Monday, November 1, 2021

লেখিকা রোকেয়া ইসলাম -এর একটি গদ্য

 স্মৃতি বিস্মৃতির জোছনায় 




মায়াবী কোমল স্নিগ্ধ রুপালি আলোতে ভরপুর এক উপগ্রহের নাম চাঁদ। সূর্যের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে আলো নিয়ে যখন তার মোহনীয় রুপ নিয়ে হাজির হয় পৃথিবী গ্রহের মানুষেররা তার রুপে বিমুগ্ধ হয়ে যায়। আরজুও তার ব্যাতিক্রম নয়। আরজুর ভেতর উথলে ওঠে চাঁদের সজীব ভালবাসা। 

মায়ের মৃত্যুর পর চাঁদ ওর কাছে মা , মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন সফল অপরেশন শেষে দল নিয়ে ফিরছিল, ঘাড়ে আরিফের শরীর , পুকুরের পাশে আরিফকে শুইয়ে ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত আরজু জলের কাছে যায়। অবরুদ্ধ কান্নাকে বুকের গভীরে চাপা দিয়ে আঁজলা ভরে জল পান করে। 

আরজু বুঝতে পারে আঁজলায় টুপটাপ করে চোখের জল মিশে যাচ্ছে, 

বিপ্লবীর চোখে জল মানায় না, ভেতরে একখন্ড আগুন ঢেউয়ে ভেঙে দুলছে। 

  দৌড়ে আরিফের পাশে এসে বসে, সরাসরি আকাশে চোখ রাখতেই আরিফ বুকের গভীরে কথা বলে ওঠে।

- তোরা হেরে গেলে আমাদের চিহ্নও খুঁজে পাবি না বন্ধু, তোদের জিততেই হবে। 

দেশ স্বাধীন হবার পর আর্মি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করে রিনাকে। 

ওকে হাসপাতালে রেখে বাড়ি ফিরে বসেছিল নারকেল গাছতলায়, সেদিনও আকাশে ছিল ডগমগে চাঁদ। 

বারবার চোখ আঁটকে যাচ্ছিল চাঁদের কলঙ্কে। 

কি অপরুপা চাঁদ তার কি মোহনীয় আলো! অপূর্ব সৌন্দর্যে মোহিত করছে পৃথিবীবাসীকে!! কেউ তো মাথা ঘামাচ্ছে না তার কলঙ্ক নিয়ে। 

তাহলে রিনা!!  

রিনার চলে যাবারদিনও ছিল এমনি গহন পূর্ণিমা। 

  দীর্ঘকাল শহরে বসবাস করলেও বুকের গভীরে লালন করে ওর এই গ্রামে। ছুটিছুটায় দেশের বাইরে ঘোরার চেয়ে নিরিবিলি কয়েকটাদিন গ্রামে কাটাতেই বেশি পছন্দ ওর। 


এবার দীর্ঘদিন পর এসেছে গ্রামের বাড়িতে, শরীরে নানাধরণের রোগ বাস করছে ওকে অতি আপন ভেবে। 

 গ্রামের বাড়িতে গাছতলায় বাঁধানো বেঞ্চে একা একা বসে আছে 

হেমন্তের মিহি শীতল বাতাস ওকে আরাম দিচ্ছে, আর কতদিন আসতে পারবে মায়ের মত গ্রামটিতে, বাবার এই পবিত্র বাড়িতে, জানে না আরজু।

 শুধু এটুকু জানে এখানে এলে ওর অতীত ওকে কাছে নেয় ভালবেসে, স্নেহে। 

ওর স্কুল, খেলার মাঠ, নদী, বৃক্ষ, সব ওর চেনা আত্মার স্বজন। 

অথচ জীবন যৌবনের হিরন্ময় সময়টুকু নিঃশেষ করলো শহরে। শহর ওকে কি দিলো? আর ওর কাছ থেকে শহর কতটা নিংড়ে নিলো, মনের ব্ল্যাকবোর্ডে অংকের হিসাবে জ্যামেতিক নকশায় আঁকছে।

 আহা জীবন কত দ্রুত ফুরিয়ে যায়! 

