রম্য রচনা || ছেলেবেলা || সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

 ছেলেবেলা


   ছেলেবেলায় কী ঘটে আর কী ঘটে না তা বোধকরি লিখে বা এঁকে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু তারই মধ্যে স্মৃতিপটে অমলিন। তাকে রঙ তুলি কিংবা পেন পেন্সিল দিয়ে নিজের মনের মতো বাগিচায় সাজানো বাস্তববিকই দুষ্কর। 

          অথচ ছেলেবেলায় ঘটা ঘটনার আউটলাইন করে যে ঘটনার পুননির্মাণ করবো তাও ভেতর থেকে সাড়া মেলে নি। কেননা, অবসর যে নেই ফিরে তাকানোর। তাই আগামী দিনের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করি-- যেটা মানব ধর্মই বলা যেতে পারে। যেটা কিন্তু অনেক সময়ই অন্ধকারে পড়ে বালকমনে বেশ কিছু ছবিই অকপটে নিজের কাছে নতজানু হয়ে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়।। সুতরাং ছেলেবেলার ঘটনা মনের ওপর ছাপ ফেলার আগেই নিমেষে সংশোধনাগারে বন্দীত্বকে মেনে নেয়। 

       এই ছেলেবেলার উজ্জ্বলতা যথাযথভাবে সংগ্রহ করে ফটো ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা বিশ্রামাগারে বসে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করার মতোই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তবুও চেষ্টা করছি যতটা মনে পড়ে। পিছনের দিকে তাকালে নিজের পিঠেও কী আছে জানা যায় না। বিনোদনের কিছু কেউ মনে করালে তবেই বোধহয় বর্ণনা দেয়া যায় বা সম্ভব।। মনের মধ্যে অনেক ঔৎসুক্য জমা হলেও বিচিত্র বর্ণে তাকে সাজিয়ে রাখা হয়তো আমার মতো ক্ষীণ দুর্বল চিত্তের মানুষের পক্ষে একদমই মানানসই নয়।। 

      আবার এমন কিছু নেই যেটা কে মনে করে চিরস্মরণীয় করে কেউ খোঁপা বাঁধতে সক্ষম হবে! তবু

তারই কিছু খন্ড চিত্র আজও লিপিবদ্ধ করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে চলেছে প্রতিনিয়ত আমার লেখনীর দোরগোড়ায়।। এটা সাহিত্য নয় জেনেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জানাতেই যেন এই শুদ্ধিকরণ আর কি! 

                   শৈশব

 তখন কেবল আমি একা। যদিও জাড়তুতো দিদি শ্যামলী আমার থেকে বড় হলেও একসাথেই পড়াশোনা করেছি। যৌথ পরিবার (প্রায় ৭০/৭২) ভুক্ত হবার কারণে জাড়তুতো, খুড়তুতো, বা সহোদর, সহোদরার মানে বোঝানো হয়নি, সেসময় বা বুঝতে শিখিনি। পাঠশালা নয়। নিজের বাড়িতে এক মাটির ঘরে বসে পন্ডিত মশাই সনাতন চক্রবর্তীর কাছে শিক্ষা শুরু। 

