অভিজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস (দ্বিতীয় পর্ব)
মুকুট
(২)
অ্যানুয়েল পরীক্ষায় ভালো করল মুকুট। সুখেন্দু স্যার রেজাল্ট হাতে দিয়ে বললেন- তুই তো দারুণ করেছিস, ১ টা নম্বরের জন্য ফোর্থ হয়ে গেলি।
থার্ড হলে মন্দ হতো না বুবুনের। স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানে বই দেওয়া হয়। ফার্স্ট হলে ৩টে বই, সেকেন্ড হলে ২ টো বই আর থার্ড একটা বই।
সুভাষ এসে মুকুটকে বলল- দুজনে হলে বেশ হতো।
হাসল মুকুট। বলল-তুই বাড়ি যাবি তো!
সুভাষদের বাড়ি ত্রিপুরা রাজ্যে। টিফিনের পরে লাইব্রেরি ক্লাস থাকলে বই নেওয়ার সময় গল্প হয়। সুভাষ ত্রিপুরার গল্প বলে। পার্বত্য ত্রিপুরা খুব সুন্দর। পাহাড়, অরণ্য সব রয়েছে।
বাড়ি ফিরে মুকুট রেজাল্ট দেখাতে মায়ের মুখ উজ্বল হয়ে উঠল। মুকুট অংকে এবার ‘৮৫’ পেয়েছে।
আর ভৌতবিজ্ঞানে পেয়েছে ‘৯০’।
বাবার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি-ই ফিরেছে আজ।
মুকুট বাবা-কে প্রণাম করে রেজাল্ট দেখালো।
বাবা বলল- কোন্নগরে তোর ঠাকুরমা, থাকুর্দা-র কাছে দেখাতে হবে তো!
এখানেও নদী গঙ্গা আছে, বাড়িটাও মন্দ নয় কিন্তু কোন্নগরের বাড়ি সে তো সত্যিকারের রূপকথার জগৎ মুকুটের কাছে। দাদুর সঙ্গে বাজারে যাবে, মাছ কিনবে আর ঠাকুরমার সঙ্গে চলবে দুনিয়ার খুনসুটি। চলে আসার সময় মন খারাপ করবে। বাবা-মায়েরও করবে। বারণ শুনবে না ঠাকুরমা। রিক্সায় চড়া অবধি খালি পায়েই এগিয়ে দেবে ওদের।
এবারও সেরকম হল। বুবুনের ভালো ফলের জন্য এলো ইলিশ মাছ। সাদা ধবধবে রোদ্দুরের লুটোপুটি বেশ লাগল মুকুটে।
তবে এই রোদ্দুরে সেই ফোটন কণাদের সঙ্গে দেখা হল না।
সূর্য প্রণাম করতে বেশ লাগে মুকুটের মন্ত্র-টন্ত্র সে জানে না। তেমন পাত্তাও দেয় না কিন্তু মনে হয় অসংখ্য ফোটন কণা অগ্নির গোলা হয়ে দীপ্তি দিচ্ছে।
এবার তারা দেওঘরে চলেছে। ঠাকুরমা-দাদু তখনও বলে, পশ্চিমে যাওয়া। ঠাকুরমার যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু শেষমেশ স্কুলের পেনসনের কাগজ-পত্তর জমা দেওয়ার কারণে আটকে গেলো।
ওরা ট্রেন ধরল ব্যান্ডেল থেকে। বাঘ এক্সপ্রেস। হয়তো অন্য একটা লম্বা চওড়া নাম রয়েছে কিন্তু আপাতত রাত সাড়ে দশটায় ট্রেনে ওঠা গেলো। সংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেনীর স্লিপার।
লুচি, ছোলার ডাল, মিষ্টি আর মুকুটের জন্য মুড়িঘন্ট আর ভাত রাতের খাওয়া ট্রেনে উঠেই সারতে হলো।
ওপরের বাঙ্কে শুয়েছে মুকুট। খুন আসছে না। সে পড়ছে এইচ জি ওয়েলস। কামরার আলোগুলি একের পর এক নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শেষমেশ একটা আবছায়া নীল লাইট মৃদু আলো নিয়ে জ্বালা থাকল।
সর্বজিৎ খুব রহস্যময় ছেলে। ক্লাসে শেষ বেঞ্চে বসে। তাঁর হাত দুটো সব সময় ঠাণ্ডা থাকে। শেক্সপিয়রের নাটকগুলি বাংলা অনুবাদ মুকুট পড়েছে। ঠাণ্ডা হাত ভালো নয়। অন্য রকম মানুষদের লক্ষণ।
সর্বজিৎ অবশ্য খারাপ নয়। খুব কম কথা বলে। গায়ের রং চাপা অথচ চোখ দুটোর মনি নীল।
সর্বজিতের কাছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প শুনেছে। সেখানে বর্ণিত একটি সহজ তান্ত্রিক প্রক্রিয়া বুবুন করল। কানের ফুটো দুটো আঙ্গুল দিয়ে টিপে ধরে চোখ দুটো চেপে ধরল।
তার আগে কামরার নীল লাইটও নিভে গেছে। মুকুটের দুই ভুরুর মাঝখানে অশৈলি কিছু হতে থাকল। মনে হলো আকাশের চাঁদটা এসে তার কপালে ধাক্কা মারছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে শরৎচন্দ্রের মর্মর মূর্তিতে কখনও কখনও অপরাহ্ন বেলায় নাচতে থাকা ফোটন কণা দুটো ট্রেনের কামরায় মুকুটের কাছে এসে ধরা দিলো।
তারা দুজনে মিলে ডাকল- মুকুট!
