লেখিকা ডঃ রমলা মুখার্জী -এর একটি গল্প

 ভূতের গিফট



গরমের ছুটিতে ছেলেদুটিকে নিয়ে গেলাম কালিংপঙ। আমার স্বামী গভঃ অফিসার, বাংলার বিভিন্ন স্থানে পোস্টিং হয়। এবারে পোস্টিং নর্থ বেঙ্গলে। আমি পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে ছেলেদের নিয়ে থাকি। আমি ঐখানেই একটি স্কুলে শিক্ষকতার কারণে ছুটি কাটাতেই কেবল স্বামীর কাছে ছেলেদের নিয়ে দেখা করতে আসি। দেখাও হয় আবার বেড়ানোও হয়। ছেলেদেরও খুব মজা হয়। ওরা তো বেড়াতে পেলে আর কিছু চায় না।

    কালিংপঙের কালিঝোরার পিডব্লুডির বাংলোতে আমরা পৌঁছালাম বেলা এগারোটা নাগাদ। বাংলোটা পাহাড়ের ওপর, সামনে বেশ কিছুটা বাঁধানো রাস্তা। দুপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। আমি লক্ষ্য করলাম এখানকার লজ্জাবতী গাছের পাতাগুলো সমতলের লজ্জাবতীর গাছের তুলনায় বেশ বড় আর বেশ বড় বড় বেগুনী ফুলও হয়ে আছে গাছগুলোতে। ছেলেদের দেখাবো বলে যেই পাতা ছুঁয়ে পাতার মুড়ে যাওয়া দেখাতে গেছি দেখি ফুলের মধ্যে থেকে একটা অচেনা সাপ ফনা তুলেছে। ছেলে দুটোকে নিয়ে ছুটছি সেই বাঁধানো রাস্তা ধরে বাংলোর দিকে। সাপটাও হিস হিস আওয়াজ করতে করতে ছুটছে সেই বাগান ধরে, তারপর বাগানে মিলিয়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বাংলোতে এসে ঘটনাটা বলতেই বাংলোর নেপালী কুক কাম চৌকিদার বাহাদুর বলল এসব পাহাড়ী সাপ খুবই বিষাক্ত। ছোঁবল মেরে যদি বিষ ঢেলে দেয় তো মৃত্যু ছাড়া গতি নেই কারণ পাহাড়ের এই প্রত্যন্ত এলাকাতে নৈসর্গিক দৃশ্য যতই মনোরম হোক না কেন কোন চিকিৎসালয়ই এখানে নেই। একটা সামান্য দেশলাই আনতেও এখন থেকে একমাইল পথ যেতে হয়, সেখানে ডাক্তার বা ওষুধ এসব তো দূরের কথা। আমার স্বামী তো খুব বকাবকি করলেন সবসময় আমি গাছপাতায় হাত দিয়ে ছেলেদের উদ্ভিদের অনেক জিনিস বোঝাই বলে। কি করবো উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করার জন্যে ছেলেদের গাছপালা দেখিয়ে প্রাকৃতিকে যতদূর সম্ভব বোঝাতে চেষ্টা করি। 

     দুপুরে বেশ ভাল রকম খাওয়াদাওয়া হল। আমার স্বামী সমস্ত রকম জিনিসপত্র কিনেই বাংলোতে ঢুকেছিলেন। বাহাদুর দারুণ রান্নাও করেছিল। খাওয়ার পর বাহাদুর ঘুরে-ঘুরে সুবিশাল বাংলোটা আমাদের দেখালো। বড় ছেলে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। বাহাদুর ছুটে এসে তার হাত ধরে টেনে বলল, “মুন্না, উধারসে মত যানা, ও ধারমে ভূত রহতা হ্যায়।” বড় ছেলে তো ভূতের ভয়ে আমাকে জাপটে ধরল। ছোট ছেলে খুব সাহসী, ও বলল, “মা ভূত দেখবো।” ওর বাবা তাড়াতাড়ি ওদের টেনে অন্যপাশে নিয়ে গেলেন। আমার কিন্তু মনে ভীষণ কৌতূহল হতে লাগল। তারপর নির্ধারিত রুমে এসে ছেলেদুটো ও স্বামী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার চোখে ঘুম নেই। আমি কিচেনে গিয়ে বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাহাদুর, উসকে ঘরমে ঘোস্ট রহে গা, ডরো নেহি, সাচ বাতাও মুঝে।”