তার আগে বাড়ির কাছে ঐতিহ্যবাহী কালীমন্দিরের দোরে হাতে খড়ি। বিশাল একটা চক( আয়তনে প্রায় ৭/৮ ইঞ্চি হবে। দুদিকটা সরু মাঝে মোটা পটল আকৃতি।) অ আ ক খ লিখে সেই যাত্রার শুরু। তারপর বাড়িতে পড়াশোনা। সংস্কৃত পড়াতেন ঐ পন্ডিত সনাতন চক্রবর্তী। আমার উচ্চারণে বাবা অনুপ্রাণিত হয়েই বোধহয় কাব্য মধ্য তীর্থ বেদান্ত পড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেটা যদিও আর বাস্তবে রূপ পায়নি। বাবার মামাতো ভাই শ্যামসুন্দর দত্ত নাকি খুব ছোট্ট বয়সেই কীর্তনীয়া কোনও নবদ্বীপ গায়কের ভুল ধরে দিতে পেরেছিলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র ৯/১০! সেই শুনে আমার কাছেও বাবার ইচ্ছাগুলো নাভিশ্বাস তুলতো মনে হয়। সেই মামাতো কাকা পরে ভারত সরকারের বিশিষ্ট পদে আসীন ছিলেন এবং উলুবেড়িয়ার সাব --জর্জ নিযুক্ত হয়েছিলেন। আবার পরে রিটায়ার্ড হয়ে পূর্বাঞ্চলীয় ফুড করপোরেশনের ম্যানেজার হয়েছিলেন -- শুনেছি। গুটির ( হুগলি) তৎকালীন বিখ্যাত জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন সেই শ্যামু কাকা। আমার দাদু মানে বঙ্কুবিহারী পাইন সেই জমিদার বাড়িরই জামাই। শুনেছি- পায়ে হেঁটে শ্বশুর বাড়ি যেতে হতো সেসময় প্রায় ১৪ কিমি।যাবার পথে রাস্তায় একদিন কোনো এক অজানা ভিক্ষুক দাদুর কাছে একটা কাপড় চাইলে দাদু তৎক্ষণাৎ নিজের ধুতি খুলে দিয়ে একটা গামছা পড়ে শ্বশুর বাড়ি যান। জমিদার বাড়িতে সবাই অবাক হলেও সব শুনে আর কিছু প্রতিবাদ করেননি। আমি সেই বংশজাত বলে বাবা তাই বারবার আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। যেটা নাকি আমাকে পরে সেই দাদুর উত্তরসূরি বা পুনর্জন্ম নেওয়া ভেবে আমাকে আমার নাম না ধরে 'বাপ'বলে সম্বোধন করা হতো। ঠাকুরদা আমি জন্মাবার মাত্র বছর দুই আগে যদিও মারা গিয়েছিলেন। আর ঠাকুমা মারা যেতেই আমাদের বেনে পাড়ায় যত পুজো অনুষ্ঠিত হতো( দুর্গা, অন্নপূর্ণা, বাসন্তী)সবই বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো। এক বৎসর কোনও এক ব্রাহ্মণ এমন আরতি করেছিলেন-- যেটায় ঠাকুমা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কেননা, সেই বৎসর আমাদের কূল পুরোহিত মারা গিয়েছিলেন বলে অন্য ব্রাহ্মণ পুজো করেছিলেন। সেটা শুনে জেনেছি-যে জন্য আর পুজো হয়নি। যদিও আমি ঝোঁক ধরে অনেক বড় বয়সে বাবাকে জানিয়ে ই দুর্গাপূজা আনিয়েছিলাম। যেটা বেশি বৎসর অবশ্য চালাতে সক্ষম হইনি। বাবা মারা যাবার পরে পরে বছর দুই চালাতে পেরেছিলাম মাত্র। সেটা অবশ্যই পরের কাহিনী। আমি আমার খুব ছোট্ট বয়সে আমাদের বাড়ি থেকে লুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছুটা উল্লেখ করতাম বলে আমার প্রতি একটা অন্য টান ছিল বাড়ির সবারই। যাই হোক্-- সেসবই অন্য ব্যাপার। 

   এখন শৈশবের পর্দা খোলা হয়েছে। সেটাই অভিনীত হবার কথা। তাই ওদিকে না এগিয়ে শৈশবের কথাই বরং বলি। যৌবনে একদিন হঠাৎই মা ডেকে এনে ছড়া লিখতে বলেন- সম্ভবত ১৯৬০/৬২ সালে। তার পরেই আমার কলমের পথ চলা বা এগিয়ে চলা। 

