লেখক অমিত পাল -এর একটি গল্প

 গরীবের ভূত

 




একদা একটা গ্রামের ঘটনার কথা আজ বলব৷

ঘটনাটি শুনেছিলাম অবশ্য ঐ গ্রামের কিছু বয়স্কদের কাছ থেকে৷ গ্রামটির নাম লাভপুর৷

বীরভূম জেলার অন্তর্গত এই গ্রামটি খুব একটা বড়োও নয়, আবার খুব একটা ছোটও নয়৷ মোটামুটি একটা বটে৷ এই গ্রামে কিছু ধনী পরিবার, কিছু মাঝারি পরিবার এবং কিছু দরিদ্র পরিবারও ছিল৷ প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী গ্রামের ধনী ব্যক্তিরা সর্বদায় পদতলে অবদমন করে রাখত, অত্যাচার করত গরীবদের উপর৷ এমনকি তখন জমিদারী প্রথাও প্রচলন ছিল৷ ফলে ধনীরা আরও ধনী ও গরীবরা আরও গরীব হতে লাগল৷


      এই গ্রামেই বাস করত এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ৷

তার নাম কানু চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি ছিলেন খুবই দরিদ্র এক ব্রাহ্মণ৷ তার কোনো বউ, ছেলে-মেয়ে ছিল না৷ ফলে সে একা অতি দারিদ্রতার সঙ্গে জীবন যাপন করত৷ ঐ গ্রামে একটা বড় এবং পুরাতন কালী মন্দির ছিল৷ সেখানেই সে নিত্য কালীপূজায় রত থাকত৷ আর সঙ্গে কিছু যজমানগিরি করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করত৷


   ব্রাহ্মণটি অবশ্য সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করত৷ সবার সাথে সৎ আচরণও করত৷ অবশ্য অন্যান্য সবাই ব্রাহ্মণটির সাথে ভালো আচরণ করত, ব্রাহ্মণটিকে শ্রদ্ধাও করত৷ এমনকি ব্রাহ্মণের অধিকাংশ কথা গ্রামের মানুষ জন মেনে চলত৷ ব্রাহ্মণটিও মনে মনে ভাবত গ্রামের লোকজন তাকে এই ভাবেই সহযোগীতা করে যাবে সারাজীবন৷ কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল? থাক সে কথা, পরে আসছি৷


                       হঠাৎ ঐ গ্রামে একটা ঘটনা ঘটে গেল৷ ঘটনাটি হল এই, ঐ গ্রামের এক জমীদার, নাম তার বীররাম চৌধুরি৷ সে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে বাণিজ্য করে খুশি মনে বাড়ি ফিরছিল৷

সঙ্গে ছিল তার লোকজন তথা নায়েব, পনেরো জন লেঠেল, পনেরো জন অশ্বারোহী ইত্যাদি৷

এখানে বলে রাখি এই গ্রামের সাথে অন্য গ্রামে যাওয়ার রাস্তাটি ছিল বাঁশ বনে ঘেরা এক বন্য পথ৷ এখানে সূর্য্য অস্ত যাওয়ার আগেই যেন সন্ধ্যা নেমে আসে৷ বীররাম চৌধুরি আজ কুড়ি দিন পর নিজের গ্রামে ফিরছে৷ মন তার বড়ই আনন্দে আপ্লুত, এটা যে শুধু বাড়ি ফেরার তাগিদেই নয়, বরং সে বাণিজ্যে ভালো মুনাফা অর্জন করেছে৷

     

   সে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে৷ সে যখন গ্রামের বড় রাস্তার মুখে এল, তখন সে দেখল রাস্তার একধারে তাদের থেকে পঞ্চাশ - ষাট হাত দূরে ডানদিকে বাঁশ ঝোপের আড়ালে সাদা কাপড় পরাহিত একটা কী দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এই দৃশ্য দেখা মাত্রই সবার মধ্যে এক ভীতির সঞ্চার ঘটল৷ বীররাম চৌধুরি নামে বীর হলে কী হবে? সে ভূতকে খুব ভয় পেত৷ তারা অবশ্য এই দৃশ্য দেখা মাত্রই সেখানে দাঁড়িয়ে পরেছিল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ মুর্তিটি তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷

তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে সবাই দে-দার

ছুট দিল৷ বীররামের লোকজন সমস্ত বাণিজ্যের জিনিস ফেলে পালিয়ে গেল যে যেখানে খুশি৷

           

