Monday, January 30, 2023

হৃদের ভুলে - উৎপল মুখার্জী || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 হৃদের ভুলে... 

         উৎপল মুখার্জী



দেখতে দেখতে বয়স এগিয়ে চলেছে, সাধুসঙ্গ ছেড়ে , মোহে আজ অমাবস্যার দিনে একাকী বসে আছি পাশের শ্মশানে, সাথে চৌরস, দুটো শালের কুচি দন্ড, প্রয়োজন ঘি, আগুনের ফুলকি, মরা টাটকা মানব মাথার ফুটকির ঝলসানো প্রেতাত্মা, পাশেই কুমারী মায়ের ভয়ার্ত চিৎকার "ছেড়ে দে আমাকে- আমি কোন দোষ করি নি, ভোগের মাঝে কি পেয়েছিস শুধু ই শুন্যতা... সমাজের চটকানো ভালোবাসার কুয়াশা, দুরন্ত ঝাপটা, আমার নরম দেহটার উপর অসামঞ্জস্য গঠনের ভারসাম্যের ভিড়ে উদগ্ৰীব রহস্য, হয়েছে তো"? .. মনের অবলোকনের রহস্য খুঁজতে গিয়ে আমি, অনিমেষ, বিবেকের কথন, যখন নাড়াচাড়া দিচ্ছে, যজ্ঞের আগুনের পাশেই । ভুতুড়ে বাতাসে ছনমনে হৃদয় স্থির হয়ে একাগ্ৰ চিন্তায় সেই কুমারী, নাড়া দেয়, বলে, "প্রায়শ্চিত্ত করছিস!.... 

কোন লাভ নেই, বল তুই সাধু হয়ে ছিলি কেন? - গোপন মনের তৃষা যেখানে, নরে র প্রতি নারী র আকর্ষণ ঘিরে, কিসের চেতন ছিলো?- ভালোবাসার -যা কুরুচি ভরা, তোর নিস্তার নেই, আমি নিস্তারিণী বলছি, তোর শাস্তি হবেই "। আমি, অনিমেষ- ছিলাম মনের ডাকাত, ধরা পড়ি, আজ, খুনের হুমকি মামলায়-যাবজ্জীবন, পড়ে জেলারের চোখে ফাঁকি দিয়ে পরিভ্রমন, পরে সন্ন্যাসী, কিছু বানী, মন্থিত ধর্ম, ও মহারাজ চন্ডালানন্দ। ভালোবাসি এখনো বাল্যের নিস্তারিণী কে, - ঘৃনা করে- ও ভোগে পেয়েই একেবারে, -পরে খুন করে নলি কাটা মাথা নিয়ে যজ্ঞের আহুতি, -পাশেই ছটফট করা বাকী দেহ, -অভিসারের শেষে- তদন্তের পুলিশের গাড়ি, নারায়ণগঞ্জের থানার। চল সাধু পাকা খুনী অতিশয়.... ! ( ১৭৫ শব্দের)

প্রত্যাবর্তন - চন্দন চক্রবর্তী || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 প্রত্যাবর্তন

চন্দন চক্রবর্তী


রঞ্জনা প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই,আবেগ তাড়িত হয়ে,ওকে বুকে টেনে নিলাম । আমার দুই বাহুর বাঁধনে,ভীত কবুতরের মত,ও এখন কেঁপে কেঁপে উঠছে ।


সকালেই খবর পেয়েছি রঞ্জনার শিক্ষকতার চাকরিটা হয়েছে । পাঁচ ছটা বছর ওকে টিউশান দিয়েছি । সেই যেদিন ও হায়ার সেকেন্ডারি পাস করল,ওর বাড়ি গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম,ওকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াবো । প্রথমে রাজি হয়নি । তার গভীর কারণ ছিল । ওর জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তাতে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মত পরিস্থিতি ওর ছিলো না ।


রঞ্জনা পাড়ার মেয়ে । শুধু মেয়ে বললে একটা মেয়েকে আর কতটুকু বোঝানো যায় ! ওকে যারা আগে দেখেছে,এক কথায় স্বীকার করবে,চলন,বলন,আচার,আচরণ সব মিলিয়ে,ভীষণ মিষ্টি একটি মেয়ে । যে কোন যুবক ওকে একবার দেখলেই ওর প্রতি ভালোবাসা জন্মে যাবে । কিন্তু এখন,এখন ঠিক তার বিপরীত । মানুষেরও বলিহারি,কি করে এত নির্দয় হয় ! কৌতুহলী দৃষ্টি,কটূক্তি ওকে সর্বত্র উত্যক্ত করে মারে । জীবন মানেই সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নায় মোড়া । সব জীবনেই থাকে,কিছু হেরফের হয় । কিন্তু জীবনে যদি শুধু কান্নাই থাকে,যদি হাসি না থাকে ?


রঞ্জনা মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর,ইলেভেন ক্লাসে ভর্তি হল । মনে তখন অনেক আশা,অনেক স্বপ্ন । বাবার অবস্থা ভালো নয় । ওর ইচ্ছা দিদিমণি হয়ে বাবাকে সাহায্য করবে,গরিব ছাত্রীদের কথা ভাববে । মানুষ ভাবে এক,আর হয় আর । সেতো সবার জীবনেই সত্যি । কিন্তু রঞ্জনার ? প্রেম ভালোবাসা ছাড়া জীবন ভাবা যায় না । ভালোবাসা জীবনের পরম পাওয়া । দুটি হৃদয় তখন এক হয়ে যায় । কিন্তু জোর করে ভালোবাসা আদায় ? ভালো করে ফুল ফুটলে তবেই তার নির্যাস পাওয়া যায় । ফুল ফোটার সময়টুকুতো দিতেই হবে,সেইতো ভালোবাসার সাধনা ।


রঞ্জনার জীবনে এক তরফা কেউ এসেছিল । রঞ্জনার সায় ছিল না । বছর ঘুরে তার তখন বারো ক্লাস,পড়ার ভীষণ চাপ,সন্ধ্যাবেলা কোচিংয়ে যায় । সেই সুযোগে কোন এক অভিশপ্ত দিনে রঞ্জনা আর আগের সেই মেয়ে থাকে নি । অসুখে ভুগে,দুর্ঘটনায় মানুষের অঙ্গহানি হয়,আগুনে পুড়ে বীভৎস রূপ ধারণ করে । সেখানে মানুষ নিরুপায় । কিন্তু কেউ যদি কারো রোষানলে দগ্ধ হয়ে কদাকার রূপ ধারণ করে,তেমন পাশবিক কাজের কোন ক্ষমা হয় কি ? অপরাধীর শাস্তি হলেও সমাজকে যে সেই কদর্য ঘটনার সাক্ষী থেকে সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় !


অ্যাসিডে মুখ পোড়া রঞ্জনা হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রায় একটি মাস পরে । মুখে, ঘাড়ের চামড়ায় আদিম হিংসা,লালসার ক্ষত চিহ্নগুলো তখন অ্যাসিড শিকারের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে । আর তখন থেকেই রঞ্জনা হয়ে উঠল সবার চোখের বিষ । তারই মধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষী যারা,অনেক বুঝিয়ে তাকে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসাতে চেষ্টা করেছে । 


সেদিনের সেই ঘটনা জানার পর হসপিটালে গিয়ে সেই প্রথম ওর সামনে হাজির হয়েছিলাম । ও যখন ছোট,স্কুলে যাওয়া-আসা করত,তখন থেকেই ওকে দেখছি । নেচে নেচে কথা বলে এমন মাতিয়ে রাখতো,আট-দশটা মেয়ের মধ্যে ওকে আলাদা করে চোখে পড়ত । আমিও ওকে চোখের দেখা দেখবো বলে জানালায় বসে থাকতাম । মনে মনে আমারও কি ওর প্রতি ভালোবাসার জন্মে ছিল,কে জানে ! তবে ওকে দেখলে মনে পুলক জাগত,এটা সত্যি । মনে দ্বিধা ছিল,বয়সে ও আমার থেকে অনেকটাই ছোট । মেয়েটার ঝলসে যাওয়া মুখটা দেখে অনেকক্ষণ বোবা হয়ে বসেছিলাম ।


হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর রঞ্জনা আবার বেঁকে বসল । আর পড়বে না । রাস্তাঘাটে ওকে দেখে অনেকে বাজে মন্তব্য করে । ওর কদাকার রূপ দেখে নাকি শিশুরা ভয় পাবে,তাই মায়েরা শিশুর চোখ হাত দিয়ে ঢেকে সরে যায় । কেউ কেউ এমনও বলেছে,ওর মরে যাওয়াই ভালো । 


হসপিটালে রঞ্জনার বাবা,মায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওরা আমাকে এমন করে আপন করেছিল সরে আসতে পারিনি । ধীরে ধীরে রঞ্জনার সমস্যাকে নিজের সমস্যা ভাবতে শুরু করেছি । প্রথম প্রথম দরজা বন্ধ করে থাকতো । কতদিন যে ফিরে আসতে হয়েছে ! কিন্তু ওকে যে মনে মনে ভালোবাসতাম সে ভাবনা তখন আমার ছিল না । 


ধীরে ধীরে রঞ্জনা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে । রঞ্জনাকে টিউশান দিয়ে কলেজ,ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করলাম । রঞ্জনা আবার রাস্তায় স্বাভাবিক চলাচল শুরু করলো । কিন্তু হাসি ছিল না ওর মুখে । আমার পণ ছিল ওর মুখে হাসি ফোটাবো । কিন্তু রঞ্জনা যত স্বাভাবিক হয়ে উঠছে,আমার প্রতি ওর এবং ওর পরিবারের নির্ভরতা আরো বেড়ে চলেছে । এরপর রঞ্জনা বিএড পাস করেছে,এসএসসি পরীক্ষায় বসবে, তার প্রস্তুতি চলছে । আর এই সময় হঠাৎ আমার ভাবনা অন্যদিকে মোড় নিল । 


বারবার মনে হয়েছে সরে যাই । যে ভাবে আমার ওপর ওর নির্ভরতা বাড়ছে ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়ালে তখন সামাল দিতে পারব না । মনকে বুঝিয়েছি ওকে ভালবাসা যায় কিনা । কিন্তু ওর মুখটা মনে করে,মন বেঁকে বসেছে । কিন্তু বিবেক বারবার আমাকে বুঝিয়েছে,ক্ষণস্থায়ী রূপ নিয়ে আমার এত ভাবনা কেন ! এখন যদি আমি সরে আসি কোন অঘটন ঘটবে না তো ! ভয়ে আমি শিউরে উঠেছি । রাত্রিবেলা শুয়ে এমন বিক্ষিপ্ত ভাবনা ভেবে আমি অস্থির হয়ে উঠতাম । শেষে রঞ্জনাকে একদিন বলেই দিলাম,আমি ওকে ভালোবাসি । আর কি আশ্চর্য,কথাটা উচ্চারণ করার পরেই মনে হল আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি । কিন্তু রঞ্জনার দিক থেকে কোন সাড়া পেলাম না । তাতেই যেন আমার আরও রোখ চেপে গেল । কিন্তু যতই বোঝাই রঞ্জনা নিরব ! হয়তো ওর ধারণা,আমি ওকে দয়া করছি,হয়তো আমাকে যাচাই করে নিচ্ছিল । সেটা বুঝলাম যখন এসএসসির রেজাল্ট জেনে ওর ওখানে গেলাম । রেজাল্ট নিয়ে কথা বলতে বলতে ও আমাকে প্রণাম করতে যেই নিচু হয়েছে,কি যে হল,এই প্রথম আবেগে তাড়িত হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । ও কিন্তু একটুও প্রতিবাদ করল না । 


রঞ্জনা পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে জয়লাভ করেছে,জীবনের চাওয়া ওর পূর্ণ হয়েছে । রঞ্জনা হাসছে,এই প্রথম রঞ্জনা আগের মত হাসছে,চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে,তাও রঞ্জনা হাসছে । আর ওর হাসি দেখে আমার চোখেও জল,এতদিনে আমার সাধনাও যে পূর্ণ হল । 


আমাদের আর কোন ভয় নেই,কোন সংশয় নেই । আমরা পেরেছি এতবড় একটা যুদ্ধে জয়লাভ করতে । বললাম,চলো রঞ্জনা ঘুরে আসি । সঙ্গে সঙ্গে ও রাজি হয়ে গেল । দুজনে হাত ধরাধরি করে আমরা পথে নামলাম,যে হাতের বন্ধন কোনদিন খুলবে না ।

ভালো বাসা - অন্নীষা মুখার্জ্জী || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 ভালো বাসা

অন্নীষা মুখার্জ্জী


... অবশেষে হঠাৎ একদিন ফোনটা এলো। কিছুটা ঘাবড়ে ঘেঁটে যাওয়ার কথা। আমি তখনও বেশ নির্বিকার।


-রাগের শেষে আমার একটা রোদ ঝলমলে সকাল চাই। দিবি আমায়? 

-"সব শেষের নিষ্পত্তি হলেও যে সকালটা আর আসে না রে। রাগ নেই তোর ওপর আমার।"

সে বললো, "কেমন যেন মনে হচ্ছে, ঢেউয়ের ওঠা পড়া বন্ধ হয়েছে! তুই কি সত্যিই আজ অব্যক্ত ভাষাদের দলে হারিয়ে গেছিস?"

-"সব কথা বলে ওঠা হয়না আর। সেদিনের আমার সেই সিক্রেট বক্সটাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি অনেক দিন হলো। আজ ফিরে পেতে আর ইচ্ছে হয়না রে। বলতে পারিস, ভয় পাই আবার নতুন কিছু সিক্রেট জমিয়ে আরও খানিকটা আপন করে নিতে।"

-"হারায়নি, বিশ্বাস কর। সব আজও আছে একই রকম সুন্দর। মাঝে দিনগুলো বড্ড একঘেয়ে আর বস্তাপচা।"

-"সত্য যদি বস্তাপচা হয়, তবুও সে সত্যের বদল হয়না। কি হারিয়েছি, কি পেয়েছি, তার হিসেব কষতে মন চায়না আর।"

-"কি চায় তোর মন? আমাকে বল।"

-"বসন্তের ভোররাতে শিশির ভেজা সোঁদা গন্ধটা মন ভরে মেখে নিতে। চোখ জোড়া সবুজ,চলে যেতে হবে জেনেও আপ্রাণ ভালোবাসা। উন্মাদনা ভরা চিরসবুজের দৃষ্টিকোণ। স্বার্থহীন প্রকৃতির তৎপরতা, কৃষ্ণচূড়ার দোলন, ফাগের মাতন। আজকাল এসবই ভালো লাগে।"

-"আর ভালোবাসা?"

-"ভালোবাসাটা আর হলোনা, জানিস! বসন্তের কালবেলা এ দাঁড়িয়ে শুধু নিঃসারে ভালোবাসার মানেটা খুঁজলাম। তারপর বুঝলাম, ভালোবাসাটা ঠিক হয়না। ভালোবাসার অনেকটা জটিলতা।

 সবাই একটা বাসা খোঁজে ভালো থাকার তাগিদে। সেখানে কোথাও রোদ্দুরের বাড়াবাড়ি,কোথাও ঘনঘোর অন্ধকার। আমরা সবটুকু ঠিক মন মতো না হলে মানিয়ে গুছিয়ে সেথায় একটা শান্তির নীড় গড়ে তুলতে পারিনা। 'এই বাসাটা মোটেই আমার মনের মতো না', বলে আমরা হাল ছেড়ে দিই। তাই, ভালো একটা বাসার খোঁজে শেষমেশ ভালোবাসাটা আর হয়না। 


ধরে নে না হয়, সেই সূত্র মেনেই আমার ভালবাসাটা আর হলো না।"

জীবন আকস্মিক - মনোরঞ্জন গড়াই || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

  জীবন আকস্মিক 

     মনোরঞ্জন গড়াই



গত রোববার আমার বাইকটির জীর্ণ হয়ে যাওয়া সিট কভারটি পাল্টাতে গিয়েছিলাম দাদুর দোকানে। 


        যাই হোক সেখানে গিয়ে দেখলাম দোকানের মালিক অর্থাৎ বয়স্ক দাদুটি সেখানে নেই।  প্রতিবার এখানেই আমি সিটকভার পাল্টাই কারণ যে দাদুর কথা বললাম তাঁর আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। 


         টাকা কম থাকলে বা অন্য কোন অসুবিধা থাকলে তাঁর কাছে কাজ করাতে কোন অসুবিধাই হয় না।  যাই হোক আমি তাঁকে না দেখে অনুমান করলাম হয় তিনি আসেননি নতুবা শরীর খারাপ হয়েছে। 


         যাই হোক যে লোকটি ছিল তাকে বলে সিটকভারটি লাগালাম। 


        পয়সা দিতে যাব এমন সময় কি মনে করে বলে ফেললাম - দাদুকে দেখছি না শরীর খারাপ নাকি? 


         লোকটি বললেন দাদু দেওয়ালে আছেন। 


         আমার মাথা ঘুরে গেল। দেওয়ালে আছেন মানে? 


