন্টুদা? 


সে অনেক কথা রমা। শুনবি? 


শুনবো রন্টুদা। 


রন্টুদা মুখটাকে রুমাল দিয়ে মুছে বলতে শুরু করলো। গোল বেঁধে ছিলো ওখানে যদি মামার দেওয়া জিলিপিগুলো না খেতো তাহলে মনে হয় পুনরায় মুখটা মুছলো। দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। বেশ কিছু দিন আগে আমার মেজমামা আমাদের আনতে গিয়েছিলেন গ্রামের কীর্ত্তন উপলক্ষ্যে। আমার মামাবাড়ী পল্লী অঞ্চলে। যেখানে শুধু সবুজের সমারোহ। তাকাচ্ছে চারিদিকে আড়াল করে থাকে পুকুরকে। ভোরে কোকিলের কণ্ঠস্বর মনকে বড় মাতোয়ারা করে দেয়।


 সেই পল্লী গ্রামেই ছিলো আমার মামা বাড়ী। মা'র সাথে আমিও আমার বোন, হাজির হলুম মামা বাড়ীতে। বেশ ভালো লাগছিলো গ্রামখানিকে। বহুদিন পর মামাবাড়ীতে এলুম। ছোটবেলাতে কয়েকবারই এসে ছিলুম। তারপর বয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামাবাড়ীর আকর্ষণ অনেকটা হ্রাস পেয়েছিলো। কিন্তু মা'র কথা কাটতে পারলাম না। কীর্ত্তন মোটেই ভালো লাগতো না। মামাতো ভাই সুব্রতর সাথে নানান জায়গায় আড্ডা দিতাম। পর পর দুটো দিন নানা রঙে ঢঙে তামাসায় কেটে গেলো। ভাবতে পারিনি কিভাবে সময় কাটছিলো। তৃতীয় দিন আমাদের সকলের মধ্যে যে শোকের ছায়া নেমে আসবে কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। মামা বাড়ীতে যে বোনটার উজ্জ্বল শিখা নিভে যাবে তা বুঝতে পারিনি।


 ঐদিন কীর্তনের শেষে আমরা সকলেই উঠানে বসে আছি। একটু পরে গ্রামের বুকে অন্ধকার নেমে এলো। মামা একসময় বড় প্যাকেটে কিছু গরম জিলাপী নিয়ে এলেন। সকলের হাতে কিছু কিছু দিলেন। বেশ হৈ হুল্লোড়ে সকলেই কিছু কিছু খেয়ে ফেললুম। ঘন্টাখানেক পর শুরু হলো এক করুণ দৃশ্য। সে দৃশ্য আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খাদ্যে বিষক্রিয়া শুরু হলো। বুঝতে পারলাম, এটা নিশ্চয়ই ফুড পয়েজিং এর কেস। যারা শক্তিশালী তারা সহ্য করতে পারল কিন্তু আমার বোন বীনা ও মামাতো বোন গোপা বিষক্রিয়ায় শিকার হয়ে উঠলো। আমি পাগলের মতো ডাক্তার ডাকার জন্য চিৎকার করতে থাকলাম। কি করবো অরণ্যের রোদন করে। ঐ এলাকায় কোন ডাক্তার নেই তো গ্রামের লোকেরা কি করবে। 


বীনার শেষ অবস্থা ঘনিয়ে এলো। গরুর গাড়ীতে করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবার ব্যবস্থা করলাম। গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে হাসপাতাল। গোপা ও বীনাকে হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই বীনার জীবন দ্বীপ নিভে গেলো। সে চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে পরম শান্তি লাভ করলো।


রন্টুদা চুপ করলো। ওর চোখ দিয়ে গরম জল নির্গত হলো। লোমশ বুকের মধ্যে। হাত রেখে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, ওর মৃত্যুতে বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিলুম। বিশেষ করে মা ওর শোক সহ্য করতে না পেরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সেই রোগ শয্যা হতে তিনি আজও পর্যন্ত উঠতে পারেননি। মনে হয় আর বাঁচবেন না। বীনার মতো উনারও আয়ু শেষ হয়ে এসেছে।


 রন্টুদার দীর্ঘশ্বাস পড়লো, সে অপলক নেত্রে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে হয় সেই শোকাবহ ঘটনা তার স্মৃতিপটে উদিত হওয়ায় সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। পর পর দুবার ডাক দেওয়ার পর আমার কথায় সাড়া দিলো। আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, অতীতকে মনে এনে নিজেকে দুর্বল কোরো না রন্টুদা। ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শুধু তোমার বোন বীনা কেন, ঐ বয়সর কত কত মেয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে বলে কি বিধাতার উপর দোষারূপ করবো? নিয়তিকে কেউ বাধা দিতে পারে না। জানবে আমার মধ্যে তোমার হারানো বোন ফিরে পেয়েছো। দাদা কতক্ষণ আগে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে তা লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম।


