কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ চৌধুরী -এর উপন্যাস (চতুর্থ তথা অন্তিম পর্ব)
মুকুট
(৪)
পরদিন ভোর রাতে মুকুট এলো বৃদ্ধ মানুষটর কাছে। কুলকুচির শব্দ শুনতে পেল।
বিশ্বজিৎ কাকুও রয়েছেন।
মুকুটকে দেখে বললেন- আজ আমাদের ছুটির দিন।
মুকুট বলল- কাকু, প্রতি বুধবার ছুটি থাকে।
হ্যাঁ। অন্যান্য দিনগুলি তো কাজ আর কাজ আর আজকের দিনে সবাই মিলে নানা অন্বেষণ।
মুকুট বলল- মহাকাশ, আলোকবর্ষ, সুপারনোভা- এসবও আলোচনা হয়!
এইসময় বৃদ্ধ মানুষটি এলেন, বললেন- মুকুট এসেছ!
প্রণাম করল মুকুট।
বিশ্বজিৎ বলল- মহাকাশ সম্পর্কে ‘ও’ জানতে চাইছে।
বৃদ্ধ বললেন- মুকুট যুক্ত হতে চাইছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উৎসের সঙ্গে।
মুকুট বলল- আমি কিন্তু অংকে আর ভৌত বিজ্ঞানে কাঁচা।
বৃদ্ধ বললেন- আমি তো চাষা। তবে মাঝে মাঝে ভূমির সঙ্গে আকাশের যোগ করার চেষ্টা করি।
আলোকবর্ষ তো আলোর একক। আর বিজ্ঞানের ভাষায় E=mc2 এনার্জি দেখা যায়।
গ্যালাক্সি তো আমাদের মস্তিষ্কে রয়েছে। কতো গ্রহ, তারার খেলার সেখানে।
মুকুট বলল –ফোটন কণারাও আছে।
আছে বৈকি।
মুকুট বলল- আমি কখনও কখনও তাদের দেখি।
দেখবে বৈকি দাদু- তুমি যে ভালো ছেলে। ভাবনার চাষ করো।
ওদের কথা থেমে গেলো কারণ একজন ভয়ংকর মানুষকে দেখা গেলো।
ঋত্বিকও এগিয়ে এলো তখন।
দেবলীনা ভয় পেয়েছে, সেও সঙ্গে রয়েছে।
লোকটা সামনে এসে দাঁড়াতে মুকুট ফিসফিস করে বলল- ‘ও’ কে দাদু!
লোকটা বলল- আমি শার্প শ্যুটার।
উপস্থিত সকলেই চমকে উঠল।
দাদু বলল- বারুই, পাট ফলন কেমন হবে!
লোকটি এবার অমায়িক কণ্ঠে বলল- ভালোই হবে, বাবা-মশাই।
প্রণাম করে চলে গেলো লোকটি।
তখন বৃদ্ধ বললেন- খুব distorted character ছিল তো! তবে কর্ষণে সবাই বদলে যায়।
এখন কিছু স্মৃতি বেঁচে রয়েছে, খুব দগদগে।
তাই নতুন লোক দেখলেই বলে- শার্প শ্যুটার।
বৃদ্ধ বললেন- মুকুট, রাতে আকাশ দেখব। আমার একটা দূরবীণও আছে।
দেখবো- তুমি কেমন শার্প শ্যুটার!
দুজনেই হেসে উঠল। তাসুর বাইরে অঘ্রাণের রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে তখন।
পরদিন ভোরে কৃষিকাজ করে বৃদ্ধ মানুষটা আবার বসলেন তাবুতে।
মুকুট মাফলার, টুপি সোয়েটার চাপিয়েছে, মা-বাবাও তাই। আর বৃদ্ধ মানুষটি একটি সাদা ফতুয়া গায়ে দিয়ে উত্তরাস্য হয়ে বসে রয়েছেন।
মুকুট এসে প্রণাম করল।
বৃদ্ধ মানুষটি বললেন- বিজ্ঞান চর্চা হলো !
মুকুট হঠাৎ ‘তুমি’ বলা শুরু করল।
তুমি না থাকলে আমাকে কে শেখাবে!
বৃদ্ধ হাসলেন, বললেন- তাই তো। মুকুট, তুমি যা চাইবে মন-প্রাণ দিয়ে ঈশ্বর তা মঞ্জুর করবেন।
মুকুট বলল- ঈশ্বর কি আছেন!
বৃদ্ধ হেসে বললেন- আছেন আমাদের কাজের মধ্যে। আমার কাছে তিনি আছেন লাঙ্গলের ফলায়। ধানে শিস্ এলে আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।
মুকুট বলল – তুমি কি ফোটন কণা নিয়েও জানো!
বৃদ্ধ হাসলেন, বললেন- গিলবার্ট লিউস ১৯২৬ প্রথম বলেন ফোটন কণার কথা।
মুকুট অবাক হয়ে গেল। একটু আগে এই দাদু গাছে গাছে সার দিচ্ছিলেন। ফুটগাছে জল দিচ্ছিলেন। কাদামাখা হাতে-পায়ে ফিরে এসেছিলেন কর্ষণভূমি থেকে।
মুকুট বলল- দাদু, তুমি আইনস্টাইনের কোয়ান্টামও জানো! ওসব খুব শক্ত- আমি বুঝতে পারব না।
বৃদ্ধ হাসলেন- মুকুট, তোমার মধ্যেই আলোকবর্ষের গতি। তোমার মধ্যেই আছে সুপারনোভা, এমনকি মহাবিশ্ব।
যখন বড় হবে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে মানুষ, পরিপার্শ্বের বৃদ্ধি ভাবতে ভাবতে আলোর গতি প্রাপ্ত হবে।
আর তুমি তা পারবে!
কি করে দাদু!
সেই বৃদ্ধ বললেন- তুমি যে ফোটন কণাকে দেখতে পাও। তোমার সরল বিশ্বাসই তো তোমার দূরবীণ। দূরের জিনিসকে কাছে দেখায়।
মুকুট বা স্বর্নেন্দু বড় হয়েছে। সেই দাদু আর ইহলোকে নেই। বাবা, মা মারা গেছেন। তাঁরা সবাই মুকুটের ফোটন কণা। আর দেওঘরের সেই দাদু যেন আশ্চর্য এক কৃষ্ণগহ্বর- যাঁর কাছে জন্ম-মৃত্যু স্তব্ধ হয়ে থাকে।
খুব নতুনই ব্যারাকপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হয়ে এসেছে স্বর্নেন্দু। নির্বাচনের দুন্দুভি বাজছে। পৃথিবী জুড়ে হিংসার চাষের মধ্যে স্বর্নেন্দু এখনও স্বপ্ন দেখে ভালোবাসা ফিরে আসবে। কিশোর মুকুটের মতোন সে আবার দেখতে পাবে সহজ বিশ্বাস থেকে অশেষ ভালোবাসার পৃথিবী। সেই দূরবীনটা হৃদয়ে অক্ষত রেখে কাজে ডুব দিলো স্বর্নেন্দু বা মুকুট।
সমাপ্ত।
Comments