গল্প || ঐতিহাসিক খাট || সুজিত চট্টোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক খাট
পয়লাবৈশাখের বাংলা ক্যালেন্ডার নাতি ভম্বল টাঙিয়ে দিলো ঠাকুমার ঘরে , ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে।
দুর্গাঠাকুরের ছবি আঁকা ক্যালেন্ডার । "আদিগঙ্গা বস্ত্রালয়" প্রতি বছরের মতো এবছরও দিলো। সঙ্গে এক বাস্ক সস্তা মিষ্টি । নববর্ষের প্রীতি উপহার।
ঠাকুমা বললো ,, " দেখ তো ভম্বল , পুজো কবে? "
ঘরে নতুন ক্যালেন্ডার এলেই সবার আগে খোঁজ হবে পুজো কবে? পুজো বললেই বুঝে নিতে হবে দুর্গা পুজো।
পুজো অনেক দেব দেবীরই হয়। কিন্তু দুর্গাপূজার ব্যপারটাই আলাদা। একটা অদ্ভুত আনন্দ হিল্লোল আকাশে বাতাসে মনে।
লালকালিতে সার সার অন্তত চারটি দিন। ইস্কুলের দিন গুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
" আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে "।
সত্যি কথা বলতে , বয়স যতই এগোয় মন ততই দরকচা মেরে যায় ।
অনাবিল হাস্য মুখর ডানপিটে মজা গুলো গুমড়ো মুখো হয়ে যায় ।তখনই আসে গলায় বিষাদের সুর,,
" আজকাল সেই আগের মতো প্রাণবন্ত পুজো আর নেই। কেমন যেন দায় সারা গোছের হয়ে গেছে "
আসলে কিন্তু তা নয়। পুজোর জৌলুশ আগের চেয়ে বেড়েছে বৈ কমেনি। জৌলুশ কমেছে মনে। পাংশুটে পটলের মতো কোঁচ ধরেছে।
তবুও ঠাকুমা বৈশাখের নতুন ক্যালেন্ডারে আশ্বিনের শারদীয়া খুঁজছে। জপের মালা সমেত হাত কপালে ঠেকিয়ে অস্ফুট উচ্চারণ দুগগা,, দুগগা,,।
আজ থেকে উনিশ বছর আগে দুর্গা সপ্তমী তে বৈধব্য পেয়েছিলেন। তাতে কী? তাইবলে দুগগা মায়ের ওপর থেকে বিশ্বাস ভালবাসা উঠে যাবে কেন । তা অটুট আজও।
নাতি ক্যালেন্ডার টাঙাতে টাঙাতে হেসে বলে,,
" কীহবে জেনে তোমার। ধুনুচি নাচবে না-কি বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের ঠাকুর দেখতে যাবে ? "
ঠাকুমা চুপ করে যায় । জম্পেশ জবাব দেওয়া যেতো কিন্তু ঠাকুমা চুপ করে থাকাই ঠিক মনে করে মুখে কুলুপ দিলো।
নইলে অনায়াসেই বলা যেত,,,
একটা গাড়ি কেনার যোগ্যতাও তো নেই কারো অথচ ঠাকুর্দার গাড়িটা পুরনো হয়ে যাবার অজুহাতে জলের দামে বিক্রি করতে এতটুকু লজ্জা বোধ হয়নি।
ঐ গাড়িতে চড়ে সারারাত ধরে কত ঠাকুর দেখে বেড়িয়েছি সব্বাই মিলে।
বাংলা ক্যালেন্ডার এখন আর তেমন করে কারুরই কোনও কাজে লাগেনা। বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীর মতো টিমটিম করছে। তবে ঠাকুমার ওটা চাই ।বিশেষ করে একাদশী পূর্ণিমার হদিস পাবার জন্যে।