 দাদা বলল, তোদের এই স্নেহের বন্ধন আমার মনে এক অপার্থিব আনন্দের স্পর্শ এনে দিয়েছে। রন্টু আশাহত ছেলে। ও জীবনে অনেক কিছু করবে ভেবেছিলো কিন্তু এ সমাজের নিষ্ঠুরতার ওকে বলি হতে হয়েছে। সে অনেক কথা, ওর জীবনী নিয়ে একদিন বলবো তোকে। তবে মনে রাখিস ওকে ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করে যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিস।


 বললাম, রন্টুদা আমার আপন দাদা, তাই চিরদিনই ওকে মনে রাখবো।


 কি রে রন্টু, রমাকে পেয়ে তোর জীবনের ভগ্নি হারানোর শূন্যতার স্থান পূরণ করলি তো?


 রন্টু ঘাড়টা নাড়লো। মিনিট খানেক পরে নীরব থাকার পর আমরা সকলে বাড়ী যাবার জন্য পা বাড়ালাম। রন্টুদা বাক্যালাপ না করে আমাদের পিছনে হাঁটতে থাকলো। বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে রন্টুদার বোনের নিয়ে কথা বললে প্রথমতঃ তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।


 এমনি আনন্দের মাঝে শারদীয়া পূজো কেটে গিয়ে ওদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। ওদের বিদায় দিতে হবে শুনে মনটা বড় কেঁদে উঠলো। মনে হলো ওদের যেন হারিয়ে ফেলছি। মন চাইছিলো ওরা যেন আজীবন আমাদের কাছে থাকে। কিন্তু কর্তব্যের অনুরোধে তাদের ছাড়তে বাধ্য হলাম। ওদের কর্তব্যে বাধা দেওয়া আমার কাম্য নয়।


রন্টুদাকে প্রণাম করে বার বার আসতে বললাম। সে সম্মতি জানালো নিশ্চয়ই আসবে দাদা বিদায়ের আগে বলল টাকা পাঠাবার জন্য। বাবা কথা দিলেন যথা সময়ে ওর নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন ওরা বিদায় নিলো। আমি ও বাবা কিছু দূরে এগিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফিরে এলাম।


                               ক্রমশ...

Saturday, June 11, 2022

ছোট গল্প - প্রায়শ্চিত্ত || লেখক - তপন তরফদার || Short story - Praichitto || Written by Tapan Kumar Tarafdar


 


