Monday, June 3, 2024

আন্তরিক - তপন তরফদার || Antarik - Tapan Tarapdar || ছোট গল্প ||Shorts story || Story || Bengali story || Bengali Short story

আন্তরিক

 তপন তরফদার


আন্তরিকতার কোন সঙ্গা হয়না। আন্তরিকতা কখন কার সঙ্গে গড়ে ওঠে তার কোন ব্যাকরণ এখনো অজানা। তবে এটা সবাই জানে দুপক্ষের মধ্য এক অদৃশ্য সেতু আতন্তরের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনই আন্তরিকতার মূল শিকড়। এই শিকড়কে দেখা যায়না অথচ উপলব্ধি করা যায়। যেমন শেষ শ্রাবণের বৃষ্টি থামলে সোনালি রোদ এক অনাবিল আনন্দে সবার মনকে রাঙিয়ে এক আন্তরিকতার প্রলেপ অন্তরে গেঁথে দেয়। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ যেমন মনে অনুরণন তোলে - বৃষ্টির শব্দ থেমে গেলেও একটা নিঃশব্দের স্বর্গীয় পরিবেশ আন্তরিকভাবে মনে গেঁথে যায়।


বার বাঁধভাঙ্গা আনন্দ হয় আন্তরিকতার সাথে সেই সময় যদি বাড়িতে নতুন


অতিথি আসার আওয়াজ আঁতুরঘর থেকে ভেসে আসে।


              রতন লাফিয়ে কাদাখোঁচা উঠানে নেমে পড়ে আঁতুরঘরের বন্ধ দরজার দিকে মুখ করে দাইমা রাধার উদ্দেশ্যে বলে কী হয়েছে? রাধা এক সোহাগ মেশানো আন্তরিক রসালো গলায় বলে - রতন রসগোল্লা আনা, আমার জন্য গরদের শাড়ী নিয়ে আয় - তোর ছেলে হয়েছে।


        মুহূর্তে রতনের বুকের ছাতি দীর্ঘ হয়ে যায়। মুখে লটারি পাওয়ার হাসি।


বসন্তপুরের পঞ্চায়েত অফিস, নলিনীবালা বিদ্যালয়ে যাওয়ার তেমাথা রাস্তার প্রথম বাড়িটা রতনদের। রতনের ভিটে দুটো রাস্তা পেয়েছে। রতনের পিছনে মদনের ভিটে। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্র ধরে এই


দুই তেলি পরিবার আন্তরিকতার সঙ্গে এক হয়েই থাকে। কয়েক বছর আগে রতন, মদনের বাবা এক সঙ্গে


গঙ্গাসাগরে নৌকাডুবিতে মারা গেছে। রতন, মদনের বিয়ে প্রায় একই সময় হলেও


মদনের দুই ছেলে এক মেয়ে হয়ে গেছে। রতনের কিছুই হয়নি - গ্রামে রটেছে রতনের


বউ পুষ্প বাঁজা। মদন-মদনের বউ হরিমতি মনে মনে খুব খুশি ছিল - ওদের কোন


বাচ্চাকাচ্চা না হলে - ওই ভিটেটার স্বত্ব মদনের ছেলেরাই ভোগ করবে। বড়


রাস্তার ধারে স্কুলে, পঞ্চায়েত অফিসে ঢোকার রাস্তা। রাস্তা ঢালাই হয়ে


গেলেই লোক চলাচল বেড়ে যাবে। শোনা যাচ্ছে নলিনীবালা স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক


হয়ে যাবে। পঞ্চায়েত অফিসের পাশে ব্যাঙ্ক খোলা হবে। ওই তেমাথায় রতনের


জমিতে যদি ‘ভ্যারাইটি স্টোর্স’ খোলা যায়, ভালই জমে যাবে। এ টু জেড সব


পাওয়া যাবে। সব আশায় ছাই ফেলে দিল নবজাতক! মদনের বউ হরিমতি বলে - কোন


বেটা টের পাবে না - আমি সব ঠিক করে দেবো।


 


        ছেলের নাম রাখলো মঙ্গল। অন্নপ্রাশনে হরিমতি কোমর বেঁধে রান্না করে দিল।


মঙ্গলের মুখে ঠুসে দিল পঞ্চব্যাঞ্জন। অন্নপ্রাশনে বাচ্চাকে পেট পুরে খাওয়াতে হয়। মঙ্গল বিকালেই কেমন নেতিয়ে পড়ল। ওরা গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার শম্ভুর কাছে নিয়ে যায়। শম্ভু ডাক্তার মনে করে সমস্ত রোগের উৎস পেট। পেট যদি পরিস্কার থাকে - বিশেষ করে বাচ্চাদের স্ফূর্তি ভালই থাকবে। শম্ভু ডাক্তার মঙ্গলের পেট -সাফার ওষূধ দিয়ে দেয়। বেশ কয়েকবার বাহ্ন্যি করার পর শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল মঙ্গল। মঙ্গলের হাসিশুনতে পেয়ে মদন হরিমতিকে বলল -কি গো, সবতো ঠিকই আছে। হরিমতি বলে – মনে হয় ধুতরোটা কম পরেছিল।


                মঙ্গল ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। স্কুলের পিওন ব্রজকিশোরের বউ সরমা, মেয়ে ময়না সময় পেলেই পুষ্পর সাথে আন্তরিকতার সঙ্গেই গল্প করতে আসে। ময়না-মঙ্গল খেলনাপাতি খেলে। মঙ্গল হয় বর, ময়না হয় বউ। ময়না পাকা গিন্নির মতো বলে - তুমি চান করে এসো, আমার ভাত রান্না হয়ে গেছে – তোমাকে খেতে দেবো।


          মঙ্গলের দশ বছরের জন্মদিন খুব আন্তরিকভাবে পালন করা হচ্ছে। হরিমতি পায়েস এনেছে মঙ্গলের জন্য। এখন মঙ্গলকে হাতে করে খাওয়াতে হয়না। লাউ-চিংড়ি খেয়ে উঃ আঃ করতে থাকে মঙ্গল। পুষ্প মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে - লঙ্কা খেয়ে ফেলেছিস, পায়েস মুখে দে। ঝাল কমে যাবে। মঙ্গল পায়েস মুখে দেয়। জিভে কেমন যেন ঠেকে। কিছু বলে না - হয়তঃ ঝালের জন্য পায়েসটার স্বাদ এমন তিতকুটে লাগছে।


             বিকাল থেকেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা - বমি করতে যায় অথচ বমি হয় না। যন্ত্রণায় কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে থাকে।শম্ভু ডাক্তার এবারও আন্তরিকতার সঙ্গে পেট পরিষ্কারের ওষুধই দিল - কিন্তু কোন কাজ হল না। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলার মতো ঘি রঙের থুথুর সঙ্গে নিলচে ছোপ। শম্ভু ডাক্তার আন্তরিকতার সঙ্গে দেখেই বলে, এখুনি একে বড় হা্সপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমি ভাল বুঝছি না।


     যমে মানুষে টানাটানি। বেঁচে গেছে মঙ্গল কিন্তু বাঁদিকের হাত পা কেমন বেঁকে গেছে। বাঁদিকের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লালা পরে।কথা বলতে গেলে চোখে মুখে অসহ্য যন্ত্রণার ছবি ফুটে ওঠে। হরিমতি আপশোষ করে বলে - কলকের বিষ মেরে ফেলতে পারল না। রতন একেবারে ভেঙে পড়ল। সুস্থ ছেলেটার এ কি হল?


     তাপ দেওয়া তাসার মত গুমগুম করে বেজে যায় রতনের মন। বেশ কিছু বছর পরেও রতন


মনে করে নিশ্চয় কোন পাপ করেছিল - তাই এই সাজা। সব কিছু ভুলে থাকার জন্য আদিবাসী পাড়ায় যাতায়াত শুরু করল। এখন আদিবাসীদের ডেরায় হাঁড়িয়ার সঙ্গে চোলাই ও চালু হয়ে গেছে। মদনও লুকিয়ে লুকিয়ে ধেনোমদের বোতল রতনকে এনে দেয়। সজনে ফুলের এক বিশেষ গন্ধ থাকে, যারা জানে তাদের নাকে ধাক্কা মারে। এই ধেনোর এক আন্তরিকতার বিশেষ মহিমা আছে যা ছড়িয়ে পরে দাবানলের মতো -সবাই জেনে যায় রতন “নেশা করে”। মদনের এনে দেওয়া ধেনো খেয়ে রতনের বুকে যন্ত্রণা শুরু হয়। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোতেস থাকে। বুক চেপে শুয়ে পড়তেই পুষ্প তালপাতার হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে। এই হাওয়া কোন কাজে লাগেনা। রতন অকালেই উবে যায়।


           ওদিকে ব্রজকিশোর মারা গেল। শম্ভু ডাক্তার রোগটা যে ‘ডেঙ্গু’, ধরতেই পারেনি। ময়নার মা সরমা, স্কুল সীমানায় একপ্রান্তে নির্জন ডোবার ধারে বাঁশ বাগানের পাশে টিনের চালার মাটির ঘরে যেখানে থাকে, সেখানে রাতের অন্ধকারে দরজায় টোকা পড়তে লাগল। রাত হলেই মা-মেয়ে দুজনেই সিঁটিয়ে থাকে, বুঝতে পারে ওরা পঞ্চায়েতের লোক।


      ওদিকে মদন - হরিমতি নিজেদের আকাঙ্খা পূরণ করতে কোন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। পুষ্পকে পাখি পড়ানোর মতো সব সময় বলতে তাকে ছেলের চিকিৎসার জন্য, তোমাদের সংসার চালানোর জন্য ভিটেটা বিক্রি করে দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাও। মামার বাড়িতে ন্যালাখ্যাপা ছেলে অনেক সাহায্য পাবে।


      পুষ্প নিজের শ্বশুর বাড়ির ভিটে ছেড়ে যেতে রাজি নয়। মদনরা বুঝতে পারে


চালটা ঠিক ধোপে টিকল না। হাল ছাড়ার পাত্র নয় মদনরা। কিছুদিন বাদে আন্তরিকতার সঙ্গেই বলে - বউদি তোমরা তো মাত্র দুজন, এতবড় জায়গা নিয়ে কি করবে। তোমার ছেলেকে দিয়ে তো কিছু হবেনা। আমি তোমাকে ভিটের এক দিকে ঘর করে দেবো। জমির জন্য টাকাও দেব। পুষ্প বুঝতে পারে বাঘের থাবার সামনে পড়েছে। দুর্বলের সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনা। এখন রাজনীতির ঝান্ডা না ধরলে বাঁচা যাবে না। মদন পঞ্চায়েতের দলের লোক হয়ে গেছে। পুষ্প কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে অসহায়, ফুলের মতো ফুটে আছে। সবাই তাকে দখল করতে তৎপর। মুখ নীচু করে বলে - ঠাকুরপো তুমি যা ভাল বোঝো, করো।


       ব্রজকিশোর নিজে ভাল লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চেয়েছিল। মেয়েরা নতুন কিছু সাহসী কাজ, প্রতিভা ও আন্তরিকতার জোরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি মেয়েকে দিত। উৎসাহ দিয়ে বলতো - জানিসতো মা, এক মেয়ে এভারেষ্ট জয় করেছে। ময়না বলে, জানি অনেক মেয়েই পাহাড়ে উঠেছে। ব্রজকিশোর বলে, এ মেয়ে অরুণিমা সিনহা একপায়ে ভর করে উঠেছে। ময়না বলে, আন্তরিকতার সঙ্গে মনের জোরই আসল জোর।