 লেখাপড়া চললো। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হলো তৃতীয় শ্রেণীতে। বয়স তখন ৬ ( ছয়) হয়নি। তাই কিছুটা বয়স বাড়িয়ে ভর্তি হতে হলো। জন্ম আমার ১৯৫২সালের ১৯ এপ্রিল। করা হলো ১৯৫২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সনাতন পন্ডিতের পরে শিক্ষক হলেন কাশীনাথ করাতি, পরে সত্য রঞ্জন সাধুখাঁ এবং সবশেষে দেবীপুর গ্রামের সুদেব গাঙ্গুলী মহাশয়। যখন লেখা চলছে অর্থাৎ ১৪২৮ বঙ্গাব্দেও যিনি জীবিত আছেন। সেখান থেকেই সোজা কলেজের পান্থ দেশে। এর আগে চতুর্থ শ্রেণীর বৃত্তি- পরীক্ষায় অবশ্য উত্তীর্ণ হতে পারিনি। শ্যামলী দিদি ও আমি ক্লাসে প্রথম ও দ্বিতীয় হলেও দুজনেই কিন্তু চতুর্থ শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় ফেল। তারপর পঞ্চম শেণীতে ভর্তি হলাম। শ্যামলী দিদি র পড়া হলো না। কেননা, নারীদের পড়াশোনা করার পক্ষে তখন কেউ ছিলেন না। স্কুলও ছিল না। আমি ভর্তি হলাম গড় ভবানীপুর রামপ্রসন্ন বিদ্যানিকেতনে। যেটি আর এক স্থানীয় জমিদার (রায় )বংশেরই একজন ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা।

    এখানে এই স্কুলে স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় একবার পদধূলি দিয়েছিলেন, রাত্রি যাপনও করছিলেন-- শুনেছি তাঁর হস্তাক্ষরের নমুনা আজও বিদ্যমান।( আমি পরে এই স্কুলেই বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছি। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছি)! যাক গে সে কথা। ভর্তি হবার পর থেকেই আমি সকল শিক্ষকদের খুব অনুগত এবং গুণগ্রাহী ছিলাম। কারণ কী অবশ্য কোনও দিনই জানতে পারিনি। বাবার উঁচু মাথা নাকি আমার ব্যবহার বোঝা যায়নি। যদিও ক্লাস ফাইবের ফাইনালে আমি বিজ্ঞানে অকৃতকার্য হই। বাবা আমাকে ষষ্ঠ শ্রেনীতে তুলতে রাজি হননি। আমি কেঁদে কেঁদে যখন অন্যরকম তখন স্কুলের শিক্ষকদের আব্দারে বাবা ষষ্ঠ শ্রেণীতে তুলে দেন একপ্রকার বাধ্য হয়েই। আবার সেই শ্রেণীতে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাতেও আমি বিজ্ঞানে ফেল করি। তারপর ফাইনালে যদিও আমি পঞ্চম হই। প্রগ্রেস রিপোর্ট দিয়ে তাই সেই সময়কার মাষ্টার মশাইরা বলেছিলেন-- দেখুন দেখুন , গার্জেন যদি লক্ষ্য করেন তাহলে "সঠিকটা" কেমন সম্ভব। তারপর থেকে শুধুই উঁচুতে ওঠা। পরপর ক্লাসে উন্নতি। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় হয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসা। এবং সেখানে দ্বিতীয় হওয়া। মাঝে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। যদিও এটা এখন সম্ভব কিনা আগামী ভবিষ্যৎ ই বলবে। এখনকার ছেলে মেয়েরা তো বাবার মায়ের শসন মানতেই চায়না। তারা উচ্ছৃঙ্খল কিনা বলতে পারবো না। কিন্তু বড়ই অবাধ্য। কিছু একটা চেয়ে না পেলেই আত্মহত্যা করতেও পিছপা হয়না। একবার আমি বাবার কাছে একটা জুতো আব্দার করলে বাবা দূর অদৃশ্যের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলেন দাখো একট লোক হাঁটছে। একটা পা নেই। তোমার দুটো পা আছে একজোড়া জুতো আছে। আবার কিসের দরকার!?

