নিবন্ধ || তৈমুর খান || লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক

 লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক



এমন একটা সময়ে আমরা উপস্থিত হয়েছি যে, প্রায় সর্বত্রই 'ফ্যালো কড়ি মাখো তেল' অবস্থা। এই কিছুদিন আগেও অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরকমটি ছিল না। যদিও আমার প্রথম জীবনে একটা কবিতা ছাপানোর জন্য এক লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক দশ কপি পত্রিকা গছিয়েছিলেন। সেই বাজারে তার দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা। পত্রিকা তো কাউকে দিতেই পারিনি, বিক্রি করার ব্যাপারটা তো আরও কঠিন ছিল। এই পঞ্চাশ টাকার জন্য আমাকে মজুর খাটতে হয়েছিল। কিন্তু সেই অবস্থার মধ্যে আর বেশিদিন থাকতে হয়নি।

      ইদানীং একটি বিষয় লক্ষ করছি, পত্রিকায় লেখা চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন কোনো সম্পাদক বা কোনো প্রকাশন। এসব যে কোনো নামকরা সংস্থা বা ব্যক্তি তা কিন্তু নন। তবে কয়েকটি ঐতিহ্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠানও এই পন্থা অবলম্বন করেছে। কবিতা বা গল্প-প্রবন্ধের পংক্তি সংখ্যা এবং শব্দ সংখ্যা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। বিজ্ঞাপনের ওপর ভিত্তি করে যেকোনো লেখক লেখা পাঠালেই ইমেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ মারফত ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার চলে আসছে এবং একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠানোর আবেদন জানাচ্ছে। কখনো কখনো এই টাকার পরিমাণটা এত বেশি যে লিখতে আসা তরুণ-তরুণীর বেশ কয়েকবার ঢোক গিলতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে: পত্রিকার দাম এবং ডাক খরচের জন্য নেওয়া হচ্ছে। কারণ পত্রিকা বা সংকলন এবং সার্টিফিকেট একইসঙ্গে পাঠানো হবে। নিরুপায় কবি-লেখকটি কখনো কখনো টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেন হচ্ছেন তা জানি না। এই পত্রিকা বা সংকলন এবং সার্টিফিকেট তাঁর কোন কাজে লাগবে সেকথাও হয়তো চিন্তা করেন না। তাঁর সৃষ্টিকে সকলের দৃষ্টিগোচর করার আবেগ হয়তো এই কাজে তাঁকে চালিত করে। কিন্তু উক্ত পত্রিকায় বা সংকলনে লিখে কয়জনেরই বা দৃষ্টিগোচর হবেন? এই পত্রিকা বা সংকলন যাঁরা করেন তাঁরা সেই কয়জনেরই করেন, যাঁরা টাকা দেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এইসব সংকলনের মান উন্নত হয় না। লেখা দেখেও নির্বাচন করেন না। শুধুমাত্র টাকা দিলেই এসব পত্রিকায় লেখা যায়।

     এইরকমই অবস্থা হয়েছে কলকাতার নামকরা কলেজ স্ট্রিটের বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যপূর্ণ পত্রিকারও। একবার একটা পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ভেবেছি হয়তো প্রকাশিত হবে না। কিন্তু আশ্চর্য কয়েকদিন পরেই সম্পাদক ফোন করে বললেন: 'এই নাম্বারে মোবাইল রিচার্জের জন্য তিনশো টাকা ভরে দিতে হবে তবেই আপনার লেখাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হবে।' পত্রিকার যিনি সম্পাদক তিনি একজন সাহিত্যিকও। ফোনটি পেয়ে অনেকক্ষণ থ হয়ে বসে থেকেছি। সাহিত্যজগৎ যে অন্ধকারের জগৎ, দালালের জগৎ পরবর্তী সময়ে আরও গভীরভাবে টের পেয়েছি। লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় লেখক কপি আনতে গিয়ে কয়েকটি জায়গায় তা সম্মানের সঙ্গে বিনা পয়সায় পেলেও বেশিরভাগ জায়গায় টাকা দিয়ে কিনতে হয়। দীর্ঘদিন সাহিত্যজগতে থেকেও যদি সত্যিই টাকা দিয়ে ম্যাগাজিনে লিখতে হয় এবং টাকা দিয়ে লেখক কপি কিনে নিতে হয়, তাহলে সেরকম লেখক হওয়ার কি কোনো মূল্য আছে? হয়তো অনেকেই বলবেন লিটিল ম্যাগাজিনগুলিকে প্রত্যেকের সহায়তা করা দরকার। কিন্তু একজন লেখক খুব কম করে গোটা দশেক পত্রিকায় গোটা দশেক কবিতা লিখে যদি অর্থ প্রদান করেন, তাহলে তাঁর সাংসারিক জীবনেও টানাপোড়েন আসতে পারে। সব লেখকেরই অর্থ দেবার সামর্থ্যও থাকে না। যদি সম্পাদকগণ লেখকদের সম্মান জানাতে না পারেন, পত্রিকার সৌজন্য কপি দিতে না পারেন, তাহলে আমি মনে করি পত্রিকা না করাই অনেক ভালো। কেননা মনে রাখা দরকার লিটিল ম্যাগাজিন কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়, সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য প্রেরণা স্বরূপ। এই প্রেরণা কি টাকা দিয়ে কেনা যায়? অথবা এই প্রেরণা কি টাকা নিয়ে বিক্রি করা যায়?

