শ্রাবণী মুখার্জীর একটি গল্প

   তৃপ্তি



এলার্মের আওয়াজ টা এতো তীব্র লাগে উফ আর পারি না বাবা , সকাল বেলাতেই মুখটা বাংলার পাঁচ করে বিছানার উপর উঠে বসলো শিপ্রা । রবিবারেও একটু শান্তি নেই । মাসি আজ কাজে আসবে না বলেছে , ওর ছেলের জন্মদিন । এদিকে বিষ্ণুপুর ঘরানা তে সংগীতের ডাক পড়েছে শুভম এর , যেতে হবে।  

বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে যাবার পথে হঠাৎ দেখলো শুভম সরস্বতী ঘরে কি যেন করছে ঝুঁকে মন দিয়ে ।

'এতো সকাল বেলা শুভম সরস্বতী ঘরে কেন '?

পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েও ফিরে এলো শিপ্রা , চেয়ারে ঝুঁকে পড়া শুভম এর গায়ে হাত দিয়ে আলতো করে ঠেলতেই শুভমের দেহ এলিয়ে দিলো মেঝেতে ।

বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠেই শিপ্রার চক্ষুস্হির ।

শুভমের মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে ।

তাহলে কি তাকে সাপে কাটলো ?

কান্নায় বুকটা ফেটে চৌচির হলেও মিনিট পরেই নিজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব কাটিয়ে একটা নার্সিংহোমে ফোন করে এম্বুলেন্স এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । 

করোনা কালে নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া ভীষণ জটিল , যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে কি হবে ? শুভমের হলোটা কি ? একটি বড়ো সরস্বতী মায়ের মুর্তি ও একটি সরস্বতী মায়ের স্কেচ ছবি দেওয়ালে ছাড়া কিছু থাকে না এই ঘরে , এই ঘরেই শুভম সংগীতের সাধনা করে , কোনো কাজ না থাকলে ও সময় পেলে এই ঘরেই এসে বসে ,। শান্তি পায় মাতা সরস্বতী র মূর্তির দিকে তাকিয়ে থেকে ।ইদানিং একটা আরামকেদারা রেখেছে , যখন ই মন খারাপ হয় এখানে বসে কিছুটা স্বস্তি পেত সে ।

সারাদিন মেঝেতে বসেই সে সাধনা করে সংগীতের ।

   বারো বছরের দাম্পত্য জীবনের মূলমন্ত্র হলো বিশ্বাস যা রসহীন হয় নি কোনোদিন ।একটু নামডাক হয়েছিল ইদানিং , দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী শুভম রায়ের সুমধুর ক্লাসিকাল কন্ঠ ,জয় করেছে সবার মন ।

শুভমের সারা শরীর উল্টেপাল্টে নিরীক্ষণ করে 

 না কোথাও তো কোনো কাটা দাগ বা ক্ষত চোখে পড়লো না ।সাপের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলো না সে সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও ।

তাহলে মুখে গ্যাজলা কেন বের হলো ?


পাশের ঘরে প্রফুল্ল কে জাগিয়ে বললো "শোনো সোনা তোমার বাবার শরীর খারাপ হয়েছে , এম্বুলেন্স এলেই আমরা হাসপাতাল যাবো তুমি বাড়িতে দরজায় লক করে চুপচাপ খেয়ে শান্ত হয়ে পড়াশোনা করবে , বুঝলে" ?

 ঘুমচোখে প্রফুল্ল একনিশ্বাসে বলা কথা গুলো অর্ধেক বুঝলো অর্ধেক বোধগম্য হলো না ।

এম্বুলেন্সের শব্দে দ্রুত শিপ্রা বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে । 


ডাঃ বাবু কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে আশার আলো দেখাতে পারলেন না ।

বললেন একটা অপারেশন করে চেষ্টা করতে পারি হয়ত, তারপর ভগবানের হাতে । 

কি হয়েছে ওর ?

