রামপ্রসাদ সরকারের একটি প্রবন্ধ
আমায় যে পিছু ডাকে
বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই সংগ্রহ আমার নেশা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে শিশির চক্রবর্তী সংকলিত পাঁচ দশকের বাংলা গানের গীতবিতান ‘এ শুধু গানের দিন’ কিনে ফেললাম। বইটির ভূমিকার প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ে আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম।
রবিবারের নিঝুম উদাস দুপুর। নির্দিষ্ট সময়ে সকলেই উৎকীর্ণ, রেডিওতে আধুনিক গানের অনুরোধের আসর হবে। একের পর এক প্রিয় শিল্পীর গান। শ্রোতারা হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-শ্যামল-ধনঞ্জয়-মানবেন্দ্র-সতীনাথ-প্রতিমা-উৎপলা-গীতার পাশে সমান আগ্রহে শুনছেন অখিলবন্ধু-সুবীর-মৃণাল-আল্পনা-গায়ত্রী-ইলা কিম্বা শৈলেনের গান। এসব শিল্পীর অনেক গানই মানুষের কণ্ঠস্থ, যন্ত্রায়োজন সমেত। চলে-যাওয়া শতকের পাঁচ-ছয়ের দশকে ছবিটা এমনই ছিল। তখন দূরদর্শন আসেনি, ঘরে ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারও (সে সময় শুধু রেকর্ডই বেরোত) অপ্রতুল, শিল্পী ও গান এখনকার মতো দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে ওঠেনি। তখন সাধারণ মানুষের ভালো গান শোনার জন্য একমাত্র রেডিওই ভরসা।’
বইটা হাতে পেয়ে, পাতা উল্টে আমি আমার ফেলে আসা দিনগুলোয় ফিরে গেলাম, যে সময় আমাদের দিন-রাত ভরে থাকতো স্বর্ণযুগের বিভিন্ন শিল্পীর সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া গানে। সে প্রায় পাঁচ-ছয় দশকের কথা। প্রথমেই মনের মাঝে গুঞ্জরিত হলো অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের কয়েকটি কলি :
‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,
স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ের বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে.....
সত্যি সত্যি আমার মন ফিরে গেল বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের সেই সব হারানো দিনে, যখন স্বর্ণযুগের শিল্পীদের কণ্ঠের সুর মাধুর্যে আমরা মগ্ন হয়ে থাকতাম।
ছোটবেলার দিনগুলোতে কিছুটা বুঝে এবং অনেকটাই না বুঝে সেই সব গান শুনতাম, যার সিংহভাগ ছিল প্রেমের গান এবং বিরহজনিত শূন্যতায় আচ্ছন্ন।
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিতেই ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে সেই সব গান প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতো মনের মধ্যে এসে পড়লো।
আজও ভুলতে পারিনি কৈশোরের সেই স্মৃতি। যখন রবিবারের ছুটির দিন নিঃঝুম উদাস দুপুরে বাবা ভাত-ঘুম ভাঙিয়ে তুলে দিতেন রেডিওতে ‘অনুরোধের আসর’-এর গান শোনার জন্যে। গান শোনার ব্যাপারে বাবা তাঁর গাম্ভীর্যের মুখোশ সরিয়ে তখন আমাদের বন্ধু হয়ে যেতেন।
আজও ভুলতে পারিনি ছেলেবেলায় শোনা আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেলা কণ্ঠের সেই অবিস্মরণীয় গানগুলো-
‘হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো সিং
তারা হাট্টিমা টিম টিম......
অথবা
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাক ঢোল মাদল বাজে......’
আবার সরস্বতী পুজো এলে যতো কষ্টই হোক না কেন, উপোস করে আমাদের মধ্যে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ায় ধুম পড়ে যেতো। আমাদের তখন কতোই বা বয়স-ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমাদের সমবয়সী মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে, অধিকাংশের শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তখনও পুষ্পাঞ্জলি শুরু হয়নি। হঠাৎ পুজো মন্ডপের মাইকে বেজে উঠলো সনৎ সিংহের গান :
‘সরস্বতী বিদ্যেবতী তোমায় দিলাম খোলা চিঠি-
একটু দয়া করো মাগো বুদ্ধি যেন হয়,
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়.......