মুকুট কোন অবয়ব দেখলো না। দেখলো আলোর তরঙ্গ অদ্ভুত এক নৃত্যের ভঙ্গিমায় তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
সে তাদের ভাষাও বুঝতে পেরে বলল, কিছু বলছ তোমরা!
আমরা কিছু বলবো না কিন্তু তোমার যদি প্রশ্ন থাকে- বলতে পারো।
মুকুট বলল- তোমরা বুঝি সব জানো!
কিছুটা জানি।
মুকুট বলল-ব্ল্যাক হোল!
ওদের মধ্যে একজন বলল- একটি তারার মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় একটি ছোট্ট ব্ল্যাক হোল।
মুকুট বলল- তারা-দেরও মৃত্যু হয়!
একজন ফোটন কণা বলল- হয় বৈকি!
তারা-র যদি ঘনত্ব বেড়ে যায় তবে তো তার হৃদরোগ হয়। মৃত্যু হলে কোন আলো আর বের হতে পারে না। ফলে ভয়ংকর মহাকর্ষীয় শক্তি তাকে টেনে নেয়।
মুকুট বলল-কৃষ্ণগহ্বর।
ঠিক বলেছ, সেখান থেকে কোন আলোর তরঙ্গ বের হতে পারে না।
আরেকজন ফোটন কণা বলল- তুমি কি খুব ‘আলো’ ভালোবাসো!
মুকুট বলল- আমার সূর্যের দিকে হেঁটে যেতে বেশ লাগে। মনে হয় আমি যেন আলোর অভিযাত্রী।
ফোটন কণারা বলল- বেশ, বেশ।
মুকুট, মুকুট- উঠে পড়। জসিডি চলে এলো। আমাদের নামতে হবে।
ঘুম ভেঙে উঠে পড়ল মুকুট। শীতের কামড় বেড়েছে। ভূ-প্রকৃতি নিশ্চয় বদলে গেছে।
মুকুট বলল-মা, নদীটা চলে গেছে!
হ্যাঁ, দারোয়া নদী চলে গেছে।
আর মধুপুর! লাল মাটির স্টেশন!
হাসল দেবলীনা।
চলে গেছে। তোর বাবা স্টেশনে নেমে ‘চা’ নিলো। তোকেও তো ডাকছিল।
মুকুট বলল- ইস্ একদম টের পাইনি।
ভেষজ গন্ধ তখনও নাকে আসেনি। এই গন্ধটা নাকি দেওঘর জুড়েই পাওয়া যাবে।
চটপট তৈরি হয়ে, ব্রাশ করে নিলো।
ট্রেন ঢুকে পড়ল যসিডি। প্রচুর ট্যুরিস্ট নেমেছে। সবাই প্রায় বাঙালি।
একজন বোধহয় প্রথম এসেছেন দেওঘরে।
বললেন- কি দেখার আছে!
সহযাত্রী উত্তর দিলেন- পাথর আর কি! তবে ইঁদারার জন পেটের পক্ষে ভালো। আর অনেকটা সস্তার ভ্রমণ। একসময় তো রিক্সার ভাড়া অবিশ্বাস্যভাবে কম ছিল। এখন জানি না কি হয়েছে।
দরাদরি করে অটোতে উঠতে যাবে, এইসময় একজন এগিয়ে এসে বললেন,
চিনতে পারছেন!