      ছিপছিপে শ্যামাঙ্গী প্রতিমার মতো মুখ ও চুল ময়নার। তার শরীরে ক্লান্তি নেই, চনমনে চিতল হরিণী। গাঁইয়া মুখ হলেও মুখে বালি সরানো ফল্গু নদীর মতো ঝকঝকে লাবন্য। বুদ্ধিতে খনার থেকে কিছু কম নয়। ময়না আন্তরিকতার সঙ্গেই প্রথমেই চায় স্কুলের জায়গাটা ছাড়তে। ঝুপসি গাব, মহানীম গাছের মাঝে ফাঁকা জমিতে রাতের অন্ধকারে ভুতের নাচের আসর বসে - তারাই রাত্রে দরজায় আওয়াজ তোলে। রুখে দাঁড়ালে বাঁশ ঝাড়ের ভিতরে পালায়। এইভাবে আর কতদিন চলবে।


      মঙ্গলের বাড়িতে যায় সরমা, ময়নার খোঁজখবর নিতে। সুখ-দুঃখের গল্প করতে। পুষ্পকে আশ্বাস দেয় - চিন্তা করবেন না আন্তরিকতার সঙ্গেই বলে মাসিমা, মঙ্গল ভাল হয়ে যাবে। পুষ্পর মুখে শুকনো হাসি। সে দিনের সূর্য মঙ্গলদের বকুল গাছের পাতায় শেষ আলোর চুম্বন দিয়ে বিদায় নিচ্ছে। এই সময়েই মদন এসে বলে - বৌদি তোমাদের দলিলটা দাও। কালই রেজিস্ট্রি করব, তোমাকে নিয়ে যাব - ওখানেই সব টাকা দিয়ে দেবো। ময়না বলে ওঠে - না “মা”- আপনি দলিল দেবেন না। আমার শ্বশুর বাড়ির ভিটে আমরাই আন্তরিকতার সঙ্গে রক্ষা করব। মদন রেগে গিয়ে বলে - সেদিনের ছুঁড়ি, আমার সাথে রসিকতা হচ্ছে। ময়নার পাথরে খোদাই করা চোখ মুখ আরো দৃঢ় করে বলে - আমরা অসহায়রা এক হয়েই নিজেদেরই আন্তরিকভাবে সহায় হব। আমার বাবা মারা গেছে – ওই শকুনরা আমাদের ছিঁড়ে খাবে। অসহায় বিধবার ভিটে হায়নারা খাবে, তা হবেনা। আমি মঙ্গলকে বিয়ে করে সব সামলে নেব। মঙ্গলকে নিয়ে সিধে ময়না কালীতলায় চলে আসে। পূজারির কাছ থেকে সিঁদুর চেয়ে নিয়ে মঙ্গলকে বলে পড়িয়ে দিতে। মঙ্গলের চোখে মুখে যুদ্ধ জয়ের ছবি। একটুও হাত কাঁপে না। বুদ্ধপূর্ণিমার আলো, সমগ্র জগতকে মোহময়ী করে তুলেছে। ময়না মঙ্গলকে নিয়ে ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিয়ে গাইতে থাকে - ও রজনীগন্ধা তোমার ..........। বেচারা মদন, হরিমতিরা


ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দুই বিধবা পরস্পরের হাত ধরে আন্তরিকতার সঙ্গে শরীরের ইশারায়


বুঝিয়ে দেয় আমরাও পারি জয়ী হতে পারি।

ভীমরতি - অমিত কুমার রায় || Bhimrati - Amit Kumar ray || অনুগল্প || Shorts story || Story || Bengali story || Bengali Short story

 ভীমরতি 

অমিত কুমার রায়


সত্যেনকে প্রায়ই অনেকে এসে মুখর জিজ্ঞেসু স্বরে বলে -- সত্যেন তোমার লেখা রেডিওতে শুনলাম। বেশ ভালই লেখ, তো নজরানা পাও?

সত্যেন সংক্ষেপে না বলে আবার খবরের কাগজ পড়তে থাকে। সেই ব্যক্তি বলেই চলে -- তবে লিখে লাভ কী? সত্যেন হাসতে হাসতে বলে -- সেই কথাই এবার আমার অণুগল্পে লিখবো, বাঁদর করে কলার আদর, মুক্তা চেনে ঝিনুক বৌ!

ওপাড়ার মণি কা একদিন সত্যেনকে বলল -- সত্যেন, তোমার লেখা উদ্বোধন এ পেয়ে পড়লাম, বেশ ভাল লেখা ! তো কিছু নোট টোট পেলে?...... সত্যেন শান্ত ভাবেই বলল-- না। ভীমরতি ধরেছে লিখেটিখে ফেলি ওই আর কি!

পাশদিয়ে নয়না কলেজ যাচ্ছিল সে থমকে দাঁড়ালো, মণি কা চলে যেতে সত্যেনের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল-- সতুদা, এক রতি. দেড় রতি, দুরতি..... পাঁচ রতি দশ রতি শুনেছি ভীমরতি কতো রতিতে হয় গো ! সত্যেন এবার একটা অণুগল্প লেখার চেষ্টা করছিল সে বিরক্ত হয়েই বলল -- লেখার ক্ষতি যে করে তার মধ্যে হয়। 

নয়না চোখ বড়ো করে বললো, রাগছো কেন সতুদা রতি মানে তো মিলন, তাহলে ভীমরতি মানে ভীমের ওজন যতো ভরি তাই না সতুদা! সত্যেন বললে-- থামবি? নয়না বললে, থামবো কেন সতুদা, তুমিই তো আমার অগতির গতি, দশরতি হাজার রতি রত্ন গো! 

সত্যেন বলল দেখাচ্ছি, আমি ক'রতি, আজই তোর বাবা মায়ের কাছে যাব।

নয়নার বাবা সত্যেনকে বললেন, তোমার লেখা যদি ভীমরতি হয় তো আমার মেয়ে নয়না আ-রতি, কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে নিয়েছো তো আগেই।

রতনের প্রেমের স্বর্গাভা - রানা জামান || Rataner premer sargova - Rana Zaman || ছোট গল্প ||Shorts story || Story || Bengali story || Bengali Short story

 রতনের প্রেমের স্বর্গাভা

রানা জামান


 

 


রতন কাঁদছে। মাঝে মাঝে বিলাপের মতো শোনা যাচ্ছে; তবে বিলাপে কী বলছে বুঝা যাচ্ছে না।


পাশে ধবধবে শাদা শশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্বিকার বসে থেকে গিটারের তার টাইট দিচ্ছেন।


হেচকি টানার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথকে আড়চোখে বারবার দেখছে রতন।


রতনের কান্না আর কবিগুরুর নির্বিকারভাব আমার মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছিলো। রতনের প্রতি সহানুভূতি শতভাগ; বয়োবৃদ্ধ কবির প্রতি রাগতে গিয়েও পারছি না। এতো প্রিয় কবি; নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নিজ হাতে গীতাঞ্জলী ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য।


আর রতনটাও যেনো কী! সেই কিশোর অবস্থায় কোন এক পোস্টাপিসে চাকরি কালে যুবক রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েছিলো। যুবক রবীন্দ্রনাথ রতনের প্রেমে পড়েনি। যুবক রবীবাবু অনুগ্রহ করে রতনকে কিছু অ আ শেখাতে চেষ্টা করেছেন মাত্র। এতেই মেয়েরা প্রেমে পড়ে যায়! সেকারণে ঠকেও খুব তাড়াতাড়ি। 'বড় প্রেম শুধু কাছেও টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।'


এসব ভেবে রতনের প্রতি রাগ হলো আমার। রতনের কাঁধে হাত রেখে বললাম, সেই কিশোর কালে এই লোকটাকে দেখেছিলে। এখন উনি বৃদ্ধ, থুরথুরে বুড়া। উনার প্রতি তোমার প্রেম আজও অটুট আছে! এই বৃদ্ধ এখন তোমাকে কী দিতে পারবে রতন?


একবার হেচকি টেনে রতন বললো, তুমি কী বুঝবে প্রেমের মর্ম? তোমাদের আজকের প্রেম শরীর নির্ভর হয়ে গেছে। আমারটা সেরকম না। উনি যেমনি যে অবস্থায় থাকুন, উনাকে ভালোবাসি। উনি আমার আরাধ্য। আমৃত্যু উনাকে ভালোবেসে যাবো।


গিটারের তারটানা ঠিক হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিটারে একবার টুং শব্দ করে স্বগতোক্তি করলেন, এইবার ঠিক হইয়াছে।


রতন ফের ডুকরে কাঁদতে শুরু করলে রবীবাবু নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে কাঁদে ওখানে? কান্নার স্বরটা কেমন যেনো চেনা মনে হচ্ছে।


আমি বললাম, ও রতন।


কোন রতন? দাঁড়াও দাঁড়াও! সেই পোস্টাপিসের রতন! পোস্টাপিসের নামটা মনে করতে পারছি না।


রতন এগিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে একবার হেচকি টেনে বললো, আমি সেই রতন বাবু। এখন বেশ বড় হয়েছি। সব বুঝতে পারি।


রবীন্দ্রনাথ প্রলম্বিত কন্ঠে বললেন, আমি যাকে ভালোবাসি সে তুমি নও রতন। তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো।


রতন মুখে ওড়নার আঁচল চেপে ডুকরে কাঁদতে লাগলো।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিটার বাজানোয় মগ্ন হয়ে গেলেন।

কারণ ব্যক্তিগত - প্রদীপ সেনগুপ্ত || Karon Baktigoto - Pradip Sengupta || ছোট গল্প || Shorts story || Story || Bengali story || Bengali Short story

কারণ ব্যক্তিগত

প্রদীপ সেনগুপ্ত




এষার কদিন ধরেই মনে হচ্ছিল শ্রেয়া বোধহয় ভালো নেই। বেশ কয়েকবার উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসাও করেছে মেয়েকে, কিন্তু শ্রেয়া সরাসরি জানিয়েছে মাকে - উৎকণ্ঠার কিছু নেই।


এষা একদিন দৃঢ় ভাবে প্রশ্ন করল মেয়েকে,

আমার কিন্তু ভয় করছে শ্রেয়া তোকে দেখে, কি হয়েছে বলত?


শ্রেয়া খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল, -

আমি বোধ হয় কনসিভ করেছি মা।

কথাটা এতটাই নির্লিপ্তভাবে শ্রেয়া তার মাকে জানাল যে ব্যাপারটা যেন এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়, তবে একটু অসময়ে ঘটে গেছে। এষা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকল শ্রেয়ার দিকে, কি যেন একটা বলতেও গেল - কিন্তু গলা দিয়ে শুধু একটা ঘড়ঘড় আওয়াজের মত হল।

শ্রেয়া পরিবারে একরকম একাকিনী। বাবা প্রিয়তোষ চিরকালই স্বল্পভাষী, তার উপর, সংসারে এষার নিয়ন্ত্রন বেশী থাকায় ওর দায়িত্বও কমে আসছিল ক্রমে ক্রমে। শ্রেয়ার কাকা মনতোষ বেশ দৃঢ় স্বভাবের মানুষ। সংসারে তার অভিমত বা শাসন যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। এষার মনের মধ্যে তখন ঝড়, ও সিদ্ধান্ত নিল ব্যাপারটা আর গোপন রাখা উচিত নয় - পরিবারের মানসম্মান যেমন জড়িত, তেমন শ্রেয়ারও একটা কিছু করা দরকার।


মনতোষ অফিস থেকে ফিরলে এষা ওর মুখোমুখি হল। মনতোষ বিপত্নীক, বইপত্রই ওর সবসময়ের সঙ্গী। অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলায় মনতোষ একটা বই মুখে করে ইজিচেয়ারে বসেছিল। এষা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল।

- কিছু বলবে বৌদি? মনতোষ জিজ্ঞাসা করল।

এষার গলার ভিতর একটা মাংসপিণ্ড কয়েকবার ওঠানামা করল। মনতোষ সহজেই বুঝে নিল একটা মারাত্মক কিছু ঘটেছে, কিন্তু সেটা যে শ্রেয়ার এই ব্যাপার সেটা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।


মনতোষ দু' হাত এক করে মাথা নিচু করে বসে থাকল অনেকক্ষণ। এষার মনটাও অনেকটা হালকা হল মনতোষকে সব জানাতে পেরে। 

-- ছি, ছি, আমি ত ভাবতেই পারছি না বৌদি!