     ভর্তি হতে গিয়ে বাসে মামার পকেট থেকে টাকাকড়ি সহ সমস্ত সার্টিফিকেট খোয়া যায়। । আবার ডুপ্লিকেটের জন্যে কলকাতা থেকে এসে স্কুল থেকে ফের ভর্তি হতে যাওয়া। আবার ভর্তির ঠিক পূর্ব মুহুর্তে কলেজের ক্যাশ কাউন্টার থেকে বাবাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয় "কোথায় ছেলে থাকবে"!? বাবা অকপটে কলেজ হোষ্টেলের কথা বললে-- কাউন্টার থেকে ফেরত দেয়া হয়। বলা হয়" আগে ঘর দেখুন। তারপর ভর্তি। এখানে থাকলে ছেলে মরে যাবে।" ঘর খুঁজে তারপর ভর্তি হলাম। একা একা রান্না করে কলেজ করার অনুমতি নিয়ে। ভাবাই যায় না। যে --আমি এর আগে কোনো দিনই কিছুই করিনি,-- জল খাওয়া , স্নান করা, জামা প্যান্ট পড়া কিচ্ছু না সেই আমি সূদুর কলকাতায় এক্কেবারে একা! বাবার ভগবানের ওপর ভরসা আর মায়ের বিদায় কান্না আজও বড় মনে পড়ে। যেন মেয়েকে শ্বশুর বাড়ির পথে এগিয়ে দেওয়া। সেটা ১৯৬৭ সালের কথা। অবশ্য প্রথম বছর হাওড়ায় পিসিমার ভাড়া বাসায় থেকে পড়াশোনা শুরু। পিসিমা ছিলেন বিধবা এবং খুবই গরীব। কিন্তু "সেজদা "র ছেলে হিসেবে যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন আমার ওপর। পিসিমার ছোট ছেলে খোকন পড়াশোনায় একেবারেই ভাল ছিল না। তবুও আমার সাথে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিল। বয়সে আমার থেকে একবছরের বড়ো। কিন্তু বোকা হাঁদা যেন। একসাথে রেশন তুলতে, বাজার করতে যেতাম-- হাওড়ার তাঁতিপাড়া লেনে। যেখানে নকশাল আমলের বেশ কিছু ছেলে আমাকে খুব ভালোবাসতো ও চোখে চোখে রাখতো। পুলিশ এলে অবশ্য তেমন আমার সাহায্য ও সহযোগিতা পেত। তারপর অনেক ইতিহাস স্বাক্ষী করে আমি প্রথম বছর কাটিয়েছি। কিন্তু অনার্স পরীক্ষায় আবার ফেল। ফলে একই বছরে পুনপদার্পণ। সেই থেকে ১৯৬৮ সালের ১৫ আগষ্টে কলকাতার তালতলা লেনে একা একা পড়াশোনা করা। অনেক মেয়ে বন্ধু এসেছে। আমাকে শয্যা সঙ্গী হিসেবে পেতেও চেয়েছে কেউ কেউ-- ফলপ্রসূ হয়নি। ছেলে বন্ধুরা অবশ্য আমাকে নীতিশিক্ষা বা জটিল শহরের আদিখ্যেতা বোঝাতো সবসময়। এমনিভাবে কেটেছে বেশ কয়েকটা বছর। অনার্স পেয়ে পাশ করেছি। কিন্তু পরবর্তী মাষ্টার ডিগ্রিতে (মাত্র সীমিত সিটের জন্যে)আবার অকৃতকার্য হওয়ায় পড়া হয়নি। পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়তে চাইলাম। বাবার হুকুমে দেশে ফিরে আসতে হলো১৯৭৩ সালে। বাবার ধারণা হয়েছিল-- আমি কামিনী মোহে মশগুল। কারণ, বাবার মনে দৃঢ় হয়েছিল-- আমি কামিনী অনুরাগী নাহয় সন্ন্যাসী হবার পথে অগ্রণী।তাই ছেলের অন্তর্দশা কাটাতেই ফিরিয়ে আনা। ততক্ষণে ১৯৬৯ সালে ভাই পুশান( প্রশান্ত) হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। তাকেও বাধ্য হয়েই একপ্রকার কমার্সের জন্য গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে এ্যাকাউন্টেসি অনার্সে। যদিও আমরা স্কুলে দুজনেই ছিলাম আর্টসের ( কলা বিভাগের) ছাত্র। কারণ, স্কুলটায় তখন সায়েন্স বা কমার্স কিছুই স্বীকৃতি পায়নি। এটা আর একটা দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। বহুদূরে গিয়ে পড়লে জাড়তুতো রেনু দিদির বাড়িতে ঝিখিরায় - পড়তে হতো -- যেখানে স্কুলে সায়েন্স ছিল। দিদি রাজিও ছিল। বাবা রাজি হননি। ফলে-- অগত্যা--- আর্টস পড়ে ইকনমিক্স, আর কমার্সের পথে এগিয়ে চলা আর কি! হায়ার সেকেন্ডারিতে তারপরে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করে ইকনমিক্স পড়তে সোজা কলকাতার পথে সেন্ট পলস কলেজে। অধিকাংশ কলেজেই সেসময় ইকনমিক্স ছিল না বলে। তাছাড়া যখন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিই তখন সিট পড়েছিল এই এখানে সুদূর সেন্ট পলস স্কুলে। সেটাতেই এই কলেজের প্রতি একটা আলাদা টান ছিলই। খুব পছন্দ হয়েছিল ক্যাম্পাস টা। আবার নিয়তির বিধানে অন্য কলেজে ভর্তি হতে না পারাটাও মনে হয় সাহায্য করেছিল আমায়।। 

