লেখক রানা জামান -এর একটি গল্প

 কিশোর মুক্তিযোদ্ধা যতীন


 


উনিশ শ একাত্তর খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাস।পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগ্রাসী ইচ্ছা নিয়ে আস্তে আস্তে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।যেখানে যাচ্ছে সেখানে সহযোগীদের সহায়তায় আশেপাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে; লুটপাট করছে এবং হত্যা করছে অসহায় বাঙালিদের; ধরে নিয়ে যাচ্ছে মা-বোনদের-সম্ভ্রম নষ্ট করছে।


অকুতোভয় বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সেই ২৬ মার্চ হতেইপ যার যা অস্ত্র আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।ইন্ডিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করছে।গেরিলা যুদ্ধ, সন্মুখ যুদ্ধ। যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন তেমন চলছে যুদ্ধ।


এপ্রিলের ২৫ তারিখ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্যারাস্যুট নিয়ে বরিশাল জেলার ইছাকাঠি এলাকায় নামে।স্থানীয় থানা দখল করে ঘাঁটি গাড়ে।পরদিন থেকে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও জ্বালাও-পোড়াও।নথুল্লাবাদ হয়ে হাসপাতাল রোড থেকে চড়বাড়িয়া ইউনিয়নে লামছড়িতে চলে যায় পাক হানাদার বাহিনী। ঝুনাহার গ্রামে চালায় আক্রমণ।আগুন দিতে থাকে বাড়িঘরে।চলতে থাকে লুটপাট এবং বাঙালি হত্যা।হানাদার বাহিনী এসে ঢুকে উপেন্দ্রনাথ কর্মকারের বাড়িতে।তখন উপেন্দ্রনাথ ঘরের বারান্দায় বসা ছিলেন।পাশে কিশোর যতীন।


পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক মেজর উর্দুতে জিজ্ঞেস করেন,তোমার বড় ছেলে সচিন কোথায়?


উপেন্দ্রনাথ কর্মকার ভয়ে কাঁপতে থাকলেও নিজকে সংযত রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, মার সাথে মামার বাড়ি বেড়াইতে গেছে।


হানাদার বাহিনীর সাথে এক মৌলানা ছিলেন।তিনি সাথে সাথে বলেন, হে মিছা কথা কইতাছে স্যার।হের বড় পোলা সচীন মুক্তিবাহিনীতে গেছে।


উপেন্দ্রনাথ কর্মকার মৌলানার দিকে তাকালেও কিছু বলতে সাহস পান না।সাথে সাথে পাক বাহিনীর সৈন্যরা ওর দিকে একে ফরটি সেভেন রাইফেল তাক করে ধরে।যতীন ভয় পেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যান।একটু পর সবগুলো রাইফেল একসাথে গর্জে উঠে।রাইফেলের ব্রাশ ফায়ারের প্রচণ্ডতায় যতীনের কানে তালা লাগার যোগার তখন। তিনি ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়েন। দুই হাতে তিনি দুই কান চেপে ধরে আছেন।হঠাৎই সব শান্ত হয়ে যায়।যতীন কান ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে বসেন।উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে আসেন বারান্দায়।বাবার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে উল্টাপাল্টা অবস্থায় বারান্দায়।যতীনের চোখ শুকনো।সে বাবার নিথর দেহের পাশে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন।হঠাৎ ওর মনে হয় দাদা স্বরূপকাঠি থানায় একটা স্কুলে আছে,যেটা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প।যতীন একবার গিয়েছিলেন।তিনি বারান্দা থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করেন।


যতীন দৌড়াচ্ছেন।কেউ ওকে দেখছে কিনা বা অনুসরণ করছে কিনা এই বোধ ওঁর মাঝে নেই।হাঁপালেও ক্লান্তি ওঁকে স্পর্শ করছে না।নিজ এলাকা ছেড়ে চলে এলেন স্বরূপকাঠি এলাকায়।দৌড়ানোয় বিরতি নেই ওঁর।উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকেন তিনি। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলেন আটঘর কুড়িয়ানা হাইস্কুলে।মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের সবাই ওঁকে চেনে। কিশোর থাকায় সবাই আদরও করে বেশ।ওকে হাপাতে দেখে ক্যাম্পের সবাই অবাক হন।


সচীন কর্মকার বেরিয়ে আসতেই যতীন বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।ওর কান্নায় সবাই অবাক।সবাই একে অপরকে দেখতে থাকেন।


সচীন ছোট ভাইকে বুকে জড়িয়ে রেখে জিজ্ঞেস করেন, কী রে ছোটদাদা? তুই এইভাবে কানতাছস ক্যান? কী হইছে?