          লোকটি বললেন - বাবু পেছনের দেওয়ালে তাকান।

         

        এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম পর্দা থাকায় আমি পিছনের দেয়াল দেখতে পাইনি। লোকটি পর্দা সরিয়ে দিতে আমি দেখলাম দাদুর ছবিটি দেয়ালে টাঙানো  এবং ছবিতে মালা দেওয়া রয়েছে।  


        লোকটি বললেন - দাদা মানুষের জীবনের কোন দাম নেই।  দু সপ্তাহ আগে রাত্রেবেলা বাবার বুকে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। হাসপাতালে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারিনি।  সব শেষ হয়ে গেল।  


        আমি  বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।  কিভাবে লোকটিকে সান্ত্বনা দেব বুঝতে না পেরে মাথা নামিয়ে ফেললাম। 


         জীবন হয়তো এতোটাই অনিশ্চিত ও আকস্মিক।


দূরদৃষ্টি - রানা জামান || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 দূরদৃষ্টি

       রানা জামান



প্রিয় নেতার আশীর্বাদ নেবার জন্য ছেলে নবীনসহ হরিহরবাবু স্থানীয় সাংসদ রবিশঙ্করের শহরের বাড়িতে এলেন। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। দারোয়ান আটকে দিলো ওদের। কিন্তু হরিহরবাবু জানেন দারোয়ান ওকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবে না-সাংসদ ওর নাম শোনার সাথে সাথে ভেতরে ডেকে নেবেন। কারণ, সাংসদ জানেন ওর হাতে কত ক্ষমতা! ওর এই ক্ষমতা হলো ভোট। ওর হাতে প্রচুর ভোট। হরিহরবাবুর এলাকায় হাজার ভোটার আছে, যা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এই সকল ভোটার হরিহরবাবুকে দেবতার মতো মানে এবং ওর কথামত ভোটও প্রদান করে থাকে। ঘটনাচক্রে নবীনের জন্মও হয়েছে রবিশঙ্করের গাড়িতে। ঐদিন এম্বুলেন্স আসতে বিলম্ব হওয়ায় রবিশঙ্কর তাঁর গাড়ি দিয়ে হরিহরের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন; কিন্তু গাড়িতেই নবীনের জন্ম হয়ে যায়।


হরিহরবাবু বললেন, স্যার আমাদের চেনেন। আমরা হরিগাতি গ্রাম থেকে এসেছি। আমার নাম হরিহর।

হরিহর দারোয়ানের হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিলে দারোয়ান ওদের ঢুকতে দিলো ভেতরে।


নবীনসহ হরিহর ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে স্থানীয় এক নেতা ভেতরে ঢুকে রগচটা স্বরে বললো, উপজেলা ইলেকশানে এবার আমাকে নমিনেশন না দিলে খবর আছে আপনার নেতা!


সাংসদ রবিশঙ্কর রগচটায় ওর চেয়ে এক কাঠি উপরে।


রবিশঙ্কর নেতার মাথা ধরে টি-টেবিলে আঘাত করে বললেন, আমাকে ভয় দেখাস তুই! কী করবি তুই আমার?


নেতা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। মাথায় ঢুকে আছে টি-টেবিলের কাঁচের একটা ভাঙ্গা টুকরো। হতভম্ব রবিশঙ্কর নেতার হাতের নাড়ি টিপে বুঝতে পারলেন মারা গেছে।


আতঙ্কিত চোখে ওদের দিকে তাকালে হরিহর বললো, আপনি ওকে মেরে ফেলেছেন স্যার!


রবিশঙ্কর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আমাকে খুব পছন্দ করো, তাই না হরিহর?


জ্বি স্যার।


খুনের দায়ে আমি এখন জেলে গেলে এলাকার খুব ক্ষতি হবে। তুমি এই খুনের দায় নিয়ে নাও। আমি তোমার পরিবারের ভার নিলাম এবং ছেলেটাকে ডাক্তার বানানোর দায়িত্বও নিলাম।


নবীন এক কদম এগিয়ে এসে বললো, বাবা না স্যার, আমি নেবো। কিশোর অপরাধী হিসেবে আমার কয়েক বছর সাজা হবে। তবে শর্ত আছে একটা।


কী শর্ত?


উপজেলা ইলেকশানে বাবাকে নমিনেশন দিতে হবে। বাইরে জনতার সামনে গিয়ে এখনই ঘোষণা দিয়ে তারপর পুলিশে খবর দিন!


 

মাতৃত্ব সে কেবলই অন্তরের - সঞ্চারী ব‍্যা্যানাজ্জী || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 মাতৃত্ব সে কেবলই অন্তরের

      সঞ্চারী ব‍্যানাজ্জী



খবরের কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা "তিয়াশা" নামটা পড়ে বেশ প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ করলাম।কাগজে লেখা আছে " বিভাস চক্রবর্তী পরিচালিত বিধবা ছবির জন‍্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন তিয়াশা"।শুধু নামটাই লেখা পদবী ও ব‍্যাবহার করে না।বয়স মাত্র তেইশ।মাত্র পাঁচ বছরের কেরিয়ারেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নায়িকা বনে গেল।মা হিসাবে ওকে নিয়ে গর্ববোধ তো হবেই তাই না! লক্ষী বেঁচে থাকলে আরও খুশি হত।শুধু লক্ষী কেন হারাধনও কি কম খুশি হত!চেয়ারে বসে পেপার পড়তে পড়তে আজ বড্ড পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ছে।এই হয়েছে আমার এক ব‍্যামো বয়স বাড়তে না বাড়তেই স্মৃতিচারণায় মেতে উঠি যখন তখন।আর স্মৃতির ঝাঁপি তো আপনা আপনিই খুলে যায়।আরে শরীরের বয়স বেড়ে গেছে তো কি হয়েছে?কিন্তু মনের বয়স তো আর বাড়েনি আমি বাড়তেও দিইনি।ওই যে এখন কার একটা গান আছে না "দিল তো বাচ্ছা হ‍্যা জি"।ওইরকম কিছুটা।আমার বয়স একষট্টি কর্তার বয়স সত্তর।আর মেয়ের বয়স তো বললামই,সব মিলিয়ে আমরা বাড়িতে সাত জন সদস্য ।কে কে?ওই তো আমরা তিনজন আর চারজনের মধ্যে হল গিয়ে একজন ড্রাইভার রমেশ,রান্নার কাজ করা মেয়ে ইন্দু,ঘরদোর পরিস্কার করার মেয়ে বুলা আর মেয়ের ম‍্যানেজার অনুসূয়া।সবাই মিলে থাকি তাই আমরা সবাই এক পরিবার হলাম কিনা?আসলে এটা ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শিখেছি।আমাদের গ্রামের বাড়িতে যত কাজের লোক ছিলেন তাদেরকে মা কোনো দিনই বাইরের লোক বলে মনে করতেন না।মায়ের কাছে তারাও ছিলেন বাড়ির সদস্য।আজ অবশ‍্য ভীষন আমার সেই পুরনো গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা যেদিন গ্রামে গিয়ে খবর পেলাম লক্ষী আর হারাধনদা বেঁচে নেই।লক্ষী আমাদের বাড়িতে কাজ করত সেই ষোলো বছর বয়স থেকে।ওর বাবা ছিলেন না।মা প্রায়দিনই অসুস্থ থাকতেন।তাই সংসারের হাল ধরতে লক্ষী আমাদের বাড়ি কাজ করত।পড়াশোনাটা শিখে ওঠা হয়নি ওর।কিন্তু ও ছিল বুদ্ধিমতী,ভদ্র,মার্জিত স্বভাবের মেয়ে।পেটে যে বিদ‍্যা ছিল না সেটা কোনো দিন ওর কথায় বা আচরনে প্রকাশ পেত না।শেখার আগ্রহও ছিল খুব।আমিই ওকে হাতে ধরে ধরে সই করতে শিখিয়েছিলাম।আমার তখন কত বয়স হবে কুড়ি।কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছি। লক্ষীর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই আমার খুব ভাব ছিল।ওকে আমি বোনের মতোই দেখতাম।আর আমার মা তো ওকে চোখে হারাতেন বাবাও তাই।লক্ষী যখন কুড়িতে পা দিল ওর মা তখন ওর বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন।পাত্রও পেয়ে গেলেন বাপ,মা হারা হারাধন।চাষ বাষ করে।আমার মা ওখানে লক্ষীর বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না।উনি চেয়েছিলেন আরও কোনো সচ্ছল ছেলের হাতে ওকে তুলে দিতে।কিন্তু ওর মা জেদ ধরে বসলেন ওখানেই উনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান চোখ বোজানোর আগে।তারপর বিয়েটা হয়ে গেল।আমাদের বাড়ি থেকেই হল।বিদায়ের সময় মায়ের তখন সে কি কান্না আর লক্ষীও কেঁদে কেটে একশা করছিল।যাইহোক ও শশুর বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমারও বিয়ের তোড়জোড় লাগল।কলকাতার ছেলে সত‍্যজিৎ।আমার কোনো অপছন্দের কারন ছিল না কারন আমি চিরকাল কলকাতার ছেলেকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।কলকাতা শহরটাকে আমার ভালো লাগত।তা বলে এই না যে আমার জন্মভূমি আমার গ্রামকে আমি ভালোবাসি না।আমারও বিয়ে হয়ে গেল আমি কলকাতায় চলে এলাম।ওদিকে লক্ষীর সংসারও ভালোই চলছিল।কিন্তু হঠাৎ একদিনই হারাধনের চাষ বাষের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।ব‍্যাস তারপর থেকেই আর্থিক অনটন শুরু হল।আমার মা,বাবা জানতে পেরে লক্ষী আর হারাধনকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন।ওদিকে তখন লক্ষীর মাও মারা গেছেন।লক্ষী আবার আগের মতো কাজ করতে লাগল।আর হারাধনদা আমার বাবার সঙ্গে ব‍্যাবসা সামলাতেন।এদিকে আমার সংসারও দিব‍্যি চলছিল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমাদের সন্তান হচ্ছিল না।যখন প্রায় আমি মা হওয়ার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম ঠিক সেই সময় লক্ষীর কোল আলো করে এক ফুটফুটে কন‍্যাসন্তান এল।নাহ্ এর জন্য আমি কোনো দিন ওকে হিংসা করিনি।কেনই বা করব?ভগবানের যা ইচ্ছা আমি তাই মেনে নিয়েছি।ভগবান হয়তো চাননি আমি কোনো সন্তানের জননী হই বা আমারও কোল আলো করে কোনো সন্তান আসুক।ভগবানের যা ইচ্ছা হবে তাই তো সকলকে মেনে নিতেই হবে।কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারি ভগবান কেন এমনটি চেয়েছিলেন।


গ্রামে যতবার যেতাম ততবারই লক্ষীর ওই ফুটফুটে একরত্তি শিশুটাকে কোলে নিয়ে কত আদরই না করতাম।নিজের কোনো সন্তান ছিল না বলেই হয়তো আমার ওই বাচ্ছাটির প্রতি এত টান ছিল।সম্ভবত লক্ষীও এটা টের পেত তাই তো গ্রামে যখনই গিয়ে থাকতাম তখনই ও আমার কোলে ওর বাচ্ছা মেয়েটিকে দিয়ে বলত,"রিনা দিদি ওকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না।আমার কাছে থাকলে খুব দুষ্টুমি করে"।আমিও তখন সব কাজ ছেড়ে ওই বাচ্ছাটিকে ঘুম পাড়ানোর কাজে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়তাম।এরপর এল সেই ভয়ংকর দিন যেদিন গ্রামে গিয়ে শুনলাম লক্ষী আর হারাধনদা মারা গেছে।এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল ঘুরতে ফেরার সময় মর্মান্তিক বাস দূঘর্টনায় দুজনেই নিহত হয়।ওদের বাচ্ছা মেয়েটির বয়স তখন মাত্র তিন বছর।আমার মাতো দিশেহারা হয়ে গেলেন ওই বাচ্ছাটির কথা ভেবে।তিন বছরের একটা ছোট্ট মেয়েকে উনি যে কিভাবে মায়ের স্নেহ,ভালোবাসা ছাড়া মানুষ করবেন সেটাই ভেবে পেলেন না।প্রায়ই চোখের জল ফেলে বলতেন,"ভগবানের কি নিষ্ঠুর বিচার বল রিনা!বলি কি এমন পাপ, করেছিল আমার লক্ষী যে তাকে ওমন সাত তাড়াতাড়ি তুলে নিল।এখন এই বাচ্ছাটিকে নিয়ে কি করব আমি?হা ভগবান এর থেকে তুমি আমাকে তুলে নিলে পারতে"।আমারও বাচ্ছাটির প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গিয়েছিল।তাই একটু সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।লক্ষীর মেয়েকে আমি মানুষ করব। আমারও মা হওয়ার স্বপ্ন পূরন হবে।মাকে এই কথাটা জানাতে মা খুশি হয়েছিলেন বটে কিন্তু বেশ অবাক হয়ে জানতেও চেয়েছিলেন যে,"তোর যখন নিজের সন্তান হবে তখন কি করবি মা?যতই যাইহোক নিজের সন্তানের প্রতি যে মায়েদের আলাদা একটা টান থাকে"।আমি একটু হেসে বলেছিলাম,"মা আমার যে সন্তান হবে না সেটা তুমি না বুঝতে পারলেও আমি আর সত‍্যজিৎ এতদিনে বেশ বুঝে গেছি।তাই আমরা দুজনে মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তুমি আর আপত্তি করো না মা।আমি ওর মা হতে চাই"।এমন কথা শোনার পর আমার মা,বাবা কেউই আর কোনো আপত্তি করলেন না।ছোট্ট তিয়াশা চলে এল আমার সাথে কলকাতায়।এই তিয়াশা নামটা ওর নিজের মা লক্ষীরই দেওয়া।এখানে নিয়ে আসার পর ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিই।পড়াশোনায় ও বরাবরই ভীষণ ভালো ছিল।তবে পড়াশোনা ছাড়াও ওর আর একটা জিনিস শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল সেটা হল নাচ।নাচতে খুব ভালোবাসত মেয়েটা।সেইজন‍্য ওকে নাচের স্কুলেও ভর্তি করে দিলাম।ওয়েস্টার্ন ডান্স শিখতে লাগল।এইভাবে দেখতে দেখতে কখন যে ও বাচ্ছা থেকে কিশোরী হয়ে উঠল সেটাই টের পেলাম না।স্কুল পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হল।কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও ডান্স করত এমনকি অ‍্যাক্টিংও করত।ওর কলেজে অনুষ্ঠিত রোমিও জুলিয়েট নাটকে ও জুলিয়েটের চরিত্রে এত চমৎকার অভিনয় করেছিল যে কলেজের টিচার থেকে শুরু করে প্রফেসর সবাই ওর ভীষণ প্রশংসা করেছিলেন।কলেজের প্রফেসর বি.কে মুখাজ্জীর এক বন্ধুও ওই নাটকটি দেখতে এসেছিলেন।তিনি আবার সিরিয়াল বানাতেন অর্থাৎ ডিরেক্টর ছিলেন।আমার তিয়াশার অভিনয় ওনার এতটাই ভালো লাগে যে উনি ওনার আগামী সিরিয়ালের জন্য তিয়াশাকে নেওয়ার কথা ভেবে ফেলেন।এই কথাটা তিয়াশার কানে যেতেই ও লাফিয়ে উঠেছিল।আমি বেশ বুঝতে পারতাম ওর অ‍্যাক্টিংয়ের প্রতি একটা ভালোলাগা আছে।ও স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের কাছে পারমিশন চেয়েছিল যে ওই ডিরেক্টর ভদ্রলোককে হ‍্যাঁ বলবে কিনা?সত‍্যজিৎ আর আমি প্রথমে একটু দোনোমনো করলেও পরে ওর মুখের দিকে চেয়ে রাজিই হয়েছিলাম।তারপর ওই সিরিয়ালের জন্য অডিশান দিল এবং প্রায় তিনশো জনের মধ্যে থেকে ওকেই ওরা মেন লিডের জন্য সিলেক্ট করল।ব‍্যাস তারপর থেকে একটু একটু করে ছোটপর্দা থেকে বড়োপর্দায় পা রাখল।ওর অভিনেত্রীর হওয়ার স্বপ্নও পূরন হয়ে গেল।পড়াশোনাটাও অবশ‍্য ছাড়িনি।ইংরেজিতে স্নাতক হয়েছে।আজকের অভিনেত্রী "তিয়াশাকে"সকলেই এক ডাকে চেনে।এর পিছনে আছে ওর কঠোর পরিশ্রম এবং অতি অবশ্যই অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা।রাস্তায় বেরোলে কেউ যখন আমাকে দেখে বলে ওঠে,"ওই দ‍্যাখ অভিনেত্রী তিয়াশার মা যাচ্ছে রিনা দিদি"।বিশ্বাস করুন তখন গর্বে মাথা উঁচু হয় আমার।চোখে জল চলে আসে ।এই যেমন এখন আসছে।মনে হয় আমি সফল হয়েছি।"পেটে না ধরলে নাকি মা হওয়া যায় না "এই যে ধারনাটা আমি ভেঙে ফেলার আপ্রান চেষ্টা করে গেছি সারা জীবন।আমার অন্তরের মাতৃত্ব দিয়েই আমার তিয়াশাকে আমি মানুষ করেছি।কখনও ওকে অবহেলা করিনি।সত‍্যজিৎও তিয়াশাকে খুব ভালোবাসে।আর আমাদের তিয়াশাও আমাদের ভীষণ ভালোবাসে।ও যে আমাদের সন্তান নয় এই কথাটা আমরা ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখিনি।ও সব জানে।ওর বেডরুমে ও লক্ষী আর হারাধনের একটা ছবি লাগিয়ে রেখেছে।রোজ সকালে উঠে প্রনাম করে তারপর বাড়ি থেকে বের হয়।ওর আসল পদবী হালদার আর সৌভাগ্যবশত আমাদেরও পদবী হালদার।ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি আমাদের নাম দিয়েই।আগে ও সারনেম সব জায়গায় লিখলেও এই অভিনয় জখতে আসার পর আর সারনেম ব‍্যাবহার করে না।বলে,"আমার তিয়াশা নামটাই যথেষ্ট মা এই তিয়াশা নামেই সবাই চেনে আমায়।শুধু শুধু পদবী জুড়ে আর নামটাকে বড়ো করার কোনো দরকার নেই "।সত‍্যি আজ আমার তিয়াশার অনেক নাম ডাক হয়েছে,ও আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে।আমারও কোথাও না কোথাও একটা দায়িত্ব শেষ।এবার বাকি আছে ওর বিয়ে দেওয়াটা।এই প্রসঙ্গে বলে রাখি মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে।ওর নতুন ছবি "বিধবার" ডিরেক্টর বিভাস চক্রবর্তীর সাথে মন দেওয়া নেওয়া কমপ্লিট।আমাকে জানিয়েছে সে কথা।আমি তো ওর সাথে সব সময় বন্ধুর মতো মিশেছি তাই ও মন খুলে আমার সাথে সব কথা শেয়ার করে।মেয়ে বলেছে এখনই বিয়ে করতে চায় না আরও কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়িতে বসবে।ওই যে!বাইরে গাড়ির আওয়াজ মেয়ে এসে গেছে।এবার আমাকেও উঠতে হবে।শেষে একটাই কথা বলব মমত্ব সব নারীর মধ্যেই লুকানো থাকে।ভগবান আমায় নিজের সন্তান বোধহয় এইজন‍্যই দেননি।আমার নিজের সন্তান থাকলে কি আমি এতটা আদর,যত্নে তিয়াশাকে বড়ো করতে পারতাম?জানি না।তবে সারা জীবন চেষ্টা করেছি একজন সত্যিকারের মা হওয়ার।জানি না কতটা পেরেছি!!



