প্রাবন্ধিক রামপ্রসাদ সরকার -এর একটি প্রবন্ধ






 কলকাতার পরী ও স্মৃতিমেদুরতা


।।এক।।

আমি এখন একটি জেনেরাল ইনসিওরেন্স কোম্পানীর প্রধান কার্যালয়ের ভিজিটিং রুমে বসে আছি, আমার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচের কিছুটা অংশের চেক পাওয়ার আশায়। ছ’তলার খোলা জানালা দিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখা যাচ্ছে। মাথার পরীটা ঘুরছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন স্থবীর থাকার পর পরীটা আবার ঘুরছে। কলকাতার পরী প্রাচীন ঐতিহ‌্যের প্রতীক। 

 এই পরীর ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পুরনো দিনে ফিরে যেতে হবে। রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত‌্যুর পর তাঁর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে এই সৌধটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লর্ড কার্জন। এই স্মৃতি সৌধটি নির্মাণ করতে ১৫ বছর সময় লেগেছিল ১৯০৬ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত। ১৯২১ সালে সৌধটির মাথায় প্রায় সাড়ে ছয় টন ওজনের পরীটি বসানো হয়।

 তখন পরীটি ঘুরতে ঘণ্টায় পনেরো কি.মি. বেগের বাতাসের প্রয়োজন হতো। বলবিয়ারিং প্রযুক্তির সাহায‌্যে পরীটি ঘুরতো। কালের প্রবাহে শহরের অনেক উন্নতি সাধন হয়। চারদিকে সুউচ্চ অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, বেড়েছে বায়ুদূষণ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে হাওয়ার বেগ। তাই এখন পরীটি ঘুরতে ঘণ্টায় কুড়ি কি.মি.-র বেশি হাওয়ার বেগের প্রয়োজন হয়। মাঝে মধ‌্যেই পরীর ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়। সে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার সৌভাগ‌্য আমি সেদিন কলকাতার পরীকে ঘুরতে দেখেছিলাম, সে ২০০৭ সালের কথা। 

 এই সৌধটির স্থাপত‌্যশৈলী ইতালিয় রেনেসাঁ ও মুঘল স্থাপত‌্য রীতির সংমিশ্রণ।

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখতে সারা বছর ধরে অসংখ‌্য মানুষের সমাগম হয়। তার প্রাচীনত্ব যেমন মানুষকে আকৃষ্ট করে, তেমনি মেমোরিয়াল চত্বরে প্রায় ৬৪ একর জমি জুড়ে নানান ধরনের বাহারী গাছ, রং বেরঙের ফুল গাছের সমারোহ সমভাবে আগত মানুষকে আনন্দ দেয়।

 এটি একটি সংগ্রহশালাও। এখানে পঁচিশটি গ‌্যালারি আছে। ব্রিটিশ আমলের বহু তৈলচিত্র ও নথিপত্র এখানে দেখতে পাওয়া যায়।

 একটি সংবাদ পত্রের প্রতিবেদনে প্রকাশ যে বাজ পড়লেই কলকাতার পরীর ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হলে তার ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রথম বার বাজে ক্ষতি হয়েছিল পরীটির। ঘুর্ণন থেমে গিয়েছিল।

 দ্বিতীয়বার ২০০৬-২০০৭-এ বাজ পড়ে আবারও সেটির ক্ষতি হয়। দুবারই প্রযুক্তির সাহায‌্যে মেরামত করা হয়। বর্তমানে যেভাবে মুহূরর্মুহু বাজ পড়ছে তাতে যে কোনও দিন ‘কলকাতার পরী’-র ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। 


।।দুই।।

 তন্ময় হয়ে কলকাতার পরীর ঘোরা দেখেছিলাম। ভিজিটিং রুমের এক কোণায় পুরনো ফাইল পত্তর ডাঁই করা। তারই গন্ধ নাকে আসছিল। গন্ধটা খুব চেনা চেনা। ঠিক স্মরণে আনতে পারছিলাম না। গন্ধটার সঙ্গে কবে আমার পরিচিতি হয়েছিল।

 বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নামলো। মন কেমন করা বৃষ্টি। তখনই স্মৃতির পরদায় একটা পুরনো মুখ ভেসে উঠলো। এমনি এক বর্ষণমুখর দিনে কলকাতা হাইকোর্টে পুরনো ফাইল-পত্তরের গন্ধের মাঝে চেয়ার টেবিলে মুখোমুখি বসে রঞ্জিতদা ও আমি। রঞ্জিতদা আমার বস। বি.কম, পাশ করে শিক্ষকতা ছেড়ে সবে তখন কলকাতা হাইকোর্টের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছি। জজ সাহেবদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। জজ সাহেবদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ইংরেজিতে নোট পাঠাতে হত। সেই নোটের ওপর তাঁরা তাঁদের নির্দেশাবলী দিতেন। সেগুলোর আবার সঠিক উত্তর তৈরি করে দিতে হত। 

 জজ সাহেবদের কাছে অফিস নোট কীভাবে লিখতে হয়, কীভাবে পেশ করতে হয় তারই তালিম দিচ্ছিলেন রঞ্জিতদা। প্রথম পরিচয়ে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে রঞ্জিতদা আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন।

 পুরনো ফাইল-পত্তরগুলোর মাঝেই বসে আমাদের কাজ। এগুলো যে কতো পুরনো কেউ বলতে পারে না। কিন্তু সেইসব ফাইল-পত্তরের মাঝে যে কতো পুরনো ইতিহাস লুকিয়ে আছে, সে কথা সবাই বলে। পুরনো ফাইলের সেই গন্ধ আজও আমার নাকে লেগে আছে।

।।তিন।।

 কাজের ফাঁকে রঞ্জিতদা একদিন আমাকে বলেছিলেন, এখানে পড়ে থাকিস না। কোনও ভবিষ‌্যৎ নেই। এই আমাকেই দ‌্যাখ না— চল্লিশ বছর ধরে কলম পিষে সেই কেরাণী হয়েই আছি। শেষ বয়সে গিয়ে হয় তো অফিস সুপার হব-তাও রিটায়ারমেন্টের কয়েক বছর আগে।

 আরও বলেছিলেন, তুই যদি এখানে থাকিস তাহলে লেখ। হাইকোর্টকে নিয়ে লেখ। পুরনো ফাইল-পত্তর দেখার পারমিশন করিয়ে দেব। এইসব ফাইল পত্তরগুলোর মধ‌্যে অনেক লেখার খোরাক পাবি। তোর যখন লেখার হাত রয়েছে, দেখিস তুই একদিন বড় লেখক হবি, নাম করবি।

 রঞ্জিতদার কথা শুনে সাহিত‌্যিক শ্রদ্ধেয় মণিশঙ্কর মুখোপাধ‌্যায়ের (শঙ্কর) লেখা প্রথম উপন‌্যাস ‘কত অজানারে’ বইটির কথা মনে পড়ে গেল। স্কুল ফাইনাল পাশ করার আগেই (১৯৫৮) এই বই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল। বইটির পটভূমিও জানা ছিল। 

 আমার গর্ব হতো এই কথা ভেবে যে প্রথিতযশা সাহিত‌্যিক শঙ্করের প্রথম উপন‌্যাসের পটভূমি কলকাতা হাইকোর্ট, আর আমি সেখানে চাকুরি করছি।


।।চার।।

 রঞ্জিতদা, তোমার কথা আমি রাখতে পারিনি। উঁচু বেতনের মোহে, হাইকোর্টের চাকুরি ছেড়ে, কলকাতা ছেড়ে, সান্ধ‌্য কলেজে ‘ল’ পড়া ছেড়ে মফস্বলের একটি ব‌্যাঙ্কের শাখায় জয়েন করি। তুমি তো তার আগেই রিটায়ার করে গেলে। তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি।

 তোমার কথা রাখলে হাইকোর্টের পুরনো ফাইল-পত্তর ঘেঁটে গল্প-উপন‌্যাস লিখে আজ হয়তো বড় লেখক হতে পারতাম। 

(লেখকের ব‌্যক্তিগত বাস্তব উপলব্ধি)

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024