আশীষ কুণ্ডুর একটি গল্প
অমিত
পুকুরপাড় বরাবর হেঁটে চলেছে অমিত। টুপ করে আওয়াজ হোলো। মনে হয় কোনো বড় মাছ ঘাই মারছে। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। অমিত আজ একটু অন্যমনস্ক। উল্টোদিক থেকে আসা ভদ্রলোককে প্রায় ধাক্কা মারতে যাচ্ছিলো অমিত, শেষ মুহূর্তে সরে আসতে আসতে দেখলো ত্রিদিবকে।
" অমিতদা,এখানে,ইভিনিং ওয়াক, তোমার কাছে যেতাম, লকডাউন তাই যেতে পারিনি, খবরটা ফোনে দিতে পারতাম, কিন্তু তোমার নম্বর সেভ নেই, দাদা গত রোববার সকালে চলে গেলেন।"
অমিত আচমকা খবরটায় চমকে গেলেও, মনে আশঙ্কার মেঘ, করোনা নয়তো, তবু ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, "কি হয়েছিল? "
- "দাদার হাইসুগার ছিল জানোইতো, একটু জ্বর ছিলো, দাদা করোনার ভয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলো না, সব শেষ হয়ে গেলো" গলাটা ধরে আসে ত্রিদিবের।
" তার মানে টেস্ট কিছু হয়নি, হয়তো সাধারণ জ্বর,আবার করোনা,থাক্, কিছুই জানতে পারলি না, অদ্ভুত সিস্টেম আমাদের, তোরা আইসোলেটেড থাকছিস না কেন? কেউ তোদের বলেনি। "
-" তুমি শুধু শুধুই ভাবছো, ডাক্তার ডেথসার্টিফিকেটে হার্টফেল লিখেছেন। তাই আমরা হঠাৎ করে আইসোলেটেড থাকবো কেন? "কথা বাড়ালো না অমিত।
এই ছোট্ট রেলের শহরটা অধিকাংশই রেলের অধিকারে। তাকে ঘিরে যে বলয় সেটা পুরসভার অধীনে। অমিত অবিবাহিত।
প্রায় দুবছর আগে পিতৃবিয়োগের পর থেকে একলা চলা জীবন। দাদা দূরে ওড়িশায়। গত বছরটা দেশের নানাপ্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছে অমিত, মন তখন চঞ্চল, আর একটা কারণ ওর ট্রাভেলসের বিজনেস। মাঝে মাঝে ফিরে আসা। তখন পার্টির কাজ, যদিও পার্টি এখন ক্ষমতায় নেই, তবু অনেক কাজ করতে হয়। সোশ্যাল ওয়ার্কে আনন্দে থাকে অমিত। খেলাধুলোর জগতের সাথে জড়িয়ে গেছে অমিত গতবছর ডিসেম্বর থেকে। তাই বেরোনো হয়নি। সবে যখন একটা ট্যুর প্লান করছে তখনই ঘটলো বিপত্তি। করোনা। শুরু
হোলো লকডাউন। দাদার সঙ্গে গত মাসে শেষ দেখা হয়েছে।
আজ রোববার, ডি আই জি অমিতকে ডেকেছিলেন, বললেন, " অমিত,আই হ্যাভ ফেথ ইন ইউ। আমি তোমাকে কিছু ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছি। তুমি দুঃস্থদের দিও, এ্যাট ইওয়োর ডিস্ক্রিশন।আমরা পুলিশের লোকেরা গেলেই , বুঝতেই পারছো, শাসকদলের খপ্পরে পড়ে গুবলেট পাকিয়ে যাবে। মূল উদ্দেশ্য আর্তদের সাহায্য,হবে না। গাড়ী দিচ্ছি, ফটাফট্ করো। " সব বিতরণ করে বাড়ী ফিরতে অমিতের দুপুর দুটো হয়ে গেলো। বারোটা নাগাদ রাস্তায় এসেছিলো দাদার ফোন, সাবধান বাণী , করোনা নিয়ে জিজ্ঞাসা ,দাদার উদ্বেগটা চাপা থাকেনি অমিতের কাছে।
রান্না করতে হবে।অমিতের মাথায় পাক খাচ্ছে ত্রিদিবের কথা।' বিকেলে দেখি '-এই ভাবনা নিয়ে রান্না খাওয়া সেরে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে অন করতে যাবে , ফোনটা বেজে উঠলো, দাদার নম্বর ফুটে উঠেছে। তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করতেই বৌদি কান্নাজড়ানো স্বর," তোমা- আ-র দাদা--কেমন করছে-- এ, স-ও- ব শেষ !"
ফোনটা ছিটকে মেঝেতে। অমিত ফোনটা তোলার চেষ্টা করলো একবার। হাত এতো কাঁপছে যে ফোনটা জোড়া যাচ্ছে না। " মাথায় হাজার হাতুড়ির শব্দ। ' কি হোলো দাদার,' একমাত্র এই পৃথিবীতে দাদা ছিলো নিজের রক্তের শেষ সম্পর্ক ! 'কি ভাবতে কি ভাবছি,'শেষ '-কথাটা ভাবা যাবে না, পজিটিভ ভাবতে হবে।'-কম্যুনিস্ট মনে এখন অনেক দ্বন্দ্ব ! বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অমিত, লকডাউন হোক, যাই হোক, দাদার কাছে পৌঁছানো জরুরী। চিন্তার ঘোড়া দৌড়চ্ছে।দাদার চন্দনগরে ব্যবসা । দূরত্ব নব্বই কিলোমিটার। রাস্তা ফাঁকা। মেরেকেটে দেড়ঘন্টা লাগবে। পাশের বাড়ির সমরদাকে অমিত বললো সব কথা এবং বললো ডিআইজিকে একটু বলে দিতে।
দাদার বাড়ীর দরজা খোলা, বুক ঢিপ ঢিপ করছে।একি! দাদা সোফায় বহাল তবিয়তে। ব্যাপারটা কি? দাদা হাসতে হাসতে বললো, " দূর পাগলা, বৌদিকে তো জানিস, আমি আসন করতে করতে শবাসনে,একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর তোর ফোন বন্ধ পেলাম। এসেছিস যখন লকডাউন কাটিয়ে যাবি। "
Comments