তাছাড়াও যেগুলো ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে শহুরে ব্যস্ততার দাপটে , ঝুলনযাত্রা , স্নানযাত্রা , রাধাষ্টমী , পঞ্চম দোল , বিপত্তারিণী ব্রত, ষষ্ঠী , ইত্যাদি। কেউ তো বলে দেবার নেই। সবাই ব্যস্ত যে যার নিজের কাজে। তাই তাকেই খোঁজ রাখতে হয়।
কিছুই নয় , শুধু ভালো দিন গুলোতে রাধামাধবের পায়ে একটু পুজো দেওয়া। পরিবারের মঙ্গল কামনায়।যদিও ঠাকুমা জানে এ-সব কিছুই না, প্রাচীন প্রথাগত সামাজিক লোকাচার মাত্র।
পালন করলে কি _না করলে , কিছুই এসে যায়না তাতে। তবুও যতক্ষণ টিঁকে থাকা ততক্ষণ টিঁকিয়ে রাখা। তার সঙ্গেই বিদায় নেবে এইসব অনাহুত অলাভজনক পুরাতন সংস্কার কিংবা কুসংস্কার ।
সেদিন ঠাকুমা বললেন " ওরে ভম্বল , একটা কাজ করে দিবি বাবা "
গলায় অনুনয়ের সুর। " এই ঘরের মেঝেতে একটা বিছানা ক`রে দিতে পারবি ? "
স্বাভাবিক ভাবেই ভম্বল অবাক।
" মেঝেতে বিছানা ,, কেন কী করবে ? "
" আমি মেঝেতে শোবো। "
" মেঝেতে শোবে ! কেন হঠাৎ ? খাটে কি তোমার অসুবিধে হচ্ছে ? "
" না না সেকথা নয়। আবার অসুবিধে একেবারেই হচ্ছেনা এমনও নয়। বিশেষ ক`রে ওঠানামা করতে বড্ড,,, যাকগে, সেটা বড় কথা নয় । আসলে কি জানিস , চোদ্দো বছর বয়সে এবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম। এই খাটেই ফুলশয্যা হয়েছিল। শৌখিন মানুষ ছিলেন উনি। গোলাপ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন সেই মধুযামিনী রাতের শয্যা। সেই কতদিন আগের কথা। আজও ছবির মতো চোখের সামনে যেন দেখতে পাই।
এক এক ক`রে ছেলে মেয়েরা এলো । সব এই খাটে।
নরম নরম কচি কচি হাত পা ছুঁড়ছে কাঁদছে ঘুমোচ্ছে। রোজ একটু একটু ক`রে বড় হয়ে যাচ্ছে। সব এই খাটে।
উনিশ বছর আগে যখন উনি চলে গেলেন চিরকালের জন্য , ওনার শেষ শয়ন ছিল এই খাটে। কত সুখস্বপ্ন সুখস্মৃতি কত বেদনা স্বপ্নভঙ্গ চোখের জল , জন্ম থেকে মৃত্যু সবকিছুর বির্বাক সাক্ষী এই খাট ।
এবার ছুটি নেবো , ছুটি দেবো। বহুকাল ঐ
মাটি ছেড়ে এই উঁচু ঐতিহ্যশীল বনেদীয়ানায় মোড়া আভিজাত্যের অহংকারে নিজের সবটুকু নিয়ে বসে আছি।
এবার ফিরে যেতে চাই মাটিতে অকাতরে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে। "
ভম্বল ব্যস্ত মানুষ। কথা গুলো শুনে মুখ কুঁচকে হাত ঝাঁকিয়ে বিরক্তি দেখিয়ে বললো,,
" আচ্ছা আচ্ছা , সে দেখা যাবে আখুন "।
পরদিন সকালে সবাই অবাক চোখে প্রত্যক্ষ করলেন ঠাকুমার নিথর নিষ্প্রাণ দেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে সেই খাটেরই মাঝখানে। তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করার সুযোগই আর পাওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক খাটে ইতিহাস হয়ে রয়ে গেলেন ঠাকুমা ।
Comments