লেখক রঞ্জিত মল্লিক -এর একটি গল্প

             তিলের নাড়ু




               আশ্বিন মাস পড়ে গেছে। শরৎ প্রকৃতি নব সাজে সেজে উঠেছে। চারিদিকে কাশের চাদর, বাউল মাঝির গানের মেঠো সুর, টলটলে দীঘিতে শাপলার আদর,ঢাকের বোহেমিয়ান মাতাল করা বন্দিশ জানিয়ে দিচ্ছে মা উমা আসছেন।


                    সামান্য বহুদিন পরে পুজোতে ঘুরতে যাচ্ছে। বন্ধুর দেশের বাড়ি। মালদার রতুয়াতে। সেখানে গোবরাহাটে বাড়ির পুজোতে বেশ ধুম। 


                আরও একটা কারণ আছে ওখানে যাবার। পুরানো ব্যথা, আবেগটা মাঝে মাঝেই নাড়া দেয়। ছাব্বিশ বছর পরে সেটা আবার নতুন করে টের পাচ্ছে।


                     "কাল রওনা দিবি ?" মা বলল।

             "হ্যাঁ। রাতের ট্রেনেই যাব।" সামান্য ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল।

     "সমু, শিউলির সাথে দেখা করবি না ? একবার খোঁজ নিস।"

              "তুমি আবার শুরু করলে।"   

      

               সামান্য এড়ানোর চেষ্টা করলেও মা প্রায়ই প্রসঙ্গটা তোলে। যাতে ছেলের সুমতি ফেরে। সংসারী হয়।


                 মালদাতে সকালেই নেমেছে। স্টেশন থেকে নেমে মোরামের রাস্তা ধরে বিবর্তনের বাড়ি অনেকটা পথ। পুরোটা হেঁটেই গেল। গ্রামের জ্যামিতি অনেকটাই চেঞ্জ হয়েছে। সেই সাথে মানুষের রুচিও।


              একটা দীঘির কাছে এসে একটু থেমে এদিক ওদিক ঘুরেই আবার সামনে হাঁটতে শুরু করল। পুরানো কিছু হয়ত মনে পড়েছে। তাই......


               শরৎকালের চেনা ছবিটা গ্রামে আসলেই ধরা পড়ে। ছবির মত সব কিছু যেন সাজানো।


                "সমু, এসেছিস বাবা। কতদিন পরে তোকে দেখলাম।" ঠাকুরমা বুকে জড়িয়ে ধরল।

         "তোমাদের খবর সব ভাল তো ?" সামান্য ঠাকুরমাকে প্রণাম করে।

         "আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো ?" বলেই বিবর্তন হাত ধরে টানতে টানতে সামান্যকে দুর্গাদালানে নিয়ে যায়। মৃন্ময়ী মাকে দেখে সামান্যর চোখ ছল ছল করে ওঠে। মা অপর্ণার মধুর হাসি ঝরে ঝরে পড়ছে উঠোনে, দালানে, বাড়ির সর্বত্র।


             বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। শুধু একজনের অনুপস্থিতি ভীষণভাবে সামান্যকে কষ্ট দিচ্ছে। সেই অনুপস্থিত ব্যাক্তিকে দেখতেও পাচ্ছে না।



                       "বাজলো তোমার 

                         ...........,আলোর ....." 


                 দুটো দিন কিভাবে হাসি ঠাট্টা মজাতে কেটে গেছে ও নিজেই জানে না। এখানে মানুষ জন বড্ড আপন। সবাইকে বেশ নিজের বলে মনে হয়। 

           

               আজ অষ্টমী। পুজো বসেছে। একটু পরেই অঞ্জলি শুরু হবে। ঢাকের মিষ্টি মল্লারে চারিদিক মুখরিত। 

            

               অষ্টমী আসলেই বুকের ব্যথাটা টনটন করে। সারারাত ঘুমোতে পারেনি। একটা চাপা কষ্ট তাড়া করেছে ওকে। অথচ সেই কষ্টের কথা কউকে বলতে পারছে না। নিজেকে দ্বগ্ধ করছে বারে বারে।


             শিউলির কথা মনে পড়েছে। জানে না ও কোথায় আছে। কেউ ওর কথা তুলছেও না। সামান্য নিজেও কিছু বলতে সংকোচ করছে। খুব ইচ্ছে ছিল শিউলির সাথে অঞ্জলি দেবে। তারপর গোটা গ্রামটা ওকে সাইকেলে চাপিয়ে ঘুরে দেখবে। ওকে ভালবেসে কিছু কিনে দেবে। ওর জন্যে দামী দুটো শাড়িও এনেছে। 


             বহু বছর আগে এখানে এসেছিল। শিউলির সাথে তখন দেখা। বোবা, কালো আদিবাসী মেয়ে। তিন কূলে কেউ নেই। অনাথ শিউলির দূর সম্পর্কের এক মাসিই ভরসা। বিবর্তনের বাড়িতে কাজ করত। 


