লেখক রোকেয়া ইসলাম -এর একটি গল্প

 জ্বর



 শেষরাতে প্রচন্ড শীতে ঘুম ভেঙে যায় রেহানা নাসিমের। গায়ের উপর পশমিনা কম্বল আছে তবুও এতো শীত। 

ওর গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। 

ওঠে কম্বলের উপর আরেকটা কাঁথা কম্বল দেবার ইচ্ছে বা শক্তি কোনটাই নেই। গায়ের কম্বলটা কান অবধি ঢেকে দিয়ে শুয়ে থাকে। 

হাড় কাঁপিয়ে জ্বরটা এলোই শেষ অবধি। 

রেহানা আর্লি রাইজার তবে 

শীতের সকালে ঘুম ভাঙে না রেহেনার । রোদ ডানা মেলে দেয় ডাঙায় তবেই জেগে ওঠে। 

আজ একেবারেই ওঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু নিম্নচাপ কঠিনভাবে চেপে ধরেছে। এই বয়সে যদি বিছানা ভিজিয়ে দেয় তবে বেজ্জতির শেষ থাকবে না। 

বাথরুম থেকে একবারে ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই ক্ষিদেটাও চনমনিয়ে জানান দেয়। 


বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে বিছানা ঝেড়ে টানটান করা আছে। 

রেহেনার এই এক দোষ। ভোরে আগের রাতের চিহ্ন দেখতে চায় না। 

বাসি ঘর ঝাড়ু না দিয়ে কোন কাজ শুরু করবে না। জানালা দরজা খুলে রোদটুকু ঘরে এনে ছড়িয়ে দিতেই স্বস্তি । 

জানালার পরদার কুঁচি ধরে ধরে ক্লিব দিয়ে আঁটকিয়ে রাখা। থাই রঙিন কাঁচ দিনেরবেলার রঙ বৈচিত্র্য ধরা দেয় ঘরের ভেতর। রাতের রঙ আঁটকে রাখে পরদায়। 

বেশকিছু পুরানো নিয়মকে ধরে রেখেছে সংসারে। তাতে কোন ক্ষতি হয়নি। বরঞ্চ।ভালটাই পায় সংসারে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা সকাল থেকেই শুরু হয়। 

এগুলো সুসংস্কার। এগুলো যতটা পারা যায় ততোটা আঁকড়ে থাকতে হবে। 

দিনের খা খা রোদেও চোখ খুলতে পারছে না আজ রেহানা। সমস্ত শরীর ব্যাথায় কাতর হয়ে আছে। 

ঘোর জ্বর ওর শরীরে পাকাপোক্ত আসন নিতেই ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এইসময় জ্বর মানেই তো অতিমারি করোনা। প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে মৃত্যু। 

মৃত্যুকে ভয় পেয়ে লাভ নেই। মৃত্যু অনিবার্য সত্য সেটা আজ হোক কাল হোক আসবেই। 

মৃত্যু পরম বন্ধুর মতো হোক।" মরন তুহুঁ মম শ্যাম সমান "। 

মৃত্যু হোক নিরবে নিভৃতে ঘুমের মধ্য দিয়ে। অথবা মৃতুর সময় ঘিরে থাকুক প্রিয়জন। ও দেখে যাক জীবনের রক্ত মুখে তুলে যাদের লালন পালন করেছে যাদের মঙ্গল কামনায় দিনরাতের বেশিরভাগ সময় ব্যায় করেছে তারা ওর বিয়োগ ব্যাথায় কাতর। তাদের বেদনা বিধুর মুখ দেখেই পাড়ি দিক পরপারে। 

করোনা মানে তো কেউ চাইলেও কাছে আসতে পারবে না। একাকী এক ঘরে রোগ কষ্টের সময় যাপন করতে হবে। হাসপাতালে চিকিৎসার দুরবস্থার কথা তো অজানা নয়। 

লাসের মুখটাও তো কেউ দেখতে পারে না। 

ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠে।

মৃতদেহকে কতটা অপমান করা যায়!! 