যতীন হেচকি টানতে টানতে এমনভাবে জবাব দিলেন যে সচীন বা অন্যরা কিছুই বুঝতে পারলেন না।সচীন ফের জিজ্ঞেস করেন, কীরে ছোট? কী হইছে? এইভাবে কানতাছিস ক্যান? কেউ মারছে তোকে?


এবার সচীন একবার হেচকি টেনে স্বর স্পষ্ট করে বলেন, পাক বাহিনী বাবারে মাইরা ফালাইছে দাদা।


সবাই বুঝতে পেরে স্তব্দ হয়ে গেলো।কারো মুখে কোনো কথা নেই।পিন পতন নিরবতা কক্ষটায়।নিরবতা বজায় রেখে ধীর পায়ে একে একে সবাই এগিয়ে আসতে থাকেন দুই ভায়ের দিকে।ছোট ভাইকে আকড়ে ধরে থাকা সচীনের হাত আস্তে আস্তে শক্ত হতে থাকে; আর ওঁর চোখ দুটো ভিজতে শুরু করে।হঠাৎ হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেন সচীন।দুই ভায়ের কান্নায় অন্যদের চোখেও অশ্রু দেখা দেয়।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ অশ্রু মুছে বলেন, কেঁদে আর কী হবে সচীন।যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে হানাদার বাহিনী শুধু তোমার বাবাকেই হত্যা করে নি; বহু সন্তান বাবা-মাকে হারাচ্ছে; বোনকে হারাচ্ছে;আত্মীয়স্বজনকে হারাচ্ছে।আমাদের এই স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে।হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।অশ্রু মুছো।ছোট ভাইকেও শান্ত করো।তুমি কাঁদতে থাকলে ও-তো কাঁদবেই।আজ থেকে ও আমাদের সাথে ক্যাম্পেই থাকবে।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ সচীনের কাছে গিয়ে পিঠে হাত রাখেন।সাথে সাথে সচীন কান্না থামিয়ে ক্যাম্প-ইন-চার্জের দিকে তাকান।ক্যাম্প-ইন-চার্জ চোখ বুজে মাথা নেড়ে ইতিবাচক সায় দেন।


সচীন একটা হেচকি গিলে ছোট ভাই যতীনের দিকে তাকান।ছোটভাইকে বুকে আরেকটু চেপে ধরে বলেন, কান্দন থামা যতীন।আমরা আর কাঁদবো না।আমরা বাবা হত্যার বদলা নিবো।


যতীন কান্নার শব্দ থামিয়ে নিরবে কাঁদতে থাকেন।ক্যাম্প-ইন-চার্জ যতীনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন স্কুলের একটা কক্ষের দিকে, যেটা ক্যাম্প-ইন-চার্জের শয্যাকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।কক্ষে ঢুকে বিছানায় বসে যতীনকে পাশে বসান।হাত দিয়ে যতীনের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলেন, বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই না?


যতীন একবার হেচকি টেনে ইতিবাচক মাথা নাড়েন।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ বলেন, তোমার সামনেই কী পাক বাহিনী তোমার বাবাকে গুলি করেছে?


যতীন ফের একবার হেচকি টেনে ইতিবাচক মাথা নাড়েন।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ বলেন, আমরা ওদের ছাড়বো না যতীন।আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে।কদিন পরই তোমার ভায়ের ট্রেনিং শেষ হবে।তখন সে যুদ্ধে চলে যাবে।


যতীন বলেন, বাবারে মারলো ক্যান? ওরা কারা?


ক্যাম্প ইন-চার্জ বলেন, তোমার বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।তাই ওরা তোমার বাবাকে মেরে ফেলেছে।আমরা এর বদলা নেবো।


যতীন জিজ্ঞেস করেন, ওরা কারা ভাইয়া? ওরা মানুষ মারে ক্যান?


ওরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।


হানাদার বাহিনী কী?