কয়েক বছর আগে এলেও দেখা হতো শৈশব সাথীদের সাথে, তাদের কেউ চলে গেল, কেউ রোগের সাথে মিতালি, করে মৃত্যুর সাথে কানামাছি খেলছে । 

আরজুও তো দাঁড়িয়ে আছে তেমনি কানামাছির খেলার দলে।  

আজ ওর মনটা ফুরফুরে। 

আকাশে ডগমগে হেমন্তী পূর্ণিমার অনন্য আলোময় চাঁদ। 

ওর কাছে এসে মা আদুরে ভঙ্গিতে বসে, বাতাসে বাতাসে হাত বুলিয়ে দেয় ওর সমস্ত মুখে, ফিরে তাকাতেই আরিফ এসে দাঁড়ায় হাতে স্টেনগান। আরিফ আর আরজুর মাঝখানে রিনা দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক যেমন কলেজের বারান্দায় দাঁড়াতো। 

আরজু উঠে দাঁড়াতেই তিনজন হাত ধরে হাঁটতে থাকে ধান ক্ষেতের আইল ধরে। 

নারকেল গাছতলায় এসে গাছটা আঁকড়ে ধরে আরজু, চিৎকার করে ডাকতে থাকে, কেউ পিছু ফেরে না। 

শুধু বাতাসে নারকেল পাতার সরসর শব্দ হয়। আকাশে চোখ রাখে। পরিপূর্ণ চাঁদটা নারকেল গাছের উপরে উঠে গেছে। চাঁদটার চারপাশ জুড়ে জলধণূ । 

দোতলায় শোবার ঘরে দক্ষিণের জানালা খুলে দিতেই , হুড়মুড়িয়ে জোছনা বিছানায় লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। 

আরজু জানালায় দাঁড়ায়। 

সামনের সোনালী ক্ষেত থেকে পাকা ধানের মৃদু সঙ্গীত বাতাস মুঠো ভর্তি করে তুলে আনছে চঞ্চল কিশোরীর হাতে। 

আরজুর জীবনে আর কি কেউ এসেছিল, যে জোছনা ভালবাসতো, কে সে কে? 

আজকাল বিস্মৃতিও ওকে আপন করে নিয়েছে। 

নিকট অতীত ভুলে গেছে, দূর অতীত মনে পড়ে। 

সে কি ওর নিকট অতীত? কে কে! ? 

এমনি পূর্ণিমায় সে উতলা হয়ে পড়তো অপরুপা জোছনা অবগাহনে। 

আরজুর মাথার ভেতর সুক্ষ্ম যন্ত্রণা হয় , কিছুতেই মনে করতে পারে না কে ছিল এতোকাল ওর পাশে? সে কোথায় চলে গেল কেন চলে গেল?

বুকের ভেতরটা নদীর চরের মত ফাঁকা লাগছে, 

অনেকদূরে একটা ছায়া নড়ে ওঠে। কে ও। 

চিনতে পারছে না কেন ওকে?  

রুপালি চরে বালির মত চিকচিক করছে তার বসন। ওর বসন অতো শুভ্র কেন?  

ওকি কখনো শুভ্র রঙ পছন্দ করতো। 

চাঁদটা আঁটকে আছে তালগাছের মাথায়, ছড়িয়ে পড়েছে অকাতর জোছনা। 

আরজু মনের ভেতর ক্রমাগত আতিপাতি করে খুঁজছে কেউ ছিল এতোকাল ওর কাছে খুব কাছে। সেই কে? কোথায় গেল? কে সে? 

দূরের ছায়াটা কার?? 

চাঁদটা তালগাছের উপরে উঠে গেছে। আরজু আবার তাকায় চাঁদের দিকে, প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে পড়ে, 

 স্নিগ্ধ আলোর চাঁদ একটু ইশারা দাও কে ছিল ওর কাছে? দূরে ও কে? 

তাকে চেনাটা খুব প্রয়োজন এখন ওর। 

কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না তাকে!  

দুহাত দিয়ে নিজের মাথার চুল টানতে থাকে। নাহ! কিছুতেই মনে পড়ছে না কিছুতেই না!! 

চাঁদকে ঢেকে দিয়েছে পলকা মেঘ,

  মেঘও আস্তে আস্তে সরে আসছে চাঁদের কাছ থেকে। 

দ্যূতিময় হাসিতে মেঘমুক্ত চাঁদ নীল আকাশে ভাসতে থাকে,  

আরজু তাকিয়ে থাকে নিবিড় জোছনায় স্মৃতি বিস্মৃতির জাগরণে....

No comments: