লেখক হর্ষময় মণ্ডল -এর একটি গল্প

 কর্তব্য



যে ঘটনা নিজের জীবনটাকে ছারখার করে দিয়েছে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন মেয়ের জীবনে না ঘটে । এই চিন্তাটাই সব সময় মনটাকে

কুরে কুরে খায়, আর সেই ঘটনাই আজ ঘটে গেল।এতো সাবধান, উপদেশ, অনুরোধ করা

সত্তেও ঈশি মা ঈশিতার কোন কথাই শুনলো না।

     পই পই করে ঈশিতা বুঝিয়েছিলো মেয়েকে, 

দেখ তুই খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে, সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস। এবছর টুয়েলভ ভালো করে পড়ে ভালো

রেজাল্ট করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

তোর গার্জেন তুই নিজেই। আমার চাকরি আছে, 

সংসারের কাজ আছে, তাই তোকে স্কুলে, টিউশনে

পৌঁছে দিয়ে আসবো আবার সাথে করে নিয়ে

আসবো সে সময় নেই। দিনকাল যা পড়েছে তাতে

সব সময় চোখ কান খোলা রেখে চলবি নইলে

বিপদ অবসম্ভাবি। সেই বিপদেই ঘটিয়ে ফেলল

ঈশি মায়ের শত বারন সত্ত্বেও।

     একদিন মেয়েকে চেপে ধরলো ঈশিতা, বললো- কি ব্যাপার রে তোর? কয়েক দিন ধরে লক্ষ্য করছি তোর কেমন যেন একটা উদাসিনতা, উড়ু উড়ু ভাব। পাঁচ বার ডাকলে তবে একটা উত্তর

পাওয়া যাচ্ছে! বল কি হয়েছে?

অনেক চাপাচাপির পর ঈশি বললো - সে একটি ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছে। এর বেশি আর কিছু বললো না। ঈশিতার মনে হলো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ঘরকুনো গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায় ঈশিতার ও সেই রকম দশা হলো।

এই ভয়টাই পাচ্ছিল যে আমার জীবনে যা ঘটে গেছে সেই ঘটনা যেন মেয়ের জীবনে না ঘটে, একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।

ঈশিতার ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে গেল

….. সায়ন্তনকে ভালোবেসে ছিল মন প্রান উজাড় করে , মা-বাবাকে সে কথাটা অকপটে জানিয়ে ছিল।বাবা মানস মা রীতা মেয়ের মুখের কথা শুনে

স্তম্ভিত হয়ে গেছলো।

  এই হয়েছে বাঙালির এক দোষ ।যতোই আর্থিক

স্বচ্ছলতা থাক একটি সন্তান তার সে ছেলে হোক বা মেয়ে। যত ভালোবাসা , মায়া মমতা সব তাকে উজাড় করে দিয়ে ফেলে, ফলে সন্তানরা তাদের দুর্বলতার জায়গাটা সহজেই বুঝে ফেলে।এই 

দুর্বলতার কারণে সন্তান ভুল করলেও তেমন শাসন করতে পারে না, এই ভয়ে যে যদি সন্তান

আত্মঘাতী হয়! তাহলে তারা কি নিয়ে বাঁচবে! সেই রকমই অবস্থা মানস রীতার ক্ষেত্রেও। মানস

অনেকক্ষণ চুপ দিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল তুই কি ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করবি?

--- রীতা খুবই শান্ত ও ভীরু প্রকৃতির সংসারের কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না।এই কথা শোনার পর

কেঁদেই চলেছে।

ঈশিতার স্পষ্ট ও স্বল্প উত্তর - হ্যাঁ বাবা।

-- বেশ। ছেলেটির কি নাম, কি করে, কয় ভাই বোন? বাবা মা কি করেন বা করতেন, কোথায় থাকে এই সব খবর নিয়েছিস?

--- হ্যাঁ বাবা। ছেলেটির নাম সায়ন্তন, ইঞ্জিনিয়ারিং

পড়ে, লাস্ট ইয়ার। বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন। কোন ভাই বা বোন নেই। উনাদের আর কয়েক বছর চাকরি আছে। এই দুর্গাপুরের স্টিল

টাউনসিপে কোয়ার্টারে থাকে।

কয়েক দিন পর ছেলের বাড়ি থেকে মানস ,রীতা ফিরে এসে বললো - না মা তোর ওখানে বিয়ে করা উচিত হবে না। ওরা সাধারণ ভদ্রতা টুকু পর্যন্ত জানে না। খুব টাকার গরম।অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না।

--- ঈশিতা বললো - বাবা আমি উনাদের বাড়ি গেছি,ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি আমার তেমন মনে হয়নি। উনাদের উপরটাই ওরকম ভিতরটা খুব নরম। আমাকে তো এখন থেকেই বৌমা বৌমা বলেন। আমরা দুজনেই পড়া কমপ্লিট করি সায়ন্তন একটা চাকরি জোগাড় করুক তারপর