 না না করোনা নয়!! প্রবল শত্রুকেও করোনায় মৃত্যু নয়!! 

এমন ঠান্ডা জ্বর বছরে একবার আধবার হয়। এটা কি তেমনই নাকি করোনার করাল গ্রাস? 

বুকের ভেতরটা তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতরের অসহ্য যন্ত্রণা। ভয় সবমিলিয়ে খুব অসহায় সময় রেহেনার এখন। 

মনে পড়ছে মায়ের কথা। এমন জ্বর হলে মা ঠান্ডা পানিতে মাথা ধুয়ে গা মুছিয়ে পাউডার মেখে দিতে যাকে ফুলেল সৌরভে রোগাভোগা শরীরের মনটা উৎফুল্লু থাকে। তাতেও অর্ধেক রোগ দূরে সরে যায়। 

রবিনসন্স বার্লি লেবু লবন দিয়ে চুমুকে চুমুকে খেতে দিতো। দুধ সাবুও চলতো কখনো কখনো। আবার পাটায় একটা আস্ত হলুদ পিষে সরষের তেল মেখে গরমাগরম ভাত মেখে খাওয়া হতো। বাটি ভর্তি আনারস খেতেও ভাল লাগতো। 

রেহেনার পছন্দ ছিল জাম্বুরার লাল লাল কোয়া ছাড়ানো লবন আর টালা শুকনো মরিচের গুড়ো ছড়িয়ে প্লেট ভরে সামনে দিলে চামচে করে একটু একটু মুখে পুরে আস্তে আস্তে চিবিয়ে খাওয়া। 

সিবাজলের সাদা ট্যাবলেট খেয়েই জ্বর পাগার পার। 

কতদিন হলো মা নেই পৃথিবীতে। মায়ের মত ছোট খালাও রেহেনার জ্বর হলে এমনি আদর করতো। 

রেহেনার মনে হচ্ছে ওর জ্বরের উত্তাপে ফেটে যাবার উপক্রম কপালটার উপর মায়াময় শীতল হাতের স্পর্শ পড়ুক। একবার মায়ের হাতের স্পর্শ পড়ুক। 

গরম চোখের উপর শীতল স্পর্শের জন্য আকুল হয়ে ওঠে রেহানা। 

-আর একটু আর একটু মাথাটা উঁচু করে ধর। আর একটু। 

অনেকক্ষণ পর মাথায় জলস্পর্শ পড়ছে। গরম চোখের পাতায় শীতল পরশে বেশ আরামদায়ক লাগছে। 

চোখ খুলে দেখতে পায় পুত্রবধূ আফরোজা আর বড় নাতী দীপ্র ওর মাথায় পানি ঢেলে জ্বর নামিয়ে এনেছে। শরীর মুছিয়ে সমস্ত শরীরে পাউডার মাখিয়ে দিচ্ছে। 

চামচে করে থাই স্যূপ খাইয়ে ঔষধ দিয়ে দেয়। 

দুধ সাবুর আধুনিক সংস্করণ থাই স্যুপ। 

রেহেনা শুয়ে পড়ে। মাথার কাছে পিরিচ থাকে ছোট ছোট লবন মাখানো আদার টুকরো। 

না করোনা নয় সাধারণ ফ্লু। হাফ ছেড়ে বাঁচে রেহেনা। 

মনে হয় মাঝেমাঝে এমন নিরাপদ জ্বর হলে শরীর নতুন হয়। অতীতও কাছে আসে।  

মা ছোট খালা নতুন রুপে।

চোখ ভিজে ওঠে রেহানার। 

মনের ভেতর রেহানা এবাদতের হাত তোলে সৃষ্টিকর্তার দরবারে-

"সৃষ্টিকর্তা করোনার ভয়ংকর রুপ দূর করে দাও। মানুসের জন্য সহনীয় কর। 

করোনাকে মানুষের করায়াত্ত কর প্রভু। 

আর্তের দোয়া কবুল কর। বিশ্বের জন্য করোনাকে সহনীয় কর।"

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024