তুলি - অভিজিৎ দাস || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 তুলি

    অভিজিৎ দাস


 বাইরে সোনাঝরা নরম রোদ । মাঠের সবুজ ঘাসগালিচার ওপর যেন গুঁড়ো গুঁড়ো সোনা মুঠো ভরে ছড়িয়ে দিচ্ছে । ভাইয়ের হাত ধরে দৌড়ে বাগানে এল তুলি । এই সময়টা বাগানটা যেন আরও রঙিন হয়ে যায় । রং বেরঙয়ের প্রজাপতি দল বেঁধে গাছে গাছে উড়ে বেড়ায় । কোনোটা সাদা, কোনোটা হলুদ , কোনোটা নীল আর কালো , কোনওটার গায়ে আবার বিভিন্ন রঙ দিয়ে আঁকা । ভারী সুন্দর লাগে তুলির । শরৎ আসব আসব করছে । নীল আকাশে সাদা মেঘের দল পানসী ভাসিয়ে এক দিক থেকে আরেক দিকে চলেছে ।


        “ দেখ দিভাই, কি সুন্দর ওই প্রজাপতিটা !” – টিটু বলল ।


“ হ্যাঁ , নীল আর সাদা রঙের ওপর কালো গোল গোল ফুটকি । খুব সুন্দর । ”


ওহ , বলতে ভুলেই গেছিলাম । তুলির ভাইয়ের নাম টিটু । একমাথা ঝাঁকড়া চুল । টানা চোখদুটোতে স্বপ্ন ভরা ।


প্রতিদিন সকালে তুলি আর টিটু বাগানে চলে আসে । ওদের বাড়ির একপাশে লম্বা বাগান । সামনের দিকে সবুজ ঘাসের লন । সকালের দিকে একঝাঁক ছাতারে পাখি আসে । ওদের ক্যাঁচর-ম্যাচরে ঘুম ভেঙে যায় তুলির ।


         একটা সাদা-কালো প্রজাপতি বসেছে ওই টগর ফুলের ওপরে । তুলি একটু এগিয়ে যায় । ধুস্ ! দু পা এগোতেই টুক করে উড়ে যায় । বড্ড দুষ্টু প্রজাপতিটা । আর একটু এগোয় তুলি । টগরের পাশে একটা জবা গাছ । লাল টুকটুকে জবা ফুলে গাছ ভরে আছে । জবা গাছটায় ছোট্ট ছোট্ট দুটো প্রজাপতি উড়ছে । সাদা রঙের । আবার ডানার নিচের দিকে কমলাটে ছোপ আছে ।


  ‘ আরে ! এগুলো কী । ’- মনে মনে বলেই একটা পাতা তুলে ধরে তুলি । পাতার নিচের দিকে খুব ছোট্ট ছোট্ট দানা লেগে আছে । একসাথে অনেকগুলো । তুলি এগুলো ভাল করেই চেনে । ওই প্রজাপতি দুটোর ডিম । মা দেখিয়েছিল আগে । ভাইকেও দেখায় তুলি । কী সুন্দর লেগে আছে পাতার নিচে । যতই ঝাঁকাও, পড়বে না ।


       বেশ কিছুদিন কেটে গেল । তুলি রোজই একবার করে গিয়ে ডিমগুলো দেখে আসে । অবশ্য একা যায় না । টিটুও সঙ্গ নেয় । বাবা সবসময় বলে , ‘প্রকৃতি হল সবচেয়ে বড় বই । এখান থেকে যা শিখবে , কোনও বইতে পাবে না ’ । মাঝখানে


দুদিন বৃষ্টি হয়েছিল । তাই বাগানে যেতে দেয়নি মা । কিন্তু তুলির খুব ইচ্ছে করে বৃষ্টির পর বাগানে আসতে । বাচ্চা শামুকগুলো বেরোয় । তারপর কমলা রঙের ফড়িং ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় । কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ । কী আর করবে তুলি ! তাই আজ বাগানে এসেই ছুটে গেল জবা গাছটার দিকে । ডিমগুলো আর নেই । তার জায়গায় খুব ছোট ছোট সবুজ রঙের পোকা হয়েছে । দিব্বি পাতার মধ্যে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে ।


পাতাটার গায়ে এক টুকরো লাল সেলোটেপ লাগিয়ে দিল তুলি । যাতে করে একবার দেখলেই চেনা যায় । সবই ঠিকঠাক চলছিল । গন্ডগোল বাঁধল অন্য জায়গায় । পড়তে বসে খালি ওই ডিমগুলোর কথা মনে পড়ে । কেমন হয়েছে ডিমগুলো , ফুটবে কখন , বাচ্চাগুলো কেমন দেখতে হবে ......এইসব । যথারীতি নামতা বলতে গেলে ভুল হয় । ইংরেজি বানান লিখতে গেলে অ্যালফাবেট বাদ চলে যায় । অথচ তুলি সব পারে । এইতো কাল সন্ধ্যেবেলা মা পড়াতে বসে ধাঁই করে পিঠে একটা বসিয়ে দিল । কারণ ? তুলি গুণ অঙ্ক করার সময় সাত দুগুনে চৌদ্দ র বদলে ষোল লিখে ফেলেছিল ।


      কিছুদিন কাটল এভাবে । তারপর একদিন তুলি আবার বাগানে গেল । কোথায় ডিম ! ছোট ছোট সবুজ রঙের শুঁয়োপোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে । আর পাতার ধারগুলো কুরে কুরে খাচ্ছে । শুঁয়োপোকাগুলোর গায়ে রোঁয়া কম । দেখলেই বোঝা যায় নরম তুলতুলে । ফিসফিস করে ওদের সাথে কথা বলে তুলি । বলে, ‘এখন পেট পুরে পাতা খেয়ে নাও । প্রজাপতি হলে উড়তে শক্তি লাগবে ।’


 সেদিনের মতো ঘরে চলে আসে তুলি । কয়েকদিন পর আবার গেল ।


         তুলিদের বাড়িটা অনেক বড় । বাড়ির পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে পিচের রাস্তা চলে গেছে । তার ওপাশে সরস্বতী নদী । নদীর ধার বরাবর সবুজ ঘাসের পাড় । পাড় ধরে হাঁটলে সারাটা রাস্তা শিরশিরে বাতাস । মাঝেমধ্যে একআধটা কৃষ্ঞচূড়া গাছ । পাতার ফাঁকে আগমনী শরতের নীল আকাশ কাঁপে । নদীতে জল তেমন থাকে না । তবে বর্ষায় দুকূল কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায় । নদী ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে একটা ব্রিজ । ওর ওপর দিয়ে চলে গেছে দিল্লী রোড ।


        এবার তুলি একটা পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে এসেছে । এই কদিনে একটু বড় হয়েছে শুঁয়োপোকাগুলো । এখন এক একজন আলাদা আলাদা পাতা খাচ্ছে । পাতা ধরে একটু ঝাঁকুনি দিতেই টপাটপ বাক্সের মধ্যে পড়ে গেল শুঁয়োপোকাগুলো । তুলি গুনল । মোট পাঁচটা । তারপর বেশ কিছু পাতা ছিঁড়ে বাক্সে ফেলে দিল । মনে মনে ঠিক করল , বাক্সটাকে মায়ের আড়ালে ঘরে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে । এই ভেবে যেই না পেছন ঘুরেছে তুলি , সাক্ষাৎ মূর্তিমান দাঁড়িয়ে । টিটু যে নিঃশব্দে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে , টের পায়নি । উফ্ , এই ছেলেকে না দেখিয়ে কিছু করার উপায় নেই । না হলেই মা র কানে তুলে দেবে ।


    আকাশে তখন পালতোলা মেঘের নৌকো । তুলি শুঁয়োপোকাগুলো নিয়ে ঘরে চলে এল । বইয়ের কাবার্ডের একেবারে নিচের ড্রয়ারটায় বাক্সটা ঢুকিয়ে দিল । ব্যস্ । আর মায়ের চোখ পড়বে না ।


      তুলি রোজই রাতে শোওয়ার সময় একবার করে ওগুলোকে দেখে আর বাগান থেকে পাতা এনে খেতে দেয় । কিন্তু চিন্তার বিষয় হল , যেমন খাচ্ছে শুঁয়োপোকাগুলো , ঠিক সেই পরিমাণ পটি ও করছে । এই ক’দিনে বাক্সটা নোংরা করে ফেলেছে । তবুও কিছু করার নেই । মা জেনে গেলেই মুশকিল ।


  সেদিন ছিল রবিবার । আগের দিন বাক্সটা দেখা হয়নি । শুতে গিয়ে তুলির হঠাৎ খেয়াল হল । বাক্সের ঢাকনা খুলতেই চোখদুটো আনন্দে ভরে উঠল । শুঁয়োপোকাগুলো আরও বড় হয়েছে । গায়ে বাদামী রঙের বুটি বুটি দাগ এসেছে । রোঁয়াগুলো আরও বড় ও ঘন হয়েছে ।


‘এই তো ! প্রজাপতি হওয়ার দিকে এগোচ্ছে ।’ – তুলির মন আনন্দে নেচে উঠল ।


বেশ কিছুদিন কেটে গেল । এখন শুঁয়োপোকাগুলো নড়াচড়া কম করে । আগের তুলনায় মোটা হয়েছে ।


একদিন তুলি দেখতে পেল, শুঁয়োপোকাগুলো আর নড়ছে না । বরং চারপাশে সবুজ রঙের মসৃণ আস্তরণে ঢেকে স্থির হয়ে গেছে ।


‘এগুলো কি রে দিদি ?’ – টিটু জিজ্ঞেস করে বসল ।


‘এগুলোকে বলে গুটি । এখান থেকেই প্রজাপতি বেরোবে কদিন পর ।’


আরও দু সপ্তাহ মতো চলে গেল । একদিন দুপুরবেলা তুলি পুতুল নিয়ে খেলছিল । হঠাৎই ড্রয়ারের মধ্যে কিছু একটা নড়াচড়ার শব্দ পেল । তাড়াতাড়ি উঠে ড্রয়ারটা টানতেই ...... আরে বাঃ! সাদা ধবধবে তিনটে প্রজাপতি ! ...... আর ঐ যে আরেকটা বেরিয়েছে । হলুদের ওপর কমলা কালো র বুটি দেওয়া।


পুতুল ফেলে আনন্দে নাচতে নাচতে ভাইকে ডাকতে চলে গেল তুলি । দুজনে মিলে সারাটা দুপুর দেখল প্রজাপতিগুলোকে । রাত্রে খেতে বসে মা কে সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল তুলি । তবে মায়ের মুডটা সেদিন ভালই ছিল । তাই সব শুনে শুধু বলল, প্রজাপতিগুলোকে ছেড়ে দিতে । নাহলে ওদের কষ্ট হবে ।


নাঃ ! শুধু মায়ের মুড ভাল বললে হবে না । সেদিন তুলি সাতটা বড় বড় ভাগ অঙ্ক একেবারে ঠিক করেছিল । সেটাও ভাবতে হবে ।


          সকাল হল । সূর্যদেব হাসি হাসি মুখে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন । তুলি আজ একটু তাড়তাড়িই উঠে পড়েছে । মাথার কাছের জানালাটা দিয়ে কাঁচা সোনার মতো রোদ এসে পড়েছে । তুলি আগে বাক্সটা খুলল । সবকটা প্রজাপতি বেশ বড় হয়ে গেছে । বাক্সটা নিয়ে জানালার ধারে এনে রাখল । একে একে বেরোতে লাগল প্রজাপতিগুলো । একটা , দুটো করে মোট পাঁচটা । ওদের ডানার লাল, হলুদ, কালো, বাদামী রঙের ডিজাইনগুলো যেন সূর্যের আলোয় আরও বেশী করে উজ্জ্বল লাগছে । ওরা যেন আজ নতুন আনন্দে নেচে নেচে চলেছে । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুলি ।


     টিটু পাশ থেকে বলল, ‘দেখ্ দিদি, ওই প্রজাপতিটা কী সুন্দর !’


- হ্যাঁ , ওই কমলা কালো টাই সবচেয়ে সুন্দর !


