রামপ্রসাদ সরকারের একটি প্রবন্ধ
আমি বৃষ্টি
আমি বৃষ্টি। আমার মনটা আজ ভাল নেই। মনটা ভাল থাকবে কী করে বলো। নীল নবঘনে আষাঢ় গগন থেকে বারিধারা হয়ে যখন ঝরে পড়ি বা শ্রাবণ মেঘের চাদর সরিয়ে যখন অঝোর ধারায় নেমে আসি, তখন তো কেউ স্বেচ্ছায় আজকাল বারিধারায় ভিজতে আসে না। বাদল ধারায় উছলিয়ে পড়া পুকুর, নালা, খাল, বিলে ছেলেমেয়েরা আজকাল কেউ আর কেয়াপাতার নৌকা ভাসায় না, সেই জলে কত শাপলা শালুক ফুটে থাকে, ফড়িং-এর দল খেলে বেড়ায়। কচি-কাঁচার দল তো আসে না ফড়িং ধরতে, ফড়িং-এর ল্যাজে সুতো বেঁধে ঘুড়ির মতো করে ওড়াতে, ছেলেদের দলও জলে-কাদায় মাখামাখি করে ময়দানে ফুটবল খেলতে নামে না, হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে চু কিত-কিত খেলে না অনাবিল আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে।
তোমাদের রবিঠাকুর কতোভাবে কবিতায়, গানে আমার বন্দনা করেছেন—
‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’
‘ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরির মাঝি
অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি’
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝর ঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়’
তবু সবাই চায় আমার থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে চলতে। তাই তো রক্ষা পেতে বর্ষাতি আজ সবার বর্ষায় ভরসা। মা বলেন ‘এই ভরা বাদলে খোকাকে স্কুলে দিয়ে আসতে যাচ্ছ যাও, দেখো ভেজে না যেন। ওর মাথায় ছাতাটা ঠিক করে ধরো।’ এদিকে রিক্সা-অটোওয়ালারা বকুনি খাচ্ছে সিটের সামনে ঝোলানো আচ্ছ্বাদন নেই বলে।
তোমরাই বলো এ অপমান আমার গায়ে লাগে না বুঝি? আমার মন যে খারাপ হয় তা তোমরা কেউ বুঝতে চাও না।
অতচ তোমাদের কবিরাই আমাকে নিয়ে কতোনা মাতামাতি করেছেন।
প্রথমেই তোমাদের রবিঠাকুরের কথাই বলি। তিনি আমাদের কতো আপন করে নিয়েছেন, কতো ভালোবেসেছেন।
আমার অঝোর ধারায় ঝরে পড়ার দিনে তিনি বলেছেন—
‘আজ শ্রাবণে আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষনে ক্ষনে
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে।’
বর্ষার প্রতীক কদম ফুল। কদম ফুল সব কবিদের মনে এক কাব্যিক মোহময় জাল বিস্তার করে। প্রকৃতি প্রেমিকরা কদম ফুলে রূপলাবণ্যে দিশেহারা হয়ে তোমাদের রবিঠাকুরে আশ্রয় করেন।
‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছে দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান...
তোমাদের রবিঠাকুরের কলমে আবার ভিন্ন সুরও শোনা যায়
‘আমি তখন ছিলেম মজন
সুখের ঘোরে
যখন বৃষ্টি নামলো...’
তোমাদের আর এক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘যখন বৃষ্টি নামলো’ কবিতায় কী বলেছেন জেনে নাও—
‘বৃষ্টি নামলো যখন আমি
উঠোন পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার
পাবো দেখা
হয়তো মেঘে বৃষ্টিতে শিউলি
গাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো
আকাশ ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাইরে অন্তরে
মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের
মধ্যে ঝরে’
আবার ...ভরা বাদলের রাতে তোমাদের বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুলের লেখায় বিরহের সুর ফুটে ওঠে;
‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে
মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে’
বিরহের কথা যখন এলো তখন বলি সত্যিই তো শ্রাবণের বারিধারা প্রেমের গুঞ্জন তোলে, বিরহের বেদনা জাগায় মানুষের মনে। তোমরা একটা পৌরাণিক গ্রন্থের দিকে নজর দাও। দেখবে কালিদাসের ‘মেঘদূতম’ কাব্যে বিরহী যখন রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত হয়ে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে নববর্ষার মেঘ দেখে তার মাধ্যমে আলকাপুরীর রম্য প্রাসাদে তার বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করবেন বলে মনস্থির করেন।
আমি যখন অঝোর ধারায় ঝরি তখন তোমাদের স্মৃতিকাতর, বেদনাবিদুর, কর্মবিমুখ করে তুলি।
সব কিছু পেছনে ফেলে চলে এসোনা আমার কাছে— ভিজবে শুধু ভিজবে। তোমাদের সব ক্লান্তি, বেদনা দূর হয়ে সতেজতা ফুটে উঠবে দেহবল্লীতে। তোমাদের কচিকাঁচাদের পাঠিয়ে দাও নবদুর্বাদলের সবুজতায় ভরা জল থই থই মাঠে। তারা মনের আনন্দে ভিজুক, খেলুক। আমার ধারায় ভিজতে ভিজতে জমে থাকা জলে কাগজের নৌকা ভাসাক।
আমি বৃষ্টি। কথা দিচ্ছি তাদের জ্বরজারি কিচ্ছু হবে না। তাদের মনে আনন্দের ঢেউ বয়ে যাবে। তোমরা ঘরের জানালা বন্ধ করে আমার প্রেবেশের পথ রুদ্ধ করো না, খোলা বাতায়নে বসে শুধু আমার পরশটুকু নিও।
আকাশ পানে চেয়ে দেখো জলভরা মেঘের আস্তরন ভেঙ্গে আমি টুপ করে ঝরে পড়বো বলে তোমাদের প্রতীক্ষায় আছি। ভয় পেওনা। না হয় ভিজলো শাড়ির আঁচল। তখন মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আপনা থেকে গুনগুনিয়ে উঠে আমার গুণগান করবে আর মুহূর্তে আমার মন খারাপ উধাও হয়ে যাবে।
এক দুর্বোধ্য রহস্যময়তার মধুর আবেশ ছড়িয়ে আছে বর্তমান প্রজন্মের এক গায়কের কলিতে—
‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম’
Comments