লেখক অরবিন্দ সরকার -এর একটি গদ্য

 লবাবপুত্তুর 

               

       


নবগ্রামের দ্বিজপদ মিস্ত্রি একজন মৃৎশিল্পী। নিঃসন্তান , পরিবারের জমিজমা বিঘা পনেরো হবে। শেষকালে দেখাশোনা কে করবে তাই ভেবে অস্থির স্বামী স্ত্রী মিলে। দ্বিজপদরা তিনভাই। অন্যভাইদের জমিজমা সব শেষ হয়ে গেছে কুড়েমিতে।এখন তারা কাঠের কাজ করে লোকের বাড়ি বাড়ি।


দ্বিজপদ একভাইয়ের দুই ছেলের একজনকে পোষ্য নিলেন। অন্যছেলেটিও নিলে ওরা ধন্য হতো। কিন্তু দ্বিজপদ ঐ বড় ছেলে ধনঞ্জয়কেই বাড়িতে আনলেন। ধনঞ্জয় বেয়ারা ছেলে। কথা শোনে না, স্কুলেও যায়না শুধু খায়। আসলে ওরা ভালো খাবার চোখেও দেখেনি,তাই জ্যেঠু বাবার পেয়ে এতদিনের ঘাটতি পূরণে খেয়েই যাচ্ছে।


ধনঞ্জয় বড়ো হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে । দ্বিজপদ মনস্থির করলেন যে শেষকালটা ছেলে বৌমার আদর যত্নে পার হ'য়ে যাবো।তাই তিনি প্রচার শুরু করলেন যে ছেলে ধনঞ্জয়ের বিয়ে দেবো।

দূরবর্তী এক গ্রামের নিমাই দাস সম্পর্ক নিয়ে হাজির। সঙ্গে আরও জনা পাঁচেক লোক। উনাদের যথারীতি সম্মান করা হলো। জলখাবার খাওয়ার পর মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে কথাবার্তা শুরু হলো।

নিমাই দাস বললেন আপনার তো যথেষ্ট সুনাম আছে এই অঞ্চলে, নামকরা মিস্ত্রি মশাই আপনি।তা ছেলেকে ডাকুন।ছেলে দেখে কথাবার্তা শুরু করবো সবার সাথেই।

ধনঞ্জয়ের ডাক পড়লো- সে এসে দাঁড়ালো সবার সম্মুখে। দাঁড়িয়েই আছে , দাঁড়িয়েই আছে।

আদব কায়দা দেখার জন্য নিমাই দাসেরা সবাই চুপচাপ আছে।

দ্বিজপদবাবু তাড়াতাড়ি নিজের দু পায়ের ধূলো নিয়ে ধনঞ্জয়ের মাথায় দিলেন। ধনঞ্জয়ের প্রনাম হয়ে গেলো।

ধনঞ্জয় বললো কথা বলবেন না বলবেন না? শুরু করতে কতক্ষন লাগে।খেতে তো বেশি সময় লাগেনি? সবাই গণ্ডেপিণ্ডে খেলেন তাড়াতাড়ি। যেনো বাপের কালেও এইসব মিষ্টি মাছ মাংস খাননি?

নিমাই দাস বললেন- ঠিক বলেছো বাবা! যেমন তুমি বাপের জন্মেও খাওনি তেমনি আমরাও খায়নি।যে যেমন সে তেমন ভাবে! আর যাই হোক এখানে বিয়ে দেবো না।দ্বিজপদবাবু মারা গেলেই আমার মেয়ে না খেয়ে মরবে। তুমি সব নষ্ট করবে সম্পত্তি।কারন বংশের ধারা বইবে! তোমার বাপ সব শেষ ক'রে আজ ভিখারী। তুমিও তাই করবে। অতএব এখানে বিয়ে দেবো না। তাছাড়া রাখালের হাতে জেনেশুনে বিয়ে দেবো না।

ধনঞ্জয় বললো - তাহলে এলেন কেন? 

নিমাই দাস বললেন- তোমাকে দেখতে , আর তুমি আমার মেয়ের উপযুক্ত কিনা তাই যাচাই করতে।

ধনঞ্জয় - কতো লোক আসবে দেখুন! আমার মতো লবাবপুত্তুর এ অঞ্চলে কটা আছে।এত বড়ো বাড়ি পুকুর, জমিজমা কার আছে?