 


ঘিলুছাড়া পল্লব - সৌমেন দেবনাথ || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 ঘিলুছাড়া পল্লব 

সৌমেন দেবনাথ 


পল্লবের সাথে বিকালের অবসর সময়টা কাটাই। সহজ-সরল মানুষ, অনেকটা আলাভোলা। কোনদিন দুজনে এক কাপ করে চা খাই, কোনদিন একটি করে চিতই পিঠা খাই নানা পদের ভর্তা দিয়ে। পাঁচ-দশ টাকায় শরীর গরম।


নানা গল্প করি। কথা বলতে খরচ হলে অত কথা বলতাম না। জ্ঞান দিই তাকে সারাক্ষণ। ঘিলুছাড়া মানুষ পেলে সবাই-ই জ্ঞান দেয়। শোনেই কেবল, মনে হয় না সেসব কথা সে কানে রাখে। তবে তার ভালো চাই বলে কথাগুলো বলি। একসাথে ঘুরি-ফিরি, কেউ তাকে ঠকালে খারাপ লাগে। তার ভালো চাই, তাই তাকে জ্ঞান দিই। কিন্তু সে ঠকেই যায়, তবুও খাটা-খাটি করে গরুর মতো, মোষের মতো। গরু আর মোষ খাটতে পারে, কিন্তু মাথার ভেতর বুদ্ধিটুকুও নেই বলে পরিশ্রমের দাম পায় না।


ওদিকে পল্লব যার কাজ করে দেয় তাকে পেয়েই আমি তাকে যেসব জ্ঞানের কথা বলেছি সব বলে দিলো। বুদ্ধিহীন তো এসব করবেই। কাজ করে দেয়, সারাটা দিন কাজ করে দেয়। দিন শেষে পরিশ্রমের যে দাম, তা তো সে পায় না, দেখলেই খারাপ লাগে। যার ভালো চায়, তার খারাপ দেখলে খারাপ লাগে।


নজর চাচা আমাকে পেয়ে গরম দিলো। আর যেন কুবুদ্ধি পল্লবকে না দেই জানিয়ে দিলো। ভালো বুদ্ধিও কুবুদ্ধি হয়ে যায় অপাত্রে বিলালে। পল্লব বিকালে আর আমার সাথে ঘোরে না। কাজের বিনিময়ে টাকা পেলে মানুষ তার সান্নিধ্যেই থাকবে, ফ্রিতে জ্ঞান বিলালে তার সাথে থাকবে না।


আত্মার সম্পর্কগুলো হেরে যায় আর্থিক সম্পর্কগুলোর কাছে।

মাহেশ্বরী - কবিতা ধর || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 মাহেশ্বরী

   কবিতা ধর

 


মোহন বাবু সকাল বেলায় বাজারে বেরিয়েছেন । সকাল বেলায় বাজারের এদিকটায় বেশ ভিড় থাকে। হঠাৎ দেখেন সবাই সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।একটু এগিয়ে গিয়ে দেখেন সামনে একটা কালো বিড়াল আহত হয়ে রাস্তায় শুয়ে আছে।মোহন বাবু মনে মনে হাসলাম সারাদিন মানুষের কত ব্যস্ততা অথচ একটা বিড়াল রাস্তায় আছে বলে তার ভয়ে মানুষ একটুও নড়ছে না। বাড়ি ফিরে এসে সারাদিন ধরে সারাবাড়িতে আলপনা দিয়ে চলেছে অপটু হাতে। মাটির প্রদীপ গুলো জ্বালাতে গিয়ে মোহন বাবুর মনে পড়ে এই আগুনেই বলি হতে চলেছিল তার একমাত্র অন্তঃসত্বা মেয়ে শ্বশুরবাড়ির ষড়যন্ত্রে । আজ প্রদীপের আলোয় বাড়িটা খুব স্নিগ্ধ লাগছে।গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে বরণ ডালার থালাটা হাতে নিয়ে ছুটে যায়।গাড়ি থেকে নেমে তার সহধর্মিনী আর তার একমাত্র মেয়ে তুহিনা।মেয়ের কোলে তোয়ালে জড়নো পাঁচ দিনের ছোট্ট এক রত্তি।তার আদরের নাতনি।


সদর দরজায় নাতনিকে বরণ করে মোহন বাবু। উঠোনে পা দিয়ে তুহিনা আর তার মা অবাক হয়ে যায়। তুহিনা বলে " বাবা আজ তো লক্ষ্মী পুজো নয়।আজ যে কালী পুজো। তুমি সারা উঠোনে লক্ষ্মীর চরণ একেছ কেনো?" মোহন বাবু বলে আজ যে মহালক্ষ্মীর ও পূজো রে মা।আমার নাতনি তো আমার মহালক্ষ্মী। তুহিনা বলে কিন্তু ও যে মা কালির রূপ নিয়ে জন্মেছে।আর বাবা তুমি তো আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করলে না। মোহন বাবু তার একমাত্র নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন "কালো বিড়ালনী হও" এই কথা শুনে তুহিনার র চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে।


মোহন বাবু তার অভিমানী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে “বিড়াল কালো হোক বা সাদা দুজনেই তো মা ষষ্ঠীর সন্তান । তবে কালো বিড়াল এর কথা শুনে তোর মন খারাপ হচ্ছে তাই না রে। সে শুভ না অশুভ টা তো মানুষের তৈরি।তবে একটা জিনিষ খেয়াল করেছিস কখনো,কালো বিড়াল যখন সামনে দাঁড়ায় তখন সবাই তাকে রাস্তা ছেড়ে দেয়।আমার নাতনিকেও সেইরকম সাহসিনী বানাব। সে যখন দাঁড়াবে সবাই তাকে রাস্তা ছেড়ে দেবে। তোকেও যদি এমন সাহসিনী বানাতে পারতাম তাহলে তোর শ্বশুরবাড়ির লোক তোকে পুড়িয়ে মাড়ার সাহস পেত না। তুই নিজেই তো তোর মেয়ের রূপ নিয়ে চিন্তিত। তাই আমি ওকে এমন ভাবে তৈরি করবো যাতে ওকে সবাই ভক্তিতে না হলেও ভয়ে ভজবে ।ওর অন্তর হবে মহালক্ষীর র মত স্নিগ্ধ।আর বাহিরে থাকবে মহাকালীর মত তেজ ।তাই আজ কালী পুজোর দিনে কালীমায়ের নামে ওর নাম রাখলাম। ওর নাম হল মাহেশ্বরী।

পিপাসা - রথীন্দ্রনাথ রায় || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