গানটি আমাদের মনের দরজায় কড়া নাড়তো আর ভাবতাম, আরে, গায়ক তো আমাদের মনের কথাই বলছেন। এমনই ঐ ছোট্ট বয়সে দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে সনৎ সিংহের গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এক-ছুটে পুজোমন্ডপে চলে গিয়েছিলাম। আজও এতোগুলো বছর পেরিয়ে গানের কিছু কিছু কলি মনের মাঝে যখন গুঞ্জরিত হয়, তখনই মন চলে যায় বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সেই সব সুরেলা অধ্যায়ে।
‘এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই-
নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে,
নন্দী-বাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে।
মন বসে কি আর?
আহা-হা চন্ডীতলায় বাদ্যি বাজে ঢাক গুড় গুড়.....
কে জানে এবার বোধহয় সিংহরাজের কেশর দিল জুড়ে,
অসুর বোধহয় বেরিয়ে গেছে মোষের পেটটি ফুঁড়ে-
মন মানে না আর,
আহা-হা কতক্ষণে যাবে যে সব দেখবে ঠাকুর।’
।দুই।
ছোটদের গান শুনতে শুনতে বড় হলাম। বাল্য পেরিয়ে কৈশোরে। তারপর একদিন হঠাৎ করে যৌবনে পা দিলাম তখন ছোটদের গান বা ছড়ার গানের চেয়ে প্রেমের গান শুনতে ভালো লাগতো। তখন যে আমাদের অনেকেরই যৌবনে প্রেমের প্রথম মুকুল দেখা দিয়েছে। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। প্রেমের প্রথম পরশবাবার পর যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে ততবারই স্বর্ণযুগের শিল্পী মান্না দের বিষাদ মাখানো গানটি মনের মাঝে উদয় হয়েছে আর মনটা বেদনায় ভরে উঠেছে—
‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো,
কী চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজও হয়তো......’
তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের আর এক মরমী শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী প্রেমের গানটি মনের গভীরে রেখাপাত করলো।
‘আমি এত যো তোমায় ভালোবেসেছি
তবু মনে হয় এ যেন গো কিছু নয়,
কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।
তোমার কাজল চোখে যে গভীর ছায়া কেঁপে ওঠে ওই,
তোমার অধরে ওগো যে হাসির মধুমায়া ফোটো ওই,
তারা এই অভিমান বোঝে না আমার
বলে, তুমি তো আমায় ভালোবেসেছে-
শুধু আমার গোপন ব্যথা কেঁদে কেঁদে কয়।
কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।’
জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে তাকে পেয়েও না পাবার বেদনা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তখন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সুললিত কণ্ঠের গানটি হৃদয় বীণায় ধাক্কা মারে :
‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে আমারই এ দুয়ারে প্রান্তে,
সে তো হায় মৃদু পায় এসেছিল পারিনি তো জানতে।
...................................’
আজ কাছে তারে এত আমি ডাকি গো,
সে যে মরীচিকা হয়ে দেয় ফাঁকি গো-
ভাগ্যে যে আছে লেখা হায়রে
তারে চিরদিনই হবে জানি মানতে।’
১৯৬১ সালে সবে কলেজে পা ফেলেছি। সুধীন দাশগুপ্তের কথা ও সুরে শ্যামল মিত্র গাইলেন :
‘নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি,
হয়তো বা সেই ক্ষণেই তোমায় ভালোবেসেছি।
বনলতা কও কথা, হয়ো না গো কুন্ঠিতা-
দ্বিধা থরো থরো মনেই তাই না এসেছি।
জলভরা মেঘ ওই দু’চোখে দেখতে আমি পেয়েছি,
একলা মনে নির্জনেতো তোমার ছবি এঁকেছি।
একটি কথাই শুনব বলে তাই তো কাছে এসেছি,
বলবে কি গো, আমিও তোমায় ভালোবেসেছি।’
গানটি সুপার-ডুপার হিট হয়েছিল। সকলের কণ্ঠেই তখন গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠতো। কাকতালীয় ভাবে আমার বোনের বান্ধবীর নাম ছিল ‘বনলতা’। সে তখন কিশোরী। গানটা শোনার পর সে যেন মর্মে মরে গেল। বেশ কিছুদিন ঘর থেকে বেরই হলো না সে। ছোট্ট রেলওয়ে কলোনী সবাই সবাইকে চেনে। আজকের দিনে হলে ছেলেরা হয়তো তার পিছনে লেগে পড়তো। কিন্তু আমরা একসাথে বড় হয়েছি, খেলাধূলো করেছি। কেউ কিন্তু কোনোদিন শালীনভাবে সীমা লঙ্ঘন করিনি। কিছুদিনের মধ্যে বনলতা আমাদের সঙ্গে আগের মতোই হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলো। জানি না, আজ সে কোথায়?