        প্রায়শ্চিত্ত

                         তপন  তরফদার 



         মানুষ প্রেম করে, মানুষই ভালোবাসে, আবার মানুষই প্রায়শ্চিত্ত করে।  নিউ র্নমাল যুগের অনেক আগের ঘটনা। তখনও অনেক কালজয়ী প্রেম ঘটিত ঘটনা সমাজে দাগ কেটেছিল। আবার এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য আলোকিত হয়নি।দেশের রাজধানী,বা বড়ো শহরের ঘটনায়   যেমন আলোচিত ও আলোকিত হয় মফস্বল, এক অনামী গ্রামের ঘটনা বা রটনা বাতাসে ভেসে  থাকতে পারেনা। কিন্তু  ঘটনার মশলা অনেক অনেক প্রেমগাথার থেকেও ঝাঁঝালো। প্রায়শ্চিত্ত ও দাগা দিয়ে যায়। যুগের  পরিবর্তন হয়েছে, প্রেমের ও পরিবর্তন হয়েছে। চণ্ডীদাস কত কষ্ট ও কসরত করে প্রেম করেছিল সবাই  জানে। কেষ্টকে কত কষ্ট করে শরীরের সব দম বাঁশির পিছনে ফুঁকে রাধিকার মান ভঞ্জন করতে হয়েছিল।
         উত্তর বঙ্গের অনেক চা বাগান আছে। প্রত্যেক চা বাগানের কুলি কামিনদের নিজের গল্পকথন থাকে। ঠিক মত প্রচার পেলে লায়লা  মজনুর কাহিনী ম্লান হয়ে যেত।  মথুরা চা বাগানের ঘটনা। সিমলাবাড়ি থেকে  আরও চার মাইল খাড়াই পথের দূরত্বে মথুরা টি এস্টেট। সিমলাবাড়ি কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্কুল,গ্রামীন হাসপাতাল, কিছু দোকান। আশেপাশের পয়সাওলা লোকেদের বিনোদনের জন্য  হোটেল কাম বার। হোটেলের নাম ব্লু হেভেন। সিমলাবাড়ির মুকুটে নতুন পালক যোগ হয়েছে ভানু ভক্ত স্কুল উচ্চমাধ্যমিকে উন্নত হয়েছে। আগে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য সদর শহরে যেতে হত, এখন আশেপাশের ধামগুজারি, চিলপাতা,চকোযা,কুর্মাই বাঁশবাড়ির  ছেলে মেয়েরা এখানেই পড়ছে। সিমলাবাড়ি আরও জমজমাট হচ্ছে।
             মথুরা চা বাগানের ক্লার্ক পরেশ চক্রবর্তী চুটিয়ে সংসার করছে। এখানে ব্রাম্ভনের বড়ই  অভাব। পরেশবাবু ও নিজের জাত নিয়ে গর্বিত। চা বাগানের কুলি কামিনরা উঁচু  জাতের মানুষকে সমীহ করে। পরেশ চক্রবর্তীর মেয়ে ওই ভানু ভক্ত স্কুলের ছাত্রী। কোদাল বস্তি হয়ে মালাঙ্গি পেরিয়ে হাইওয়ের পাশে বাঁশবাড়ি থেকে হাজিরা বাবু কদম ছেত্রীর দুর সম্পর্কের ভাগ্নে দেবেশ রায়,ভানু ভক্ত বিদ্যালয়ে বিঞ্জান নিয়ে  পড়বার জন্যে ভর্তি হয়েছে।
        গায়ত্রী  সেজেগুজে স্কুলে এসেছে। সরস্বতী  পুজোয়,প্রথম শাড়ি পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখছে আর বলছে এই আমি  কি সেই আমি। সরস্বতী পুজোর দিন মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। গায়ত্রী পড়েছে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি।শাড়িতে কাঠগোলাপ ফুলের নকশা। ফুল হাতা গোলাপি ব্লাউজ। মাথার্ভতি ঢেউ খেলানো চুল। চুলের রঙের সাথে মিশে যাওয়া কালো ক্লিপ দিয়ে মাথায় লাগিয়েছে কাঠগোলাপ ফুল। গায়ত্রীর উজ্জ্বল ত্বক,সুন্দর গড়ন। পেলব ঠোঁট, হাসলে গালে টোল পড়ে । গায়ত্রী সাইকেলই স্কুলে যায়। গায়ত্রী আজ উপোস করে আছে। স্কুলে পুষ্পাঞ্জলি দেবে। স্কুলেই খিচুড়ি খাবে।