  পিপাসা 

  রথীন্দ্রনাথ রায়



রোহিত আঢ্য। ওর খুব একটা যে বড় স্বপ্ন ছিল, তা নয়। তবে বাবা মায়ের কষ্ট লাঘব করতে খুব সচেষ্ট ছিল সে। গ্রাম থেকে মানে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকেই উঠে এসেছে। এলাকার কলেজ থেকে বি কম পাশ করার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম বি এ করেছে। বন্ধুরা বলেছিল, বি কম পাশ করে তেমন কিছু হবেনা। তোকে আরও কিছু করতে হবে। সেই আরও কিছুর জন্য এম বি এ তে ভর্তি হওয়া। এর জন্য ওকে দুবেলা টিউশানি পড়াতে হতো। তারপর এমবিএর ক্লাসে আসতে পারতো। তারও পর ছিল রাত জেগে পড়াশোনা। ফলও ভালোই হয়েছিল। এমবিএ তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। খুব আনন্দ হল তার। কিন্তু তেমন ভাবে প্রকাশ করলনা। যেন কিছুই হয়নি। তবে বাড়ি ফিরে বাবা মাকে প্রনাম করে আশির্বাদ নিয়েছিল। 
এর আগে কয়েকটা কর্পোরেট সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদনও করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে তেমন কোনও রেসপন্স আসেনি। তাই আবার নতুন করে আবেদন করতে মনস্থির করল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ওর মোবাইলে রিং টোন বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে দেখল ডিপার্টমেন্টাল হেড সুমন্তবাবু --
-- স্যার, ভালো আছেন ? 
-- হাঁ, আছি। কালই মুম্বাইয়ের একটি সংস্থা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নিতে আসছে। তুমি চলে এসো। 
-- স্যার ? 
-- ঠিক দুটোর মধ্যে। এখন রাখছি, কাল কথা হবে। 
রোহিত নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। স্যার নিজে ডাকছেন ! 
তাছাড়া ইতিপূর্বে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে সে যায়নি। কেমন হবে ব্যাপারটা কে জানে ? যদিও স্যার তার পাশে থাকবেন। তবু একটা আশঙ্কার দোলাচল থেকেই যায়। ওইসব সংস্থায় ওয়ার্ক কালচার কেমন , সে জানেনা। তবে কর্পোরেট কালচার নিয়ে সে কিছু পড়াশোনা করেছে এবং শুনেছেও কিছু। 
ওদের সবকিছুই নাকি কেতাদুরস্ত । ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিচ্ছদ, চলন বলন সবকিছুই। 
আগামীকাল ইন্টারভিউ। রাতটুকু সময়। তার জানার ব্যাপারে সে একশো শতাংশ আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু সাজপোশাক এবং বাচনভঙ্গি নিয়ে তার একটু খুঁত খুঁতুনি আছে। যদিও সে ব্যাপারে স্পোকেন ইংলিশের ক্লাসে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। তবু শেষ পর্যন্ত কি হবে কে জানে ! 
কাল ঠিক দুটোর মধ্যে। তাহলে রাতটুকু মাত্র সময়। মাকে বলল , কাল একবার বর্ধমান যেতে হবে।
-- ক'টায় যেতে হবে ? 
-- বাড়ি থেকে ন'টা নাগাদ বেরোলেই চলবে। 
-- তাহলে সকাল সকাল রান্না করে দেব ? 
-- না মা, ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনেই খেয়ে নেব। জানো মা, এটা যদি হয়ে যায় তাহলে তোমাদের আর কষ্ট পেতে হবেনা। 
-- আমাদের কষ্টের কথা ভাবিনা, তুই নিজের পায়ে দাঁড়ালেই আমরা খুশি। 
মা রান্নার কাজে চলে গেলেন।্য্য্য্য্য্য্য্্য্য্য্য্য্য 
যেন সদা ব্যস্ত। একটুও কথা বলার সময় নেই। 
পরদিন যথা সময়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছাল রোহিত। স্যার যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। 
আরও অনেকেই এসেছে। তবু স্যার যেন ওকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ও যেতেই আশ্বস্ত হয়ে বললেন, যাক তুমি এসে গেছো ! আমি খুব খুশি। আর তুমি সিলেক্ট হলে আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই সুনাম হবে। ব্যাপারটা মাথায় রেখো।
ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিল রোহিত। ওর সি ভি দেখে এবং ওর সঙ্গে আলোচনা করে খুশি হল মুম্বাইয়ের সংস্থাটি। ওর হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক'বে জয়েন করতে পারবেন। 
-- যখন বলবেন ? 
-- ঠিক আছে। আমরা আপনাকে নেক্সট্ উইকে কোম্পানি ডিটেইলস আ্যন্ড প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দেব।
-- থ্যাঙ্কস।
এবারও তার আনন্দ হল বটে কিন্তু প্রকাশ করলনা। বন্ধুরা বলে, ও নাকি বড্ড বেশি ইন্ট্রোভার্ট। উচ্ছাসে ভেসে যাওয়া ওর স্বভাব নয়। 
কয়েকদিন পরেই একটা পার্সেল এল ওর বাড়িতে। কোম্পানি ডিটেইলস এবং প্লেনের টিকিট। আগামীকালই যেতে হবে। 
না, আর কোনও কিন্তু নয়। ও তো চেয়েছিল যা হোক একটা কিছু। কিন্তু এ তো যা হোক একটা কিছু নয়। দ্য এশিয়ান -- একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদের সাম্রাজ্য। চাকরিও হবে, আবার ঘুরে ঘুরে দেশ দেখাও হবে। মুম্বাইয়ের জুহুতে শ্রীরাম হাইটসের ছাপ্পান্ন তলায় এদের অফিস। তার মানে আকাশের সাথে হবে তার বন্ধুত্ব। সুতরাং আর পিছিয়ে থাকা নয়। 
দুপুর বারোটায় ওর ফ্লাইট। সুতরাং বাড়ি থেকে ওকে বেশ সকাল সকাল বেরোতে হল। একটা টেনশন ছিলই। কাজটা কেমন কাজ ? কিছুই জানেনা সে। সম্পূর্ণ অপরিচিত। নানারকম ভালোমন্দ ভাবনায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি সে। ইতিমধ্যে নিজের ব্যাগটা নিজেই গুছিয়ে নিয়েছে। এই ভোরে বাবা মা দুজনেই উঠে পড়েছে । রোহিত বেরোবার সময় বলল, তোমরা কিচ্ছু ভেবোনা, আমি নিয়মিত তোমাদের ফোন করব। 
প্রনাম করে উঠে দাঁড়াল সে। 
বাবা বললেন, তুমি ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব। ব্যাগটা বাবার হাত থেকে নিল রোহিত। এ পর্যন্ত তো আমার ভার তুমিই বহন করেছ। এবার আমাকে সুযোগ দাও। 
-- তাই বুঝি ! ছেলে আমার কতো বড়ো হয়ে গেছে । 
মা ওর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন, ভালো থাকিস বাবা। 
বেরিয়ে পড়ল রোহিত। কিন্তু বর্ধমান স্টেশনে এসে সে আশ্চর্য হল। সায়ন্তিকা। সায়ন্তিকা রক্ষিত। ওকে তো সে মুম্বাই যাওয়া নিয়ে কিছু বলেনি। তাহলে ও জানল কেমন করে ? এটা টেলিপ্যাথি না মনোপ্যাথি কে জানে ? 
সায়ন্তিকা ওর কাছে এসে বলল, তুই লুকিয়ে লুকিয়ে মুম্বাই যেতে চেয়েছিলি । ভেবেছিলি তোকে সি অফ করার কেউ নেই ? 
-- না রে, সেরকম কিছু ভাবিনি। ভেবেছিলাম মুম্বাই পৌঁছে তোকে ফোন করব। তারপর ওখানে সেটল হয়ে তোদের বাড়ি আসব। 
-- ভালো খবরটা আমাকে জানাতে পারিসনি ! আর সত্যি আমি ূ ফেললাম ! এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিস ? আসলে তোর আমার সম্পর্কটা বাহ্যিক নয়, আন্তরিক। রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখলাম, তুই মুম্বাই চলেছিস। আর তোকে আমি সি অফ করতে স্টেশনে এসেছি । 
রোহিত ওর চোখদুটোর দিকে চেয়ে থাকে। ওর চোখের েে
গভীরে সে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। বলে, কিছু মনে করিসনা আমি তোর ছিলাম , আছি , থাকব ।
-- ঠিক আছে বাবা, ঠিিক আছে। শোন, তোর ট্রেন ক'টায় ? 
-- আটটা কুডিতে। 
-- বেশ এই খাবারটা রেখে দে। সকালেই বানিয়েছি। 
-- তুই ? 
-- হাঁ। কেন, আমি পারিনা নাকি ? 
-- পারিস । তবে -- 
-- তবে ? 
-- বলবনা।
-- তুই না একই রকম আছিস। খাবি কিন্তু।
-- নিশ্চয়। তুই নিজের হাতে বানিয়েছিস, আর আমি খাবোনা সে কি হয় নাকি ? 
খাবারটা ব্যাগে রেখে দিয়ে ধীরে ধীরে প্লাটফর্মের দিকে পা বাড়ায় রোহিত। 
সায়ন্তিকা হাত নাড়তে নাড়তে বলে, সাবধানে থাকিস। 
পর্ব দুই
ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনালে পৌঁছে রিসেপশন এল রোহিত। উদ্দেশ্য সংস্থার তরফে যদি কেউ থাকে তাহলে তার পক্ষে অফিসে পৌঁছাতে অসুবিধে হবেনা। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল দ্য এশিয়ানের ব্যাজ এবং টুপি পড়ে এক ভদ্রলোক ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ভদ্রলোক কাছে এসে বলল, এক্সকিউজ মি, আর ইউ রোহিত আঢ্য ? ফ্রম ওয়েষ্ট বেঙ্গল?
-- ইয়া। ইউ ?
-- রাও গনেশন, দ্য এশিয়ান। আপ হিন্দি সমঝতে ? 
-- থোড়া। লেকিন বোলনেমে কভী কভী দিক্কত আতা হ্যায়। 
-- জরুরৎ মে দিক্কৎ নেহি রহেগা। ম্যায় তেলেগু। অন্ধ্রকা আদমী মগর অব আসানী সে হিন্দি বোল শক্তা হায়। 
লোকটাকে ভালো বলেই মনে হল রোহিতের। বেশ টকেটিভ মানে কথা বলতে ভালোবাসে। তার মতো মুখচোরা নয়। ওদের গাড়িটা মসৃন গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। তার মানে এসি আছে নিশ্চয়। দ্য এশিয়ান -- একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বলে কথা। একটা ট্রাফিক সিগন্যালে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল গাড়িটা। তারপর আবার এগিয়ে চলল। দুপাশে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং। কতগুলো ফ্লোর হবে কে জানে ? দুপাশে অজস্র গাড়ি। তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িটা। 
মাঝে গনেশন একবার বলল, আপ বাঙালি হ্যায় না ?
-- হাঁ।
-- হমারা বস্ মীন সিইও ভি বাঙালি। 
-- আদমী ?
-- নেহি। আউরৎ। লেকিন বহোৎ মেজাজী। ম্যায় তো ফোর্থ ক্লাস হুঁ। ইসলিয়ে পাশ নেহি গ্যয়া । দূর সে দেখা। বলতে বলতেই গাড়িটা জুহুর মেরিন ড্রাইভের ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল। রাস্তাটা মসৃন। মানে কোথাও খানাখন্দ বলতে নেই। গাড়ি আশি - একশোতে ছুটলেও কোনও ঝাঁকুনি লাগছেনা। ডানদিকে নীল আরব সাগর আর তার বেলাভূমিতে অজস্র রঙিন মানুষের ভিড়। কেউ বলে মুম্বাই এক আজব নগরী। বেচারা বচ্চন ( অমিতাভ ) কলকাতায় পাত্তা করতে না পেরে মুম্বাইতে এসে বিরাট এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।‌
স্বপ্ন সে দেখে। কর্পোরেট জগতের। সুন্দর পিচাইয়া কি তার থেকেও ওপরে উঠতে হবে তাকে। গাড়িটা একটা বড় বিল্ডিং এর সামনে এসে থামল। দুজন সিকিউরিটি গার্ড লোহার গেট খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল। 
গনেশন সিকিউরিটির খাতায় লেখালেখি করে তার কাছে ফিরে এসে ফিরে এসে বলল, চলিয়ে সাহাব।
-- সাহাব নেহি, রোহিত।
-- ম্যায় তো ফোর্থ ক্লাস হুঁ !
-- ওসব ছোড়িয়ে। মিত্র শোচিয়ে। 
-- ঠিক হ্যায় --
গাড়ি থেকে নেমে বেশ বড় একটা লাউঞ্জ পার হয়ে ওরা লিফটের সামনে এসে থামল লিফট এখন টপ ফ্লোরে আছে মানে একশো দুইয়ে -- তার অর্থ এই শ্রীরাম হাইটসে একশো দুটি ফ্লোর আছে। আর ওদের অফিস ছাপ্পান্ন তলায়। 
লিফট গ্রাউন্ডে এসে থামল। বেশ কয়েকজন কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এল লিফট থেকে। ওরা কোন ভাষায় কথা
বলছে কে জানে ?
গনেশন লিফ্টম্যানকে বলল, ফিফটি সিক্স।
একটার পর একটা ফ্লোর পার হয়ে চলল লিফট। রোহিত কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। স্বপ্নকে ছুঁতে পারার একটা রোমান্টিকতা এবং ভয় দুটোই একসঙ্গে তার বুকের ভেতর ধুকপুকুনি শুরু করেছে।
এইচ আরও হেমন্ত সাকসেনা রোহিতের কাগজপত্র দেখে নিয়ে বললেন, শোচিয়ে মত্। নিয়োগপত্র মিল গিয়া, জয়েনিংভি হো গিয়া। অব আপকা বিশ্রাম কি জরুরৎ হ্যায়। 
কলিং বেল টিপতেই পিয়ন টাইপের একজন লোক এসে হাজির হল। হেমন্তবাবু তাকে বললেন, সাহাবকো হমারে রেসিডেন্সমে লে যাও। রুম নাম্বার সেভেনটিন সাহাবকা রেসিডেন্স হ্যায়। চাবি লো আউর সাহাবকো সবকুছ সমঝা দেনা। 
লোকটা চাবি নিয়ে রোহিতকে বলল, আইয়ে জী, ম্যায় হুঁ রাজ শ্রীনিবাসন, কেরলসে আয়া।
-- ম্যায় রোহিত আঢ্য । পশ্চিম বঙ্গালসে।
হাতজোড় করে নমস্কার করল রোহিত। 
লোকটা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি হাতদুটোকে বুকের কাছে এনে বলল, নমস্তে সাহাবজী।
  বেশ কয়েকটা ঘর পার হয়ে একটু ফাঁকা মতো জায়গায় দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে সমুদ্রটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আদিগন্ত নীল জলরাশি। বিকেলের সোনালী রোদ যেন মায়াবী আলোয় রাঙিয়ে দিয়েছে নীল সমুদ্রকে।
পাশেই একটা ক্যান্টিন। কিছু স্ন্যাকস্, চা এবং লস্যির ব্যবস্থা রয়েছে বলে মনে হল।
শ্রীনিবাসন রোহিতকে বলল, লস্যি লিজিয়ে না সাহাব, মুম্বাইকা লস্যি বহুত মিঠা হোতা হ্যায়। 
-- ঠিক হ্যায়, লিজিয়ে। লেকিন খর্চ ম্যায় দুঙ্গা। 
-- ও সাহাব, আপকো খাতিরদারি করনেকা মওকাভি নেহি দেঙ্গে ? বাঙালি লোগ বহুৎ ঈমানদার হোতা হ্যায় য্যায়সে বিবেকানন্দ, সুভাষ বোস কি মাফিক।
বিবেকানন্দ, সুভাষ -- বাঙালির আইকন। কিন্তু আজ দুনিয়ার সেরা ধান্দাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্তরা হল নব্য বাংলার আইকন। 
শ্রীনিবাসন দুগ্লাস লস্যি নিয়ে এল। সমুদ্রের দিকে চেয়ে রয়েছে রোহিত। বেশ ভালো লাগছে ওর। শ্রীনিবাসন লোকটাও বেশ। কতো তাড়াতাড়ি একজন অপরিচিতকেও বন্ধু বানিয়ে নিতে পারে।
পর্ব তিন
শ্রীনিবাসন ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় কি আছে সেটাও বুঝিয়ে দিল। রোহিত দেখল ব্যবস্থা বেশ উত্তম। একটা বেডরুম, ড্রয়িং, কিচেন, আ্যটাচড্ ওয়াশরুম -- সবই আছে। সমুদ্রের দিকে খোলা বারান্দা। কাকে ধন্যবাদ দেবে ? ভাগ্যকে না দ্য এশিয়ানকে ? 
অবশ্য তার ভাবনাটা ভেবেছিলেন সুমন্তবাবু। সুযোগটা এনে দিয়েছিলেন তিনিই । একটু ফ্রেশ হওয়ার পরে স্যারকে ফোন করে প্রনাম জানিয়ে বলল, স্যার আপনি যদি এটাকে আমার উন্নতির প্রথম ধাপ বলেন তো এর কারিগর আপনিই। আপনার জন্যই এখানে আসতে পেরেছি। 
-- ব্রাভো,মাই বয়। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। আরও, আরও -- 
অনেক কিছু বললেন স্যার। 
স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে বাবা মাকেও ফোনে প্রনাম ও কুশল জানাল সে।
সবশেষে সায়ন্তিকা। ও ফোন ধরেই বলল, যাক বাবা মনে পড়েছে। 
-- হাঁ পড়েছে। কিন্তু -- 
-- কিন্তু আবার কি ? তুই না বড্ড ভীতু। 
-- না রে, তা নয়। আসলে -- একা এই এতো দূরে আরব সাগরের তীরে আমি খুঁজে ফিরি যারে --
-- এই সাবধান, আর কাউকে খুঁজছিস না তো ?
-- যা:,তুই না বড্ড বেরসিক। তোর সঙ্গে আর কথাই বলবনা।
কলটা কেটে দিল রোহিত। 
এবার ফোন করল সায়ন্তিকা। বলল, প্লীজ রাগ করিসনা। জানিসই তো, আমি ঠিকঠাক কথা বলতে পারিনা। 
-- জানি বলেই রাগ করিনি। এখন রাখি। সারাদিন খুব ধকল গেছে। এখন স্নান করতে হবে। 
-- বেশ রাখছি। তুই ভালো থাক। 
আর কোনও কথা হলনা। স্নান সেরে বুঝতে পারল এবার ক্ষিধে পেয়েছে। ফুড সাপ্লাইয়ের চেইনের একটা নাম্বার দিয়েছিল শ্রীনিবাসন। সেটায় ফোন করতেই ওরা খাবার দিয়ে গেল। বেশ সুস্বাদু। তবে ঘরানাটা কোন্ প্রদেশের মনে করতে পারলনা। 
  পরদিন ঠিক দশটাতেই ও অফিসে এসে আ্যডমিনিস্ট্রেশনে আসল। অফিসার জগন্নাথ সুব্রহ্মনম যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। বললেন, আপ রোহিত আঢ্য ? 
-- ইয়া।
-- আপকো রেগুলার ইহা আকে রেজিস্টারমে সিগনেচার করনে পড়েগা। উসকে বাদ আপকা প্লানিং সেকসনমে -- আপকা সিনিয়র ভূপেন্দ্রজী আপকো হেল্প করেগা। কোঈ দিক্কত হোনেসে মুঝে ফোন করনা। 
ফোন নাম্বারটা নিল রোহিত। 
অফিসের সাজানো গোছানো ঝাঁ চকচকে পরিবেশ বেশ ভালো লাগে তার। বেশ কয়েকটা সেকশন পার হয়ে প্লানিঙ আ্যণ্ড ইনফরমেশন সেকশনে এল সে। সিনিয়র অফিসার ভূপেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ হতেই বুঝতে পারল অমায়িক ভদ্রলোক তিনি। বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা। কিন্তু বিয়ে করেছেন মালদা জেলার একটি মেয়েকে। 
মেয়েটি ট্রেনে ভিক্ষে করত। পুলিশ এবং স্টেশনের হকারদের দ্বারা অত্যাচারিত হত। যাওয়া আসার পথে একদিন বলেছিলেন, " তুই যদি একটা সম্মানজনক কাজ পাস, করবি ? 
মেয়েটি রাজী হয়েছিল। এক প্রাইভেট স্কুলে সাফাইয়ের কাজ। লেখাপড়া শেখার ইচ্ছেও হয়েছিল তার। শেষ পর্যন্ত ভুপেন্দ্রবাবুই ব্যবস্থা করলেন। তারপর একদিন দ্য এশিয়ানে চাকরি পেলেন। মেয়েটিকে নিয়ে পড়লেন আথান্তরে। কি করা যায় ? অগত্যা মেয়েটিকে বললেন, তুই বিয়ে করবি ?
-- আপনি বললে করব।
-- কেন তোর নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছে বলে কিছু নেই ? 
-- না। আপনি সাহায্য না করলে এতদিনে আমাকে শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেয়ে নিত। তাই আপনি যা বলবেন -- 
মেয়েটি জানতে চায়নি কাকে বিয়ে করতে হবে ? কিন্তু মন্দিরে গিয়ে বরকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। ওর পায়ে পড়ে কেঁদে বলেছিল, আপনি মানুষ না, ভগবান। 
সে একটা গল্প বটে। তবে মানুষটা ভালো সেটা সে অনেকের মুখেই শুনেছে। অফিসের যে কেউ বিপদে পড়লেই ভূপেনদাদা হাজির। 
বেশ কয়েকদিন হল সে কাজে যোগ দিয়েছে।‌‌ কিন্তু এখনো তার বস্ সিইও'র সঙ্গে দেখা হয়নি। নাম শুনেছে। ওনার নাম গার্গী বোস। বাঙালি। তবে মিস্ না এসএমটি জানেনা। কারণ নামের আগে তিনি কিছু লেখেননা। অফিস কলিগদের মুখে শুনেছে বেশ সুন্দরী, এবং মেজাজী। কাজের ব্যাপারে তেমন তাড়াহুড়ো নেই। তবে ভুল হলে ছেড়ে কথা বলেননা। 
সেদিন একটা মেসেজ পেল রোহিত। চেয়ারম্যান এবং সিইও ঠিক দুটোের সময় ফিনান্স আ্যণ্ড প্লানিং নিয়ে কিছু বলতে চান। তাই ওই দুই সেকসনের অফিসারদের দুটোর মধ্যে মিটিং হলে উপস্থিত থাকতে হবে। 
রোহিত ভাবল, যাক এবার দেখা হবে। তবে এই ক 'দিনের মধ্যে একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু আউটলাইন তৈরি করেছে। যদি সে ব্যাপারেে গ্রীণ সিগন্যাল পাওয়া যায় তবেই এগোবে সে।এ ব্যাপারটা ভূপন্দ্রবাবুকে বলা যেত। কিন্তু ব্যাপারটা হল, প্রেজেন্টেশনের ওপরে এর সাফল্য নির্ভর করছে। 
ঠিক দুটোতেই ওর প্রজেক্ট ফাইল এবং একটা পেনড্রাইভ নিয়ে মিটিং হলে এল রোহিত। 
সিইও গার্গী বোস যে বাঙালি তার কথাবার্তায় তা বোঝার উপায় নেই। হিন্দি এবং ইংরেজিতে চোস্ত। এমনকি অন্যান্য ভাষাতেও। সুন্দরী এবং স্মার্ট। পোশাক পরিচ্ছদেও। তবে বয়স বলা যাবেনা। আলাপ পরিচয়ের পরে সিইও রোহিতকে বললেন, আপনি বাঙালি এবং আপনি বলছেন প্রজেক্টটা সাকসেস হবে ?
-- হোয়াই নট ? কেন হবেনা ? 
-- আসলে এতোটা আত্মবিশ্বাস সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায়না। ঠিক আছে, ইউ মে গো ফরওয়ার্ড। আপনি এগিয়ে চলুন। আমি একটা আ্যপ্রুভ অর্ডার পাঠিয়ে দেব। 
পর্ব চার
পরদিন অফিসে এসেই আ্যপ্রুভ অর্ডারটা পেয়ে গেল রোহিত। ওর প্রজেক্টের বিষয় দ্য এশিয়ানের সমস্ত প্রডাক্টগুলোকে একই ছাতার তলায় রেখে পাবলিসিটির ব্যবস্থা করা। তার জন্য একটা গাইড লাইন তৈরি করা। বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সে একটা টিম তৈরি করল। আর সমস্ত ব্যাপারটা তার মস্তিষ্ক প্রসূত বলে অন্যান্যরা তাকেই টিমলিডার হতে বলল। সে যে নতুন কিছু একটা করতে চায়, তার কোম্পানিকে সেরাটা দিতে চায় এটা সে বোঝাতে পেরেছে। 
সেদিন দুপুরে বস্ তথা সিইও গার্গী বোসের চেম্বার থেকে একটা কল এল। এক্ষুনি যেতে হবে। কি ব্যাপার বুঝতে পারলনা রোহিত। যেতেই হবে। বস্ বলে কথা। রেগে গেলে যদি যদি চাকরি থেকে নট করে দেয় ? 
কি বলবে গার্গী বোস ? 
ওর চেম্বারে আসতেই ডোর কিপার বলল, আপ অন্দরমে যাইয়ে। আপকো জরুরী এত্তেলা দিয়া গ্যয়া। 
জরুরী এত্তেলা ? কিন্তু কেন ? 
বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। দরজা ঠেলে বলল, মে আই কাম ইন ? 
-- আইয়ে। ম্যায় আপকি ইন্তেজারমে থী। ও হো, আপনি তো বাঙালি। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। বসুন। 
রোহিত বসল। বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা। পায়ের তলায় নরম গালিচা। ঘরে একটা নরম আলো। আর তার মাঝে সুন্দরী বস্। 
কি বলবেন ?
বসার পরেও বুকের মধ্যে ঢিপঢিপানি রয়ে গেছে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু কারণটা এখনো বলেননি। 
-- কোন্ কারণটা ? ও হো ! আপনাকে ডেকেছি কেন ? কারণ আছে। তবে সেট এখনি বলা যাবেনা। লাঞ্চ করেছেন ?
-- না। দুটোর সময় ক্যান্টিনে গিয়ে করে নেব। 
-- দরকার নেই। আমি লাঞ্চ আনিয়ে রেখেছি। 
-- না মানে -- 
-- না, মানের -- দরকার নেই। আসুন, বসের সাথে লাঞ্চ করতে আপত্তি আছে নাকি ? 
-- না, তা নেই। 
গার্গী বোস কলিং বেল টিপে ডোর কিপারকে বললেন, এখন তিনি লাঞ্চ করবেন। কেউ যেন না আসে। 
সিইও 'র চেম্বারের সঙ্গেই একটা রেস্ট রুম। সেখানে ছোট একটা বেড, চেয়ার, টেবল, এবং প্রসাধনের সব ব্যবস্থাই ছিল। 
-- বসুন। আপনি এখানে চাকরি করতে এসেছেন, আমিও তাই। আপনি চান সেরাটা দিতে, আমিও তাই। সেই সঙ্গে বস্ আর অধস্তনের সীমারেখাটাও আমি ভেঙে ফেলতে চাই। তাছাড়া আপনিও বাঙালি আমিও বাঙালি। সুতরাং -- খাবারটা দুটো প্লেটে সাজিয়ে নিল গার্গী বোস। ভাত, ডাল , পাঁচমিশালি সবজি এবং মাছের কালিয়া। গন্ধটাও বেশ। বিশুদ্ধ বাঙালিখানা বলেই মনে হচ্ছে। প্রায় দিন পনের হল এসেছে এখানে। হোটেল ক্যান্টিনের রান্নাও যেন একঘেয়ে। নিজেকে এখন ভাগ্যবান বলে মনে হল তার। সুন্দরী বস্ তাকে তাঁর নিজস্ব চেম্বারে ডেকে এনে লাঞ্চ করাচ্ছেন ; একি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার ? কিন্তু মনের কোণে একটা সন্দেহও উঁকি দিচ্ছে। তাকে এতো তোয়াজ কেন ? কোনও দুরভিসন্ধি নেই তো ? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, দূর , তা কেন হবে । তার প্রজেক্টটা বসের ভালো লেগেছে তাই। 
খাওয়ার শেষে ওই বিশেষ ঘর থেকে চলে আসছিল রোহিত। গার্গী বোসই বললেন, এখনো লাঞ্চ টাইম শেষ হয়নি। সুতরাং আপনি রেস্ট নিতেই পারেন। 
তবু একটু ইতস্তত করছিল সে। বসের সাথে এতখানি অন্তরঙ্গতাকে কি তার সহকর্মীরা ভালো চোখে দেখবে ? মানুষের বাঁকা দৃষ্টির ধার যে বেশি। জীবনটাকে কেটে ফালা ফালা করে দেয়। 
আসলে কি জানেন -- 
বলতে বলতে নিজের মেকাপটা ঠিক করে নিচ্ছিল গার্গী -- আমি তো এখানে একা। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে খুব বোর ফিল করি। তখন নিজের ভাষাভাষী কাউকে পেলে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। তাই আপনাকে এতো তোয়াজ করছি। 
-- কি যে বলেন, আমি এক অতি সাধারণ -- 
-- স্টপ ইট। সাধারণ ভাবলে চলবেনা। নিজেকে একস্ট্রা অর্ডিনারি ভাবতে হবে। নিজের কাজ দিয়ে প্রমান করতে হবে, আমি সাধারণ নই, অসাধারণ। 
সামনে ফিরল গার্গী। হাঁ, ওকে দেখে তাই মনে হয়। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয় সে। হয়তো বসিঙ করার জন্যই জন্ম ওর। 
কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর নিজের ডেস্কে ফিরে এল সে। না, তার কলিগরা তার এই বেশ কিছুক্ষণের অনুপস্থিতির জন্য কোনও প্রশ্ন করলনা। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তার প্রজেক্টের ব্যাপারে টিমমেম্বারদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছে। তারা এখন নিজেদের মতো করে ভাববে। দুদিন পরে সবাই মিলে একটা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেবে। এ পর্যন্তই ঠিক হয়ে আছে। 
কিছুক্ষণ কম্পিউটারটা ঘাঁটাঘাঁটি করল। কয়েকজনের সঙ্গে অনলাইনে মিটিং করল। কিন্তু কাজটা যেন এগোলনা। বারবার গার্গী বোসের সঙ্গে লাঞ্চ করাটা নিয়ে একটু এলোমেলো ভাবনা আসতে লাগল। কখনো মনে হল বস্ হয়তো স্টাফের সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করতেই পারেন। কিন্তু এতখানি অন্তরঙ্গতা আশা করা যায় কি ? এমনকি তার পার্সোনাল রুমে বাইরের কাউকে ? 
কিন্তু বস্ তাকে মোটিভেট করার চেষ্টা করেছে। 
আজ হঠাৎ সায়ন্তিকার কথা মনে পড়ল। 
 পর্ব পাঁচ 
সায়ন্তিকা তাকে মোটিভেট করতে চায়নি। মোটিভেটেড হতে চেয়েছে। বসিঙ করতে চায়নি। তবু গার্গী বোসকে ভালো লাগছে তার। তাহলে সেকি সায়ন্তিকার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ?
ইতিমধ্যে অনেকখানি সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। তবে অফিসের ভেতর থেকে সন্ধ্যে হয়েছে কি দিনের আলো আছে তা বোঝা যায়নি। প্রায় আটটা। কাজ করতে করতে সময়টা দেখতেও ভুলে গেছে সে। কেয়ারটেকার এসে মনে করিয়ে দিতেই বলল, হাঁ তাইতো। 
লিফট্ বেয়ে অফিসের বাইরে এল সে। না মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাট দেখে কেউ বলবেনা যে রাত্রি। এখানে মধ্য রাত্রিতেও শহর পুরোপুরি জেগে থাকে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে জুহুর সমুদ্র সৈকতে এসে বসল। সামনে আদিগন্ত নীল সমুদ্র। তবে রাতের বেলায় সমুদ্রকে নীল বলে মনে হয়না। মুম্বাইয়ের এই এলাকায় দিন ও রাতের মধ্যে কোনও ফারাক থাকেনা। নানা রকমের মানুষ -- দেশী ও বিদেশী, সবাই সমুদ্রতীরে হাজির হয়েছে। নানা রকমের মোটর চালিত নৌকায় সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। আর মাঝ সমুদ্র থেকে সাদা ফেনার মুকুট পড়ে এক একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরভূমিতে। 
হঠাৎ মনে পড়ল বাবা মায়ের কথা। গত দুদিন ভালো করে কথা বলা হয়নি ওদের সঙ্গে। আজ বলল। অনেক কথা। প্রথমে মায়ের সঙ্গে, পরে বাবার সঙ্গে। তবে ওর বিশেষ উৎকণ্ঠার কথা কাউকে বললনা। এমনকি সায়ন্তিকাকেও না। শুধু বলল, বেশ ভালো আছি। 
মুম্বাইয়ের কয়েকটা ছবিও পাঠাল ওদের।
সায়ন্তিকা বলল, তুই ভালো থাকলেই আমার আনন্দ। 
-- সত্যি বলছিস ? 
-- সত্যি না তো কি ? তুই কি বিশেষ কিছু ভাবছিস ? 
-- না তো। নতুন চাকরি। বুঝতেই পারছিস; এখনো অফিসের ব্যাপারস্যাপার ভালো করে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। সেজন্য একটু চাপে আছি -- এই আর কি ! 
-- বেশ আজ আর বকবক করবনা। তুই আনন্দে থাক এবং ভালো থাক। এটাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। 
না, আর বেশি কথা হলনা। মোবাইলটা অফ করতে গিয়ে দেখল, দশটা বেজে গেছে। তবে মুম্বাইয়ের ক্ষেত্রে এটা সন্ধ্যে রাত। 
উঠে পড়ল সে। কিছুটা হাঁটতেই একটা বাজার পেল সে। সাবান, টুথপেস্ট এবং এবং কিছু শুকনো খাবারের দরকার ছিল। সেগুূলো নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
রেসিডেনসিয়াল আ্যপার্টমেন্টে এল রোহিত। 
সিকিউরিটি গার্ড বলল, আপ পায়দলমে গিয়া থা ? 
-- নেহি। অফিসকা কারমেই গিয়া থা। লেকিন ঘুমনেকে বাদ পায়দলমেই আগ্যয়া। 
গার্ডরা আর কিছু বললনা। 
ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বসেছে এমন সময় কলিং বেলের টুং টুং আওয়াজ হল। খুলতেই দেখে ফুড ডেলিভারির লোক। 
লোকটা একগাল হেসে বলল, আপ ক্যায়সে হ্যায় সাব ? খানা আচ্ছা হ্যায় কেয়া ? 
-- ঠিক হ্যায়। লেকিন নমক থোরা জাদা থা। 
-- জাদা থা ? ম্যায় কুককো বতা দেঙ্গে। কালসে আচ্ছা হোগা নেহি। 
টাকা দিয়ে খাবারটা নিল রোহিত। না, আজ বেশ হয়েছে। ঘ্রাণেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। 
খাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে যথারীতি সবাইকে ফোন করল। শেষে ঘুমাবার চেষ্টা করলেও সফল হলনা। পায়ে পায়ে উঠে এল। ওদের বিল্ডিংটা শুধু মাত্র মেল রেসিডেন্টদের জন্যই। সবাই দ্য এশিয়ানেরই কর্মী। মোট বারোটা ফ্লোর রয়েছে। চারপাশের বিল্ডিংগুলোর থেকে এটাই কম ফ্লোরের। লিফট্ তখনও সচল ছিল। টপ ফ্লোরে উঠে এল রোহিত। সমুদ্রকেও এখান থেকে বেশ দেখা যায়। রাত্রি প্রায় বারোটা। তবু সমুদ্র সৈকতে তখনও লোকের ভিড় কম ছিলনা। 
হঠাৎই মোবাইলটা রিং হল। দেখল গার্গী বোস। বস্! সুতরাং ধরতেই হল। 
-- হ্যালো, ম্যাডাম বলুন -- 
-- কি ব্যাপার, দুপুরের পর থেকে দেখা করেননি যে -- 
-- আসলে ওই প্রজেক্টের ব্যাপারে টিমমেম্বারদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম।
-- খুব ভালো কথা। আপনার এই একাগ্রতা দেখে খুব ভালো লাগছে। একটা কথা, অফিসে আমি বস্ হলেও এমনিতে তো বন্ধু হতে পারি, নাকি ? 
-- তা না হওয়ার কোনও কারণ নেই। 
-- মুখে বলছেন। অথচ প্রয়োজনে আমাকে ভুলে যাচ্ছেন। নতুন স্টাফদের কোম্পানি থেকেই কিছু আ্যডভান্সের ব্যবস্থা করা হয়। কালই ফিনান্স সেকসনকে একটা নোট দেব। 
-- না, ম্যাডাম এতোটা দরকার হবেনা। 
-- কোনো কথা নয়। কাল ডিউটি শেষে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। গুডনাইট। ফোনটা কেটে দিল গার্গী বোস। কথা বলার সুযোগই দিলনা। 
রোহিত ভাবল, গার্গী বোস তার প্রতি এতটা দয়ালু কেন ? ম্যাডাম কি তার মার্কেটিং করা দেখেছে ? গার্গী বোস কি সব স্টাফের ব্যাপারেই এতোখানি খোঁজ খবর রাখেন? না, শুধু তার ব্যাপারেই ? এমনিতে ওনার সান্নিধ্য মন্দ লাগেনা। কিন্তু বস্ বলে কথা। তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ভালো দেখায় না। একটা সীমারেখা থাকা দরকার। কিন্তু উনি বন্ধুত্ব চান ? 
পর্ব ছয়
পরদিন কাজের মধ্যেই ডুবে রইল রোহিত। প্রজেক্টের আউটলাইন আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখন সেটা কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সেটাই টিম মেম্বারদের বোঝানোর চেষ্টা করছিল সে। মেম্বাররা নিজেরা কিছু ভেবেছিল বটে, তবে শেষ পর্যন্ত রোহিতের পরিকল্পনাকেই গ্রহন করল। এখন এই পরিকল্পনাকে কিভাবে বাস্তবায়িত করা যাবে তারও রূপরেখা তৈরি করল। যদিও হাতে এখনও তিনদিন সময় আছে তবু সে তাড়াতাড়িই শেষ করতে চাইল। 
এসব করতে করতে কখন যে লাঞ্চ টাইম এসে গিয়েছিল তা বুঝতে পারেনি। সহকর্মীরা একে একে ক্যান্টিনে গিয়েছিল। কিন্তু কম্পিউটারের সামনে বসেই ছিল রোহিত। হঠাৎই গার্গী বোসের কথা মনে হল তার। বস্ তার প্রতি একটু বেশিই আগ্রহী। সেটা মন্দ নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল সে সায়ন্তিকার জায়গায় আর কাউকে ভাবতে পারছেনা সে। ৈৈ
আবার কাজের সুবাদে বস্ এর সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটাও জরুরী। পরিস্থিতিটা কোন্ দিকে যাবে কে জানে ? 
যা হয় হবে ! দেখাই যাক -- উঠতে যাবে , এমন সময় দেখে অফিসের অপর প্রান্ত থেকে হেঁটে আসছে গার্গী বোস। যারা তখনও ডেস্কে ছিল, তারা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল। 
রোহিতের দিকে এগিয়ে এল গার্গী বোস। বলল, আপনি এখনো লাঞ্চে যাননি ?  
 -- এই উঠছিলাম - 
-- আপনি তো কথা শুনবেন না। আসুন -- 
সহকর্মীদের উৎসুক চোখের সামনে দিয়েই বসের নিজস্ব কেবিনে গেল রোহিত। ইচ্ছে ছিলনা, আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারলনা। 
সেদিনের লাঞ্চে ছিল আলু বিরিয়ানি এবং কষা মাংস। এখানেও যে এতো ভালো রান্না করা খাবার পাওয়া যায় সেটা ভাবতে পারেনি রোহিত। বেশ ভালো লাগলো তার। বস্ যখন নিজের থেকে এতো কিছু করছে তখন তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত হবেনা। 
গার্গী বোস বলল, খেয়ে নিন। 
একবার ওর দিকে চেয়ে দেখল রোহিত। ওকে বেশ সুন্দরী বলেই মনে হয়। সঙ্গে আধুনিকা। ব্লেজারের নিচে একটা ছোটখাটো টপ্। ফর্সা বুকের ভাঁজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। না , ম্যাডামের শরীর দেখানোতে কোনও কুণ্ঠা আছে বলে মনে হলনা। 
খাওয়া শেষ হল রোহিতের। 
গার্গী বোস বললেন, আপনার কিন্তু এই পোশাক এখানে চলবেনা। আজ আমার সঙ্গে কাজের শেষে আপনাকে বেরোতে হবে। 
-- কিন্তু !
-- কোনও কিন্তু নয়। আই আ্যম ইওর ফ্রেণ্ড আ্যণ্ড আই লাভ ইউ। 
শেষের কথাটা চারদেয়ালের মধ্যে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল ওর দুই কানে। 
বস্ তাকে ভালোবাসে। সামান্য একজন কর্মীকে ? এতো অসম্ভব পাওয়া ! রাজ্য এবং রাজকন্যা একসঙ্গে ! রোহিত স্তম্ভিত, মুগ্ধ। অনেক কিছু বলতে চাইছে সে । কিন্তু পারছেনা। জিভটা বুঝি আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। 
নিজের ডেস্কে এল সে। টিম মেম্বাররা এখনো আসেনি। গার্গী বোসের কথাটা এখনো তার কানের কাছে বেজে চলেছে। না, এর আগে এতখানি অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কেউ তাকে কাছে টেনে নেয়নি। কি আছে তার মধ্যে , যার জন্য এক সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট, উচ্চপদস্থ কর্মরতার তাকে ভালো লাগলো ? 
সময়টা কখন কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারলনা রোহিত। 
বেশ কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। মাথাটা কেমন যেন ধরে এসেছিল। চুপচাপ শুয়ে রইল সে। একটু চা পেলে ভালো হতো। আ্যপার্টমেন্টের ক্যান্টিনে চা এবং স্ন্যাকসের অর্ডার দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এবং ভুজিয়া নিয়ে এল প্রায় দশ বারো বছরের একটি ছেলে। 
রোহিত ওকে ডেকে বসাল। জিজ্ঞেস করল, তুমহারা নাম কেয়া ? 
-- সত্যানন্দ। বিহার কি এক গাঁওসে আয়া। 
খুব অভাব ছিল ওখানে। তিনভাই। সে বড়। তারই দায়িত্ব। মাসে মাসে টাকা পাঠায় সে।‌‌যার এখন লেখা পড়া শেখার কথা -- সে এখন চায়ের দোকানে ! সমগ্র ভারতে কতো কতো শিশুর যে চায়ের দোকানে শৈশব কাটে; কে জানে ? 
চা এবং ভুজিয়ার দাম দিতেই চলে গেল সত্যানন্দ। 
চা টা খেয়ে এখন মাথাটা বেশ ফ্রেশ মনে হল। জানালাটা খুলে দিতেই দেখল নীল সমুদ্র আর অজস্র রঙিন মানুষের ভিড়। 
কমার্স নিয়ে পড়ার সময় অন্য স্ট্রিমের বন্ধুরা বলত ওদের নাকি শিল্পবোধ নেই। মানুষের দুঃখ, কষ্ট, অসহায়তা -- এসব ওদের চোখে পড়েনা। ওরা নাকি টাকাপয়সা সংক্রান্ত নীরস বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মনে মনে একটু হাসলো সে। মানুষের জীবনবোধ নিয়ে তার ভাবনা কম নয়। কিন্তু সেটা একজন শিল্পী সাহিত্যিকের মতো করে প্রকাশ করতে পারেনা। রাজনৈতিক নেতাদের মতো মিথ্যে ভরং দেখাতে পারেনা। সে এটা বুঝতে পেরেছে যে টাকা না থাকলে সব 'বোধ'ই মিথ্যে হয়ে যায়। 
আজ আবার বেরোতে হবে গার্গী বোসের সঙ্গে। 
গার্গী বোস তার বন্ধুত্ব চায়। আপত্তি নেই। কিন্তু ও হল বস্। আর সে তারই অধস্তন কর্মী। বন্ধুত্বের কারণে সেই সীমারেখাটা মুছে গেলে সমীকরণটা কেমন হবে কে জানে ?
পর্ব সাত 
রাত্রি প্রায় আটটা। তবে রাত্রি না বলে সন্ধ্যে বলাই ভালো। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। হঠাৎই মোবাইলে একটা মেসেজ দেখে উঠে পড়ল। " আই আ্যম আ্যট ইওর ডোর স্টেপ।" বস্ মানে গার্গী বোস তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্যান্ট শার্টটা পড়ে নিয়ে বেরিয়ে এল ্্।
ম্যাডাম ওর জন্য ওয়েট করছে। না জানি এবার কি হবে ! আ্যপার্টমেন্টের বাইরে এসে একটা দুধ সাদা মার্সিডিজ বেঞ্জ দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্টিয়ারিঙয়ে স্বয়ঙ গার্গী বোস। কাছে আসতেই গাড়ির দরজাটা বাঁ হাত দিয়ে খুলে দিলেন তিনি। 
-- এক্সকিউজ মি !
-- নো এক্সিকিউশান। কাম ইন। 
ম্যাডামের পাশেই বসতে হল। ভিতরটা বেশ ঠাণ্ডা এবং একটা মিষ্টি গন্ধে ভরা। 
-- ঘুমাচ্ছিলে ? 
-- হাঁ। এরজন্য দুঃখিত। 
-- হোয়াই? 
-- আপনাকে ওয়েট করতে হল এর জন্য । 
-- ও হো, এরজন্য ! 
হাসল গার্গী। এখন ওকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে। ব্লু জিনস এবং ওপরে একটা সাদা রঙের টপ। না টাইট ফিটিং নয়। ওতে ওর বুকের সৌন্দর্যটা যথেষ্ট অনাবৃত। চুলগুলোও খোলা। বেশ উড়ছে। 
কিছুটা ছোঁয়া বাঁচিয়ে বসেছিল রোহিত। কেমন যেন একটা সংকুচিত হয়ে। গার্গী বোসের মতো একজন মহিলা তার পাশে -- এটা তার কল্পনারও অতীত ছিল। গাড়িটা মসৃন গতিতে এগিয়ে চলেছে। স্পীড কখনো পঞ্চাশ অথবা ষাট। ড্রাইভিঙয়ে চোস্ত বলতেই হবে। হঠাৎই গার্গী তার বাঁ হাতটা রাখল ওর হাতে। বলল, আর ইউ আ্যকসেপ্টিঙ মি ? 
-- হোয়াই নট ? 
-- তাহলে এতো দূরে কেন ? আপনার কি কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে ? 
-- গার্লফ্রেন্ড ? কি যে বলেন -- আমার মতো একজন চালচুলোহীন ব্যক্তির কে গার্লফ্রেন্ড হতে চাইবে ? 
-- আমি তো চেয়েছি।
-- সেটা আপনার বদান্যতা। আমি জানি, আমি আপনার -- 
-- ডোনট্ সে ফারদার। 
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটা একটা শপিং মলে এসে থামল। মলের সিকিউরিটির লোকেরা এগিয়ে এসে পার্কিংয়ের জায়গাটা দেখিয়ে দিল। ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল ম্যাডাম বেশ পরিচিত। 
ঝাঁ চকচকে একটা মল। এর আগে রোহিত মল দেখেনি এমন নয়। তবে এ যেন অনেক বড় ব্যাপার। শয়ে শয়ে লোক আসছে, যাচ্ছে। তবে সবাই গাড়িতে চড়েই। বাণিজ্যিক গাড়িও আছে, সেই সঙ্গে আছে ব্যক্তিগত গাড়িও। 
রিসেপশনে একজন সুন্দরী মহিলা বললেন, আইয়ে জী, বহোৎ দিনো কে বাদ -- 
হাসল রোহিত। এই মলে সে প্রথম এল। ওরা হয়তো এভাবেই সবাইকে রিসেপশন করে। 
চলমান সিঁড়ি। চলেই যাচ্ছে। উঠে দাঁড়ালো সে। গার্গী বোস ভারসাম্য রাখতে না পেরে রোহিতের হাত ধরতে বাধ্য হল। সে লক্ষ্য করল ম্যাডাম অনেক কাছে সরে এসেছে। পিঠের ওপরে ওর বুকের ছোঁয়া। ইতিপূর্বে কোনও মহিলা এতোখানি কাছে আসেনি। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হল সেখানে আবার একবার ম্যাডামকে ধরতে হল। হাত ধরেই মলের ভেতরে প্রবেশ করল ওরা। রোহিতের মনে হল ম্যাডাম বুঝি তার কতো কাছের মানুষ। মাত্র অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে কতো আপন করে নিয়েছে। এখন সায়ন্তিকার মুখটা বুঝি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। 
হঠাৎই এক মহিলার সঙ্গে দেখা হল গার্গী বোসের। মহিলা হেসে বলল, হাই গার্গী কেমন আছো ? 
-- খুব ভালো। আপনি ? 
-- ভালো। তো ইনি ?
-- মাই ফ্রেণ্ড। রোহিত আঢ্য। 
"হাই" বলে মহিলা হাত এগিয়ে দিলে রোহিত বাধ্য হল করমর্দন করতে। ভদ্রমহিলা সাজপোশাকে বেশ বেপরোয়া। এখানে মহিলাদের দেখে মনে হয় তারা বুঝি শরীর দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। 
গার্গী বোস এগিয়ে এসে বলল, আজ ব্যস্ত আছি। বেশ কিছু মার্কেটিং করতে হবে। 
রোহিতকে একপ্রকার টেনে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল সে। মৃদুকণ্ঠে বলল, এই ধরণের মহিলাদের একদম পাত্তা দেবেননা। 
আশ্চর্য হল রোহিত। গার্গী বোস কি স্রেফ প্রেম চায় ? না, আরও কিছু ? 
গার্মেন্টস সেকসনে আসে ওরা। এখানে শুধু মাত্র পুরুষদের জন্য। ঘুরে ঘুরে দুটো ব্লেজার, দুটো প্যান্ট এবং দুটো শার্ট পছন্দ করল গার্গী। রোহিতের গায়ে মাপ দিয়ে দেখল -- না, ঠিকই হবে বলে মনে হল তার। ট্রলিতে রেখে দিল সে। পুরুষদের বেশ কয়েকটি অন্তর্বাস, গেঞ্জি -- এসবও নিল । মহিলাদের পোশাক বিভাগে এসে নিজের জন্যও কিছু নিল। 
রোহিত ওর অনেকটা কাছে সরে এসে বলল, ম্যাডাম, আমি আপনার জন্য কিছু নিতে চাই। 
-- ম্যাডামনয়, গার্গী, ওনলি গার্গী। 
-- কিন্তু আপনি যে আমার বস্।
-- সেটা অফিসে। আর অফিসের বাইরে ফ্রেণ্ড, ওনলি ফ্রেণ্ড। আর আপনি নয়, তুমি। 
রোহিত গার্গীর দিকে চেয়ে থাকে। সীমারেখাটা বুঝি অষ্পষ্ট হয়ে আসছে। এখন থেকে আর আপনি বলা যাবেনা। বলতে হবে তুমি। সে বুঝি এক অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় গল্পের নায়ক। যা নাকি রূপোলী পর্দায় সম্ভব ।
-- আ্যই, হোয়াটস আর ইউ থিঙ্কিং ? 
-- কুছ নেহি।
-- তব শোচতে কেয়া ?
-- আমি স্বপ্ন দেখছি না তো ? 
-- হাসল গার্গী। বলল, না গো। আই আ্যম ইওরস , চলো -- 
স্টেশনারি সেকসনে এল ওরা। গার্গী পুরুষদের প্রসাধনের জন্য অনেক কিছু নিল। ট্রলিটা ভর্তি হয়ে এসেছে প্রায়। ঠেলে ঠেলে সেটা কাউন্টারে নিয়ে এল। কাউন্টারের মহিলা কম্পিউটারে হিসাব লিখতে ব্যস্ত হল। 
পেমেন্ট আ্যপের মাধ্যমে টাকাটা মিটিয়ে দিল গার্গী। রোহিত এগিয়ে এসে বলল, আপনি, স্যরি তুমি পে করলে যে ? আজই কোম্পানি আমাকে পঞ্চাশ হাজার আ্যডভান্স করেছে। 
-- গুড নিউজ। আর এটা আমার বন্ধুত্বের উপহার। আপনি, স্যরি তুমি কি এটা স্বীকার করবেনা? 
অভিভূত রোহিত। এই অযাচিত, অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে স্বীকার করতেই হবে।
পর্ব আট
বন্ধুত্ব ক্রমশই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল। গার্গী বোসের বন্ধুত্বে যতটা না নিখাদ প্রেম ছিল, তার থেকেও বেশি ছিল পাওয়ার বাসনা। না, টাকাপয়সা বা প্রেম নয়। বাসনা ছিল শরীরের। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি হলেও শারীরিক সৌন্দর্যে মনে হবে কুড়ি পঁচিশের মধ্যে। যার ফলে কমবয়সী ছেলেদের ফাঁদে ফেলতে পারত। আর ওর অপারেশনের কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেতনা। নিজে ওপরতলার অফিসার হওয়ার সুবাদে ওর জানাশোনাও ছিল প্রচুর। তবে একই পদমর্যাদার লোকেদের সঙ্গে ওর মেলামেশা ছিলনা। ও চাইত একটু গরীব এবং ট্যালেন্টেড ছেলেদের। তাদের নিখাদ প্রেম এবং শরীর দুটোই উপভোগ করত সে। রোহিত তার পঞ্চম শিকার। বেশ ভালো লাগছে তার। একটা রোমান্টিকতা আবহে রোহিতের নেশায় মশগুল সে। তবে কাজের ক্ষেত্রে একশো শতাংশ পেশাদার। তবে সন্ধ্যে হলেই চাই পুরুষের ‌
সান্নিধ্য। তবে যে কোনও পুরুষ নয়। তার পছন্দের পুরুষ এবং যে শুধু তাকে নিয়েই ভাববে। 
বেশ কিছুক্ষণ আগেই রোহিতকে ফোন করেছে। আজ সানডে নাইট ক্লাবে যাবে বলে ীী
ঠিক করেছে। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। একটু নির্জন এলাকায়। শহরের ভিড় এবং কোলাহল দুটোই অনুপস্থিত। রোহিতকে আর একবার ফোন করতেই সে বলল, আমি গান্ধিজীর স্টাচুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। 
-- ঠিক আছে। আমি আসছি। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোহিতের পাশেই একটা গাড়ি এসে থামল। এটা আগের গাড়িটা নয়। এটা হয়তো কোনও ট্যুরিষ্ট কোম্পানির গাড়ি। ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। রোহিত আজ গার্গীর পছন্দের স্যুটিঙ পড়ে নিয়েছে। না, ওকে আর সেই আগের গরীব গরীব ুুচেহারায় দেখা যাচ্ছেনা। বেশ সফিষ্টিকেটেড। গাড়ির দরজাটা খুলেই গার্গী বলল, খুব খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। এস। 
পাশে বসতেই ওকে একটা ছোট্ট কিস করল গার্গী। 
বেশ ভালো লাগলো রোহিতের। কোনও বিশেষ নারীর কাছ থেকে এটা তার প্রথম পাওয়া। না, সায়ন্তিকার কখনো এরকম দুঃসাহস হয়নি। তারও না। নির্জনে ওরা অনেক গল্প করেছে বটে, তবে শারীরিক স্পর্শ ছিলনা। 
গাড়িটা ছুটে চলেছে। কোথায় সে জানেনা। গার্গী অনেক কাছে সরে এসেছে। আজ আর ও জিনস টপ পড়েনি। একটা লঙ স্কার্ট আর টপ। দুটোই সাদা। চুলগুলোও খোলা। বেশ সুন্দর লাগছে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে ছোট্ট একটা টাউনশিপের পাশ দিয়ে ছুটতে লাগলো গাড়িটা। দুপাশে নানারকমের বাহারি ফুলের গাছ -- আর তার মাঝ দিয়ে পথ। গার্গীর চুলগুলো ওর নাকেমুখে এসে পড়ছে। কেমন যেন এক রোমান্টিকতায় ভেসে যাচ্ছে সে। সায়ন্তিকার কথা আজ বারবার মনে পড়ছে। তাকে নিয়ে অনেক রোমান্টিক স্বপ্ন দেখলেও সময় হয়নি ওর। বারবার বলেছে, এখন না। আফটার ম্যারেজ আই উইল গিভ ইউ অল অফ মাইন। লক্ষীটি, জেদ কোরোনা। 
না, সে জেদ করেনি। সে ধৈর্য্য ধরতে পারে। সায়ন্তিকা তো তারই। কিন্তু আজ মনে হয় সে বুঝি এক ভিন গ্রহের বাসিন্দা। আর গার্গী খুব কাছের ; ছোঁয়া যায়, অনুভব করা যায়। 
গাড়িটা বিরাট একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। নিয়ন লাইটের সাইনবোর্ডে লেখা " সানডে নাইট ক্লাব" মেম্বার্স ওনলি। তাহলে ম্যাডাম নিশ্চয় এখানকার মেম্বার এবং নিয়মিত এসে থাকে। আসতেই পারে। সিইও। সুতরাং লাইফটাকে এনজয় করতেই পারে। এখানে আসা তার কল্পনারও অতীত ছিল। নেহাৎ ম্যাডামের সুনজরে পড়েছে বলেই। গাড়িটা ওদের নামিয়ে দিয়েই চলে যায়। 
ওরা ভেতরে এল । রোহিতের হাত গার্গীর হাতে। 
যেন কতো আপনজন। ডান্স ফ্লোরে তখন কি একটা ইংরেজি গান বাজছে। সেই গানের তালে তালে নারীপুরুষ একে অপরের কাঁধে কোমড়ে হাত রেখে বিশেষ রকমের ডান্স করছে। এরকম সে সিনেমায় দেখেছে। 
 গার্গীকে দেখে অনেকেই হাই বলল। যেন সে সবার পরিচিত। রোহিতকে সে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। এখানে এসে রোহিতের নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে হল। এরকম যে একটা লাইফ আছে, এটা সে ভাবতেই পারেনি কখনো। 
গার্গী প্রথমে নাইট ক্লাবের অফিসে গিয়ে কিছু কথা সেরে নিল। তারপর রোহিতকে নিয়ে এল ড্রিঙ্কস কিয়স্কে। সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে নানা রংয়ের পানীয়ে ভর্তি। মদ ! রোহিত রোমাঞ্চিত। মদ কখনো খায়নি সে। কিন্তু আজ বস্ কে খুশি করতে -- গার্গী দুটো গ্লাস তুলে নিল। একটা রোহিতের হাতে দিয়ে বলল, চিয়ার্স ! 
-- চিয়ার্স ! রোহিত একটু একটু করে গলায় ঢেলে নিল সবটা। বেশ ঠাণ্ডা। না, দেশী মদের মতো গন্ধ নেই। কিন্তু একটা ভালো লাগা আছে। 
পাশের একটা পাত্রে পকোড়া জাতীয় কিছু একটা ছিল।্্
গার্গীর দেখাদেখি নিজেও দুএকটা তুলে নিল সে। বেশ সুস্বাদু।
আরও দুটো গ্লাস নিল গার্গী। রোহিতকে বলল, টেক ইট। 
না, ফেরাতে পারলনা সে। আজ সে যেন ভেসে যেতে চায়। আজ সে তার আবাল্য লালিত আদর্শও ভুলে যাচ্ছে। 
গার্গী ওর কোমড়ে হাত রেখে বলল, লেট ডান্স। 
মৃদু এবং মায়াবী নীল আলোয় গার্গীর চোখে চোখ রেখে অন্যদের মতোই গানের তালে তালে নাচতে থাকল। 
কতক্ষণ হিসাব ছিলনা।‌এর আগে সে কখনো মদ খায়নি। তাই স্টেপগুলো একটু এলোমেলো হয়ে হচ্ছিল। এরই মধ্যে গার্গী আরও কয়েক গ্লাস খেয়েছে। সে আর নাচতে পারছেনা। ডান্স ফ্লোর থেকে চলে এল সে। ওর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। 
ইতিমধ্যে এক এক করে অনেকেই নিজেদের ঘরে চলে গেল। ক্লাবের কর্মীরা জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ একা একাই ফ্লোরে দাঁড়িয়ে রইল রোহিত। ও এখন সায়ন্তিকার সাথে মিলিয়ে দেখছে গার্গীকে। না, গার্গী অনেক বেশি সুন্দরী। অনেক বেশি হট। 
দরজাটা দিয়ে পোশাকটা খুলে ফেলল। গার্গীকে ভালো করে শুইয়ে দিতে গিয়ে দেখল, ও যেন বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ওর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল রোহিত। গার্গী জড়ানো গলায় বলছে, আই লাভ ইউ, আই -- লাভ -- ইউ -- 
গার্গীর পাশেই শুল সে। প্রায় নগ্ন গার্গী অনেক কাছে সরে এল। জড়িয়ে ধরল রোহিতকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল ওকে। এই প্রথম কোনও নারীকে একান্ত ভাবে কাছে পেল সে। উদ্দাম যৌনতায় ভেসে গেল ওরা। পরদিন সকাল হতেই ওরা দেখল, না নিজেদের মাঝে আর কোনও আড়াল নেই। সুতরাং বারবার অনেকবার মিলিত হল ওরা। 
পর্ব নয় : 
রোহিত অনেকটাই অগোছালো হয়ে পড়েছে। নাইট ক্লাব থেকে ফিরে স্নান সেরে অফিসে আসল বটে -- কিন্তু কাজে মন বসাতে পারলনা। সে কাজ করতে এসেছিল। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল -- বস্ এর নজরে পড়ে তার আদর্শ, একাগ্রতা সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বস্ এর সঙ্গে দেখা করবেনা -- তাই বা কি করে হয় ! এই সংস্থায় ম্যাডাম গার্গীই তো তার হেড। সুতরাং তার নির্দেশ মতোই তাকে চলতে হবে। কিন্তু এভাবে চললে তার কর্মদক্ষতাও কমে যাবে। 
কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার গার্গী বোসের কথা মনে পড়তে লাগল। অন্যদিন লাঞ্চের জন্য ম্যাডাম ডাকত। কিন্তু সেদিন তখনও ডাকেনি। তাই একটু চিন্তায় ছিল।‌‌লাঞ্চ ব্রেকের সময় ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে দেখল বস্ এর কেবিন বন্ধ। তার অর্থ নিশ্চয় বাইরে কোথাও -- ক্যান্টিনে খেতে খেতে শুনল -- বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপ ভিজিট করবে ম্যাডাম।তাই সেদিন আসেনি। 
পরপর কয়েকদিনই ম্যাডাম এলনা। মালয়েশিয়া গেছে। এই কয়েকদিন সায়ন্তিকার কথা ভাবল রোহিত। মনে করল গার্গীর কথা ভুলে যাবে। মনে করবে ওটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। 
কিন্তু তা সম্ভব হলনা। দিন পনের পরে ফিরল গার্গী বোস। আবার রোহিতকে ডাকল। না, কাজের কথা বললনা। বলল, কেমন আছো ? আরও বলল, ডোনট্ ট্রাই টু ফরগেট ! 
ওর ঘরে যেতে বলল।
ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু বস্ এর অর্ডার। সুতরাং যেতেই হল। গার্গী যেখানে থাকে সেটা একটা আবাসন। একটাই বিল্ডিং। মোট ছাব্বিশটি ফ্লোর রয়েছে। ম্যাডাম থাকে এইটটিনথ্ ফ্লোরের একশো বাহাত্তর নাম্বার ফ্ল্যাটে। না, খুঁজে পেতে দেরি হলনা। রাত্রি তখন প্রায় ন'টা। ফ্ল্যাটে একাই থাকে। তবে সর্বক্ষণের জন্য একজন মহিলা থাকেন তাকে সাহায্য করার জন্য। 
কলিং বেলের শব্দে স্বয়ঙ ম্যাডামই দরজা খুলল। একেবারে ঘরোয়া পোশাকে। একটা পাতলা সিফনের নাইটি -- ভেতরে অন্তর্বাস আছে বলে মনে হয়না। বুকের বেশ কিছুটা অনাবৃত। না , এরজন্য কোনও সংকোচ নেই। 
-- অফিসের মিটিংয়ে হঠাৎই ম্যালেশিয়া যেতে হল। তোমাকে বলাও হয়নি। ভেতরে এস।‌‌নাইটে এখানেই খেয়ে যাবে। 
রোহিত গার্গীর দিকে চেয়ে রয়েছে। বেশ কিছুদিন না দেখার পর ওকে বেশ মোহময়ী লাগছে। যেন সব পতঙ্গকেই ধ্বঙস করতে পারবে সে। ম্যাডামের সান্নিধ্যে বেশ কয়েকঘণ্টা কেটে গেল। তবু ম্যাডাম যেন ওকে ছাড়তেই চায়না।
লিফট্ সার্ভিস বন্ধ হয় রাত্রি বারোটায়। তার আগেই রোহিত বিদায় জানিয়ে ফিরে এল। রাত্রেও বেশ কিছুক্ষণ গার্গী ওকে ফোন করল। ম্যাডামের পিপাসাটা যেন বেড়েই চলেছে। পরদিন অফিসে বস্ ওকে ডেকে পাঠাল। ভেবেছিল যাবেনা। কিন্তু ও হল বস্। তাই ওর ইচ্ছে অনুযায়ী সে চলতে বাধ্য। এখন অফিসের কাজের বদলে বস্ কে এন্টারটেইন করাই তার প্রধান কাজ। 
কয়েকদিন পরে ঠিক হল ম্যাডামের সঙ্গে তাকে গোয়ায় যেতে হবে। ম্যাডামের কিছু অফিসিয়াল কাজ সারার পর ওরা সমুদ্রতীর সংলগ্ন হোটেলে একদিন ছুটি কাটাবে। রোহিতের আপত্তি ছিলনা। কারণ সে কখনো গোয়ায় যায়নি । গোয়ার সুন্দর বেলাভুমির ছবি সে দেখেছে।
সেটা ছিল অক্টোবরের মাঝামাঝি। দিনটাও ছিল মনোরম। বিকেলের দিকে এল ওরা। খুব হট পোশাক পড়েছিল গার্গী। আর সে ছিল ক্যাজুয়াল পোশাকে। বেলাভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মানুষ। মহিলারা বেশিরভাগই সুইমিং কস্টিউমে।‌‌কেউ একটু জড়তায়, আবার কেউ কেউ উদ্দামতায় ব্যস্ত।্্
সি বিচেই রয়েছে কিছ রেষ্টুরেন্ট। যেখানে মাছ এবং চিকেনের নানারকমের ফ্রাই সঙ্গে ড্রিঙ্কসের ঢালাও ব্যবস্থা। পড়ন্তু রোদে বেশ ঝলমলে দেখাচ্ছিল বেলাভূমি। ওরা দুটো চেয়ারে বসতেই স্টলের ছেলেটা কিছু ফ্রাই এবং দুটো রঙিন গ্লাসে বিদেশী ওয়াইন ওদের হাতে তুলে দিল। আরও, আরও খেল ওরা। এরই মধ্যে রোহিতের অলক্ষ্যে কি একটা ট্যাবলেট ওর গ্লাসের পানীয়ে মিশিয়ে দিল গার্গী। সে আজ খুব অন্তরঙ্গ। রোহিতের হাত ধরে সে এগিয়ে গেল উত্তাল সমুদ্রের দিকে। একজন বোট ওয়ালা এগিয়ে এল। বলল, আইয়ে জী। 
রোহিত বেশ কিছুটা নেশাগ্রস্ত হয়েছিল। পাটাও টলছিল। কথাগুলোও জড়িয়ে যাচ্ছিল। সে বোটে উঠে বলল, গার্গী কাম। 
-- আমি আসছি, তুমি শুরু করো। 
রোহিতের মোটর বোট চলতে থাকল। দুরন্ত গতিতে বড় বড় ঢেউ অতিক্রম করে বোটটা ক্রমশই এগিয়ে গেল উত্তাল গভীর সমুদ্রের দিকে। 
তীরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাল গার্গী। না, রোহিত আর ফিরবে না। নেশার ঘোরে নিয়ণ্ত্রণ হারাবে সে। তারপর গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাবে রোহিত। এভাবেই হারিয়ে গেছে আরও কয়েকজন। না, তাদের খবর কেউ পায়নি। পুলিশ একটু আধটু খোঁজা খুঁজি করেছিল বটে। কিন্তু গার্গী বোস প্রত্যেকটা নিখোঁজের জন্য মাত্র দশ লক্ষ টাকা দেওয়ায় পুলিশ আর খোঁজাখুঁজি করেনি ।
এবারেও করবেনা।
বোট ওয়ালাকে টাকা দিয়ে একটু ক্রুর হেসে হোটেলে ফিরে এল সে।
পর্ব দশ ( অন্তিম )
নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরে এসে পোশাক বদলে নিল গার্গী। হোটেলের অফিসে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে সিসিটিভি ফুটেজের বেশ কিছুটা অংশ ডিলিট করে দিতে বলল। ম্যানেজার প্রথমে রাজী ছিলনা। বলল, হোটেলের এতোগুলো স্টাফ, তাদের মুখ বন্ধ করা সহজ নয়। 
-- সেজন্যই তো বলছি, আপনি আমার ঘরে আসুন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমনিতেই ম্যানেজারের একটু নজর ছিল ওর প্রতি। -- এটা গার্গীর বুঝতে দেরি হয়নি। এখন ওর মুখ বন্ধ রাখতে রিস্ক নিতেই হবে। 
ম্যানেজার ঘরে আসতেই বলল, দেখুন আপনার হোটেলের অনেক নাম শুনেছি। ক্লায়েন্টদের নিয়ে আসতেই হয়। অনেক সময় তারা নিজের থেকেই কোথাও চলে যায়। 
-- বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে ডিলিট হয়ে যাবে। কিন্তু -- 
-- ঠিক আছে, আপনি এটা রাখুন। এতে বিশহাজার আছে। 
-- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি ভাববেন না। 
টাকাটা নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেটে ভরে নিল ম্যানেজার্। এটা তার বাড়তি রোজগার। আর এই রোজগারেই সে ফুলে ফেঁপে উঠছে।
-- আপনি কি আজই চেক আউট করবেন ? 
-- হাঁ। আমি যে আপনার হোটেলে এসেছিলাম তার কোনও প্রমান রাখা চলবেনা। 
-- সে আর বলতে -- এরকম আমরা প্রায়ই করে থাকি। কাষ্টমারের স্বার্থটাই আমাদের কাছে শেষ কথা। 
-- ঠিক আছে। হোটেলের বিল তো আগেই পে করে দিয়েছি। এখন সিসিটিভির ফুটেজটা --
-- বসুননা। আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি। 
বসল গার্গী। দেখল ম্যানেজার মাউসটা ঘুরিয়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত গার্গী নিজেই কীবোর্ডটা টেনে নিয়ে সিসিটিভির দুদিনের ম্যাটারটা একেবারে ডিলিট করে দিল। 
-- পুরোটাই ডিলিট করে দিলেন ? 
-- তাতে কি হয়েছে ! আমি তো আছি। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। চাইলে একঘণ্টার জন্য -- 
-- কি যে বলেন ! 
-- আসুন না।