            শিউলিকে দেখেই সামান্যর ভাল লেগেছিল। টানা টানা হরিণের মতন চোখ, মেদহীন ছিপছিপে শরীর, নদীর মতন নেমে আসা কোমর অবধি বিছানো কালো চুল, যেন খাজুরাহোর শৈল্পিক টাচ রয়েছে ওর শরীরে। 'ভালবাসি' এই ছোট্ট শব্দটা ওকে বলতে পারেনি। শিউলিও হয়ত ওকে ভালবেসে ছিল। চোখের ঈশারাতে সামান্যকে বুঝিয়ে ছিল প্রেমের উপপাদ্য; ওর মনের মধ্যে জমানো না বলা অনেক কথা। যা সামান্য সেদিন হয়ত সবটা অনুভব করতে পারেনি......।


            শিউলির বন্ধু বকুলও এ বাড়িতে কাজ করত। শিউলির মতনই সুন্দরী। ফর্সা গড়ন, বেশ চটপটে। একদিন সামান্যকে একা পেয়ে বলে বসল, "আমাকে বিয়ে করবে?"


             সামান্য তখন বারো ক্লাস পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। শুনে হেসেছিল। কোন উত্তর দিতে পারেনি।


            তারপর এখানে সেভাবে আসা হয়নি। পরে জেনেছিল বকুল একটা ভিন জাতের ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। তারপরে বকুলকে সবাই গ্রাম ছাড়া করে। ওর খবর কেউ জানেনা। 

       

             ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। বিবর্তনের ডাকে চমকে উঠল।

                "অঞ্জলি শুরু হয়েছে। চলে আয়।"

                 "এখুনি শুরু হবে? আমি রেডী হয়ে আসছি।"


                      অঞ্জলি শেষ করে হালকা জলযোগ সেরেই সামান্য আজ আদিনাতে এসেছে। মনটা ভীষণ খারাপ। তাই একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। শ্রাবণীর সাথেও ওর একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। সেটাও ধরে রাখতে পারেনি। শ্রাবণী পাঁচ বছর ওকে ভালবেসে ওরই অফিস বসের বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করে। এখন সুখে সংসার করছে। 


             সন্ধ্যেতে ফেরার জন্যে বাসে উঠতেই একটা মেয়ের সাথে বাসের সীটের দখল নিয়ে বচসা বেঁধে গেল। 


            "আপনি তো ভারী অসভ্য লোক আছেন?"

             "কেন? আমি আবার কি করলাম?"

              "কি করলাম মানে, একজন মহিলার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শেখেন নি?"

               "জানালার ধারে সীটটা আমিই রেখেছিলাম। আর আপনি তাতে বসে গেলেন?"

                "ও এই ব্যাপার। সেটা ভালভাবে না চেঁচিয়ে বলা যেত না?"

                 "চেঁচামেচি আপনিই শুরু করেছেন আগে......"


                কথা শেষ হবার আগেই বিবর্তনের ফোনটা ঝলসে ওঠে। ফোনে দু চার কথা হয়। ও যে গোবরাহাট থেকে এসেছে সেটা মেয়েটি জানতে পারে। পরে দুজনেই সব মিটমাট করে নেয়। মেয়েটাকে আগে কোথায় যেন দেখেছে বলে মনে হল। ফোনে সব শোনার পর মেয়েটিও কেমন ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অনেক্ষণ। যেন সামান্য ওর পূর্ব পরিচিত। সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, সেই চেহারা..


               আজ বিজয়া দশমী। মা উমা সন্তানদের নিয়ে ফিরে যাবেন। সকলের মনে তাই বিষাদের ছায়া। দশমীতে বাড়ির সবাই লরি ভাড়া করে ফুলহার নদীতে গেছে ঠাকুর ভাসানে। সামান্য যায়নি। ও দীঘির পাড়ে চুপ করে বসে সিগারেট টানছে। আর শিউলির কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। কোজাগরীর চাঁদটা দীঘির জলে রূপালী অহংকার ছড়াচ্ছে।

               সন্ধ্যের একটু পরেই একটা হাত সামান্যর পিঠ স্পর্শ করল। বেশ ভালবাসার ছোঁয়া তাতে। সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাসের সেই মেয়েটি। চমকে ওঠে ওকে দেখা মাত্রই। 


            "তিলের নাড়ু। খুব কষ্ট করে তোমার জন্যে বানিয়েছি। আর এই প্যাকেটটা বাড়ির জন্যে।" বলেই বকুল একটা নাড়ু সামান্যর মুখে গুঁজে দেয় পরম আদরে।

          "সেই পুরানো স্বাদ!" সামান্যর চোখ ছলছল করছে।

              আদিনাতে বাসে যে মেয়েটির সাথে সীট নিয়ে ঝগড়া হয়, সে আসলে বকুল। যদিও পরে দুজনে নিজেদের মধ্যে হওয়া ঝামেলা মিটিয়ে নেয়।


          বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর বকুল মুখ খোলে।

           "আমি তোমাকে আগেই চিনতে পেরেছিলাম।মেজাজটা সেই আগের মতন রয়ে গেছে।"

           "তুমিও আমার দেখা প্রথম 

দিনের মতন সেই সুন্দরীই আছ? এতটুকু বদল হয়নি।

            "মন থেকে বলছ?"