-- আমি কি ভাবতে পারছি ঠাকুর পো, কি যে করব।

-- শ্রেয়া কি বলছে? ছেলেটাই বা কে?

-- আমি জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাই নি, তুমি একটা কিছু কর।

মনতোষ ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।

-- দাদা জানে?

-কিছু বলিনি এখনো, ও জেনেই বা করবেটা কি শুনি? যা করার আমাদের দুজনকেই করতে হবে।

এষা রূঢ়ভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করল। 


শ্রেয়া ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। মনতোষ আর এষা ওর ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

মনতোষ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল শ্রেয়াকে,

-- স্কাউন্ডেলটা কে?

নামটা না জানালে কি আমার মুক্তি নেই?


রাত্রিবেলা এষা শেষমেষ প্রিয়তোষকে জানাল কথাটা। প্রিয়তোষ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, তা, তোমরা কি করবে ঠিক করেছ?'

এষা অসহায় ভাবে মাথা নাড়ল,

- কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কি করব।

প্রিয়তোষ উঠে দাঁড়াল, এষা জিজ্ঞাসা করল,

-- কোথায় যাচ্ছ?

প্রিয়তোষ কোন কথা না বলে শ্রেয়ার ঘরের দিকে চলল।


শ্রেয়া জেগেই ছিল। প্রিয়তোষ দরজায় টোকা মারতেই ও জিজ্ঞাসা করল,

-- কে?

-- আমি, বাবা।

-- এস, দরজা খোলাই আছে।


প্রিয়তোষ শ্রেয়ার পাশে এসে বসল, আলতো ভাবে মাখায় হাত রেখে বলল,

-- এটা কি করলি তুই? আমরা এখন কি করি বলত ? 

শ্রেয়া চুপ করে বসে রইল। প্রিয়তোষ আরো কিছুক্ষণ বসে উঠে দাঁড়াল, শ্রেয়ার মাথায় হাত রেখে বলল,

-- দ্যাখ, মা কি বলে।


শ্রেয়া জানে মা কি বলতে পারে, এবং শ্রেয়ার ধারণাই সত্যি হয়ে ছিল, শ্রেয়াও আপত্তি করে নি অতঃপর। এরপর সংসারে নিজের মানুষ বলতে বাবা ছাড়া আর কেউ রইল না ওর। কাকা ত' ওর মুখ দেখাই বন্ধ করেছে প্রায়। এষাও বাক্যালাপ বন্ধ রেখেছে ওর সাথে। শুধু প্রিয়তোষের সাথেই যা একটু কথাবার্তা।


এক আশ্চর্য সাবলীলতায় শ্রেয়ার দিন চলতে লাগল। এর মধ্যে পড়াশুনোটাও শেষ করেছে শ্রেয়া। তবে আরও কিছু করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সাথে সাথে। প্রিয়তোষ সংসারে তার নিস্পৃহ ভাবটা একই ভাবে বহন করে চলেছে। এষা ইদানীং একটু পাল্টেছে। শ্রেয়ার সাথে কথাবার্তা আগের মতই চলছে,

তবে কোথায় যেন একটু দ্বিধা কাজ করছে। একমাত্র শ্রেয়াই নির্বিকার।


প্রিয়তোষ বাড়ি ফিরতেই শ্রেয়া একরকম বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পরল। প্রিয়তোষ হেসে বলল,

-- কোন ভাল খবর আছে বুঝি?

শ্রেয়া ঘাড় নাড়ল,

-- চাকরী পেয়েছি, কোথায় জানো?

প্রিয়তোষ হেসে বলল,

-- সেটা তুই না বললে কি করে বলি।

-- আর বি আই তে। 

-- বাব্বা, এত দারুণ খবর! মা নিশ্চই খুশি হয়েছে?

-- মা কে এখনো বলিনি। 

-- এটা ঠিক করিস নি। যা, মা কে বলে আয়।


সেদিন রাত্রে অনেকদিন পর শ্রেয়া সবার সাথে এক টেবিলে খেল। যদিও মনতোষ কোন কথা বলে। রাতে প্রিয়তোষ শ্রেয়ার ঘরে এল। শ্রেয়া একটা বই পড়ছিল। বাবাকে এত রাতে দেখে শ্রেয়া বেশ অবাক হল,

- কিছু হয়েছে বাবা?

-- আমি ভাবছিলাম, এবার তোর বিয়েটা দিয়ে দেব।

খুব সহজভাবেই প্রিয়তোষ কথাটা বলল। 

- না বাবা, এখনই না। তুমি কি মনে কর আমি বুড়িয়ে গেছি?

-- ঠিক তা নয় রে মা, আমার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না তাই.....

- কিচ্ছু হবেনা তোমার। মেয়ের রোজগারে একটু আনন্দ করতে ইচ্ছে হয়না? আমার ত' অনেক প্ল্যান.... প্রিয়তোষ বুঝল এই ব্যাপারে এখন যে কোন আলোচনাই অর্থহীন।


শ্রেয়া সেদিন বাড়িতে ঢুকল বেশ হালকা মনে। হাতে কিছু খাবারের প্যাকেট, প্রথম মাইনে পেয়েছে সো আজ। এষাই দরজা খুলে দিয়েছিল। শ্রেয়া খাবারের প্যাকেটটা মায়ের হাতে তুলে দিল। এষা জিজ্ঞাসা করল,

-- কি আছে এতে?

-- চিকেনের কিছু প্রিপারেশন, খেও কিন্তু।


প্রিয়তোষ ঘরেই ছিল। শ্রেয়া সোজা ওর বাবার সামনে এসে দাঁড়াল, একটা খাম বাবার হাতে দিয়ে বলল

-- ধরো, আমার প্রথম আয়।

প্রিয়তোষ খামটা মাথায় ঠেকিয়ে আবার শ্রেয়ার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

- এটা মা কে দিয়ে আয়।


রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসল। খেতে খেতে মনতোষ বলল,

-- একটা কথা বলা হয় নি, বিটু আসছে, অবশ্য একদিনের জন্য। কাল সকালে এসে পরশু মর্ণিং ফ্লাইটেই চলে যাবে। মনুদি ফোন করেছিলেন।

মনুদি, অর্থাৎ মণিদীপা মনতোষের বড়শালী। মনতোষের শ্বশুর বাড়ির সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক এখনো আগের মতই। বিটু হল মণিদীপার ছেলে। কৃতি ছেলে, চাকরীটাও বেশ ভালোই করে মুম্বাইতে আছে। বছর তিনেক আগে একবার এসেছিল বিটু, চারপাঁচ দিন ছিল বেশ হৈ হৈ করে।


শ্রেয়ার থেকে বয়সে একটু বড় হলেও শ্রেয়া ওর বন্ধুর মত। প্রিয়তোষ শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, - তোর ত নতুন চাকরী, না হলে বলতাম একদিন ছুটি নিতে।

মনতোষ মুখ না তুলে বলল,

– বিটু ত আর সারা দিন বাড়ি থাকছেনা, সন্ধ্যের সময়টা যা একটু থাকবে তখন ত সবাই আছি। ওর শুধু শুধু ছুটির নেবার দরকার কি! ঘরের আবহাওয়াটা বেশ সহজ হয়ে আসছে দেখে প্রিয়তোষের ভালো লাগছিল। শ্রেয়া খাওয়া হয়ে গেলে উঠে পড়ল, প্রিয়তোষের দিকে তাকিয়ে বলল,

- আমি উঠছি।

প্রিয়তোষ ঘাড় নেড়ে অনুমতি দিল।


শ্রেয়ার একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমানো অভ্যেস, সকালে ঘুমটা যখন পাতলা হয়ে এসেছে তখন কানে এল অনেক জনের কথাবার্তার আওয়াজ, কেউ এসেছে বোধহয়। কেউ মানে নিশ্চয়ই বিটু। শ্রেয়া উঠে পরে দরজা খুলে বাইরে এল, ডাইনিং হলে বিটু চায়ের কাপ নিয়ে বসে সবার সাথে কথা বলছিল- শ্রেয়াকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল,

- সব শুনেছি, আজ ফিরে এসে যা খুশি তাই খাব এবং সেটা তোমার খরচায়।

শ্রেয়া হেসে ফেলল, বলল,

- ঠিক আছে, কি কি খাবে একটা লিস্ট করে রেখো, সবাই মিলে খাব।


শ্রেয়া অফিস চলে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। বিটু তখন তৈরী হচ্ছিল বেরোবে বলে। এষা বিটুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-- এই বেলাটা কষ্ট করে যা আছে খাও, রাত্রে ত শ্রেয়ার দায়িত্ব।

বিটু হেসে বলল,

- এ ব্যাপারটা আমিই দেখব, এত ভালো একটা খবর অল্পে ও ছাড়া পাবে না কি?


শ্রেয়ার ইচ্ছে ছিল সবাইকে নিয়ে কোন ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়াবার। কিন্তু এষার আপত্তিতে হল না। এষা বলল, 

-- জানিস ত তোর কাকা বা বাবা কেউই বাইরে খাওয়া পছন্দ করে না, আর আমারও ঠিক ধাতে সয় না। বরং খাবারটা কিনে এনেও ত আমরা এখানে বসে খেতে পারি।

শ্রেয়া চুপ করে রইল। বিটু বলল,

-- সেই ভালো, বাড়িতে বেশ হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে খাওয়া যাবে।


সন্ধ্যেবেলায় শ্রেয়া বাড়ি ফিরে দেখল বিটু তখনো ফেরেনি। এষাকে ডেকে ও জিজ্ঞাসা করল,

- কি খাবে বল, আজকে তোমার পছন্দ মত খাবার আনব।

এষা অনেকদিন পর শ্রেয়ার কাঁধে হাত রাখল, হেসে বলল,

--আমার আবার পছন্দ অপছন্দ কি, তোর যেটা ভালো মনে হয় তাই আন।

শ্রেয়া বলল,

-- ঠিক আছে, তাই আনব - এটা খাই না, ওটা খাই না বলতে পারবে না কিন্তু। যা আনব লক্ষী মেয়ের মত খেতে হবে।

বিটু অফিস থেকে এসেই চিৎকার করে শ্রেয়াকে ডাকতে লাগল। এষা বলল,

- অফিস থেকে এসেছ, চা জলখাবার খেয়ে নাও। বিটু গম্ভীর মুখে বলল,

- উঁহু, খিদে নষ্ট করতে রাজী নই আমি। এখনি বেরোতে হবে, নো দেরি। শ্রেয়া রেডিই ছিল। বিটুর সামনে এসে বলল,

- তোমার খাবার পালিয়ে যাবে না, একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। আমারও একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে।


দুজনে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ঠিক করল পার্কস্ট্রীটেই যাবে। শ্রেয়া আপত্তি করল না। একটু হেঁটে একটা ট্যাক্সিও পেয়ে গেল।

খাবারের অর্ডার দিয়ে ওরা দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসল। খাবার তৈরী হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। বিটু ওদের অফিসের নানা রকম গল্প করছিল। তারপর হঠাৎ খুব নীচু গলায় বলল,

-- আমি একটা যন্ত্রনার মধ্যে আছি শ্রেয়া। একটা অপরাধ বোধ আমাকে গত তিন বছর ধরে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না।

শ্রেয়ার বুকের মধ্যে একদল অশ্বারোহী দৌড়তে আরম্ভ করেছে। একটা অজ্ঞাত সংশয়ে ওর মুখটা আবৃত হয়ে যাচ্ছিল। বিটু শ্রেয়ার দুটো হাত ধরে বলল,

-- তুমি যতক্ষণ না বলছ যে তুমি ক্ষমা করেছ... 

শ্রেয়া মনের মধ্যে দৃঢ়তা আনল, একটা সহজ আলো সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, 

-- কথাটাত' শুনি।

বিটু মাথা নিচু করে অনেক দূর থেকে যেন বলল, 

--সেদিনের ঘটনাটা কেন যে ঘটল.. একটা এত বড় অন্যায়, মানে আমি বলতে চাইছি কেন যে সেদিন নিজেকে একটু ধরে রাখতে পারলাম না তাহলে এত বড় অন্যায়টা হত না, তোমাকে যে আমি নষ্ট করেছি শ্রেয়া সেটা আমি......

শ্রেয়া নিষ্পলক তাকিয়ে রইল বিটুর দিকে, তারপর শান্ত স্বরে বলল,

-- আমি ক্ষমা করলেই হবেত?

-- শুধু একবার বলে দাও, ব্যাপারটা তোমাকে হার্ট করে নি...

শ্রেয়া বিটুর বুকে ওর তর্জনী ছোঁয়াল, বলল,

--আমি কিছু মনে করছি না বিটু, ঠিক আছে?

বিটু হঠাৎ শিশুর মত সহজ হয়ে উঠল, উফ, বুকের থেকে একটা পাথর নেমে গেল।


সেদিন রতে সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত হৈ হৈ করে কাটিয়ে দিল। অনেক দিন পর মনতোষ শ্রেয়ার সাথে টুকরো টুকরো কথা বলল। পরদিনই বিটুর যাওয়া। এষা বিটুকে বলল,

-- এবার শুয়ে পর বিটু, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।


বিটুর ফ্লাইট সকাল সাড়ে নটায়, সকাল সাতটার মধ্যেই বিটু তৈরী হয়ে গেল যাবার জন্য। যাবার সময় দেখল শ্রেয়া ওঠে নি। এষা শ্রেয়াকে ডাকতে যাচ্ছিল, প্রিয়তোষ বলল,

-- থাক্ না, ওকে ডাকতে হবে না।

বিটু বলল,

-- বাঙালীর কাঁচা ঘুম ভাঙাতে হবে না, ও ঘুমাক। আবার বোধহয় নেক্সট মান্থেই আবার আসতে হবে, তখন একটু বেশী দিনের জন্য আসব।


শ্রেয়া আটটার মধ্যেই রোজ উঠে পড়ে। কিন্তু মাড়ে আটটাতেও যখন ওর ঘুম ভাঙল না তখন এষার বেশ চিন্তা হল। শ্রেয়ার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিল এষা, কিন্তু কোন সাড়া পেল না। তারপর বেশ জোরে কয়েকবার ধাক্কা দেবার পরেও যখন সাড়া পেল না তখন ওর বুকটা কেঁপে উঠল, কিছু হয়নি ত শ্রেয়ার?


প্রিয়তোষ অফিস যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিল। এষা ওর সামনে এসে অসহায়ের মত দাঁড়াল, প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করল,

-- কি হয়েছে? কিছু বলবে?

-- শ্রেয়া ঘরের দরজা খুলছে না।


প্রিয়তোষ এক দৌড়ে শ্রেয়ার ঘরের সামনে চলে এল। মনতোষও ততক্ষণে চলে এসেছে। এষা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওদের পাশে।


কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যটা প্রকাশ পেল, শ্রেয়া নেই। শ্রেয়ার ঘরের ভেঙে ফেলা দরজা দিয়ে ওর নিথর শরীরটা দেখা যাচ্ছিল খাটের উপর।


ওর এই নির্লিপ্ত পরে থাকাটাও যেন তেমন কোন ঘটনা নয়, ব্যক্তিগত কারণে একটু অসময়ে ঘটে গেছে।



ভুল - জিনিয়া কর || অনুগল্প || Onugolpo || Bhul - Jiniya Kar || Shorts story || Story || Bengali story || Bengali Short story

 ভুল

জিনিয়া কর



 মেখলা! আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। যথেষ্ট হয়েছে। আমার ও তো আত্মসন্মান বোধ আছে তো নাকি ! আমি আর এই বিয়েটা টানতে পারবো না। আগামী মাসেই আমি ডিভোর্সের আবেদন করছি। চায়ের কাপ হাতে প্রিয় বান্ধবীর কাছে অভিযোগ করে নদী।

মেখলা উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপ হাতে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে নদীর দিকে।

নদী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারো বলে , বেশ কয়েক মাস ধরেই দেখছি, মাস না ফুরোতেই অভির হাত টান, এমাসে তো ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সেও হাত পড়েছে। একটা এফ.ডি ম্যাচিওর না হতেই ভেঙ্গে ফেলেছে আমাকে জানায় নি পর্যন্ত। সবচেয়ে বড় কথা, টাকাগুলো কি করলো?

ওর জীবনে অন্য কেউ যে এসেছে সেটা ওর লুকোচুরির বহর দেখেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল । সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতে দেখি ও বারান্দায় । হাতে মোবাইল। আমি গিয়ে দাঁড়াতে থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি এসে শুয়ে পড়লো।কিছু প্রশ্ন করলে সোজা মুখে উত্তর ও দেয় না আজকাল ।বাড়ি ফেরার অনিয়মিততা তো ছিলই, আজকাল নটা , কোনো কোনো দিন দশটাও বাজে।সেদিন একটা জরুরী কাজের কথা বলবো বলে দুপুরে কল করেছি ওর মোবাইলে, সুইচ অফ।ওর অফিসের এইচ ও ডি পারমিতাকে ফোন করে জানতে পারলাম ও নাকি সেদিন অফিসেই যায়নি....! ভাব!

আজকেও গেছে মুম্বাই। আমাকে বলে গেছে অফিসের কাজ। খোঁজ নিয়ে জেনেছি.....

এই মেখলা কি হলো রে? তুই কেন কাঁদছিস? ভাবছিস আমি দুর্বল ! কিভাবে এতগুলো বছরের সম্পর্ক..... শেষ টায় গলা কেঁপে যায় নদীর ও!

হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে নদীকে জড়িয়ে ধরে মেখলা ।অভি কি তোকে কিছুই জানায়নি নদী? কিছুই না?

ক্কি কি জানানোর কথা? আমি কি জানি না?

 নদীকে ছেড়ে ওর হাত দুটো চেপে ধরে মেঘলা। মন শক্ত কর নদী। বড়ো কঠিন দিন আসছে হয়তো।অভিকে ভুল বুঝে আঘাত দিয়ে ফেলিস না যেন। সত্যিই কি তুই জানিস না?যে....

মেখলার কথাবার্তা হাবভাব দেখে নদী বিচলিত হয়? এভাবে বলছিস কেন রে? কি হয়েছে? 

নদী!অভির তো লিভার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আজ ওরা মুম্বাইয়ে , টাটা ক্যান্সার হাসপাতালেই গেছে....... । ওরা মানে অভি আর শমীক।তোকে জানাতে না করেছিল ।পারলাম না রে!




             


The Dream - Samir Kumar Dutta || English poem || poem || Poetry

 The Dream

          Samir Kumar Dutta

              


Walking along the way

I came across a dream

Which sees me

And I see him (personified),

It is coming again

In my rebirth

Perhaps to dream a dream.


There was such a dream

A tightly knitted dream

For which my time passed away

Leaving all of my tasks undone.


So many individuals become

So many different professionals 

But I remained unlike any of them

Being satisfied by touching my dreams,

Oh, Dream ! a thousand of salutes to you .

I was on this earth,as you were with me

Otherwise where had I, like a pauper

had the means of my livelihood

Without you,the Dream ?

Oh, Dream! a thousand of my salutes to you.

On the sky - Anjali Denandee || English poem || poem || Poetry

 On the sky

Anjali Denandee



On the sky,

There is a bit of moon.

Two bats fly...

From my balcony

I enjoy the beauty at night.

In my right hand,

Here is a silver spoon.

In my left hand,

Here is a bowl.

In it, pop corns with honey.

I am in joy of taste.

On the sky,

The stars light,

Wow, so beautiful!

In my soul,

I feel that my look is the creation-nest.

The sky,

It is too cool.

At night,

The moon, stars pull me, pull and pull.

My imagination reaches to the sky.

There it creates the imaginary poetry.

Which is just like the nectar-tree.

From which, nectar-fruits,

Come down on the earth,

On imaginary routes.

And here take birth,

Countless immortal lives,

From those fruits,

When these touch th

e Earth.

For ever they are alives.

A farmer's cow and calf - Md Mazharul Abedin || English poem || poem || Poetry

 A farmer's cow and calf 

Md Mazharul Abedin


The cow of the farmer is too obedient 

It has been feeding him her milk for about ten years.

She never complained

Never protested

Humble she remained

Though sometimes her son, the white calf remained half-fed.

The farmer called the cow’Bhutki’.

The farmer's sons needed money

For higher education.

The farmer's seven bighas of wheat burnt fully

Some people set fire.

The farmer said,” Bhutki, I shall take you to Sombari Hat”.

Bhutki stared at her master.

Tears dropped.

The farmer hid his eyes.

‘Sombari hat’ day came.

Her master said, “Bhutki, get up,”

Obedient as usual she began to walk

Her white son tied far in a poll

Began to cry repeatedly.

Bhutki once looked back while walking behind her master.

The farmer's wife comforted the calf

“Don't cry more my son,I am here with you.

