গল্প || শেষ টার্গেট || রঞ্জিত মল্লিক

 শেষ টার্গেট




        সিঁড়ির সবকটা ধাপ এখন আর মনে থাকে না।

তাছাড়া হাজারো চিন্তার সাথে দুইকুড়ি দশ বসন্তের ক্লান্তি...

এ'দিকে ঋদ্ধিমার সাথে দেখা না করলে, মেয়েটা কষ্টও পেতে পারে। সেই জন্যই দোতলা থেকে নিচে নামা...


          ঋদ্ধিমা, বছর কুড়ির এক উড়ন্ত প্রজাপতি। এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। সব সময় একটা চনমনে ভাব। সপ্তাহখানেক আগে এক সাহিত্য সম্মেলনে দুজনের পরিচয়। হিরণ্ময়বাবু নামী লেখক এবং কবি। উনার বেশ কিছু বই গুণী মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত।   


           ঋদ্ধিমার আবেগে তথা শ্রদ্ধায়, অকৃতদার হিরন্ময় সরকার কিছুটা আপ্লুত তো বটেই। তা'বলে ঋদ্ধিমা বাড়িতে চলে আসবে, আশা করেনি। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই, পদস্খলন...


        নিথর দেহটা যখন সামান্য হলেও গড়াতে গড়াতে সিঁড়ির নিচে এল', ঋদ্ধিমা পাষাণপ্রতিমা!


          কোন রকমে হিরণ্ময়বাবুকে তুলে এনে খাটে বসিয়েই বলল,"আপনার লাগেনি তো? একটু সাবধানে তো চলাফেরা করতে পারেন?"

     "না, আসলে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়েই....."

      "এবার থেকে একটু খেয়াল রাখবেন, চলুন ডাক্তারখানায়।"

       "যেতে হবে বলছ?"

       "তা নয় তো কি.....?"

       "বেশ চল তাহলে।"


             হিরণ্ময়বাবুকে টোটোতে বসিসেই ঋদ্ধিমা উনার পাশে বসল। হিরণ্ময়বাবু কিছুতেই ডাক্তার দেখাতে যাবেন না। বলে কি না তাঁর কিছুই হয়নি। উনার চেহারা দেখে উনাকে অতটা বয়স্ক বলেও মনে হয়না। চোখের চাহনিও বেশ অদ্ভুত।


            হিরণ্ময়বাবু বাঁ হাত দিয়ে ঋদ্ধিমাকে আলতো করে সাপোর্ট পাবার জন্যে ধরতেই ঋদ্ধিমা কেমন চমকে উঠল। চোখের দিকে তাকাতেই হিরণ্ময়বাবুর মুখে একটা মোলায়েম হাসির রোদ্দুর। ঋদ্ধিমা বেশ ঘাবড়ে গেছে। একটু অস্বস্তিও হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। কিছু বলতেও পারছে না। যেটা হিরণ্ময়বাবুর ব্র্যাণ্ডেড, সৌখিন পাঞ্জাবী ও ঝলমলে হাসি সবটা শুষে নিচ্ছে ব্লটিং পেপারের মতন।  


             উনাকে দেখার পর থেকেই ঋদ্ধিমার কেমন যেন সন্দেহ হতে শুরু করে। প্রথমদিন সন্মেলনে দেখার সময়ও কেমন একটা অদ্ভুত লেগেছিল। চোখের তারায় তারায় যেন গভীর দীঘির একটা প্রতিচ্ছবি। উনি অবিবাহিত। সাহিত্যের পূজারী। বেশ নামডাকও আছে।তবে কি যেটা ভাবছে....


                 হিরণ্ময়বাবু উনার পছন্দের নার্সিংহোমেই গেলেন দেখাতে। নার্সিংহোমে অনেকেই উনার বিশেষ পরিচিত। অনেকের সাথে আকারে ইঙ্গিতে কথা বলছেন। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে কেমন গম্ভীরও হয়ে যাচ্ছেন। ঋদ্ধিমা সব কিছুই লক্ষ্য করছে। আর কি যেন ভাবছে।


              ওর কপালে চিন্তার ভাঁজটা দাক্ষিনাত্যের মালভূমির মতন দেখাচ্ছে। অতিরিক্ত টেনশন আর পেশীর প্রসারণে সেটা ওঠা নামা করছে। ফেরার পথে বেশ কিছু মানুষ কেমন আড়চোখে ওদের দুজনকে দেখছে। আর নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে। দু চারটে ছোড়া অস্পষ্ট কথা কানেও এলো। তবে ঋদ্ধিমা একেবারে নিরুত্তর।


                        ******** ***********


               তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে। ঋদ্ধিমা আজও এলো না। হিরণ্ময়বাবুও বেশ চিন্তিত। এদিকে ঋদ্ধিমার ফোনটাও শব্দহীন হয়ে আছে। মনের মধ্যে একটা ঝড় বইছে। উনি অস্থিরভাবে বারান্দাতে পায়চারি করছেন। আর বারে ফোনের দিকে তাকাচ্ছেন। আর ভাবছেন এই বুঝি ঋদ্ধিমার ফোনটা বেজে উঠল। 

         

           বিকেলের একটু পরেই ঋদ্ধিমা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি খেলা করছে। সাথে বেশ কয়েকজন ওর বয়সী বা ওর থেকে একটু বেশী বয়সী কিশোরী। পাশে পুলিশের এসআই। ও দু চারজন কনস্টেবল। 


             নার্সিংহোমেই উনার কুকীর্তির কিছুটা আভাস পেয়েছিল ঋদ্ধিমা। যদিও সন্দেহটা প্রথম থেকেই ছিল। তাই তো আর দেরী করেনি। খুব তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্তে চলে এসেছিল। আর এই কাজে ওকে সবচেয়ে বেশী হেল্প করেছেন ওর মেসোমশাই। যিনি একটা সময় ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডাকাবুকো অফিসার ছিলেন। মেসোমশাইয়ের সাথে আলোচনা করেই তবে এগোনো......।


                   ........... .......... ......... 


          সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়াটা একটা নাটক ছিল। উনি যোগা করতেন। বাড়ির কাজের মেয়ের কাছে যেটুকু জানা, শরীর চর্চাও শোনা যায় নিয়মিত চালিয়ে যেতেন। তাই এইভাবে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়াটা উনার কাছে খুব একটা কঠিন নয়।আর ছল চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে নিজের নোংরা অভিসন্ধিকে চরিতার্থ করতে উনার মতন ধুরন্ধর লোক খুব কমই আছেন। 


             বহুবার এই ধরণের বহু রকম নাটক করে অনেক মেয়েকে ফাঁসিয়েছেন। এবং তাদেরকে কুপ্রস্তাবও দিয়েছেন। কখনো তাদেরকে একক বই ছাপানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনো বা তাদেরকে কাজ পাইয়ে দেবার মিথ্যে জোরালো প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কুপ্রস্তাবে অনেকে সাড়াও দিয়েছেন। অনেক উঠতি লেখিকা নিজের একক বই বা সংকলন ছাপাতে আগ্রহী হয়ে উনাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্সও দিয়েছেন। 


           নিজে সাহিত্য চর্চা করতেন বলে সাহিত্য জগতের বহু গুণী লেখক, লেখিকা, কবি, সাহিত্যিকের সাথে উনার ভালই দহরম মহরম ছিল। অনেক নামী প্রকাশনী সংস্থার সাথেও উনার বেশ খাতির ছিল। সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়েই অনেক নিত্য নতুন মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোটা বেশ সহজ হয়েছিল। তাদেরকে মিষ্টি মিষ্টি কথার জালে ফাঁসিয়ে নিজের শয্যাসঙ্গিনী করতেন। এই নোংরা নির্লজ্জ খেলায় বহুবার সফলও হয়েছেন। 


            বিষয়টা চার দেওয়ালের মধ্যেই আটকে ছিল। একমাত্র কাজের মেয়েটিই সব জানত। ঐ নার্সিংহোমেই বহুবার অনেক মহিলার গোপণে গর্ভপাত করা হয়। হিরণ্ময়বাবু বিকৃত মানসিকতার শিকার। যেটা বাইরে থেকে উনার নিপাট ভদ্র শরীরি পরিভাষা দেখে বোঝার উপায় নেই। কাজের মেয়ে সুরেধাকে অর্থের প্রলোভনে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। যদিও তা শেষ রক্ষা হল না। সত্য ঠিক প্রকাশ হল। 


         ঋদ্ধিমা ছিল উনার শেষ টার্গেট। সে এই নোংরামির অনেকটাই আভাস পেয়ে তাই দেখা করতে আসে। আর তাতেই রাঘববোয়াল ধরা পড়ে। 


           যদিও ঋদ্ধিমাকে হিরণ্ময়বাবুর এই তথাকথিত ভদ্র মুখোশটা খোলার জন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। উনার বাড়িতে সেদিন এক ডায়েরি পেয়েছিল ঋদ্ধিমা। সেখানে অনেক সুন্দরী মেয়ের ঠিকানা, ছবি, নার্সিংহোমের বিল লুকানো ছিল। যা দেখে সন্দেহের শিকড় আরো গভীরভাবে মনে প্রবেশ করে। সেই সূত্র ধরেই ঋদ্ধিমা আর পিছনে তাকায়নি। এগিয়ে গিয়েছিল।


           নিজে সাইকোলজির একজন কৃতি ছাত্রী হওয়াতে কাজ কিছুটা সহজও হয়েছিল। হিরণ্ময়বাবুর মনটা ঠিক পড়ে ফেলেছিল। কারণ ঋদ্ধির মনে একটা কথা বার বার রেখাপাত করেছে, তা হল একটা মানুষ কি করে এত ভদ্র সভ্য হয়ে থাকতে পারে। আর সেই জন্যেই.....।


                হাতেনাতে ধরা পড়ে মুখোশ খুলে যেতেই হিরণ্ময়বাবু বেশ অস্বস্তিতে। উনি ভাবতেও পারেন নি উনার নতুন এবং শেষ টার্গেট এইভাবে ব্যর্থ হয়ে উনাকেই উল্টে ছোবল মারবে। 


           বিকেল ফুরিয়ে বেশ অনেক্ষণ হল সন্ধ্যে নেমেছে। গাঢ় আঁধারে হিরণ্ময়বাবুর মুখটা ডুবে আরো ভয়ঙ্কর, রোমহর্ষক দেখাচ্ছে। উনাকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলে, ঋদ্ধিমার সাথে আসা মেয়েগুলো জ্বলন্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে তিরষ্কার আর অভিশাপ বর্ষণ করল। 


          ওদের মুখেও একটা যুদ্ধজয়ের নিষ্পাপ হাসি। আজ ঋদ্ধির জন্যেই ওরা সবাই ন্যায় বিচার পেল। সকলে সমস্বরে ঋদ্ধির নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024