ইউসুফ মোল্লার একটি প্রবন্ধ

 আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সাঁকো মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


       পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ম্যাজিক রিয়েলিজম ধারার অন্যতম ছোটগল্প 'এ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ ইনরমাস উইংস' -এর বাংলা অনুবাদ একাদশ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেন। যেখানে অনুবাদক হিসেবে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম থাকায়, বাংলা সাহিত্যের সকল স্তরের মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ ঘটে যায় তাঁর। ফলে ছাত্র-শিক্ষক-অনুবাদক-গবেষক সবার কাছে নন্দিত হতে থাকেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে সেইভাবে সন্মান পাননি। হয়তো ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে পছন্দ করতেন কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। কারণ একটাই ভীষণ কাট কাট কথা বলতেন। অবশ্য কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী তাঁর পছন্দের, নিকটের ছিলেন। তাইতো তাঁরা তাঁর আস্তানায় এসে আড্ডা দিতেন। নিছক আড্ডা বলা চলে। সেখানে পড়ালেখা কিংবা জ্ঞানগরিমার কথা বা আলোচনা হতো না।

       বুদ্ধদেব বসুর হাতে গড়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ। প্রথম ব্যাচে বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে মাত্র পাঁচ জন শিক্ষার্থী এই বিভাগে ভর্তি হন। এরমধ্যে আবার একজন ছাত্রী ছিলেন, নাম নবনীতা দেবসেন। নবনীতা দেবসেন ছাড়া আর যে চারজন ছিলেন তাঁদের মধ্যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পাঁচ জনের মধ্যে থেকে চারজনই পরে এই বিভাগে শিক্ষকতা করেন। এই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সি কলেজে (পরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) পড়েছেন, পাঠ শেষ না করে কেবলমাত্র বুদ্ধদেব বসুর প্রতি অগাধ ভালোবাসায় যাদবপুরে চলে আসেন। যাদবপুরের পরে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, তারও পরে পোল্যান্ডের ভাসকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেন। বিষয় ছিল- ভারতীয় সাহিত্যে তুলনামূলক নন্দনতত্ত্ব। নিজে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেননি, কিন্তু ওঁর কাছ থেকে বহু শিক্ষার্থী ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন। তিনি শুধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছেন ভারতীয় সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে। তবে প্রথম অধ্যাপনা শুরু করেন মায়ানমারের রেঙ্গুনে।

      মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বেশি লম্বা ছিলেন না, বেঁটে বলায় চলে। তিনি একবার রসিকতা করে বলেন, "আমার চেয়েও লম্বায় কম দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (অসাধারণ গাল্পিক, গদ্যকার, কমিউনিস্ট, একদা 'পরিচয়' পত্রিকার সম্পাদক)"। কবি-সাংবাদিক- অনুবাদক সমীর দাশগুপ্তের কথায়, 'বেঁটে বামুন হলে কী হবে, দেশি- বিদেশি সাহিত্যে ঈর্ষণীয় পান্ডিত্য। মানবের মতো এত বই আমরা পড়িনি'। একই কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পড়ুয়া সমকালীন সময়ে খুব কম জন ছিলেন। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এতো পড়াশোনা করা সত্ত্বেও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন খুব সামান্য। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলতেন, "অনেকেই আছেন, লিখছেন। লিখবেন।"

      গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে প্রথম যিনি বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালিদের কাছে পরিচয় ঘটিয়েছিলেন, তিনি হলেন এই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুবাদ যেন তাঁর হাতে মূল ও মৌলিক সাহিত্য, পরিচ্ছন্ন, শৈল্পিক। বাংলা ভাষায় এমন অনুবাদক দুর্লভ। অনুবাদের জন্য তিনি যেসকল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে বলতেন, "তাঁদের প্রাপ্য, অনুবাদ করেছি যাঁদের।" বাঙালির চোখের সামনে বিশ্বসাহিত্যের দুয়ারটা হঠাৎ করে খুলে দিয়েছিলেন এই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ১৯৮২ সালে, কিন্তু তার অনেক বছর আগেই ১৯৭০ সালে তাঁর লেখা অনুবাদের কাজে হাত দেন তিনি। তাঁর সৌজন্যেই নোবেল প্রাপ্তির আগেই মার্কেজকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন।অনুবাদ করেছেন 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না', 'সরলা এরেন্দিরা'। এমনকি নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন মার্কেজ সেটিরও অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়া কার্লোস ফুয়েন্তেস'কে বাঙালিরা পড়েছেন তাঁরই সুবাদে। এমনকি লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত সব লেখকদের সাথে বাঙালির যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছিলেন তিনিই। মার্কেসের 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না' দিয়ে কর্নেলের যে দুঃখের আঙিনায় রেখেই তিনি আমাদের স্বাদ পাইয়েছেন সারা দুনিয়াকে মোহিত করে দেওয়া লাতিন আমেরিকার জাদু বাস্তবতার। আত্মহত্যার অধিকার বইয়ে আবার লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি নাইজেরিয়ার ওলে সোয়েঙ্কা, সুদানের তায়েব সালিহর 'মাওসিম আল-হিজরাহ ইলা আল-শিমাল' উপন্যাসের অনুবাদ থেকে জঁ জেনে, টারজান, বুদ্ধদেব বসুর শিশুসাহিত্য, শিবরাম চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া প্রভৃতি নিয়ে লিখেছেন। নোবেলজয়ী মারিও ভার্গাস য়োসাকে নিয়ে 'জলের মধ্যে একটি মাছ', এদুয়ার্দো গালেনোকে নিয়ে 'প্রবন্ধের অন্য সাজ' এবং 'বাস্তবের কুহক' গ্রন্থে আরহেন্তিনার ম্যানুয়েল পুইগ, চিলির আন্তোনিও স্কারমেতা ও পেরুর ভার্গাস য়োসাকে নিয়ে দুটি করে প্রবন্ধ রচনা করেছেন।আত্মহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ বইয়ে ‘শিল্পীর সঙ্কট: দুটি চিঠি’ নিবন্ধটি উল্লেখ্য। তিরিশের দশকে হিটলারের জার্মানি। টমাস মান, হেরমান হেস, বের্টোল্ট ব্রেখ্ট দেশছাড়া। কবি গটফ্রিড বেন দেশ ছাড়েননি, বার্লিন থেকে তাঁর চিঠি, ‘শ্রমিকরা এখন আগের চেয়ে ঢের ভাল ব্যবহার পায়। সুপারভাইজার এবং কর্তৃপক্ষ অনেক ভদ্র। সোস্যালিস্ট পার্টি যা দিতে পারেনি, জাতীয়তাবাদী সমাজবাদ তাই দিয়েছে। যারা বলে, হিটলারের পিছনে জনগণ নেই, আছে ভেড়ার পাল, তারা মিথ্যাবাদী।... সাহিত্যিককেও বেছে নিতে হয়, তিনি কী নেবেন। ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি, না রাষ্ট্রাভিমুখী গতিপথ। আমি বেছে নিয়েছি দ্বিতীয়টা।’ এর পরই মানববাবু দেখান কয়েক বছর পর টমাস মানের লেখা চিঠি। মহাযুদ্ধের শেষে আমেরিকার বাসিন্দা টমাস মানকে ফিরে আসার কাতর অনুনয় করে জার্মান লেখক ও শিল্পীরা চিঠি লেখেন। মানের উত্তর, ‘যা কিছু ঘটেছে, যেমন ভাবে ঘটেছে, তা নিশ্চয় আমার কৃতকর্ম নয়। জার্মান চরিত্রেই অনিবার্য ফল ওটা। জার্মান জাতির নিয়তি।’ মানুষের স্বাধীনতার স্পন্দন, বেঠোফেনের ‘ফিডেলিয়ো’ নাৎসি শাসকদের তখন প্রিয়। বাদকেরা সেই সুর বাজান, লোকে ভিড় করে শোনে। মানের চিঠি, ‘‘হিটলারের জার্মানিতে ‘ফিডেলিয়ো’ শোনার মতো চরম নির্বুদ্ধিতা আমি কল্পনা করতে পারি না।’’