রবীন্দ্রনাথ - অভিজিৎ দত্ত || Rabindranath - Avijit Dutta || Bengali poem || Kobita || বাংলা কবিতা || কবিতা || poetry || Bengali poetry

 রবীন্দ্রনাথ 

অভিজিৎ দত্ত 



রবীন্দ্রনাথ, তুমি সত্যিই ছিলে 

এক বিষ্ময়কর প্রতিভা 

গান,নাটক, লেখা,ছবি ও কবিতা

সবেতেই ছিল তোমার 

বিষ্ময়কর প্রতিভার ছোঁয়া।


তুমি ছিলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দার্শনিক 

তুমি ভীষণ ভালোবাসতে প্রকৃতিকে 

চেয়েছিলে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য 

করে আমাদের গড়ে তুলতে। 


তুমি বুঝেছিলে নগর সভ‍্যতার 

ভয়াবহ পরিণামের কথা 

তাই তো বলেছিলে,দাও ফিরে সে অরণ্য 

লহ এ নগর।


তুমি ছিলে ভারত তথা এশিয়ার 

প্রথম নোবেল বিজেতা 

বিশ্বভারতী,শান্তিনিকেতন সহ

অনেক কিছুরই প্রতিষ্ঠাতা। 


তুমি আমাদের আশা ও ভরসা 

তোমার গান ও লেখা থেকেই পাই

জীবনে এগিয়ে চলার প্রেরণা।

তাই পঁচিশে বৈশাখ তোমার জন্মদিনে

তোমাকে অন্তর থেকে জানাই

 আমার প্রণাম, ভক্তি ও শ্রদ্ধা।

দেখি প্রিয়া চলে গেছে - অমল কুমার ব্যানার্জী || Dekhi Priya chole geche - Amal Kumar Banerjee || Bengali poem || Kobita || বাংলা কবিতা || কবিতা || poetry || Bengali poetry

 দেখি প্রিয়া চলে গেছে 

       অমল কুমার ব্যানার্জী



আমার কাছে যখন তখন বায়না ধরে,

জীবন মরণ পণ করে সে হাতড়ে মরে।

যতো কাজের মাঝে নয়ন তারা টা যে,

এদিক ওদিক খুঁজে মরে মনের মানুষ টা কে।


আমি তখন আপন মনে, বসে নদীর বাঁকে,

ঢেউয়ের মাঝে খুঁজে মরি ওগো প্রিয়া তোকে।

ঢেউগুলি সব আছড়ে পড়ে নদীর তীরে,

পাইনি তারে ঢেউয়ের পাহাড় মাঝে। 


প্রিয়া আমার, প্রদীপ হাতে মোর সমাধি পরে,

আজও খুঁজে সকাল সাঁঝে হিয়ার মাঝে মোরে,

দাঁড়িয়ে আজও উদাস আমি অবাক চেয়ে দেখি,

হয়তো তুমি বসে আছো আমার অপেক্ষাতে।


আমি তখন উঠে এসে প্রিয়ার পানে চেয়ে,

দেখি প্রিয়া চলে গেছে প্রদীপ খানা রেখে। 

Tuesday, May 28, 2024

এরা কারা - বিশ্বনাথ দাস || Era Kara - Biswanath Das || পর্ব - ৮ || part - 8 || Era Kara part 8 || Novel - Era Kara || Era Kara by Biswanath Das || উপন্যাস - এরা কারা


 


গতস্য শোচনা নাস্তিঃ কিন্তু হিড়িম্ব মহারাজ কোন মতেই অসীম রায়ের অপমানের কথা ভুলতে পারলো না। সর্বদাই কানের মধ্যে বাজতে থাকলো। সর্বক্ষন মনে হচ্ছে বুকের বাম দিক টাতে একটা আলপিন যেন ফুটে আছে। একদিন ওর সাকরেদদের ডেকে পরিকল্পনা করলো, কি ভাবে নীলরতনকে ফাঁদে ফেলা যায়। একমাত্র পথ হলো স্কুলের হেডস্যারকে হাত করতে হবে। রাজনীতির প্রভাবে হেডস্যারকে সহজেই হাত করা সহজ হবে। তার চামচারা একমত। নেতাকে থাপ্পড় মারা মানে তাদের ও ল্যাজ কেটে দেওয়া। হঠাৎ হিড়িম্বর পোষাগুন্ডা গনশা এক সময় বলে উঠলো - টেন্সন নিওনা গুরু, তুমি বললে খালাস করে দেবো। হিড়িম্ব ও তার গোপাল বন্ধুরা মিলনদার দোকানে মাল ও কচি পাঁঠার মাংস খাচ্ছিল। হঠাৎ দাঁতের খাঁজে এক টুকরো হাড় আটকে যাওয়াতে মুখের ভেতরে পুরো কব্জিটা ঢুকিয়ে বের করতে করতে বললো


- পারবি খালাস করতে? গনশা বললো- পারবো গুরু পারবো, হুকুম করলে দেখবে কাজ হাসিল। হঠাৎ গনশা বিকট চিৎকার করে বললো, -এই জোগা, একটা ট্যাংরা নিয়ে আয় নেশাটা জমাতে হবে। এমন সময় হিড়িম্ব বললো- উঠে পড় গনশা, একটা নয়া চিজ খেয়ে আসি। বলা মাত্র ট্যাংরী না খেয়ে উঠে পড়লো। এবার আপনাদের কাছে দু লাইন বক্তব্য রাখছি, এই গনশা কে? কি তার পরিচয় যদি জানতে চান তাহলে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে। এ ছেলেটি শিক্ষিত, মেধাবী ছাত্র ছিলো, এবং ভালো ক্যারেটে ম্যান ও ছিলো। কে এবং কেন তার জীবন নষ্ট করলো। পড়তে থাকুন জানতে পারবেন। তবে হিড়িম্ব হাজরার চরিত্র কিছু জেনেছেন, এখানো অনেক বাকী। নেতা হওয়ার জন্য ওর পাওয়ার এতো বেশী যে ওর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারো ক্ষমতা নেই, তার কারণ পূর্বেই প্রকাশ করেছি। তবে কোন যুবতী ওকে চটিপেটা করেছিলো। ঐ যুবতী ছিলো এক জন নার্স নাম আশালতা। ওতেও ব্যাটার লজ্জা শরম নেই। কি ভাবছেন ঐ চটি পেটার গপ্পো শুনবেন নাকি? আমি বুঝতে পারছি আপনাদের মন উত্তলা ঠিক আছে ঐ গপ্পো, আপনাদের শোনাব একটু ধৈর্য্য ধরুন। আশালতা শুধু চটি পেটা করেনি, নানা উপহার ও দিয়েছিলো। তাহলে শুরু করি কেমন? ঠিক আশ্বিনের কাছাকাছি হবে। গৌরবাবু রিটার্ড হয়ে অচীন পুরেই ডেরা বাঁধলেন পাততাড়ি গুছিয়ে। বাংলা দেশের মানুষ হলেও তিনি ভালো ও খাঁটি মানুষ। অনেক পূর্বে এখানে এসে মাষ্টারী যোগাড় করেছিলেন। সেই প্রাইমারী স্কুলে খুবই কম বেতন ছিলো। তাই তাঁর কামনা বাসনা থাকলেও তিনি বিয়ে করতে পারেন নি। তার ভয় ছিলো সংসারী হলে ঐ পয়সাতে সংসার চালাতে পারবেন না। সেই জন্য তিনি চাপা বয়সেই বিয়ে করেছিলেন। বেশী বয়সেই তিনি জনক হলেন। একমাত্র মেয়ে কনিকাকে নিয়েই তার সংসার।- ভালো মন্দের মধ্য দিয়ে দিন কেটে যায়। কনিকা যৌবনে পা দেবার পর অনেকেই ওর সাথে প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিলো কিন্তু সকলকে ডিনাই করেছে। সে তার বাবার দীক্ষায় দিক্ষিত। কনিকা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। খুবই ভালো মেয়ে স্কুলে যখন পড়তো তখন পড়াছাড়া কিছু বুঝতো না বাবার বয়স হয়েছে, মা যামিনী দেবী, গৌর বাবুকে বিয়ে করে সুখীই হয়েছিলো কিন্তু কনিকা জন্ম নেবার কয়েক বৎসর পর তাঁকে এমন রোগে আক্রান্ত করলো যে কনিকার মাধ্যমিক পাশ করার পর ইহলোক ত্যাগ করলেন। কনিকা এবার একা সংসারের কাজ কর্ম বাগিয়ে পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো উচ্চমাধ্যমিকের পর আর কলেজে যাওয়া ইচ্ছে জাগেনি। কারন বাবার সেবা করার তার কর্তব্য।


হঠাৎ একদিন প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টার স্বরুপ বাবুর সাথে কনিকার সাক্ষাৎ হলো ঘটনা চক্রে। তবে স্বরুপ বাবুকে প্রায়ই দেখতো হাটে বাজারে। এমনকি পাড়াতেও, ভোটার কার্ড, রেশনকার্ড সংশোধন ইত্যাদি কাজে। হাটের মধ্যে সম্মুখে চোখাচুখি হবে ভাবতে পারেননি উভয়েই। দৃষ্টিটা এমন প্রতিফলিত হয়ে ছিল যেন উভয়েই শুভ দৃষ্টি হচ্ছে। একটু পরে উভয়েই পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছিল। স্বরুপ বাবু প্রথম কথা বলেছিলেন- আপনি গৌরবাবুর মেয়ে! কনিকা নম্র কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন- হ্যাঁ। কনিকা ওখানে আর দাঁড়ায় নি, সোজা বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল। দিন কয়েক পর ধুমকেতুর মত স্বরুপ বাবু কনিকাদের দরজায় সামনে উদয় হলেন। কনিকার চক্ষু চরক গাছ। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, আপনি! হ্যাঁ আমি। বিশেষ দরকারে আপনার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলাম। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে সাক্ষাৎ করবো নতুবা একশো মিটার রেসে এখান থেকে পালিয়ে যাবো। কনিকা চোখ দুটোকে গোল মার্বেল করে বললো, আমার অনুমতি, ঠিক বুঝলাম না।


বুঝলেন না এই তো? ঠিক আছে আমি আপনাকে সারাংশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার নাটকে আমি হলাম নায়ক, আর আপনি হলেন নায়িকা। নায়িকা যদি নায়ককে বিয়ে করতে রাজী না থাকে তাহলে নাটক লেখার সার্থকতা কোথায়। অর্থাৎ আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারছেন। কনিকা একটু অবাকই হলো, কারন স্বরুপ বাবু যে এই প্রস্তাব করবেন ভাবতেই পারে নি। যুবকটি বলেন কি! তার সাথে কোন আলাপ হলো না, প্রেম হলো না আলে, খালে, ডালে, পার্কে বসে দশ মিনিটের জন্য কোন দিনই প্রেম কাব্য রচনা হলো না, কোন প্রেমের ভাষাতে আলাপ হলো না, আপন গালে প্রেমের চুম্বন ও আঁকলো না আমি কে, কি আমার পরিচয় তাও জানলো না। তবুও বিয়ের কথা শুনে অন্তরটা যেন কল্ কল্ করে উঠলো। অবশ্য কনিকা ওর বাবার কথা ভেবে কোনদিন বিয়ের কথা ভাববার অবকাশ পাইনি। কারন তার বাবাকে কুহকে ফেলে কোন প্রকার বিয়ে করবে না। আর পরক্ষনেই ভাবতে থাকে বাবা চিরদিন বাঁচবে না। তাঁকে সংসারী হতে হবে। স্বরুপ বাবু মেধাবী ছেলে, ভদ্র ও নম্র ও চরিত্রের সার্টিফিকেট ও ভালো। ওর কথা শুনে প্রথমতঃ থতমত করছিলো, কিন্তু সেদিনের হাটের দৃশ্য মনে করতেই তার মনের মধ্যে প্রেমের বাসা বাঁধতে শুরু করেছিলো। প্রেম যে কি তা একটু একটু করে অনুভব করছে। কিন্তু- ওর সাথে আলাপ না হলেও স্বরুপ বাবুর চোদ্দ গোষ্টীর রামায়ন শুনিয়েছে কনিকার অত্যন্ত প্রিয় দিদি আশালতা। আশালতা দেবীর কাহিনী এখন বলবো না পরে জানতে পারবেন। যাইহোক স্বরুপের কন্ঠস্বরে কনিকার সম্বিৎ ফিরে এলো- কি ভাবছেন? তাহলে আমি বাড়ী ফিরে যাই?


