প্রাবন্ধিক দেবলীনা অধিকারী -এর একটি প্রবন্ধ
পুরুলিয়া
পশ্চিমবঙ্গের একেবারে পশ্চিমে লাল মাটি সবুজ টিলা রুখা মাটির জেলা হলো পুরুলিয়া। রূপ রস রঙে বরাবর জেলাতে আছে পাহাড়, নদী, জঙ্গল আর বড়
বড় জলাশয় এর সমারোহ॥
সাথে আছে মানুষের দেশীয় শিল্প সংস্কৃতির অটুট ধারা যার প্রবাহে জেলার সুনাম অক্ষত থাকে ।
দেওয়াল চিত্র এমনই এক লোকজ শিল্প যা মানুষের এক অকৃত্রিম মানব সম্পদের নমুনা । এ ছাড়াও বাঁকুড়া, বর্ধমান, ঝারখণ্ড তেও এ ধরণের শিল্প দেখা যায় । পুরুলিয়া জেলায়
এই সব চিত্র এর নির্মাতা সাঁওতাল,ডোম, কামার,কুমোর,সরাক প্রভৃতি উপজাতি সম্প্রদায় এর লোকজন করে থাকে নিজেদের উতসব আর পার্বণ উপলক্ষ্যে । বেশিরভাগ আল্পনার নকশা মেয়েরাই করে আঙুল দিয়ে করে ।কোনরকম প্রশিক্ষক ছাড়াই বাস্তব অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির সাহায্যে এরা রং তৈরি করে দেয়ালে সূক্ষ্ম ভাবে অঙ্কন করে । ফুল, লতাপাতা, পশু পাখি, দেব-দেবী ইত্যাদির ছবি ।
এখানকার বাসিন্দারা তাদের বাড়ী সাজানোর জন্যও ছবি আঁকে বাড়ীর দেওয়ালে শখে ।সে ছবি এক এক জায়গায় একেক রকম। সাধারনত সাদা, গেরুয়া, কালো রঙ ব্যবহার করা হয় বাড়ীগুলি রঙ করতে। নানা রকমের নক্সা আঁকা হয় প্রধানত দরজার-জানালার চারপাশে। যা দেখলে সত্যিই মন মুগ্ধ হবেই । কালিপূজা, লক্ষী পূজা, বাঁদনা পরবে মেয়েরা এ ধরণের নকশা অঙ্কন করে দেয়াল গোবর দিয়ে নিকে , পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রাখার ব্যাপার টাকেও গুরুত্ব দেয় অনেক খানি । সময়ের সাথে সাথে মানুষের কর্মব্যস্ততার জন্য কিছু রীতিনীতির অনেক বদলালেও পাহাড় জঙ্গল ঘেরা এই জেলাটিতে কিন্ত এখনো অনেক কিছুই সেই আগের মতই অপরিবর্তিত আছে। পুরুলিয়া শহর থেকে ৬০-এ জাতীয় সড়ক ধরে বাঁকুড়ার দিকে যেতে একটি জায়গা যার নাম লালপুর। এই লালপুর থেকে ডান দিকে গেলে মানবাজার যাওয়া যায়।
আর বাম দিকে আর একটি সরু রাস্তা ধরে গাড়িতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট গেলেই যে দৃশ্য দেখা যায় তাতে আশ্চর্য হবেন যেকোন মানুষ , জায়গার নাম হাতিমারা। পুরুলিয়া শহর থেকে মাত্র ৪৩ কিলোমিটার দূরে এটির অবস্থান। মূলত সাঁওতাল গ্রাম এটি। পেশাগতভাবে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত, কিন্তু পুরুলিয়ায় যেহেতু কৃষি বৃষ্টি নির্ভর, তাই বেশিরভাগ সময়-ই এরা মজুরী করেন । অভাব থাকলেও তারা পরিশ্রম করে নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখে । অন্য জায়গার যে ছবি দেওয়ালের গায়ে আমরা দেখে থাকি, এখানের ছবি কিন্তু তার থেকে আলাদা অনেকটা ।প্রত্যেক বাড়িতে মূলত দেওয়াল জুড়ে জ্যামিতিক নক্সা আর নানা রঙ-এর সমন্বয় । মোটা কালো বর্ডারে কখনো কখনো ফুল, লতা-পাতা, ময়ূর, পাখী এ-সবও আঁকার বিষয় হয়ে উঠেছে। শুধু যে রঙ দিয়ে আঁকা তা নয়, সাথে সাথে মাটির দেওয়ালে মাটি দিয়েও রিলিফ-এ নক্সা করা হয়েছে আঁকা ছবির সাথে সঙ্গতি রেখে। এখানে রঙ হিসেবে মূলত প্রকৃতি জাত গিরিমাটি, পাতার রং,খড় পুড়িয়ে, সেরামিক যুক্ত মাটি সাথে বাজার চলতি আঠা ব্যবহার করা হয়েছে। আরও উল্লেখযোগ্য যে, একটি বাড়ীর ছবির সঙ্গে আর একটি বাড়ীর ছবির কিন্তু কোন মিল নেই। বাড়িগুলির সামগ্রিক পরিকল্পনা, বিন্যাস এবং রঙ-এর ব্যবহার সর্বোপরি তার ছবির বৈচিত্র্য দর্শককে মুগ্ধ করবেই। সাথে মানুষের সরল ব্যবহার বারবার আসতে বাধ্য করবে । এই শিল্প আর শিল্পীর সাথে যুক্ত থাকে মানুষের ভাবাবেগ, জঙ্গলমহলের.রূপ,লোককথা সংস্কৃতি ।
Comments