যে সেনা বাহিনী অন্য দেশে জোরপূর্বক ঢুকে যুদ্ধ বাঁধায়, ওদের হানাদার বাহিনী বলে।পাকিস্তানি সেনা বাহিনী আমাদের দেশে জোর পূর্বক ঢুকে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে।


আমার বাবা কী দোষ করেছিলো?


তোমার বাবা দোষ করে নাই।কিন্তু তোমার বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সেকারণে তোমার বাবাকে মেরে ফেলেছে।ওরা এমনই করছে। আমরা ওদের এদেশ থেকে হটানোর জন্য যুদ্ধ করছি।


আপনেরা ওদের সাথে পারবেন?


অবশ্যই পারবো।আমাদের পারতেই হবে।আর কথা না।তুমি আমাদের সাথে থাকো।ঘুরাফেরা করো।তোমার ভায়ের সাথে কথা বলে কোনো একদিন তোমাকে তোমাদের কোনো আত্মীয় বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।


যতীন ক্যাম্পে অবস্থান করে এদিক সেদিক ঘুরাফেরা করেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেখেন।ওঁর ভালোই লাগে।তিনি মাঝে মাঝে স্টেনগান, গ্রেনেড গুলি হাতিয়ে দেখেন।অস্ত্র গোলাবারুদ দেখলে খুব ভালো লাগে ওঁর।


একদিন যতীন ক্যাম্প-ইন-চার্জের অফিস কক্ষে ঢুকে মুখোমুখি দাঁড়ান। একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে থাকেন ক্যাম্প ইন-চার্জের দিকে।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ জিজ্ঞেস করেন, কী দেখছো অমন করে?


যতীন দৃঢ় কণ্ঠে বলেন,আমি মুক্তি যুদ্ধে যাইতে চাই কমান্ডার ভাই!


ক্যাম্প-ইন-চার্জ অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি মুক্তিযুদ্ধে যাইতে চাও!তোমার বয়স কত জানো তুমি? তাছাড়া থ্রি নট থ্রি বন্দুক তোমার চাইতে লম্বা! তুমি বন্দুক চালাবে কিভাবে?


আমি বন্দুক চালাইতাম না।


তাহলে যুদ্ধ করবে কী দিয়ে? খালি হাতে?


স্টেনগান আর গ্রেনেড দিয়া।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ কিছু বলতে গিয়ে থেমে তালেন যতীনের চোখের দিকে।যতীনের চোখ স্থির, যেনো আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে অগ্নিগিরির মতো।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ জিজ্ঞেস করেন, তোমার বয়স কত?


যতীন বলেন, সতেরো।


ক্যাম্প-ইন-চার্জ চেয়ার ছেড়ে উঠে যতীনের হাত ধরে বাইরে আসেন।তখন বাইরে কয়েকটি দলের প্রশিক্ষণ চলছিলো।একটি দলের সাথে যতীনকে ভিড়িয়ে দেন প্রশিক্ষণের জন্য।


আটঘর কুড়িয়ানা হাইস্কুলে ছাব্বিস দিন প্রশিক্ষণ চলার পর হঠাৎ একরাতে পাক বাহিনী ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করে।যুদ্ধ চলে সারারাত।গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে থাকে।এবং চলে যায় আত্মগোপনে।বাইশ মে তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা ফের কুড়িয়ানা হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে।কিছুদিন পরে রাজাকারের সহায়তায় হানাদার বাহিনী পুনরায় আক্রমণ করলে যুদ্ধ চলে দুই পক্ষে।কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পরে ফের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা ফের পিছু হটে খুলনা হয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়।যতীন হাসনাবাদে নয় নম্বর সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। প্রশিক্ষণের ফাঁকে যতীন মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা লেখাসংবলিত পত্রিকা বিলি করেন এলাকায়।যতীনের এ ধরনের পত্রিকা বিলি করায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।


প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে যতীন গোপালগঞ্জ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ করেন।এসময় যতীন হেমায়েত বাহিনীর সাথে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।নভেম্বরের শেষের দিকে যতীন খুলনা চলে আসেন এবং পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সন্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।যতীনের দল একে একে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও খুলনার গল্লাবেরি রেডিও সেন্টার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মু্ক্ত করে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024