কাচাপাকা চুল, মধ্য-বয়স্ক একজন মানুষ। গায়ে সাদা ফতুয়া। হালকা সাদা চাদরও রয়েছে গায়ে।
মুকুটের বাবা ঋত্বিক মনে করার চেষ্টা করছেন, স্মৃতিতে ভাসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। দেবলীনা অর্থাৎ ঋত্বিকের ‘মা’ চিনতে পেরে মুচকি মুচকি হাসছেন।
ভদ্রলোক বললেন- বিশ্বজিৎ। বছর দশেক আগে এরকম সকালেই কাছে এসে বলেছিলাম মাসেকং শরণম্।
মনে পড়ল ঋত্বিকের।
হো হো করে হেসে উঠলেন।
দেবলীনা বললেন- বাবা-মশাই কেমন আছেন!
ভালো। মুকুট তো!
দেবলীনা বললেন – হ্যাঁ।
বাপ-রে, সেই ছোট্ট শিশুটা তো এখন কিশোর।
মুকুট প্রণাম করল মানুষটাকে। অনেক কথা শুনেছে বাড়িটা সম্পর্কে। নাম-শাশ্বত।
বিশ্বজিৎ বললেন- বহু বছর পরে এলেন।
বাবা-মশাই আমাদের কথা বলতেন!
বিশ্বজিৎ বললেন- বহুবার বলেছেন, আজ বললেন- ওঁদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।
চোখ দুটো জলে ভরে উঠল দেবলীনার। স্নেহময় একজন বৃদ্ধের সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য মন আকুল হয়ে উঠল।
বিশ্বজিৎ টাঙা এনেছেন। টাঙায় উঠল ওরা।
যেতে যেতে সেই মায়ের মুখ থেকে শোনা ভেষজ গন্ধটা বুক ভরে নিলো মুকুট। রোদ উঠছে, উচ্চাবচ ভূমিতে অসংখ্য, অগুণতি ফোটন কণা নৃত্য করতে করতে সঙ্গ দিচ্ছে যেন।
বিশ্বজিৎ এবার বললেন- ভাবলুম- বাবামশাই মাঠে নিয়ে লাঙল ধরিয়েছেন বলে ঋত্বিক বাবুর রাগ হয়েছে।
ঋত্বিক বললেন- ছি, ছি। চাকরি না করে যদি বুড়ো বাবার কাছে থাকতুম- জীবনটাই বদলে যেতো।
এবার থেকে থাকুন তাহলে।
ঋত্বিক বললেন- ধান ছাড়া কি চাষ হচ্ছে এবার!
বিশ্বজিৎ বললেন- পাট।
ঋত্বিক সামান্য অবাক হলেন, বললেন- কিন্তু পাট-চাষে তো জল লাগে প্রচুর।
ক্যাপসুলারিজ পাট।
ঋত্বিক বললেন- আমি তো জানি এঁটেল আর দোঁয়াশ মাটিতে পাট চাষ হয়।
বিশ্বজিৎ বললেন- পাথুরে, খরাপ্রবণ জমিতেও হয় তবে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়। ক্যাপসুলারিজ উন্নত জাতের বীজ- বাবামশাই সংগ্রহ করেছেন।
ঋত্বিক বললেন- কৃষিতে তিনি অসাধারণ।
বিশ্বজিৎ হেসে বললেন- মহাকাস, সুপারনোভা, ফোটন কণা, ব্ল্যাক হোল- এসব জানেন তিনি।
মুকুটের সঙ্গে এবার ওঁর বেশ আড্ডা হবে।
মুকুটের মন আনন্দে নেচে উঠল। অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে দাদুটাকে।
দেবলীনা বললেন- শরীর ভালো আছে তো!
বিশ্বজিৎ বললেন- শীতের শুরুতে ওঁর ফ্যানেলজাইটিসের সমস্যা বেড়ে যায় কিন্তু কাজ ছাড়া তো উনি থাকতে পারেন না।
দেবলীনা বললেন- শুনেছি বাবা-মশাই রীতিমতোন বিজ্ঞান-চর্চা করেন।
হাসলেন বিশ্বজিৎ। বললেন- নিজের হাতে যখন তিনি চাষ করেন, বোঝাই যায় না তিনিই আবার E= MC2 বা কোয়ান্টাস মেকানিক্স অনায়াসে ব্যাখ্যা করছেন।
ঋত্বিক বললেন, আশ্চর্য তো!
দেবলীনা বললেন- আবার ধানসেদ্ধও হাতে কলমে দেখিয়ে ছিলেন আমায়।
মুকুট উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকে। এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে দেখা হবে ওর।
কি চমৎকার ভূ-প্রকৃতি। ছোট্ট, ছোট্ট টিলাগুলি তো অপূর্ব।
দেখতে দেখতে একটা সাদা রং-এর রাজপ্রাসাদের সামনে এসে থামলো টাঙা।
বৃদ্ধ বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওদের জন্য যেন অপেক্ষা করছিলেন এতোক্ষণ।
ক্রমশ...
Comments