   আমি কামিনী কাঞ্চন ভোগী কিনা-- সেটায় দ্বিমত নেই। কিন্তু "কাঞ্চনের "প্রতি অতটা টান ছিল না মনে হয়। আজও নেই। কিন্তু কামিনী যেন আজও আমাকে কুরে কুরে দংশন করে সদা সর্বদা। স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন -- শান্তিনিকেতনের ছাত্র বাসুদেব ইন্দ্র মশাই। তাঁর সৌম্য চেহারা এবং শান্তিনিকেতনীয় শিক্ষায় আমি প্রলুব্ধ ছিলাম। তাঁর চেষ্টায় ও আমার বাবার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ক্লাস নাইন থেকে নারী শিক্ষার প্রসার চালু হলো। আমিও ছিলাম এব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে সহযোগী। জানিনা এটা কামিনী মোহ নাকি নারী শিক্ষার প্রতি অনুরাগ বোঝাতে পারবো না। এরপরে অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। স্কুলে ছাত্ররা আমাকে "একঘরে" করে বসতে জায়গা দিত না। বেশ কিছু দিন এভাবে চলার পরে একদিন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে (তখন প্রায় রোজই) ক্লাস করছি। জয়দেব বাবু (এক শিক্ষক)আমার বিরুদ্ধে বাবাকে নালিশ করেন। সেটা বিভিন্ন ভাবে প্রধান শিক্ষক বাসুদেব বাবুও জানতে পেরে শান্তিনিকতনীয় ঢংয়ে অন্যান্য ছাত্র বন্ধুদের নীতি শিক্ষায় শিক্ষিত করে আমাকে পুনর্জীবন দান করেন। মেয়েরা অবশ্য এতে আমার জন্য দুঃখ পেত কিনা না জানলেও আমার মুক্তিতে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিল --বুঝেছিলাম। বুঝোছিলাম -- প্রত্যেক শরীরের অংশই বুঝিবা সবসময় ভালোবাসা পেতে আগ্রহী। 

কিন্তু বাবা যেহেতু "আমার বাবা" তাই তাঁকে পীড়া দিত কামিনী মোহের ব্যাপারে।আর কলেজ জীবনে যখন আর এক নারী আমার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছিল সেখানে বাবার কর্তব্যে একটুও ভুল হয়নি বোধহয় আমাকে মুক্ত করার। তাই ফিরিয়ে আনা আর কি। তাছাড়া বাবার মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল--( কুষ্ঠি অনুযায়ী )আমি কামিনী লোভী। তাই মেয়েদের থেকে দূরে দূরে রাখতে সর্বদা খুবই সচেষ্ট ছিলেন। আমি গয়না বা অলংকার খুব একটা ভালোবাসতাম না। একটা আংটিও হাতে কোনও দিন পরতাম না বলে মায়ের মনে কষ্ট হতো। কোনও দিন( এখনও) বিড়ি সিগারেট বা চা পান করিনি বলে মা মনে হয় ব্যাথা পেয়ে আমাকে সিগারেট পানে অনুপ্রাণিত করতে বলেছিলেন-- খাবার পর একটা অন্ততঃ খাবি বাবা, তবে পুরুষ বলে মানাবে। যদিও তার উত্তরে আমি বলেছিলাম--" মা আমি খাইনি বলে তুমি খেতে বলছো। খেলে বারণ করতে।" এখানে অন্ধভয় বা অন্ধপ্রীতি নয় নিরাপদ স্থানে অবস্থান বোঝায়। আমার চেয়ে যাঁরা বড়ো তাঁরা বলতে পারবেন হয়তোবা সত্যি কোনটা।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024