               পুষ্পাঞ্জলির “কুচ যুগল শোভিত” উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে আলোড়ন ওঠে। গায়ত্রীর মুখে রক্তিম ছোপ। আবার মোচড়। এবার  বুঝতে পারে মেয়েদের প্রতি মাসের সেই সঙ্গী  মোচড়। দিশাহারা হয়ে যায়। গায়ত্রী কাউকেই কিছুই না বলে পাঁই পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ফিরতে চায়। সোনপুর পেরিয়ে ঢালু বাঁকটা নামতে গিয়ে ধাক্কা মারে এক  মাউন্টেন সাইকেল চালককে। মাউন্টেন সাইকেলের চাকা চওড়া এবং পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তা কামড়ে চলে,সহজে পিছলে যায়না। গায়ত্রীর কমফর্ট সাইকেল যা পাহাড়ি রাস্তার উপযুক্ত নয়, অনেকটা ঝুঁকে চালাতে হয়। ছিটকে পড়ে গায়ত্রী। সাইকেল চালক দেবেশ গায়ত্রীকে শক্ত হাতে তুলে ধরে। দুজনের চোখ দুজনের চোখে। “বধূ কোন আলো লাগলো চোখে”। দেবেশ এক সুপুরুষ যুবক। গ্রীক ভাস্কর্যের প্রতিরূপ। টিকালো নাক। ধারালো মুখ। উজ্জ্বল দুটি চোখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। সব মেয়েরা শিব পুজো করে এরকমই শিবের জন্য। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে গায়ত্রী বলে আমার শরীরটা খারাপ  লাগছে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাব। দেবেশের ঘোর কাটেনি। মনে হচ্ছে কোন পরি যেন তার কোলে ধরা দিয়েছে। দেবেশ বলে আমি বাড়িতে পৌঁছে দেবো। গায়ত্রী বলে, না না দরকার নেই। পরে কথা হবে। দেবেশ বলে, একই স্কুলের আমরা। নিশ্চয়ই দেখা হবে। গায়ত্রীর যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মুখেও এক তাৎপর্য পূর্ণ হাসি।
                ওদের  স্কুলের  যাতায়াতের পথে চিলপাথা ফরেস্ট গেটের ডান দিক দিয়ে সরু পাথরের রাস্তা মিশেছে বানিয়া নদীর কিনারায়। প্রত্যেক অঞ্চলেই একটা স্থান থাকে যেখানে কপোত-কপোতীরা বক-বকমের জন্য মিলিত হয়। এইসব স্থানে প্রেমিক -প্রেমিকারা তাদের প্রেমকে অমর করে রাখতে  গাছের কাণ্ডে কিংবা পাথরে নাম খোদাই করে রাখে। বানিয়া নদীর  পাথরের বুকেও তার  নিদর্শন আছে। একদিন গায়ত্রী বলে আমারা একটা ঝোপের আড়ালের পাথরে আমাদের  নাম খোদাই করি। দেবেশ পড়াশোনায় ভালো,খোঁজ খবর ও রাখে। দেবেশ বলে পৃথিবীতে প্রাচীনতম প্রেম পত্রটি পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়ার ক্যালডিয়া অঞ্চলে।  ২২০০খ্রিঃপূঃতে ব্যাবিলনের একটি ছেলে   এক খন্ড পাথুরে মাটির ফলকে  ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিপারাবাসী তার প্রেমিকাকে হিব্রু,আরবি,আরমিক ভাষা মিশিয়ে  প্রেমগাথা  লিখেছিল।    
               দেখতে দেখতে দু বছর কেটে গেল। গায়ত্রী ক্লাস ইলেভেন উঠলো। দুজনের বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। গায়ত্রীর মা বলে  দেবেশ ছেলেটা  ভালো  ওরা দুজনে  দুজনকে ভালোবাসে। ওদের পরে বিয়ে দেবো।। পরেশবাবু শুনেই  বলে কখনো না। আমরা ব্রাম্ভন।মেয়েকে প্রাণপণ ভালোবাসি। ওই নিচু জাতের বখাটে ছেলের সঙ্গে  বিয়ে কিছুতেই নয়। ভগবান পরেশবাবুর কথা শুনতে পায়। মালিঙ্গী চা বাগানের  ম্যানেজার মোনোজ মুখার্জ্জীর ছেলের সঙ্গে  বিয়ের ঠিক করে।
            গায়ত্রীকে ঘর থেকে বেরুতে দেয় না। প্রেম যারা করে তারা ঠিক কোনো না কোন  উপায় বার করে। দেবেশ গায়ত্রীদের বাড়িতে ঠিকে ঝি বাসবীর মাধ্যমে চিঠি চালা চালি শুরু  করলো। সিদ্ধান্ত হলো বিয়ের দিন রাত্রে  পালিয়ে যাবে নয়তো বিষ খেয়ে কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে।