ম্যানেজার আর না করলনা। বাড়তি কিছু টাকা পেয়েছে। এখন যদি আরও কিছু পাওয়া যায় ক্ষতি কি ! তাছাড়া পুরুষ্টু শরীরের স্বাদ! সুযোগ বারবার আসেনা। সুতরাং সে সুযোগ নিল। 
ফিরে এল গার্গী। তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা এরকম হবে। লিফট তখনও চালুই ছিল। নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। 
আজ খুব ধকল গেছে। এর আগে তার জীবন থেকে আরও চারজন হারিয়ে গেছে। না, তাদের জন্য তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু রোহিতের জন্য বুঝি -- এসব দুর্বলতা তার জন্য নয়। নতুন নতুন পুরুষ তার উপভোগের বস্তু। ওসব নিয়ে তার ভাবার সময় নেই। 
পরদিন অফিসে এল ঠিক আগের মতোই। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। একটা কাগজে রোহিতকে দিয়ে সই করানো ছিল। সেটাতেই একটা রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে নিল। স্বাক্ষর রোহিত আঢ্য। তারিখ তিনদিন আগের। 
সুতরাং সে জানেনা রোহিত রিজাইন দিয়ে কোথায় গেছে । 
কর্মীরাও আর রোহিতের ব্যাপারে তেমন খোঁজখবর করলনা। তার বাড়ির লোকেরাও জানলনা , রোহিত কোথায় ? এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু গোয়া কোষ্টাল গার্ডের ইন্সপেক্টর লিঙ্কন ডিসুজা হঠাৎই একদিন গার্গী বোসকে ফোন করে জানতে চাইল, রোহিত আঢ্য বলে কাউকে চেনেন কিনা ? 
-- চিনি। কিন্তু উনি তো আমাদের সংস্থা থেকে গত বারো অক্টোবর রিজাইন দিয়ে চলে গেছেন। -- আমরা তাঁর লাশটা খুঁজে পেয়েছি। পচাগলা। আপনাকে সনাক্ত করতে হবে। 
-- কিন্তু -- আচ্ছা ওটাকে বেওয়ারিশ লাশ বলে চালানো যায়না ? তার জন্য -- 
-- যেতে পারে , কিন্তু -- 
-- আপনি আসুননা এখানে। মুম্বাইয়ের কোনও একটা হোটেলে -- তারপর আমাকে ফোন করবেন। 
-- ওকে। আমি আজই বিকেলের মধ্যেই আসছি।
-- হাঁ, তবে আজই লাশটার একটা ঠিকানা করে দিন। 
-- ওকে ম্যাম ! 
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো গার্গী। সত্যিই লাশটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কত টাকা খসবে কে জানে ? হোটেল সি ফেস এ একটা এসি রুম বুক করে রাখল সে। লিঙ্কন ডিসুজার এন্টারটেইনমেন্টের সব ব্যবস্থাই রাখতে হবে
আগের মতোই সব চলতে থাকল। কেউ তাকে সন্দেহ করলনা। পচাগলা লাশটা নিশ্চয় শকুন শিয়ালের ভক্ষ্য হয়ে জীবনলীলা সাঙ্গ করেছে। 
ইতিমধ্যে দেওয়ালী এসে গেল। অফিস স্টাফদের জন্য একটা স্পেশাল বোনাসের ব্যবস্থা হল। তারা তাদের বস্ কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাল। 
সেদিনটা ছিল কালীপুজোর রাত। মানে ভূতচতুর্দশীর রাত। ভূতেরা নাকি সেদিন বেশি সক্রিয় হয়। তবে সেসব নিয়ে গার্গীর ভাবনা ছিলনা। শহরটা সেদিন আলোকমালায় সেজেছিল। মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংগুলোকে অনেক অনেক আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। অন্যান্য আবাসিকদের সঙ্গে সেও ছাব্বিশতলার একেবারে শেষ তলায় উঠে এসেছিল। বেশ সুন্দর লাগছিল চারপাশটাকে। দূরের সমুদ্রটাও যেন রঙিন হয়ে উঠেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত সে ছাদেই রইল। কখন যে অন্যান্য আবাসিকরা নেমে গেছে সে বুঝতে পারেনি। হঠাৎই কেমন যেন একটা বিকট আওয়াজ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট চলে গেল। মনে হল পুরো শহরটা বুঝি অন্ধকারে ডুবে গেছে। মোবাইলটাও সঙ্গে ছিলনা। হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কেমন যেন ভুতুড়ে পরিবেশের মতো। লিফটও চলছে না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে থেকে মনে হল যেন ছায়ামূর্তির মতো কেউ এগিয়ে আসছে।
-- কে ? 
কিন্তু ওর গলা থেকে বুঝি কোনও স্বর বেরোচ্ছেনা। গলাটা বুঝি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। না, ও কথা বলতে পারছেনা। প্রচণ্ড ভয়ে ও পিছোতে লাগল আর ছায়ামূর্তিটাও যেন এগিয়ে আসতে লাগল। পিছোতে পিছোতে ও একেবারে ছাদের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাল। 
-- কে, কে তুমি ? কেন এগিয়ে আসছ আমার দিকে ? 
কান ফাটানো পৈশাচিক হাসির শব্দ চারদিকে। ও আরো পিছোতে লাগল। ছাদের ওই অংশটায় কোনও দেওয়াল ছিলনা। গার্গী বোস পিছোতে পিছোতে ছাদের সেই অংশ থেকেই তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল একেবারে নীচে। সবাই প্রথমে একটা আর্তনাদ পরে একটা 'ধপ' শব্দ শুনতে পেল। কারেন্ট এল, আলো জ্বলল। সবাই দেখল একেবারে নীচে রাস্তার ওপরে গার্গী বোসের ছিন্নভিন্ন দেহটা পড়ে রয়েছে। মাথা থেকে তখনো গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। 
মারা গেল গার্গী বোস।
সমাপ্তি ঘটল এক পিপাসার।