    কিন্তু বর্তমানে তাই হচ্ছে। এবছর বিজ্ঞাপন দেখে এই বিষয়টি যাচাই করার জন্যই বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছোটখাটো দু একটা করে কবিতা পাঠাই। প্রায় সব কবিতাগুলোই সম্পাদকগণ চোখ বুজে নির্বাচন করেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ অথবা ই-মেইলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং টাকা পাঠাবার আবেদন জানিয়েছেন। না, আশ্চর্য হইনি; বর্তমানে প্রকাশকেরা যেমন টাকা নিয়ে কয়েক কপি বই ছাপিয়ে লেখককে গছিয়ে দিচ্ছেন, ঠিক তেমনি টাকা নিয়ে লেখা ছাপিয়ে পত্রিকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বইয়ের বা লেখার সাহিত্য মূল্য কতখানি, বা লেখার মান উন্নত কিনা, বা প্রকৃত সাহিত্যমূল্যে লেখাটির উত্তরণ ঘটেছে কিনা সে বিচার করার তাদের যেমন ক্ষমতা নেই, তেমনি দায়ও নেই। বই বা পত্রিকা প্রকাশ করাটাকেই এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করেছেন। ফলে নিরপেক্ষ সাহিত্যবোধসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি প্রকৃত প্রতিভাবান সাহিত্যিকও হারিয়ে যাচ্ছেন গড্ডলিকা প্রবাহে। পাঠকরাও প্রকৃত সাহিত্যবিচারে অগ্রসর হচ্ছেন না। গতানুগতিক দায়সারা গোছের মন্তব্য বা মূল্যায়নে তাঁরা প্রবৃত্ত হয়েছেন। অবশ্যই এর ব্যতিক্রমও আছে, কিন্তু তা দূরবিন দিয়ে দেখতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলি সাহিত্যের মূল্য দেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারাও আর বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারছেন না। কেননা তাদের কাছেও সাহিত্যচর্চাকারীরা ঝাঁকের কই। শক্তিধর অথবা দুর্বল সবই সমান বলে গণ্য হচ্ছেন। হয়তো-বা বহুদিন অপেক্ষা করার পর, হয়তো-বা মৃত্যুরও পর তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে। অবশ্য জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