আপনারা আসুন। ফালতু দিনটা অতিবাহিত হলো। সকালে যে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম? তাই এই অঘটন। বুঝতে পেরেছি এই বাবা নিঃসন্তান,এদের মুখ দেখেছি সকালে তাই সম্বন্ধ হলো না!

না হোক ! কতোজন আসবার জন্য হাঁ ক'রে মুখিয়ে আছে! দেখবেন কাল থেকে মেয়ের বাপের লাইন লেগে যাবে।

নমস্কার জানিয়ে দ্বিজপদ মিস্ত্রিকে উনারা চলে যাবার উপক্রম করতেই ধনঞ্জয় বলে উঠলো এই আপনাদের ভদ্রতা। রীতিনীতি শিখেন নি? অচেনা আমাকে নমস্কার করতে হয় জানেন না? গোমূর্খ সব ।যান এখনই বিদায় হন।

দ্বিজপদ মিস্ত্রি উনাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। বললেন অসুবিধা হবেনা আপনাদের। আমার সম্পত্তি সব আপনার মেয়ের নামে উইল ক'রে দেবো।


নিমাই দাসেরা সকলেই আবার বসলেন। চিন্তা করলেন উনি যা বললেন সেটা আমার মেয়ের মঙ্গল হবে।

আবার আলোচনা শুরু হলো। দাবি দাওয়া নিয়ে।

ধনঞ্জয় বললো আমার সাইকেল চাই, ঘড়ি চাই, সোনার আংটি চাই।

জনৈক ভদ্রলোক নিমাইদাসের বললেন - বাবা ধনঞ্জয় সাইকেলে চাপতে জানো? ঘড়ি দেখতে জানো?

ধনঞ্জয় বললো- পারা পারির কি আছে? এটা সকলেই নেয়।হাতটা কেন আছে - ঘড়ি আংটি পড়ার জন্য। সাইকেল চাপতে না জানলেও মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

দ্বিজপদর অনুরোধে দেনা পাওনার সমাধান হয়ে বিয়ের দিন ঠিক করতে পঞ্জিকা আনা হলো।

তিনমাস পরে অগ্রহায়ণ মাসে দিন স্থির হলো।

ধনঞ্জয় বললো- আপনারা বিয়ে দিতে এসেছেন না পঞ্জিকা দেখতে এসেছেন। শুভস্য শীঘ্রম্ এই কথাটি মেনে এই মাসেই তড়িঘড়ি বিয়ে দিন।যা দিতে পারবেন না সময়ে দেবেন।তবে না দিলে মেয়ে ফেরৎ দেওয়া হবে।চাল যদি কিনতেই হয় তাহলে সময়ে কেনা উচিৎ।

নিমাই দাস- তুমি আমার মেয়েকে দেখবে না একবার?

ধনঞ্জয় - মেয়ের কি দেখার আছে।যা দেখা যায় সেগুলো সব মেয়েদের থাকে।চুল রঙ চেহারা বাইরের ভূষণ।আর ভেতরের ভূষন তো পোষাকে আবৃত। ভেতরে মন হৃদয় থাকে।ঐটা সবার সমান নয়। বিয়ে করলে তবে বুঝতে পারবো হৃদয়টি কেমন! তবে ঘোমটা এমন ভাবে দেবো টেনে যেনো মুখ কেউ দেখতে না পায়? সিঁদুরে ভরে দেবো সিঁথি যেনো সবাই বোঝে বিবাহিতা। আমি বাড়ির বাইরে যেতে দেবো না।বো - চোখের সামনে থো! অতএব আপনার মেয়ে যে সম্পত্তি পেয়ে পালাবে না এর গ্যারান্টি কি আছে? মেয়েদের মন বোঝা শক্ত। শতকিয়া ধারাপাত যতোই পড়ুক পরকিয়া করতে কতক্ষন।

কতশত নামকরা বড়ো বাড়িতে এসব চলছে! আমি তো কোন্ ছাড়্? লবাবপুত্তুর আমি! ওকে বেগম হয়েই থাকতে হবে।

নিমাই দাস- তার বটে! লবাবের অনেক বেগম করার লোভ থাকে। আমার মেয়ে তোমাকে নাকে লৎ পড়িয়ে ঘোরাবে। তুমি যে গরু! সোজা যদি না হও তাহলে পাঁচনে সোজা করবে আর দরকারে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে! আমি মেয়ে দিচ্ছি শুধুমাত্র দ্বিজপদ মিস্ত্রির মুখ চেয়ে। তোমাকে দেখে দিচ্ছি না। শুভ দিনে সম্প্রদান হয়ে গেলো।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024