-আমি কি তাই বললাম? কনিকা মৃদুস্বরে বললো।


- আপনি রাজী। কনিকা ঘাড় নাড়ে। স্বরুপ বাবু বললেন,


- আপনি আমার বায়োডাটা জানেন?


- কিছু কিছু জানি, আশাদির কাছে শুনেছি।


- তাহলে বাবার কাছে হাজির হই।


ভেতরে আসুন। পজেটিভ উত্তর পেয়ে স্বরুপ বাবুর মনে হলো দুইহাত তুলে চৈতন্য মহাপ্রভুর মতো নাচতে, কিন্তু পারলো না মাষ্টার মশায় হয়ে এতটা উৎফুল্ল হওয়া উচিত নয়। এবার আপনারা ভেবে দেখুন তো, মানুষের মনের আশা যদি পূর্ণ হবার সম্ভাবনা হয় তাহলে মানুষের হৃদয় আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠে। প্রেমানন্দে, অনেক খানি আত্মসুখী হয়ে থাকে। আর মনো বাসনা যদি পূর্ণ না হয় তাহলে ভেতর থেকে কান্নাকে ঠেলে নিয়ে আসে। চোখ ফেটে জল ঝরতে থাকে, হৃদয় একে বারে খন্ড বিখন্ড হযে যায়। স্বরুপবাবু জীবনে নিরানন্দের বন্যার স্রোতে হৃদয় একে বারে বারে ধসে পড়েছিলো। এই আঘাতে যে কত কঠিন তা স্বরুপবাবু অনুভব করেছিলেন। ঘটনা কি ঘটেছিল একটু পরেই বুঝতে পারবেন বা জানতে পারবেন। তবে একথা স্বীকার করেন তো? "বিধির লিখন কে করে খন্ডন"। কনিকা তার জেঠুর মেয়ে। আপন জেঠুর মেয়ে। কি ভাবছেন আমার প্রিয় পাঠক/পাঠিকা গন? ভাবছেন এ আবার কি রকম লেখা। কি করবেন আমি দুষ্টু লেখক, নায়ক/নায়িকার মিলন ঘটাতে আমার কলম বিরুদ্ধাচারণ করে এই তো বলবেন না মশায়, আমি তা চাই না, যেটা সত্য তা আমার কলম লিখে, সত্য পথে এগিয়ে যেতে আমার কলম পিছপা হবে না। এক অদ্ভুত সাহস নিয়ে কাগজের উপর লিখতে শুরু করে। আমার কলমকে বীর যোদ্ধা বললে ভুল হবে না, আমার কলমকে বন্দুকের গুলি বলতে পারেন, আমার কলমকে তীক্ষন তীর বললেও ভুল হবে না।


তাহলে শুনুন ব্যাপারটা কি দাঁড়িয়েছে। কনিকার মত পেয়ে স্বরুপ বাবু গৌরবাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে গৌর বাবুকে টুক করে প্রমান করে বললেন- আপনার কাছে এলাম স্যার। গৌরবাবু গুরু গম্ভীর লোক। প্রায় আশির কাছাকাছি বয়স। তরমুজের মতো মাথা। আধা কাঁচা ও পাকায় মাথা ভর্তি চুল। মধ্যিখানে পাক ধরেছে। নাকের ডগায় মোটা ফ্রেমের চশমা। গোঁফ খানিও মোটা। নজরুলের "সঞ্চিতা" পড়ছিলেন, স্বরুপ বাবু কণ্ঠস্বরে বই পাতা হতে চোখ সরিয়ে বললেন- কে? কোথা হতে আগমন। স্বরুপ বাবু নম্র কন্ঠে বললেন- পাশের গ্রাম ধরমপুর হতে। ঐ গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী করি। গৌরবাবু একটু ট্যারাচে চোখে বললেন- প্রাইমারী স্কুলে?


হ্যাঁ স্যার।


কোন সাবজ্যাকট নিয়ে অর্নাস করেছো?


-অংকে। ভালো, ভালো, বসো। কনিকা কে একটা চেয়ার আনার জন্য বললেন। কনিকা একটা হাতল ভাঙ্গা চেয়ার এনে স্বরুপ বাবুকে বসতে বললো। একটা প্রাইমারী স্কুলের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকের হাতল ভাঙ্গা চেয়ার! ও সব ভাবনা না ভেবে টুপ করে বসে পড়লেন। কিছুক্ষন নীরব। এমন সময় মুখ সরিয়ে বললেন, কি খাবে চা, না কফি? স্বরুপ বাবু আমতা আমতা করে বললেন,- আমার জন্য আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তবুও কনিকাকে কফি করতে বললেন। স্যার, আমি যে প্রস্তাব নিয়ে অপনার দরবারে এসেছি যদি বলার সুযোগ দিতেন তাহলে খুশী হতাম। তিনি বললেন- অবশ্যই বলো,


- আপনার মেয়ে কনিকাকে আমার ভারী পছন্দ। তাকে আমি বিবাহ করতে ইচ্ছুক, আপনার মতামত বলুন। গৌরবাবু বেশভারী গলায় বললেন, কনিকাকে পছন্দ হলো কি করে? তবে কি কনিকার সাথে প্রেম আদান প্রদান হয়েছে? হক্কচিয়ে স্বরুপ বাবু বললেন, না না ওসব কিছু নয়। আপনার মেয়েকে দেখে আমার ভারী পছন্দ হয়েছে। অবশ্য কনিকার সাথে কদাচিৎ কোন আলাপ, ও কোন কথাবার্তা হয়নি। একটু দুরে দাঁড়িয়ে ছিলো কনিকা। গৌরবাবু কনিকার পানে কর্কশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝতে পারলো বাবা ওকে দু-চার কথা জিজ্ঞেস করবে সুতরাং কনিকা হঠাৎ বলে উঠলো- না বাবা, এনার সাথে আমার আলাপ হয়নি, আর এই ব্যাপারে আলোচনা হয়নি। গৌর বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তোমার বাড়ী ও জন্ম স্থান কোথায়? সংক্ষেপে উত্তর, ঢাকা জেলায় কনকপুরে। জন্ম এই স্থানে কনকপুরের নাম শুনতেই গৌরবাবু চমকে উঠলেন। এবার বইটা বন্ধ করে গভীর ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,-


কতদিন দেশ ছাড়া হয়েছো.


তা জানি না।

তোমার বাবার নাম কি?


- আমার বাবার নাম কিশোরীলাল বসাক। হঠাৎ গৌর বাবুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে তোমার ঠাকুরদার নাম জানো? এলো,


প্রেমেন্দ্র বসাক। গৌরবাবু পুনরায় বললেন,


তোমার মায়ের নাম কি ললিতা বসাক! তার মার নাম শুনে স্বরুপ বাবু চমকে উঠলেন, গৌরবাবু কি করে জানলেন তার মার নাম ললিতা বসাক। তবুও কৌতুহল দৃষ্টি নিয়ে বললেন, -আপনি কি করে আমার মার নাম জানলেন? গৌরবাবু স্তব্দ হয়ে গেলেন। কনিকা, স্বরুপ গভীর ভাবে আশ্চর্য্য হলেন। বারংবার নিজেদের মনকে নাড়া দিতে থাকলো। গৌরবাবু কি করে জানতে পারলেন। হঠাৎ দেখা গেল গৌরবাবুর চোখ দিয়ে টপ্স্টপ্ করে জল বেরুতে থাকলো কনিকা ধীরে ধীরে গৌরবাবুর কাছে এগিয়ে এসে বললো- বাবা তোমার চোখে জল। গৌরবাবু চোখ দুটো মুছে বললেন,


এ দুঃখের চোখের জল নয় মা। এ আমার আনন্দাশ্রু। হঠাৎ মুড পালটে বাবা স্বরুপ এবার বলতো, তোমার মা বেঁচে আছেন? বললেন,


হ্যাঁ আছেন। বাবা নেই। কিন্তু আপনি স্বরুপের কথাকে লুফে নিয়ে বললেন, বলবো, সব বলবো নইলে যে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি কয়েক বছর ধরে এবার সেই যন্ত্রনা হতে নিস্কৃতি পাবো। আমি ভেবেছিলাম আমার পরিবারের লোক জন মারা গেছে, কেউ বেঁচে নেই। সেই ভয়ংকর রাত্রির কথা আজো মনে আছে। ঐ রাত্রির কথা কোন মতে ভুলতে পারিনি বাবা। দিনটা ছিল, হেমন্তের কোন এক রাত্রি। সবে মাত্র চাষীদের খামারে ধান উঠতে শুরু করেছে। প্রচন্ড ফসল ফলেছে মাঠে, সোনালী বর্নে মাঠ ভরে গেছে। চাষীদের মনে আনন্দের শেষ নেই। কি হিন্দু, কি মুসলিম। স্থানে স্থানে মৃদঙ্গের বাজনা বাজছে ঝুমুর, ভাটিয়ালী, ও গম্ভীরা গানের তালে তালে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা, খাটুনির পর সন্ধ্যের সময় গান/বাজনার আসর জমে উঠেছে। প্রতি মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার। কিছু লোক ভাঙ্গ, গাঁজা প্রভৃতি মাদকতায় ঝিমুচ্ছে। কেউ কেউ গানের সুরে সুর মিলিয়ে গান করার চেষ্টা করলে নেশার ঘোরে মানুষ গুলো নেতিয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আবার হেমন্তের মৃদু, মন্দা বাতাসে শীতের আমেজ উপভোগ করছে। গৌরবাবু আপন বারান্দায় বসে কয়েক জন ছাত্র/ছাত্রী কে পড়াছিলেন। পাশের ঘরে অর্থাৎ ত্রিশ/চল্লিশ মিটার দুরে লুডো খেলছিলো। তখন টি.ভি ছিলো না। কখনো কখনো ছোট ভাই কিশোরীলাল ছোটতেই ললিতাকে হারিয়ে বিকট শব্দ করে তাকে রাগন্ধিত করছে। এমন করে ঘন্টা খানেক কেটে যাবার পর শতশত মানুষের বিকট চিৎকার, পালাও পালাও রব। হিন্দু ভায়েরা পালিয়ে যাও। নইলে ওরা মেরে ফেলবে। 




পর্ব - ৭ || Part - 7



পর্ব - ৯ || Part - 9


Friday, May 3, 2024

এপ্রিল সংখ্যা ২০২৪ || April Sonkha 2024





সম্পাদকীয়:

নদীর বুকে নিজেকে জড়িয়ে নিন। বিকেলের পড়ন্ত রোদের বিকেলে দুদন্ড শান্তি নিন নদীর প্রান্তে। এ এক অমায়িক সুখ। হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার হোক‌। জানি সে প্রেম তাৎক্ষণিক। তবুও এই দুদন্ড শান্তি প্রত্যেক প্রহরের অক্লান্ত পরিশ্রম দূর করার এক নিবিড় প্রয়াস মাত্র।

পৃথিবীর বুক ফেটে বের হয়ে আসে লাভা, এই তপ্ত দুপুরের পরিশ্রম যেন ঐ গলিত লাভাকে স্পর্শ করেছে। তাই সুখের খোঁজে বের হোন। নদীর প্রান্তে শীতল বাতাস খুঁজে নিন। সঙ্গে নিন সাহিত্য চর্চার সমস্ত সামগ্রী। অন্তত নিজের মোবাইল সাথে রাখুন। প্রশান্তির আদলে শুরু করুন সাহিত্য চর্চা। লেখালেখির জগতে প্রবেশ করাতে শিখুন। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন আপনার সুদৃঢ় প্রয়াসকে অবশ্যই কুর্নিশ জানাবে। আসলে বিনামূল্যে সাহিত্য চর্চায় প্রশান্তি আনতে পারে একমাত্র ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন। তাই নিজের মোবাইল এর স্পর্শে ঘেঁটে ফেলুন আপনার প্রিয় লেখক এর লেখা গুলো। নদীর প্রান্তে শীতল বাতাসের প্রশান্তি আর সাহিত্য চর্চার প্রশান্তিকে করে ফেলুন এককার।

ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন সর্বদা সকলের পাশে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই সাহিত্যে থাকুন, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন পড়তে থাকুন।
     

                                ধন্যবাদান্তে
                           সম্পাদকীয় বিভাগ 


__________________________________________________


এপ্রিল সংখ্যার সূচীপত্র - 


অনুগল্প : 

১) দর্পনা গঙ্গোপাধ্যায় ২) প্রদীপ সেনগুপ্ত ৩) পার্থপ্রতিম দাস ৪) নীল মিত্র ৫) অভিষেক ঘোষ ৬) চন্দন মিত্র ৭) প্রহ্লাদ কুমার প্রভাস। 


কবিতা :

১) ইলা সূত্রধর ২) সুশান্ত সেন ৩)আনন্দ গোপাল গড়াই ৪) নাসির ওয়াদেন ৫) অনুপম বিশ্বাস ৬) মুহা আকমল হোসেন ৭) নীলমাধব প্রামানিক ৮) অমিত কুমার সাহা ৯) তপন মাইতি ১০) পূর্বিতা পুরকায়স্থ ১১) গোবিন্দ মোদক ১২) গৌতম ঘোষ দস্তিদার ১৩) সমর আচার্য্য।


গল্প :

১) সিদ্ধার্থ সিংহ ২) শাশ্বত বোস।


প্রবন্ধ :

১) তন্ময় কবিরাজ ২) শংকর ব্রহ্ম।


______________________________________



স্বর্ণমণি - সিদ্ধার্থ সিংহ || Sawarna moni - Sidhartha singha || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 স্বর্ণমণি

সিদ্ধার্থ সিংহ



বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখতেই সৌম্য বুঝতে পারল, স্বর্ণমণিকে কত লোক ভালবাসত। না হলে এইটুকু সময়ের মধ্যে এত লোক এসে জড়ো হয়! গোটা বাড়ি জুড়ে থিকথিক করছে লোক। তার মধ্যে আশপাশের মেয়ে-বউই বেশি। ও যে সবাইকে চেনে বা ওকেও যে সবাই চেনে, তা নয়। তবে স্বর্ণমণিকে নিশ্চয়ই এরা সবাই চেনে।


ও তখন মেজদির বাড়িতে রাখী পরতে গেছে। জামাইবাবুর আনা মটন বিরিয়ানি খেতে খেতেই শুনল মেজদির ফোনে রিং হচ্ছে। মেজদির কথা শুনেই বুঝতে পারল মাধুকাকা ফোন করেছে।

মা মারা যাওয়ার পর তাদের এই অকৃতদার কাকাই তাদের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে থাকেন। পঁচাত্তর পেরিয়ে গেলেও শরীর এখনও যথেষ্ট সুঠাম। কিন্তু তিনি ওখানে একা থাকবেন কী করে! রান্নাবান্না কে করে দেবে! তাই খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের সংসাররের যাবতীয় কাজকর্ম যে দু'হাতে একাই সামলাচ্ছে, সেই স্বর্ণমণিকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওখানে।

খুব ছোটবেলায় বাপ-মা মরা পলাশীর এই মেয়েটিকে তার বৌদি এত অত্যাচার করত যে, সে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতার ট্রেনে চেপে বসেছিল। সেই ট্রেনে ছিলেন সৌম্যর মা।

সে বহু যুগ আগের কথা। সৌম্য তখন ফাইভ কি সিক্সে পড়ে।

ওর মা উলটো দিকের সিটে মেয়েটিকে ও ভাবে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কোথায় যাবে?

ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়েটি কোনও রকমে বলেছিল, এই ট্রেনটা যেখানে যাবে সেখানে।

উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কোথায় থাকো?

ও বলেছিল, পলাশীতে।

--- তোমার নাম কি?

মেয়েটি বলেছিল, স্বর্ণ।

ওর মা জানতে চেয়েছিলেন, ওখানে কার কাছে যাবে?

মেয়েটির আমতা-আমতা করা দেখেই তিনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। দেখতে-শুনতে আদিবাসীদের মতো হলেও অল্প বয়স তো, চারিদিকে হাজার রকমের লোক ঘুরে বেড়ায়, কোথায় কখন কোন বিপদে পড়ে যাবে, তাই তাকে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের বলেছিলেন, এটা হচ্ছে তোদের একটা মণি। যেমন মাসিমণি, পিসিমণি, ঠিক তেমনি এটাও একটা মণি। তোরা ওকে মণি বলেই ডাকবি, বুঝেছিস?

কেউ কেউ মণি বললেও সৌম্য যেহেতু একটু পাকা ছিল, তাই মণি নয়, স্বর্ণকে স্বর্ণমণি বলেই ডাকত। আর স্বর্ণও তাদের এত ভালবেসে ফেলেছিল যে, আসার ক'দিন পর থেকেই তাদের সংসারটাকে নিজের সংসার মনে করেই দু'হাতে সামলাত। 


সৌম্যরা সব ক'টা ভাইবোনই পশুপাখি খুব ভালবাসে। তাদের কলকাতার বাড়িতে কুকুর, বিড়াল, টিয়াপাখি, কাকাতুয়া, খরগোশের পাশাপাশি সৌম্যর ভাই দর্শন একটা ছোট্ট বাঁদরের বাচ্চা পুষতে শুরু করেছিল। আদর করে নাম রেখেছিল র‍্যাঞ্চো।

দেখতে দেখতে তার বয়সও সাত-আট বছর হয়ে গেল। এত দিন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু কিছু দিন আগে তাদের এলাকায় যখন বনদফতর থেকে ঘনঘন হানা দিতে শুরু করল, যে দিন তাদের পাড়া থেকে একজনের পোষা বাজপাখিটাকে জোর করে নিয়ে গেল, তখন ভয় পেয়ে তার পর দিনই ভোররাতে একটা ছোট্ট ম্যাটাডর ভাড়া করে খাঁচাশুদ্ধু র‍্যাঞ্চোকে নিয়ে বারুইপুরের বাগানবাড়িতে রেখে এসেছিল দর্শন।

না, এ বাঁদর, মানে র‍্যাঞ্চো কলা খায় না। দই খায়। শশা খায়। লিচুর সময় লিচু, আঁশফল, সন্দেশ, কড়াইশুঁটি, পেয়ারা।

সে দিন নাকি ওকে কিছুতেই খাওয়ানো যায়নি। স্বর্ণকে মাধুকাকা বলেছিলেন, এই দুপুরবেলায় ও না খেয়ে থাকবে! যা, ওকে তা হলে দুটো রসগোল্লা খাইয়ে আয়।

র‍্যাঞ্চো যখন কলকাতায় ছিল, ছাড়াই থাকত। দর্শনের বুক জড়িয়ে কিংবা কাঁধে চড়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। শুধু সৌম্যদের বাড়ির লোকেরাই নয়, ওকে ভালবাসত পাড়ার প্রায় সকলেই।

দর্শনের খুব ন্যাওটা ছিল ও। খানিকক্ষণ না দেখলেই দর্শন যে যে জায়গায় আড্ডা দিত, হুটহাট করে সে সব জায়গায় চলে যেত। 

একদিন খুব ভোরবেলায় পাঁচিল টপকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

ওদের পাড়ায় ছিল মাদার ডেয়ারির একটি দোকান। যাঁরা দুধ দিতে আসতেন তাঁরা সবাই র‍্যাঞ্চোকে চিনতেন। কিন্তু সে দিন এসেছিলেন একদম নতুন একজন লোক। তিনি দুধের পাউচ ভর্তি ট্রে-টা মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘর্ষণের সেই বিচ্ছিরি আওয়াজ শুনে লোকটার দিকে তেড়ে গিয়েছিল র‍্যাঞ্চো।

বাঁদরটাকে ওই ভাবে তেড়ে আসতে দেখে লোকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যদি কামড়ে দেয়! তাই আগের দিন রাস্তার ধারে খুলে রাখা প্যান্ডেলের একটা বাঁশ তুলে সজোরে মেরেছিল বাঁদরটাকে। একটা নয়, পর পর বেশ কয়েক ঘা।

সেই যে লোকটা ওকে মারল, সে তো ওকে মেরে চলে গেল। আর তার পর থেকে কোনও লোক দেখলেই হল, তাকে কামড়ানোর জন্য তেড়ে যেতে লাগল। বাধা দিতে গিয়ে কামড় খেল দর্শনও। কামড়ে দিল বেশ কয়েক জন পথচলতি মানুষকেও।

বাঁদর পোষার জন্য তখন প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে দর্শনকে। পাশাপাশি দিতে হয়েছে তাদের যাবতীয় চিকিৎসার খরচ। তখনই ঠিক করা হয়, আবার কখন কাকে কামড়ে দেবে, তখন হয়তো শুধু ভর্তুকি দিলেই হবে না, এই নিয়ে থানা-পুলিশও হবে, তার চে' বরং ওর জন্য একটা খাঁচার ব্যবস্থা করি।

তখন ওদের মাথাটা কাজ করেনি, একবারও মনে হয়নি আর কিছু দিন পরে সে যখন আরও বড় হবে, তখন এই খাঁচাটা ওর তুলনায় ছোট হয়ে যাবে। তাই বারুইপুরে নিয়ে আসার পরে একটা পুরো ঘরের সমান খাঁচা বানানো হয় র‍্যাঞ্চোর জন্য। যাতে সে হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারে। তখনই ভাবনাচিন্তা করা হয়, খাঁচাটা যখন এত বড় করাই হচ্ছে, তখন একটা মেয়ে বাঁদর আনলে কেমন হয়!