                          পরদিন সকালে গ্রামের এই খবর প্রচার হয়ে গেল৷ জমিদার বীররাম চৌধুরি সকাল বেলাতেই ঐ দু'দিক বাঁশবন ঘেরা পথে তার ফেলে আসা বাণিজ্যের জিনিসপত্র গুলি আনার জন্য লোক পাঠাল৷ কিন্তু তার লোকজন সেখানে গিয়ে কোন জিনিসের হদিশ পেল না৷ ফলে ঐ জমিদার খুব চিন্তায় পরে গেল৷

   

   এই ভাবে কেটে গেল কয়েকদিন৷ ঐ রাস্তা ধরে অবশ্য গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যার পর কোথাও যায় না৷ তবে কিছুদিন পরই আবার ঐ একই ঘটনা ঘটল৷ ঐ গ্রামেরই আর এক জমীদার

তার নাম ঘনশ্যাম মিত্র, সেও বীররামের মত অন্য এক গ্রাম থেকে বাণিজ্য করে ফিরছিল তিরিশ দিন পর৷ তখনও ছিল সন্ধ্যার সময়, আর একই ঘটনায় ঘটল৷ কি একটা সাদা কাপড় পড়া জিনিস দেখে তারা ভয়ে পালিয়ে এসেছে নিজেদের বাণিজ্যের জিনিস পত্রও হারিয়েছে বীররামের মতোই৷

         এই ঘটনাটি পুনরাবৃত্তি হওয়ার জন্য গ্রামে একটা হই হই উত্তেজনার সৃষ্টি হল৷ গ্রামবাসীরা সকলেই ভয় পেল এবং সকলের মনে একটা কৌতুহল বাসা বাঁধল৷ সবাই ঐ ব্রাহ্মণ টির কাছে পরামর্শ নিতে গেল৷

       গ্রামের একজন লোক বলে উঠল, আচ্ছা পন্ডিত মশাই ঐ জিনিস টা আসলে কি বলুন তো?

ব্রাহ্মণটিও বলল, হতে পারে কোন ভৌতিক লীলার খেলা!

আবার একজন লোক বলল, যদি ভৌতিক লীলার খেলা হয় তাহলে বাণিজ্যের জিনিসপত্র গুলো নিল কে? ভূতেরা তো আর টাকা-পয়সা নেয় না!

কি জানি? ব্রাহ্মণটি বলল৷ আবার এও বলল,

যদি অলৌকিক কিছু থেকে থাকে, তাহলে ঐ রাস্তায় দিকে না যাওয়ায় শ্রেয়৷

     গ্রামের দুজন সাহসী জোয়ান ছেলে নাম হল 

তাদের এক জগন্নাথ ডোম আর একজন হল রঘুনাথ ডোম, এদের সাহসীকতার নজির সর্বত্র৷

সমাজের বিভিন্ন কাজে এরা সকলকে সাহায্যও করেছে৷ এককালীন এই গ্রামে জগা ডাকাত নামে এক নৃশংস ডাকাতের উপদ্রব ছিল৷ এরা এই ডাকাতকে মেরে গ্রামের কাছ প্রচুর সম্মানও অর্জন করেছিল৷ তারপর থেকে এরা দুজন গ্রামের চৌকিদারের পদ অর্জন করল৷

                           এই ঘটনার বাড়বাড়ন্ত দেখে 

উভয়'ই একটু উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল, আচ্ছা

চাটুজ্যে মশাই আমরা দুজনে যদি একবার দেখে আসি জিনিসটা কি? তাহলে কেমন হয়?

            

                       ব্রাহ্মণটি বলল, দেখ অলৌকিক শক্তির কাছে লৌকিক শক্তির সর্বদায় হারই হয়৷ তাই সেখানে তোমাদের নিজেদের সাহসিকতার পরিচয় দিতে যাওয়াটা মূর্খামির সামিল৷

কি জানি কি থেকে কি হয়ে যাবে? তাই তোমাদের সেখানে না যাওয়ায় শ্রেয়৷

   

                    কিন্তু এইভাবে কি চলতে দেওয়া যায় বলুন তো, রঘুনাথ ডোম বলে উঠল৷

না না আপনি যায় বলেন না কেন আমরা একবার জিনিসটা দেখতে চায়!