বিয়ে।

--- তাহলে তুই ও ছেলেটিকেই বিয়ে করবি আমাদের কোন কথা শুনবি না? ধমকের সুরে রীতা বললো।

--- খুব শান্ত ভাবে ঈশতা বললো - হ্যাঁ মা বিয়ে

আমি সায়ন্তনকেই করবো।

###

গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হতেই পালিয়ে বিয়ে করলো ঈশিতা। মাস কয়েক পরেই সন্তান সম্ভবা। সংসারের যাবতীয় কাজ ঈশিতাকেই করতে হয়, ।কারণ শ্বশুর, শ্বাশুড়ি দুজনেই চাকরি করে আর সায়ন্তন চাকরি করেনি এম টেক পড়ছে।

আদরে মানুষ ঈশিতা, সংসারের কাজ কাকে বলে জানতোই না। সেই ঈশিতা ভরা পেটে সংসার ঠেলে যাচ্ছে। অরুচি সব খাবারই, কিছুই খেতে পারছেনা। এই রকম অবস্থাতেই সংসারের সব কাজ মায় রান্না বান্না পর্যন্ত। কেউ কুটো কেটে দুটো করে না। সবাই সব সময় বসে বসে অর্ডার করে যায় এটা চাই ওটা দাও।অথচ এই ঈশিতা

যখন এই সংসারে আসেনি তখন সবাই সব করে খেয়েছে। ঈশিতার এই অবস্থাতেও কারো কোন মায়া দয়া নেই। কোন ডাক্তার দেখায়নি, ঈশিতা নিজে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে আসে। ডাক্তারবাবু বাড়তি ওষুধ লিখে দিয়ে বলে বাইরে থেকে কিনে নিতে। কিন্তু এরা কোন ওষুধ কিনে দেয়না।কিছুই যে খেতে পারে না

তাতেও কোন মাথাব্যথা নেই, কি খাবার হলে খেতে পারবে তার খর্ব কেউ নেয় না। এতো নিষ্ঠুর। এখন বুঝতে পারে বাবা মা ইনাদের ঠিক চিনে ছিলেন।

একদিন এক ঘটনা ঘটলো।পেটের সন্তান তখন সাত মাসের তখন চা নিয়ে ট্রে তে করে ঈশিতা ড্রয়িংরুমে আসছে, আর ওরা তিনজন মিলে টিভি দেখছে। হঠাৎ করে ঈশিতার মাথাটা ঘুরে গিয়ে

পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো।কাপ, প্লেট সব ভেঙ্গে গেল।যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আস্তে আস্তে মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়লো।

দেখলো যেখানে পড়েছিল সেখানেই পড়ে আছে

কেউ মুখে চোখে এক ফোঁটা জল ও দেয়নি, তুলে বিছানায় নিয়ে যাওয়া ডাক্তার দেখানো তো দূরের

কথা। ভাঙ্গা কাপ প্লেট গুলিও তেমনি পড়ে আছে।

দেওয়াল ঘড়িতে দেখলো রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, এই সুযোগে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাবে?

যাবার জায়গা বলতে তো বাপের বাড়ি। বাবা মা ছাড়া আশ্রয় দেবার আর কেউ নেই। বাবা মা কি ক্ষমা করে দেবে! আজ বছর খানেক তাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই।তারা কেমন আছে! আদৌ

বাড়িতে আছে কিনা কিছুই জানে না। মেনে নেবে

কিনা তাও জানে না। অনেক দ্বন্দ্ব আসছে মনে তবুও যেতে হবে, এখান থেকে মুক্তি চাই।

ঈশিতার বাবা মা ঈশিতাকে ক্ষমা করে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিল এই ভেবে যে তাদের মেয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাদের কোলে ফিরে এসেছে। মেয়ের অবস্থা দেখে রীতা খুব কেঁদে ছিল।

তারপর ঈশির জন্ম হলো। ঈশির বয়স যখন বছর খানেক তখন চাকরির জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলো।মাস ছয়েকের মধ্যেই চাকরি পেয়ে গেলো।

কিন্তু বাবা মায়ের শত অনুরোধের ও বিয়ে করলো না।

সেই একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেবে না। মেয়েকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। ছেলেটির বাড়িতে যাবে তাদের বোঝাতে। তাতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে বলতে হবে মেয়ের এইচ আই ভি

পজেটিভ। জীবন আর বেশি দিন নেই। সে নিজে

বাঁচবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছে কাউকে বাঁচতে দেবে না।তার এই মারন রোগের বীজ গেঁথে দেবে

বহু মানুষের মধ্যে। বলুন এ সব জেনে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন? দরকার হলে আরো নিচে নামবে, আরো কারণ মেয়েকে সুস্থ জীবন

দিতে হবে, সর্বোপরি সে যে মা।

                   

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩১ || Sarod sonkha 1431 || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র