লেখক সামসুজ জামান -এর একটি গদ্য

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা                  



ফেরিওয়ালার প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে বসে মনে হচ্ছে যে রক্তমাংসে গড়া আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই প্রতিনিয়ত এক একজন ফেরিওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কোন ফেরিওয়ালা ঘুরছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র অন্যের দরজায় পৌঁছে দিয়ে দু পয়সা রোজগার এর বিনিময়ে তার নিজের সংসার প্রতি পালনের উদ্দেশ্যে। কেউ আবার নেহাতই নিত্যনৈমিত্তিক স্থাবর প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিদীপ্তি দিয়ে অন্যের মানসিক ক্ষুধা নিভৃতের তাগিদে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। প্রথম জাতের ফেরিওয়ালার ক্ষুধা নিবৃত্তির আনন্দ আসল কিন্তু দ্বিতীয় ধারার ফেরিওয়ালাদের উদ্দেশ্য স্বর্গীয় আনন্দলাভ।

সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় স্তরের এই ফেরিওয়ালার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি অনেক কম বয়স থেকেই। তখন নিজেরই পঠন-পাঠন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে শুরু করি। এখন আমার জীবনসঙ্গিনী, তখন সে আমার গ্রামেরই এক সাদামাটা মেয়ে সামসামা, সে ই শুরু করেছিল আমারও আগে থেকে। তখন থেকে দুজনে একসাথে শুরু করেছিলাম গ্রামে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে সাক্ষরতা আর সচেতনতার ফেরি করার কাজ। সে এক নির্মল আনন্দলাভ। ক্ষেতে-খামারে কাজ করা পরিশ্রান্ত একদল নিরক্ষর মানুষকে নিয়ে ঘন্টাদুয়েকের একেবারে অন্যরকমের এক জীবন। আজ গর্ব হয় সামান্য আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে মাত্র দশ মাসের শিক্ষাবর্ষে সেই সব নারী পুরুষের কত জনের হস্তাক্ষর একেবারে মুক্তোর মত জ্বল জ্বল করত – কিভাবে যে কে জানে! বোধহয় আমাদের সেই ফেরিওয়ালার কাজে কর্তৃপক্ষ খুব সন্তুষ্ট হতেন , তাই মাঝে মাঝেই সেই সব পড়ুয়াদের আনন্দদানের প্রতি লক্ষ্য রেখে সাক্ষরতা প্রকল্প থেকে সাদা পর্দায় নানারকম চলচিত্র দেখানো হত, যেটা সেই সময়ানুপাতে কিছুমাত্র কম আনন্দপ্রাপ্তির বিষয় ছিল না। একই সঙ্গে গ্রামের বঞ্চিত সমস্ত মানুষজনই উপভোগ করতেন ব্যপারটা।   

সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় স্তরের ফেরিওয়ালা হিসেবেই নিজের পেশাগত কর্মজীবন শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের মনের মনিকোঠায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলাম। আন্দামানে পাড়ি দিয়ে কিছুদিন সরকারি মহাবিদ্যালয়ে আংশিক সময়ের অধ্যাপনা করে এবং পরবর্তীতে সরকারি শিক্ষা বিভাগে নিজেকে যুক্ত করে সেই মানসিক তৃপ্তি দানকারী ফেরিওয়ালা হিসেবেই নিজেকে নিবেদন করতে পেরে ধন্য হয়েছি। বাস্তবের খাওয়া পড়ার প্রয়োজন, স্ত্রী ও-কন্যা সন্তানদের প্রতিপালন করার জন্য অর্থ গ্রহণ করিনি একথা নিশ্চয়ই বলার চেষ্টা করব না। তবে শিক্ষকতা ফেরি করে ছাত্রছাত্রীদের মনের মনিকোঠায় পৌঁছানোর যে কি তৃপ্তি তা এককথায় অনির্বচনীয়!

আন্দামানে বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যগ্রন্থ মাতৃভাষায় ছিলনা এবং এ অভাব দীর্ঘদিনের। নিজের পেশাগত কাজে যুক্ত থাকার সুবাদেই কেন্দ্রিয় শিক্ষা বিভাগের জাতীয় শিক্ষা অনুসন্ধান ও প্রশিক্ষণ পরিষদ ( N. C. E. R. T.) – এর অধীনে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের বাংলা অনুবাদ ও উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত থেকে যখন এই কাজ কে সফল ও সার্থক করি এবং তারই স্বীকৃতিতে আন্দামান নিকোবরের সর্বোচ্চ প্রশাসক মাননীয় উপ-রাজ্যপালের প্রশস্তিপত্রের সম্মানে ভূষিত হই , তখন আবার মনে হয় স্বপ্ন ফেরি করা সার্থক হয়েছে।    

ভাবতেও অবাক লাগে নিজের কর্মজীবনের সূচনাপর্বে যাদের মুখে শুনতাম শিক্ষকতা পেশা খুব একঘেয়ে নিজে যখন সেই অনন্য পেশাটিকে গ্রহণ করলাম মন থেকে, তখন যে পরিতৃপ্তি লাভ করেছি, তা কিছুতেই ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো সম্ভব নয়। বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত জন যখন আন্দামান গিয়ে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমার মর্যাদার কিছু চিত্র দেখেছেন এবং আপ্লুত হয়েছেন, তখন নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। আর মনে হয়েছে অন্য কিছু ফেরি করে অর্থ উপার্জন হয়তো অনেক বেশি মাত্রায় করা সম্ভব হতো কিন্তু এমন সমীহ আদায় করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। ভাগ্যিস শিক্ষা ফেরি করার মন নিয়ে পথে নেমে ছিলাম! ফেরিওয়ালা হিসেবে জীবন ধন্য হয়ে গেছে।

আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ এ পি জে আব্দুল কালাম সাহেব বলেছিলেন যে, যে স্বপ্ন মানুষ কে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেয় সেটা সার্থক স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন সেটাই যা আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। বিন্দুমাত্র হলেও নিশ্চিন্তে ঘুমানোর স্বপ্ন না দেখিয়ে চেষ্টা করেছি তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। তাদের একজনেরও যদি মনের ভাব-ভাবনা থেকে রাতের ঘুম চলে যায় এবং তারা তাদের স্বপ্নকে সাকার করতে সফল হয়, তাহলে আমারও মনের কিছুটা আশা পূর্ণ হয়। তখন মনের আনন্দে আমিও নচিকেতার মত গান গেয়ে বেড়াতে পারি – “ আমি এক ফেরিওয়ালা ভাই ...., স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াই”!

                                      

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024