                তখন ব্রাহ্মণটি বলল, দেখ সেখানে যাওয়া মানে জীবন নিয়ে টানাটানি৷

এবার তোমরা দুজনে যখন সাহস নিয়ে যেতে চাইছ তখন যেতে পার৷ কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে তোমাদের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কিন্তু গ্রাম বাসীরা তোমাদের জন্য দায়ী থাকবে না৷


     ব্রাহ্মণটির বাড়ন সত্ত্বেও তারা দুজনে ঠিক করে নিল তারা যাবেই৷ তাতে তাদের যা হয় হোক৷ এই বলে তারা মন্দির থেকে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে গেল৷ বিকেলের দিকে দু'জন মিলে যুক্তি করল সেখানে সন্ধ্যায় যাওয়ার জন্য তারা কি কি করবে এই বিষয়ে৷


                             পড়ন্ত সন্ধ্যায় তারা দু'জনে

হাতে মোটা মোটা দুটি লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পরল এবং দু'জনেই এগিয়ে চলল বড়ো রাস্তার দিকে৷

সেই রাস্তায় তারা পৌঁছে কোথাও কিছু দেখতে পেল না৷

       আষাঢ় মাস, দুপুর থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে৷ এই সন্ধ্যার দিকে হাল্কাভাবে একটু ঝড়ও দিতে লেগেছে৷ কোথাও কিছু নেই দেখে তারা দুজনে মনে মনে ভাবল সবাই মিথ্যা গুজব রটিয়েছে এবং সেই সময় বৃষ্টি নামার আশঙ্কা বুঝতে পেরে নিজের গ্রামের দিকে ফিরতে চাইল৷ ঠিক তখনই তারা একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পরল৷


         আরে ওটা কি? জগন্নাথ বলে উঠল৷

তারা দুজনই দেখল একটা সাদা কাপড় পরাহিত মুর্তি তাদের সামনে কুড়ি - পঁচিশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷


             তারা একটু ভয়ও পেল অবশ্য৷ কিন্তু তৎক্ষণাৎ একটা দমকা হাওয়া দিল আর ঐ মূর্তিটির গা থেকে সাদা কাপড়টি উড়ে গেল, তারপর সব পর্দা ফাঁস৷

                   মূর্তির ভিতর থেকে যে স্বরূপটি বেরিয়ে এল সে আর কেউ নয়, তাঁদেরই গ্রামের ব্রাহ্মণ কানু চাটুজ্যে৷

           তখন তারা রেগে গিয়ে ব্রাহ্মণটিকে বাঁশের লাঠি দিয়ে করাঘাত করল৷ আর বলল এগুলি তাহলে আপনারই কারসাজি?

        

                     আজ্ঞে হ্যাঁ, ব্রাহ্মণটি বলল৷ আবার এও বলল, দেখ আমি তো খুব গরীব মানুষ তোমরা তো সবই জান? কি করব বলো এছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায়ও ছিল না৷ জীবিকা অর্জনের জন্য আমাকে এটা করতেই হত৷ তাছাড়া আমি জানতাম মানুষ ভূতকে ভয় পাই, তাই যদি ঐ নিষ্ঠুর জমিদার গুলিকে ভয় দেখিয়ে যদি তাদের মালপত্র লুট করা যায় তাহলে সেটাকে পাপ কাজ বলা যায় না৷ তাই আমি এই পথ ধরেছি৷


আমাকে ক্ষমা করে দাও, ব্রাহ্মণ আবার বলে উঠল৷ তোমরা যেন আমার এই স্বরূপের কথা গ্রামের কাউকে বলো না৷ আমি আর এই কাজ কোনদিনও করব না৷ আমাকে ছেড়ে দাও৷

    

                   তখন জগন্নাথ ডোম বলল, দেখুন আপনি যেই কাজটা করেছেন সেটি অন্যায়ের কাজ৷ এর জন্য আপনাকে শাস্তি পেতেই হবে৷

এই বলে তারা দুজন ব্রাহ্মণটিকে ধরে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেল এবং মন্দিরের একটি থামে বেঁধে রাখল৷

       সারা রাত তারা আর বাড়ি না ফিরে ব্রাহ্মণটিকে পাহারা দিতে লাগল৷ পরের দিন সকালে ব্রাহ্মণটির এই ঘটনার কথা সকলেই জানল৷ আর ব্রাহ্মণটির সাজাও হল৷

তবু আজও ঐ রাস্তায় সন্ধ্যার পর কেউ যায় না৷

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024