    কিংবা ‘আত্মহত্যার অধিকার’ প্রবন্ধটি! রবীন্দ্রনাথের পাশে জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও নিয়ে আসেন লেখক। ব্যর্থ প্রেমের আত্মধ্বংস নয়, শুধুই অকারণ আত্মহত্যা। এখানেই লেখকের চমৎকারিত্ব। পড়ে নিতে পারেন ‘অনুবাদ, প্রমাদ ও প্রমোদ।’ মানববাবু জানান, লেখককে সংস্কৃত ও সভ্য করে তুলতে হবে। অনুবাদে জুড়ে দিতে হবে সাহেবদের পণ্ডিতি। ইউনেস্কো-র পথের পাঁচালী-র অনুবাদে তাই প্রথম লাইন, Harihar Ray was a brahmin।এই ঝাঁজালো মেধার সঙ্গেই তো তর্ক করা যায়! অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর কৃতিত্বের জন্য ভারতীয় সাহিত্য একাদেমি তাঁকে 'অনুবাদ পুরস্কার'-এ ভূষিত করেছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যমন্তক দাস বলেন, "যাঁরা ইংরেজি ভাষায় সড়গড় নন, তাঁরা বিদেশের বিভিন্ন সাহিত্য বাংলা ভাষায় খুব অনায়াসেই পড়তে পেরেছেন। গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদের মধ্যে বলব, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, স্প্যানিশ সাহিত্য ইত্যাদি। তাঁর একমাত্র কৃতিত্ব দিতে হয় মানবেন্দ্রবাবুকে।" মাল মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে অবশ্য 'অনুবাদ' শব্দটি পছন্দ করতেন না। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মজার ছলে বলেছিলেন, " আমি বলি, অনুবাদ মানে হল অনু পরিমাণ বাদ। সে কারণেই এই তর্জমা শব্দটার উল্লেখ।

    মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু অনুবাদ করেননি সম্পাদনাও করেছেন। তাঁর সম্পাদিত ছোটদের গল্প সংকলন 'হরবোলা', 'জিয়নকাঠি' প্রভৃতি। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি 'খগেন্দ্রনাথ মিত্র স্মৃতি পুরস্কার' ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে 'বিদ্যাসাগর পুরস্কার' পেয়েছেন। 'আধুনিক ভারতীয় গল্প'ও তাঁর সম্পাদনায় এক অতুলনীয় কীর্তি।

      তিনি শুধু অনুবাদ বা শিশু সাহিত্য বা অন্য কিছু নিয়ে সাহিত্য রচনা করেননি। একইসাথে প্রণিধানযোগ্য খেলা নিয়ে তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল। কারণ তিনি নিজে খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে পারতেন। এই বহু প্রতিভা দেখে গৌতম চক্রবর্তী ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩ তারিখে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় একটু মজা করে লিখেছিলেন, 'বাংলায় তিনজন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা, ছোটদের জন্য ক্রিকেটের গল্প থেকে জুল ভের্ন অনুবাদ সবেতেই সিদ্ধহস্ত। দ্বিতীয় মানবেন্দ্র দক্ষ অনুবাদ শিল্পী। তাঁর হাত ধরেই কৃষণ চন্দর, গিরিশ কারনাড থেকে বরিস পাস্তের্নাক, লোরকা, গার্সিয়া মার্কেজ, পিটার বিকসেল অনেকে নাড়া দিয়েছেন বাংলা সংস্কৃতিকে। তৃতীয়জন তুলনামূলক সাহিত্যের জনপ্রিয় অধ্যাপক।' এই তিনজনই একজন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

     মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনূদিত বেলজিয়াম লেখক জর্জ রেমির কমিক সিরিজ 'টিনটিন' -এ তো একসময় দুই বাংলার কিশোরেরা ডুবে ছিল।

    মালয়ালম সাহিত্যের ভৈকম মুহাম্মদ বশীরকে আমরা বাংলায় পেলাম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে। উর্দু সাহিত্যিক কৃষণ চন্দরকে আমরা বাংলায় পেলাম তাঁর অনুবাদে। কানাডা ভাষার গিরিশ কারনাড-কে বাংলায় পেলাম তাঁর অনুবাদের মাধ্যমে। তবুও আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে আদানপ্রদানের অভাব নিয়ে আজীবন চিন্তা করে গেছেন তিনি। ঘনিষ্ঠ মহলে বলতে শোনা গেছে, কোন কোন ভাষায় বই অনুবাদ হয়েছে? মির্জা গালিবের বাংলা অনুবাদে কোনও বই আছে কি? এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন।

    ১৯৩৮ সালের ২৫ এপ্রিল সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই 'মরার আগে জন্মভিটে দেখব' বলেছিলেন, কিন্তু পূরণ হয়নি। মারণ করোনা ভাইরাসের কারণে ২০২০,৩ আগস্ট চলে গেলেন অজানার পথে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024