বাহাদুর খুব জোর দিয়ে বলে, “ঝুট নেহি, সাচ বাত হ্যায় মেমসাব, উস রুম পে এক আদমী কা ঘোস্ট থা।” তারপর ও যে ঘটনা বর্ণনা করল শুনে আমি এক্কেবারে তাজ্জব বনে গেলাম। 

      এক বটানীর তরুণ লেকচারার চার বছর আগে এই বাংলোতে এসেছিলেন তাঁর এক বন্ধুর সুপারিশে। তিনি তাঁর গবেষণার জন্যে নানান গাছ-গাছড়া রোজ সংগ্রহ করতেন। কিন্তু তিনি ঐ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিষাক্ত সাপের কামড়ে মারা যান এবং তারপর থেকেই ভূত হয়ে নাকি এই ঘরে রয়ে গেছেন। ঐ ঘরে তাঁর অনেক কাগজপত্র এখনও রয়েছে। আমি সব কিছু শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করলাম না, হেসেই উড়িয়ে দিলাম ওর কথা।

       রাত্রিবেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে পা টিপে টিপে ঢুকলাম সেই নিষিদ্ধ ঘরটায়। ঘরে ঢুকতেই একটা জোরালো হাওয়া গায়ে লাগল, এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে একজন মাঝবয়সী লোক নাকি সুরে বলে উঠল, “কিঁরে আঁমায় চিঁনতে পাঁরছিস? আঁমি ইঁউনিভার্সিটিতে তোঁর ব্যাঁচ মেঁট পুঁলক রেঁ?” শুনে আমি মোটেই পুলকিত হলাম না, বরং বেশ ভয় পেয়ে গিয়ে বললাম, “পুলক তুই, তা এখান কি করছিস?” 

পুলকের ভূত বলল, “আঁমি এঁখানে এঁসেছিলাম এঁকটা রেঁয়ার প্রঁজাতির ফাঁর্নের খোঁজে, পেঁয়েওছিলাম, এঁই ফাঁর্নটার পাঁতার রঁস অঁনেকগুলো রোঁগের ওঁষুধ, বেঁশ কঁয়েকটা রোঁগের উঁপশম হঁবে খেঁলে, কিঁন্তু এঁই প্রঁজাতিটা এঁখনও অঁনাবিষ্কৃতই রঁয়ে গেঁছে রেঁ। কিঁন্তু আঁমার সঁব পেঁপারস এঁখানে রঁয়েছে। এঁগুলো নিঁয়ে আঁমায় মুঁক্ত কঁর প্লিঁজ রঁমু। আঁমার সঁব পেঁপারস তুঁই ইঁউনিভার্সিটিতে গিঁয়ে আঁমার গাঁইড ডঃ বিঁকাশকলি কুঁশারীর হাঁতে দিঁবি। তুঁই তোঁ চিঁনিস বিঁকাশ স্যাঁরকে। কোঁন বিঁশ্বাসযোগ্য লোঁক পাঁচ্ছিলাম নাঁ যেঁ কাঁগজগুলো তাঁর হাঁতে দেঁব। আঁমি জাঁনি তুঁই এঁই পেঁপারগুলোর কঁদর ঠিঁক বুঁঝবি, আঁর তুঁই এঁগুলো ঠিঁক জাঁয়গায় পৌঁছে দিঁবি। এঁগুলো ঠিঁক জাঁয়গায় পৌঁছে দিঁয়ে আঁমায় বাঁচা। তুঁই আঁমায় বাঁচা? এঁই নেঁ আঁমার সঁব পেঁপারস, ধঁর।”