ওনার হার্ট ব্লক , ব্লাড সারকুলেশন বন্ধ হয়ে গেছে । ইমিডিয়েট অপারেশন করে ভেতরের জমাট বাঁধা রক্ত পরিস্কার করে পাম্পিং প্রক্রিয়া স্বাভাবিক করতে হবে ।


আপনি তাড়াতাড়ি করুন ফর্ম টা ফিলাপ করে টাকা জমা করে দিন আর চার ইউনিট রক্ত লাগবে , একটু তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করুন নইলে কিছু করার থাকবে না .. বলেই ডাঃ বাবু নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন । 

 অসহায়ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শিপ্রা বেরিয়ে গেলো সোজা বাইরে গাছের তলায় মাথা নীচু করে চোখের জল লুকানোর চেষ্টায় বসে পড়লো ।


 ঘন্টা খানেক পর হঠাৎ চমকে উঠলো ' শুভম কে তো কিছু খাওয়ানো হয় নি ,ও বেডে একলা পড়ে আছে হয়ত আমাকে খুঁজছে '!

হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে দেখলো শুভম ঘুমিয়ে পড়েছে ,পাশে থাকা চেয়াটায় শিপ্রা বসে পড়লো ক্লান্ত হয়ে । আজকের দিন তো পেরিয়ে গেলো , কাল যদি জোগাড় না করতে পারি তাহলে ? যতো দেরি হবে তত শুভমের জীবন সংকটে পড়বে কি করি উপায় ! ফেসবুকে অনলাইন হলো , কিছু ভালো লাগছে না ..

কোনোকিছুতেই মন বসছে না ।কী করবে সে ?

কাকে ডাকবে ? অফিসে বললে তো লোন ও এতোটাকার দেবে না একসাথে , রক্ত ই বা কোথায় পাবো ? একবোতল হয়ত নিজে দেবে কিন্তু আরো তিন টা চাই ...... উফ!! ভগবান কি শাস্তি দিলে ?

মেসেনজারে বহুলোকই মেসেজ লেখে তাদের কোনো উত্তর দেওয়া হয় না কোনোদিনই , সময়ের অভাব ইচ্ছের অভাব । আজ অলক্ষ্মে মেসেনজারে হাত দিয়ে একবন্ধুকে ভালো আছি লিখলো কাঁদতে কাঁদতে , 

 সেই বন্ধুর সাথে সাথ জবাব এলো কি ম্যাডাম একবছর পর উত্তর দিলেন যে বড়ো ??

আজ সময় আছে ??

এমনিতেই মন অশান্ত ছিলো তারপরে এর কথা ভেঙচি লাগলো ,অফ হতে যাবে সেই সময় আবার মেসেজ এলো ' সব কিছু ঠিক আছে তো ' ??

 না মানে সরি...বলছি শরীর মন সব ঠিক আছে ?

আসলে আপনি তো জবাব দেন না তাই হঠাৎ মনে হলো যেন কোনো অসুবিধা তে আছেন  

ওকে টাটা এগেন সরি ভালো থাকুন ।


শিপ্রা লিখলো হুম ঠিক ধরেছেন ..

আমি বর্তমানে আর জি কর হাসপাতালে কেবিন নং 5 এ। 

 ফোনটা অফ করে সাইডে রেখে বেডের ধারে মাথা টা ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ।


রাত দশটা বাজে মা বাবা এখনো এলো না তো ?

ভেবে মাকে ফোন করলো প্রফুল্ল । মায়ের কাছে কোথায় খাবার আছে জেনে নিয়ে বললো তুমি চিন্তা করো না মা , আমি গেটে ভালো করে চাবি দিয়ে দিয়েছি সকালেই একবারো খুলি নি তোমরা কখন আসবে মা ?