Photography - Adrija Mondal


 

Photography - Sohini Shabnam || পুরুলিয়ার ছৌ - সোহিনী শবনম


 


পুরুলিয়ার ছৌ

সোহিনী শবনম 


পুরুলিয়া জেলার ছৌ-নৃত্যের সারা পৃথিবী জোড়া খ্যাতি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের,অযোধ্যা‌ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই জেলার চড়িদা গ্ৰাম।ছৌ সম্রাট পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়ার আশীর্বাদধন্য এই গ্ৰাম মুখোশ তৈরীর জন্য বিশ্ববিখ্যাত।এই গ্ৰামের মানুষের প্রধান জীবিকা হল ছৌ মুখোশ নির্মান।কাগজ,কাপড়,মাটির প্রলেপে তুলির টানে রঙবেরঙের মুখোশ বানানো হয়।হাতের কারুকার্য এবং রঙের চমকে মোড়া এই মুখোশ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ছৌ নৃত্যের মুখ্য বিষয় রামায়ণ, মহাভারত, এবং নানান ধরনের পৌরাণিক কাহিনী ও সংসার ধর্মের বিভিন্ন বিষয়।গান বাজনা সহযোগে এই লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়।ঢোল,ধামসা,চড়চড়ি প্রভৃতি ছৌ নৃত্যের চিরাচরিত বাদ্যযন্ত্র। গণেশ বন্দনার মধ্যে দিয়ে ছৌনৃত্য পরিবেশন শুরু হয়।ছৌ নৃত্য দেখতে এবং পুরুলিয়ার নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটক এসে ভিড় জমান। ছৌ নৃত্যের মাধ্যমে এই জেলা তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এবং বিশ্বের দরবারে খ্যাতি অর্জন করেছে।


Dreamy Love - Debasmita Das || English Poetry || poem || Kobita

 Dreamy Love

   Debasmita Das



I see a spontaneous light-

In his peachen dark complexion, 

Torch-song is sung in enormous night,

Laputan concubinage is not now obstruction.


O! Eros and Venus make our vivify mind;

Is there to be in life what else?

How enjoy in love- phittere bind? 

Young love cares not for consequences.


Where is crime in a spinster ?

If she became nymphet. Soul and body is wager,

If it's pure, at any rate.


In blossoms we spend being bumble-bee,

For a millions year, the gloomy beauty I see.