তখনই ঠিক হয়, এখন যেখানে খাঁচাটা আছে সেখানেই বড় খাঁচাটা রাখা হবে। কিন্তু একবার বড় খাঁচাটা তৈরি হয়ে গেলে সেটাকে টেনেহিঁচড়ে ওখানে নিয়ে যাওয়াটা খুব মুশকিল হবে। তাই র‍্যাঞ্চোর খাঁচাটাকে একটু দূরে সরিয়ে সেখানেই পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা শুরু হয় বড় খাঁচাটি।

এত দিন যেখানে ছিল সেখান থেকে খাঁচাটি সরানোর জন্যই বুঝি সে খুব রেগে ছিল। তাই মাধুকাকা যখন বলল, যা, ওকে তা হলে দুটো রসগোল্লা খাইয়ে আয়।

সেটা খাওয়াতে গিয়েই এই বিপত্তি। স্বর্ণ যখন রসগোল্লা খাওয়ানোর জন্য খাঁচাটার সামনে গেল, দেখল, না-খাওয়ার জন্য খাঁচার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সে ছুটোছুটি করছে। মাঝেমাঝেই ওপরে উঠে রড ধরে বসে থাকছে। হাজার ডাকলেও নামছে না।

স্বর্ণ তখন ওকে খাওয়ানোর জন্য ঘুরে ঘুরে খাঁচার এ দিকে ও দিকে গিয়ে ওর মুখের সামনে রসগোল্লা ধরছে।

হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝট করে ওর হাতটা টেনে নিয়ে র‍্যাঞ্চো এমন মারণ কামড় কামড়ে ছিল যে, সেই যে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোনো শুরু হল, একটা গোটা কোলগেট পেস্ট দিয়েও সেই রক্ত বন্ধ করা গেল না। শেষে পাশের বাড়ির যে ভদ্রমহিলা সারা দিনে পঞ্চাশ বার পান সেজে খান, তাঁর কাছ থেকে একগাদা চুন এনে কোনও রকমে বন্ধ করা হয় রক্ত।

স্বর্ণকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, ও কিন্তু ডাক্তারকে একবারও বলেনি বাঁদর কামড়েছে। যাদের ভয়ে ওকে কলকাতা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, জানাজানি হলে যদি সেই বন দফতরের লোকেরা এসে ওকে নিয়ে যায়, তখন? তাই স্বর্ণ বলেছিল, বঁড়শি গেঁথে গেছে।

ডাক্তার সেই হিসেবেই ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। খাবার ট্যাবলেটও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁদর কামড়ালে যে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, ওকে তো সেটা দেওয়া হয়নি। রাত থেকেই শুরু হয়েছিল যন্ত্রণা। কাটা পাঁঠার মতো দপাদাপি করেছে সারা রাত।

স্বর্ণর অবস্থা বেগতিক দেখে দর্শনকে বারবার ফোন করেছিল মাধুকাকা। দর্শনকে না পেয়ে বাধ্য হয়েই ফোন করেছিল মেজদিকে।

আজ রাখিপূর্ণিমা। নিশ্চয় ওরা দু'ভাই তাদের মেজদির বাড়িতে প্রতিবারের মতো রাখী পরতে যাবে। ওখানে যাওয়া মাত্রই দর্শন যাতে খবরটা পায়, সে জন্যই উনি ফোন করেছিলেন।


ফোন রেখেই সৌম্যর দিকে তাকিয়ে মেজদি বলেছিলেন, স্বর্ণর অবস্থা খুব খারাপ রে। গোটা শরীর নাকি বেঁকে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওর চিৎকারে আশপাশের লোকজন সব জড়ো হয়ে গেছে। দর্শনকে ফোনে পাচ্ছে না। ও তো এইমাত্র রাখী পরে গেল। ফোন কর তো, ফোন কর, ফোন কর। এক্ষুনি ফোন কর।

সৌম্য যখন শুনল স্বর্ণমণির শরীর বেঁকে গেছে, তার মানে ওর ধনুষ্টংকার হয়েছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে না গেলে ওকে বাঁচানো মুশকিল। তাই খাওয়া থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দর্শনকে ফোন করল সৌম্য। কিন্তু ফোন বেজে গেল, বেজেই গেল। আবার। আবার। আবার। অনেক বার চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে ফোন করল মিঠুকে।

মিঠু দর্শনের ছেলে। সে বলল, হ্যাঁ, বাবাকে না পেয়ে দাদু আমাকে ফোন করেছিল। আমিও বাবাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু পাইনি। তাই আমি একটা বন্ধুর বাইকে করে এক্ষুনি বারুইপুরে যাচ্ছি।

সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা স্বর্ণর।। আর ভাবতে পারল না সৌম্য। সেই কোন ছোটবেলা থেকে সে তাদের সংসারটা সামলাচ্ছে। আজ তার এই অবস্থা! ফোন করল বড়দিকে--- শুনেছিস? স্বর্ণমণির কি হয়েছে?

--- কী হয়েছে?‍ দিদি জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, মাধুকাকা যা বলল, তাতে ও বাঁচবে কি না সন্দেহ আছে।

সৌম্যদের বাড়ির উলটো দিকেই থাকে সৌম্যর ছোটবোন। বারান্দার গ্রিলের ও পারে দেখতে পেয়ে তাকে বলল, স্বর্ণমণি বোধহয় আর বাঁচবে না রে!


খানিক পরেই ফোন করল মিঠুকে। তার বন্ধু এত জোরে বাইক চালিয়ে নিয়ে গেছে যে, পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই কসবা থেকে বারুইপুরে পৌঁছে গেছে।

সৌম্য জিজ্ঞেস করল, স্বর্ণমণি এখন কেমন আছে? মিঠু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নেই।

সৌম্য এই ভয়টাই পাচ্ছিল। ও যে কেন প্রথমেই ডাক্তারকে বলল না বাঁদর কামড়েছে, তা হলে তো ঠিকঠাক ইঞ্জেকশনটা পড়ত। এ ভাবে অঘোরে প্রাণ দিতে হত না। এই দুঃসংবাদ ও কাউকে বলবে কী করে! কিন্তু এ সংবাদ তো চেপে রাখারও নয়। জানাজানি হবেই। তাই মেজদিকে ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মেজদি, স্বর্ণ আর নেই রে...

--- কী বলছিস? আঁতকে উঠল মেজদি।


ফোন করল বড়দিকে। বড়দি স্তম্ভিত। সে কী রে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। এই তো শেতলা পুজোর সময় যখন বারুইপুর থেকে আসছি, জোর করে একগাদা গোটা ফল আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে দিল। বলল, নিয়া যান। পরে খাইতে পারবেন। এখানে তো খাওনের লোক নাই। পইরা থাইকা থাইকা নষ্ট হইব। তুই কখন খবর পেলি?

--- এই তো একটু আগে। মিঠু বলল।

--- আমি ভাবতে পারছি না রে, মেয়েটার কী হল!আমার হাত-পা কেমন কাঁপছে। এ কী খবর শোনালি তুই...


ফোন করল ছোটবোনকে। সে বলল, আমাদের তো ওখানে যাওয়া দরকার। কী করে যাই বল তো! বডি কি বাড়িতেই আছে, না হাসপাতালে?

--- আমি এখনও ঠিক পুরোটা জানি না।

--- না, ওখানে তো মাধুকাকা ছাড়া কেউ নেই। সবাই তো এ দিকেই থাকে। সবাই মিলে দল বেঁধে যেতে গেলে কখন গিয়ে পৌঁছব কোনও ঠিক নেই। এতটা পথ... যেতেও তো সময় লাগবে। তার চেয়ে বরং ওর বডিটা যদি এখানে আনা যায়, দ্যাখ না... তা হলে শেষ চোখের দেখাটা একবার দেখতে পাই।


বারুইপুরে দাহ করার জায়গা বলতে ওই একটাই। জোড়া মন্দির। তা হলে কি ও মাধুকাকাকে ফোন করে একবার বলবে, আমাদের ফ্যামিলির যারা মারা যায় তাদের সবাইকে তো কেওড়াতলাতেই দাহ করা হয়, ও তো আমাদের পরিবারেরই একজন। ওকে এখানে দাহ করলে হয় না?

কিন্তু না, বেশ কয়েক বার ফোন করেও মাধুকাকাকে না পেয়ে ও সোজা রওনা হয়ে গিয়েছিল বারুইপুরে। যে তাদের জন্য সারাটা জীবন দিয়েছে, শেষকৃত্যে তার পাশে না থাকলে হয়! লোকে কী বলবে!


বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখতেই সৌম্য বুঝতে পাড়ল, স্বর্ণমণিকে কত লোক ভালবাসত।

বাড়ির উঠোন জুড়ে এদিকে-সেদিকে জটলা। ওকে দেখেই সবাই সরে গিয়ে জায়গা ছেড়ে দিল।

ও ঘরে ঢুকেই একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দেখল, মাধুকাকা খাটের উপরে বসে আছেন। আর তার ঠিক উলটো দিকের সোফায় স্বর্ণমণি। ওকে দেখেই স্বর্ণ বলল, আপনে?

--- তুই?

--- এই তো ডাক্তার দেখাইয়া আইলাম।

--- ডাক্তার দেখিয়ে! বলেই, ওর মনে পড়ে গেল মিঠুই তো তাকে বলেছিল, ও নেই। তার মানে? তাই সৌম্য জিজ্ঞেস করল, মিঠু কোথায়?

মাধুকাকা বললেন, এই তো ছিল, এখানে তো টাওয়ার পাওয়া যায় না... ফোন করার জন্য মনে হয় বাইরে গেছে, দ্যাখ না... উঠোনে গিয়ে দ্যাখ, ওখানে আছে মনে হয়।

মাধুকাকা এই ভাবে কখনও ওর সঙ্গে কথা বলে না। তার মানে স্বর্ণমণিকে নিয়ে উনি খুব টেনশনে ছিলেন। সেই রেশ এখনও কাটেনি। তার ওপর কে যে রটিয়েছে, ও মারা গেছে... সেই নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে আছেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে সৌম্য দেখল, উঠোনের ও দিকে পায়চারি করতে করতে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে মিঠু। ও সঙ্গে সঙ্গে মিঠুর কাছে গিয়ে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল, তুই আমাকে কী বলেছিলি?

জেঠুর কথা বলার এই টোন সে চেনে। তাই ফোনের ও প্রান্তে যে আছে তাকে বলল, এই, একটু পরে ফোন করছি... বলেই লাইনটা কেটে দিয়ে জেঠুকে বলল, কী বলেছি?

--- তুই যে বললি স্বর্ণমণি নেই!

--- ছিল না তো... ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। আমি এসে দেখলাম নেই। তাই তুমি জিজ্ঞেস করতেই বললাম, নেই। কেন, কী হয়েছে?

--- ও তো ঠিকই আছে দেখছি।

--- হ্যাঁ, ডাক্তার দেখিয়ে এল তো...

--- না, মাধুকাকা যে মেজদিকে বলল, ওর শরীর বেঁকে গেছে!

--- তাই নাকি? বেঁকে গেছে বলেছে? তা হলে যাও দাদুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ঘরে আছে তো।

সৌম্যরও মনে হল এটা জিজ্ঞেস করা দরকার। তাই ঘরে গিয়ে মাধুকাকাকে ও জিজ্ঞেস করল, আপনি মেজদিকে ফোন করে বলেছিলেন ও বেঁকে গেছে... কোথায়? ও তো দিব্যি আছে।

--- বেঁকে গেছে? কে বলল? আমি তো ওকে বললাম পেকে গেছে। বাঁদরটা যেখানে কামড়েছিল সেই জায়গাটা পেকে গেছে।

তার মানে মেজদি 'পেকে'টাকে 'বেঁকে' শুনেছিল। আর বেঁকে গেছে শুনেই তার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই ধনুষ্টংকার হয়ে গেছে। আর ধনুষ্টংকার মানেই... তার ওপরে মিঠু যখন বলল নেই, তখন তার মনে হয়েছিল 'নেই' মানে, স্বর্ণ আর বেঁচে নেই। আর বেঁচে নেই ভেবেই, সে নিজেই সবাইকে ফোন করতে শুরু করেছিল।

সামান্য ভুল শোনা, আর সেই শোনার ত্তপরে ভিত্তি করে অনেক কিছু ভেবে নেওয়ার জন্যই এই বিপত্তি!

যাক বাবা, যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক, ও তো বেঁচে আছে, থুড়ি ভাল আছে, সেটাই অনেক। এ বার আবার তাকে একের পর এক ফোন করতে হবে। মেজদিকে, বড়দিকে এবং ছোটবোনকে। বলতে হবে। গুছিয়ে বলতে হবে। এমন ভাবে বলতে হবে, সেটা নিয়ে যাতে আর কোনও ভুল বোঝাবুঝি না হয়। কিন্তু কী বলবে সে! কী!


-----------------------------------