       আমি কি করে ভূতকে বাঁচাবো বুঝতে পারলাম না, ভূত যে মরে গিয়েও বাঁচতে চায় এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। বললাম, “ঠিক আছে, তুই চিন্তা করিস না, আমি ঠিক পৌঁছে দেবো, কথা দিলাম।” 

-আঃঁ তুঁই আঁমায় বাঁচালি আঁমার আঁত্মাকে মুঁক্ত কঁরার কঁথা দিঁয়ে।

পুলক ভূতকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করতে করতে ঘরে এসে ওর সব কাগজপত্র সুটকেসের তলায় কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখলাম।

      কলকাতায় ছেলেদের নিয়ে ফিরে গেলাম। আমার স্বামী নর্থ বেঙ্গলে রয়ে গেলেন। ফিরেই ইউনিভার্সিটি গিয়ে বিকাশ স্যারের সঙ্গে দেখা করে পুলকের সব কাগজপত্র দিলাম। পেপারসগুলি পেয়ে স্যার ভীষণ পুলকিত হলেন। কিন্তু আমি ঘটনাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম যে ঐ কালিঝোরা বাংলোর একটা ঘর থেকে পেয়েছি। ওখানেই পুলকের সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে সেকথা স্যার জানতেন। স্যার আমাকে বললেন, “তুমি যে কি অমূল্য সম্পদ এনে দিলে তুমি জানো না। পুলক ওর জীবনে গবেষণাকেই ধ্যান জ্ঞান করেছিল, বড় মর্মান্তিক ওর মৃত্যু। ওর নামেই আমি এই অজানা ফার্নের নাম দেবো, যাতে ওর মৃত্যুর পরেও ও অমর হয়ে থাকবে।”

      স্যারকে সব জমা দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে দেখি আমার নাম ধরে কে নাকি সুরে ডাকছে, বুঝলাম পুলকের গলা। বললাম, “পুলক আমি তো স্যারকে জমা দিয়েছি, স্যার তোর নামেই ঐ অচেনা ফার্ন গাছটাকে বিশ্বের মাঝে পরিচিতি দেবেন বলেছেন।”

      পুলক বলে, “জাঁনি জাঁনি, সঁব শুঁনেছি। তোঁর সাঁথে ঐঁ পেঁপারগুলোর সঁঙ্গে আঁমার অঁশরীরী আঁত্মাও ঘুঁরে বেঁড়িয়েছে। এঁবার আঁমার মুঁক্তি। তাঁই তোঁর সঁঙ্গে শেঁষ দেঁখা কঁরতে এঁলাম। তুঁই এঁইটা নেঁ।”                    

          একটা খুব মলিন মানিব্যাগ পুলক আমার হাতের মধ্যে জোর করে গুঁজে দিল। কি ঠাণ্ডা পুলকের হাত। আমার তো হাড় হিম হয়ে গেল। ভয়ে তো কথাই বলতে পারলাম না। পুলক বলল, “মাঁনিব্যাগ যাঁ আঁছে তোঁদের ছেঁলেদের জাঁমা প্যাঁন্ট আঁর তোঁর এঁকটা ভাঁল শাঁড়ি হঁয়ে যাঁবে। তুঁই নাঁ কঁরিস নাঁ। আঁমার এঁত বঁড় উঁপকারের এঁই গিঁফটটা তোঁকে দিঁয়ে আঁমি নিঁশ্চিন্তে আঁমার আঁত্মাকে মুঁক্ত কঁরতে পাঁরব।” 

       এই বলে আমায় কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পুলক হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

       আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। তারপর কিন্তু সত্যিই আর পুলকের আত্মা কোনদিন আসে নি আমায় বিরক্ত করতে। ভূতের কাছ থেকে গিফট পাওয়ার মত স্মরণীয় ঘটনা আমার মনে চিরজীবনের মত গাঁথা হয়ে থাকল। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024