শিপ্রা কোনো উত্তর দিতে পারে নি, ফোনটা পাশে রেখে শুভমের বিছানার প্রান্তে মাথাটা নামিয়ে দিলো ।

খুব সকালে নার্স এসে জানালো আজ আপনার স্বামীর অপারেশন হবে দশটায় । তারআগে আপনি সব ফরম্যালিটি গুলো পূরণ করে দেবেন । 

অফিসে ফোন করে শিপ্রা লোনের ব্যাপারটা স্যাংকশেন হলো কিনা জানতে চাইলো , ম্যানেজার বাবু বললেন চিন্তা করবেন না ম্যাডাম সব ঠিক হয়ে গেছে , 

রিসেপশনে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করলো শিপ্রা ,তখন ই তিনটি ছেলে রিসেপশনে এসে শুভমের নাম পরিচয় দিয়ে দেখা করতে চাইলেন তার সাথে ।শিপ্রা এগিয়ে এসে জানতে চাইলো ব্যাপারটা। 

কি ব্যাপার বলুন ? আমি শুভমের স্ত্রী ।

ও নমস্কার ম্যাডাম  

আমাকে চিনতে পারেন নি ? আমি প্রকাশ 

আপনার ফেসবুক বন্ধু ।

কাল কথা হলো আপনার সাথে , আপনার স্বামীর জন্য রক্ত লাগবে বললেন ।

শিপ্রা এতক্ষণে বুঝতে পেরে বললো ও হ্যাঁ বন্ধু মনে পড়েছে , 'আপনি রক্তের ব্যবস্থা করেছেন ' ?

হ্যাঁ ম্যাডাম ।এই আমরা তিনবন্ধু রক্ত দেবো আজ কাল আরেক জন কে নিয়ে আসবো আপনার তো চার ইউনিট ব্লাড লাগবে ? 

হ্যাঁ মানে ওই আর কি ডঃ বাবু তো তাই বলেছিলেন : 

বলে ঘাড় নামিয়ে নিলো শিপ্রা ।


সিস্টার আমরা রক্ত দেবো আপনি প্লিস ব্যবস্থা করুন তাড়াতাড়ি , আমাদের কাজে যেতে হবে , আর শুভম বাবুর ও অপারেশন তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ।

বলেই শিপ্রার দিকে তাকিয়ে দেখলো উপোসী মুখে ক্লান্তির ছাপ । উস্কোখুস্কো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখে পড়ছে আবার নিজেই সরে যাচ্ছে যেন কুমির ডাঙ্গা খেলছে ।কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে ফুটন্ত গোলাপের পাপড়ি ।

আপনি এতো ঘাবড়ে আছেন কেন ম্যাডাম ? কোনো অসুবিধা হবে না আমরা এসে গেছি , এই এলাকায় যখন যার ই বিপদ হয়েছে শুধু একবার কানে শোনার অপেক্ষা , আমরা বন্ধুরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি , যতোটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করি । আপনি ভাববেন না যে আমি আপনার বন্ধু বলে এলাম । আমরা সবার জন্যই এসব টুকিটাকি কাজ করে থাকি ।

একনাগাড়ে কথা গুলো বলে প্রকাশ থামতে শিপ্রা আস্তে আস্তে মুখ তুলে দেখলো পাতলা, শীর্ণকায় , ছেঁড়া চপ্পল পায়ে, শ্যামলা বরনের তিনটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার দিকেই তাকিয়ে , চোখে মুখে বেশ তৃপ্তির ঔজ্জ্বল্য ।

মনেই হলো তারা এসব বানিয়ে বলছে না ।

চলুন তো আপনার স্বামীর সাথে পরিচয় করে আসি 

বলেই রিসেপশনে 5 নং কেবিনটা কোনদিকে জেনে নিজেরাই দুদ্দাড় করে উপরে উঠে গেলো ।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শিপ্রা ও গেলো তাদের পিছুপিছু । শুভম বিছানার উপর উঠে বসে শিপ্রাকেই খুঁজছিলো চারদিকে তাকিয়ে , দেখতে না পেয়ে আস্তে আস্তে নামতে যাবে কিনা চিন্তা করে পা টা খাটে ঝুলাতেই দরজা ঠেলে তিনজন যুবক ঘরে প্রবেশ করলো , ভয়ে শুভমের মুখ পাংশু হয়ে গেলো , এরা কারা ? কি করবে ? আমাকে মারবে ? চোর নাকি ? শিপ্রাও নেই কাছে তাহলে কি হবে ? প্রশ্নের ভিড় যখন গিজগিজ করছে মাথায় .. 