            “ স্টুপ টু কনকার।“ দেবেশ গায়ত্রীর বাড়িতে গিয়ে পরেশবাবু কে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে,বলে আমার বাড়ির লোকজনেরও এই বিয়েতে মত নেই। আমি ও চাই  ওর ভালো জায়গায় বিয়ে হোক। মেসোমশাই বিয়েতে খাটা খাটনির জন্য আমি আছি। দেবেশ ঘরের ছেলের মতোই বিশ্বাসী হয়ে গেল। সব কাজ  হাসিমুখে করছে। এমন কি সবার সামনেই গায়ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। বিয়ের ভোজের জন্য বাছাই করে পাঁঠা কেনা হয়েছে। পাঁঠারা পাতা চিবাচ্ছেই আর ব্যাঁ ব্যাঁ করে ডাক ছাড়ছে।  দেবেশ সবার সামনেই জিজ্ঞাসা করে -এই বিয়েতে কত পাঁঠা  বলি হবে। যে যার মতোই অঙ্ক কষে উত্তর দেয়। গায়ত্রীর মনের কাঁটা খচখচ করে উঠে। তবে কি দেবেশদা ধরে নিচ্ছে ওর জীবন বলি হয়ে গেল। বিয়ের দিন সকাল এগারোটা নাগাদ খবর এলো দেবেশের কোন কাকার স্ট্রোক হয়েছে  কলকাতা যেতে হবে। গায়ত্রী খবরটা শুনেও মনেমনে বলে,সন্ধ্যায় নিশ্চিত ও আসবেই।
              ম্যানেজারের ছেলের বিয়ে। বিয়েতে জমকালো কিছু  করতেই হবে। সাদরি মেয়েদের নাচের ট্রুপ এসেছে । ঝুরানি নাচ, একতার নাচ,মাছ ধরার নাচ সর্বপোরি জোৎস্না রাতের সেই মায়াবী ভালোবাসার নাচ। সঙ্গতে সেই লম্বা লম্বা কাল বাঁশি, ঢোল, ,ফ্লুট যোগে নাচ। সারা মহল্লায় সাড়া পরে যায়। ম্যানেজারের ছেলে মোনজিৎ মন জয় করতে বন্ধুদের আকন্ঠ দারু খেয়েছে ও খাইয়েছে। গায়ত্রী কনের সাজে বসে আছে,মনে মনে আশঙ্কা, দেবেশ এখনো কেন এলোনা।  কনেকে পিঁড়িতে করে বিয়ের আসরে নিয়ে  আসা হলো তবু  দেবেশের দেখা  নেই। বর মালা বদল করার জন্য দাঁড়াতে গেলে টলে পড়ে যায়।  গায়ত্রী সাহস করে বলে উঠে ওই মদমাতাল ছেলেকে বিয়ে  করবো না।  মা ও বলে এই বাজে ছেলের সঙ্গে  আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা। হৈচৈ বেঁধে যায়। বিয়ে বন্ধ ।
          গায়ত্রীর যে বিয়ে হল না এই খবরটা দেবেশ জানে কিনা তাও জানা গেল না। আবার বিয়ের ব্যবস্থা করতে গেলে গায়ত্রী জেদ করে বলে “বিয়ে করবে না।“ গায়ত্রীর মা স্বর্গবাসী হল। গায়ত্রী নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়ে মানুষের সেবা করে জীবন কাটিয়ে দেবে। সময়ই সব দুঃখ কষ্টকে খেয়ে নেয়। কিছু  কষ্টের দাগ ছুরিকাঘাতের দাগের মতোই থেকে যায়। গায়ত্রীর মন থেকে দেবেশ মুছে যায়নি। প্রথম এবং শেষ প্রেম।
          বিলাসপুরের আমব্দেকার  মেমোরিয়ল হাসপাতালের নার্স গায়ত্রী। বাবাকে নিয়ে কোয়ার্টারেই থাকে। রবিবার রাতে  অ্যক্সিডেন্টে গুরুতর আহত  এক রুগি ভর্তি  হয়েছে। মাথায় সেলাই করে রক্ত বন্ধ করা গেছে,কিন্ত রোগি চোখে দেখতে পাচ্ছেনা। ডাক্তার চৌরাশিয়া বলেন,দৃষ্টি শক্তি হারানো, বিরল ঘটনা। বৃহস্পতিবারে ডিউটিতে গিয়ে শোনে সেই রুগিকে বাইশ নম্বরে আনা হয়েছে। রুগিকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। দেবেশ। দেবেশ এখানে কি করে আসলো। গায়ত্রী কোনো কথা না বলে রুগিকে পরম মমতায় শুশ্রূষা করে। সেবা আশ্রমের ম্যানেজার এসে বলে, উনার নাম ডাক্তার দেবেশ রায়। গত দশ বছর ধরে  আমাদের সেবা কেন্দ্রের ডাক্তার।ওনার দুকুলে কেউ নেই। রুগীই ওর আপন জন। উনি ডাক্তারি না করতে পারলে বাঁচবেন কি করে।
            গায়ত্রী অসতর্ক  মুহূর্তে কথা বলে ফেলে। দেবেশ কন্ঠস্বর শুনেই বলে গায়ত্রী কেমন আছো। এ জীবনে তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি। সেদিন যেতে পারেনি। তুমি সুখে সংসার করো। গায়ত্রী বিয়ের দিনের সব ঘটনা বলে। দেবেশদা আমি  তোমাকে  ছাড়া কারও সঙ্গে ঘর বাঁধবোনা। আমি আমার একটা চোখ তোমাকে দেবো। দেবেশ বলে পাগলামি করোনা।  গায়ত্রী বাবাকে বলে দেবেশেকে ও ওর একটা  চোখ  দেবে। আগামী  রবিবার  দিন অপারেশন হবে। রবিবার  ভোরবেলায় দেখা যায় পরেশবাবু গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। বুকে বড়ো অক্ষরে লেখা, “আমার চোখ দুটো  দেবেশকে দিয়ে অমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।“