জীবনে চলার পথে একদিন মাতৃহারা হলাম। মা ছিলেন আমার জীবনের ধ্রুবতারা। তারপর কর্মজগতে প্রবেশ করে ব্যস্ততাময় জীবনে মায়ের স্মৃতি ক্রমশ: ফিকে হতে লাগলো। তবু অবসর সময়ে মায়ের কথা মনে পড়লে স্বর্ণযুগের গানই আমার মনে প্রশান্তি এনে দিতো। গীতিকার প্রণব রায়ের কথায় ও শিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তীর নিজের সুরে গাওয়া গানটি বারবার মায়ের কথাই মনে পড়িয়ে দিতো। সবার অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলতাম।
‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে-
মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে।
তার মায়ায় ভরা সজল দিঠি সে কি কভু হারায়?
সে যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যারাতের তারায়-
সেই যে আমার মা।
বিশ্বভুবন মাঝে তাহার নেইকো তুলনা।
.......................................................’
।তিন।
স্বর্ণযুগের গানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে এক সময় দ্বারপরিগ্রহ করতে হলো। জীবন সঙ্গিনী হিসেবে যাকে পেলাম, তার কণ্ঠে গুনগুনিয়ে ওঠা হেমন্ত, মান্না, লতা, শ্যামল, সন্ধ্যার গান শুনে অবাক হলাম। অনুভব করলাম, তার জীবনের গানের জগতে স্বর্ণযুগের প্রায় সব শিল্পীই ভর করে আছেন। গানে গানে আমরা দু’জনার ভুবন ভরিয়ে তোলর জন্যে রেকর্ড প্লেয়ার কিনে আনলাম। সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাংলা আধুনিক গানের লং প্লেইং রেকর্ড। আর প্রতিমাসেই কোনো না কোনো শিল্পীর গানের রেকর্ড কেনা হতো। আর দুর্গাপুজোয় গ্রামোফোন কোম্পানী কোন শিল্পীর কি গান বের করে তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।
তার জীবনের মধ্যগগনে তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। এরপর শুরু হল আমার চলা-একা, একা শুধুই একা অন্তহীন পথে। মনের ভারমুক্ত করতে মাঝে মাঝে ফিরে যাই বাংলা গানের স্বর্ণযুগে।
আজ স্বর্ণযুগের বাংলা গান দিয়ে আমার প্রিয়াকে ভালোবাসা জানাবো-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, শ্যামল মিত্রের কণ্ঠের গান দিয়ে।
‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা
কে বলে আজ তুমি নাই
তুমি আছ মনে বলে তাই
তোমারই অমর নাম জয় গৌরবে
স্মরণে যে চিরদিন জানি লেখা রবে
মরমে হারায়ে তোমার খুঁজে পাই
তুমি আছে মন বলে তাই।
....................................’
একই সঙ্গে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের সেই সব অসাধারণ গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের জানাই আমার অন্তরের বিনম্র শ্রদ্ধা-যাঁরা স্বর্ণালী দিনের গানের মায়াজালে আজও আমাদের ভুবন ভরিয়ে রেখেছেন। আমরা সেই সুরেলা গানের নস্টালজিয়ায় আজও আক্রান্ত হই।
উদ্ধৃতি ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
এ শুধু গানের দিন
সংকলন : শ্রী শিশির চক্রবর্তী
লেখকের নিবেদন : যাঁরা আমার এই লেখাটি পড়বেন, তাঁরা লেখাটিতে উল্লেখিত গানগুলো যদি শোনেন, উপলব্ধি করবেন স্বর্ণযুগের আধুনিক বাংলা গান কথা ও সুরে আজও অবিস্মরণীয়, এক অনন্য নস্টালজিয়া।
Comments