            "মন থেকে নয়, যদি বলি অন্তর থেকে বলছি....."

            "আমি সেদিনের মত আজও তোমায় ভালবাসি। এখন আদিনাতেই আছি। একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ পেয়েছি।"

            "তোমার সম্বন্ধে বহু পুরানো একটা খবর শুনেছিলাম। সেটা কি......"

             "হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ। ফিরোজ আমাকে ভালবেসে ছিল। তারপর বলেছিল বিয়েও করবে। পরে বুঝলাম ও আমাকে ব্যবহার করতে চাইছে। তারপর....."

          "তারপর কি?"

           "তারপর নিজেই একদিন সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে চলে আসি। আদিনাতে ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকতে শুরু করি।"


          সামান্য দেখল বকুলের চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমে উঠেছে। হয়ত একটু পরেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে। ওর বেদনা ক্লিষ্ট মনে। বকুল এখনও সামান্যকে ভালবাসে। ও একটা ভুল করেছিল ঠিকই। পরে সেটা শুধরে নেয়।


             শিউলি এই দীঘিতেই স্নান করতে এসে সাপের কামড়ে মারা যায়। অনেকদিন হল। খবরটা সবাই চেপে যায়। বকুলও বলতে চায়নি।আজ ওর মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসে। শিউলির খবরটা শোনামাত্রই সামান্য কেমন মুষড়ে পড়ল। চোখ টস টস করছে। ওর চোখেও ধরা পড়ছে উত্তাল বিদ্যাধরীর ভরা কোটালের নোনা জোয়ার। আবার কিছুক্ষণের দুজনের নীরবতা। 

 

          "আমায় বিয়ে করবে তো?" বকুল সেদিনের মত হঠাৎ বলে উঠল।

         "ভালবাস আমায় আগের মত?"

         "হ্যাঁ, ভালবাসি। সেদিনের ভালবাসাটা মিথ্যে ছিল না। আজও তোমায় সেদিনের মত....."

        

           বকুলের কথা শেষ হয় না। গলা বুজে আসে। সামান্য আলতো করে ওর হাতটা ধরে পাশে এনে বসায়। কোজাগরী চাঁদের আভা ওর মুখে ঝিকমিক করছে। 

              "বেশ তো, ভালই যখন বাস;মাকে গিয়ে সব বলব।"

         "নাড়ু তৈরীর পুরো পদ্ধতিটা শিউলির কাছেই শিখেছি।"

          "তাই, আমি মুখে দিয়েই ধরে ফেলেছি।"

          "কি?"

           "এটা শিউলির হাতের জাদু। ও বিবর্তনের হাত দিয়ে প্রায়ই আমার জন্যে নাড়ু, মুড়কি, গজা, নিমকি পাঠাত।"


           দেখতে দেখতে সন্ধ্যে একটু একটু করে কালো বোরখাতে ছেয়ে ফেলছে জায়গাটা। চাঁদের মাতাল করা আলো হামাগুড়ি দিচ্ছে দীঘির চারপাশে। সেই আলোতে কাশফুলগুলো ওদের ভালবাসার মতন জীবন্ত হয়ে উঠছে। 


          আজ বিজয়া দশমী, বাইরে বিসর্জনের ঢাক বাজছে। মা উমা ফিরে যাচ্ছেন কৈলাসে। আসছে বছর আবার আসবেন। সবার ঘরে ঘরে। শিউলিও সকল বাঁধন ছিন্ন করে চিরদিনের মতন কৈলাসে ফিরে গেছে।


           জানে ও কোনদিন ফিরে আসবে না। শিউলি না ফিরলেও ওর প্রতি সামান্যর ভালবাসা বকুল ফুল হয়ে আজ ফুটছে। হৃদয়ের অলিন্দে। বকুলের চোখের তারায় ও শিউলির চেনা গন্ধটা পাচ্ছে।  


           দূরে বিসর্জনের শব্দ ভেসে আসছে। এক পবিত্র উন্মাদনা সেই শব্দে।

      

            "বল দুর্গা মাঈ কি! জয়!"

              "আসছে বছর, আবার হবে।"

               ........... ......... ..........


               "বল দুর্গা মাঈ কি! জয়!"


           যদিও আজ বিসর্জন। বকুলের ভালবাসার বিসর্জন হয়নি। সামান্যর ভালবাসা ফুলহার নদীতে ভেসে যায় নি। মা দশভূজা সব ফিরিয়ে দিয়েছেন। 

           

          তিলের নাড়ুর স্বাদ দুজনের ভালবাসাকে আরো মধুর করল। বকুলের মধ্যেই জেগে থাকল শিউলির বোবা স্পন্দন। 


            আঁধার এখন বেশ গভীর। দীঘির জলের মতন। সামান্যর কোলে মাথা রেখে বকুল চাঁদের দিকে তাকিয়ে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে। যেখানে শিউলিরও প্রতিচ্ছবি আছে। 


           হালকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। দীঘিতে ঢেউ উঠল। ওদের মনেও সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ভালবাসার ঢেউ। চাঁদের আলোকে স্বাক্ষি রেখে। 

 

          "দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী......

           মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে......"

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024