কেমন আছেন দাদা ?

আমরা আপনার সাথে পরিচিত হতে এলাম আমি প্রকাশ আর এ বিল্টু আর এই যে নীল শার্ট টা পরে আছে ও হলো শ্যামল ।

ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া শুভম কাঁপতে কাঁপতে শীর্ণ হাতদুটো তুলে নমস্কার করতেই শিপ্রা কে দেখে বুকে বল ফিরে পেলো । আলাপচারিতা সারতেই নার্স দিদির ডাক এলো , ওরা তিনজন দুদ্দাড় করে চলে গেলো আবার আসবো কাল কথা দিয়ে ।


 প্রকাশ একটা কথা বলবো ? তোমরা সবাই আজ আমার যা উপকার করলে এর ঋণ শোধ কি ভাবে করবো ?

ঋণের ব্যাপার নেই তো ম্যাডাম , আমরা সবার জন্য ই চেষ্টা করি । তাছাড়া ঋণ শোধ হলেই কি মিটে যাবে ?এই যে আপনি ব্যাংক থেকে লোন নিলেন সেই লোন হয়ত আপনি শোধ করবেন কিন্ত যে সংকটের মধ্যে আপনি এই উপকার পেয়েছেন সেই সময়টা ফেরত দিতে পারবেন ? যতোদিন আমরা পৃথিবীতে থাকবো ততদিন এই সময় টা ক্যামেরা বন্দী হয়ে গেলো । এটাই সবচেয়ে বেশী পাওনা ।

আপনি হয়ত কখনো আবার এই ঋণ শোধ করতে পারবেন আমার বা অন্য কারোর প্রয়োজনে কিন্ত এই সময় টা ফেরাতে পারবেন না ।

সুতরাং ঘোর ঘনঘটা বিপদে যে সাথে দাঁড়ায় তার ঋণ শোধ হয় না কি বুঝলেন ? এবার একটু হাসুন তো দেখি । আপনার হাসিমুখটা আমায় খুব শান্তি দেয় , ভালো লাগে ।



 সাতদিন পর বাড়িতে ফিরে এলো শুভম । ভীষণ আনন্দ লাগছে সেই চেনা গন্ধ , নিজের বাড়ির আত্মসুখ ,প্রফুল্ল র মিনিটে হাজার কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব ,পাশের গলি দিয়ে মাছমাসির মা... ছ........., আছে , বিধু গোয়ালা দুধের প্যাকেট নামিয়ে হেঁকে দিলো , সকালবেলাতে একফালি সূর্য হেসে লুটোপুটি খায় বিছানায়, তার পায়ের উপর নরম হাত বুলিয়ে দেয় , রান্নাঘরে শিপ্রার কুকারের সিটি আহা মনটা নেচে ওঠে মাঝেমাঝে ।


প্রায় দু-মাস পর আজ রেওয়াজে বসেছে শুভম , ভোরবেলা ওঠেই সরস্বতী ঘরে স্বরগম সাধছে পূরবী রাগে , বিছানায় শুয়ে শুয়েই কিছুক্ষণ শুনলো মন দিয়ে শিপ্রা , না বেশ ভালো ই গায় ও

 অফিসে সেদিনের ছুটি মঞ্জুর করার জন্য অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়েছে সে ,এবারের অনুষ্ঠান বেশ ভালো হবে ।ঠাকুর ওদের তুমি মঙ্গল করো ,যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিস্বার্থ দানের বিনিময়ে আজকের এই দিন , নিজেকে খুব তৃপ্ত লাগছিলো । ঈশ্বরের উদ্দেশ্য হাতজোড় করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনছিলো একমনে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024