       টাকা নিয়ে সংকলন বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করে যেমন শাশ্বত বা ব্যতিক্রমী সাহিত্যের ধারাকে উজ্জীবিত করা যায় না, বা সাহিত্যিককে প্রেরণা দেওয়াও যায় না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বর্তমানে এই প্রবাহটা এমনই জোর শক্তি ধারণ করেছে যে একে নিবারণ করার কোনো উপায় নেই। প্রকাশকদের উচিত ছিল, প্রতিভাবান সাহিত্যিকদের খুঁজে খুঁজে বের করা এবং বিনা পয়সায় তাঁদের বই প্রকাশ করা। কিন্তু সেই চলটা প্রায় উঠে গেল। এখন পত্রিকায় লিখতে গেলেও টাকা লাগে, বই প্রকাশ করতে গেলেও টাকা লাগে। আবার সেসব বই বিনা পয়সায় দিতে হয়। তরুণ লেখকদের বই ক্রয় করার মানুষ কম। কম হবেই না বা কেন, তিনি তো আর নামকরা প্রতিষ্ঠানের লেখক নন! কোনো নামকরা ম্যাগাজিনেও লিখেননি। সুতরাং তাঁকে ঘোষণা করতে হয়: 'আমি কবি! আমি লেখক! এই আমার প্রথম কাব্য!' এতে তাঁর দোষ কী! বাজার ভর্তি এত ব্যবসায়ী, এত ঠক জোচ্চোর! তিনি কার কাছেই বা দাঁড়াবেন! কেই-বা তাঁর বই প্রকাশ করবে! কেই-বা নিরপেক্ষ বিচার করবে তাঁর লেখা নিয়ে! সেই সুযোগ তাঁর সামনে যখন নেই, তখন নিজেকে নিজেই কবি বলতে বাধ্য হন। নিজেকে নিজেই লেখক হিসেবে প্রচার করেন। টাকা দিয়ে বই করেছি এই অহংকারও তাঁকে লজ্জানত হতে দেয় না।

        অবশ্য টাকা দিয়ে বই ছাপানোটির মধ্যে বাধ্যবাধকতা থাকলেও টাকা দিয়ে পত্রিকায় লেখা ছাপানোর ঘোর বিরোধিতা করছি। কেননা উক্ত পত্রিকাগুলি সাহিত্যের মূল্যমান নির্ধারণ করে না। খুব নিম্নশ্রেণির এবং নিম্নরুচির বালখিল্য লেখা নিয়ে সেগুলি প্রকাশিত হয়। কলেবরে বৃহৎ হলেও এবং প্রচ্ছদে চাকচিক্য থাকলেও, ভেতরের প্রতিটি পৃষ্ঠাকে মনে হয় লেখকরা কলুষিত করেছেন। লেখার পরিসংখ্যান এবং লেখকেরের পরিসংখ্যান দেখে অনুমান করা হয় দেশের বুদ্ধিজীবী রুচিবোধসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। যাঁরা সাহিত্যিক হন, তাঁরা ভালো পাঠকও হন। কিন্তু এই সব পত্রিকায় লেখা দেখে বোঝা যায়, যেন আমরা কয়েকশো বছর পেছনে সভ্যতার অক্ষর-পরিচয়ের যুগে ফিরে গেছি। সাম্প্রতিককালের সাহিত্যের বাঁকবদল, নতুন পথের ধারণা এঁদের একেবারেই নেই। সুতরাং এঁদের লেখা না ছাপালেও সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হত না। বরং ছাপিয়েই সাহিত্যের স্তূপ তৈরি করা হলো। এদিকে প্রকাশক-সম্পাদকদের ব্যবসার বাজারও তৈরি হলো।

      পত্রিকায় লেখা পাঠানোর বিজ্ঞাপন দেখে লেখা না পাঠানোই উচিত বলে মনে করি। কারণ লেখা পাঠিয়ে, টাকা দিয়ে লেখা ছাপিয়ে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কয়েকবার নিজের শখ পূরণ করা যায় মাত্র। কিন্তু বারংবার এই ধারা চলতে থাকলে লেখক মানসিক রোগীতে পরিণত হবেন। সাংসারিক জীবনেও টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে। অবশ্য যেসব পত্রিকায় টাকা লাগে না, সেসব পত্রিকায় লেখা দেওয়া যেতে পারে। তবে এমন কয়েকটি পত্রিকাও আছে যারা লেখা ছাপলে লেখককে সাম্মানিক প্রদান করেন। সংখ্যায় কম হলেও তাদের অস্তিত্ব এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। লেখা যেতে পারে সেসব পত্রিকায়ও। বেশকিছু নেট ম্যাগাজিন সগৌরবে প্রকাশিত হচ্ছে, যাদের কাছে কবিকে টাকা দিতে হয় না। সেসব ম্যাগাজিনেও লেখা দেওয়া যেতে পারে। একটা কথাই শুধু বলতে চাই, টাকা দিয়ে বই কেনা ভালো, কিন্তু টাকা দিয়ে লেখা ছাপানো যে নিজেকে মূল্যহীন করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024