লেখক সুজিত চট্টোপাধ্যায় -এর একটি গদ্য

 ফ্যালো কড়ি মাখো তেল 




মেঘে মেঘে বেলা হলো । হবেই তো। এটাই কালের নিয়ম। ব্যাটারি কমজোরি হলে , ঘড়ি স্লো চলবে। উল্টোপাল্টা সময় দেবে। একদিন নিঃশব্দে থেমে যাবে। খেল খতম। 

কত বাসনা অপূর্ণ রয়ে গেল। থাকবেই।

আক্ষেপ, মানুষের জন্মগত অধিকার। তবে মুশকিল হচ্ছে , কী জানেন তো! 

 আকাশকুসুম বাসনা পূর্ণ হয়না। কত-কী পাবার ইচ্ছে । কাকের হঠাৎ ময়ূর পেখম মেলে নাচন ইচ্ছে হতেই পারে। 

কাক যদি গান ধরে , তাহলে চড়াই পাখি হি হি করে হাসে আর কোকিল মূর্ছা যায় । 


ইচ্ছের নাকি ডানা আছে। মেলে ধরলেই হলো। মর্ত্যলোক থেকে বৈকুন্ঠ লোক , উড়ে যাও পতপত করে। কেউ কাছা ধরে টানবে না। 

স্বপ্ন উড়ান ঘুড়ি আপনা আপনিই সুতো কাটা হয়ে লাট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে কার্নিশে কাতরাবে। কোলে মার্কেটের কুলি। পাহাড় প্রমাণ মোট মাথায় নিয়ে হেঁই হেঁই করে চলছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। যেন কত সহজ কাজ।

ওদিকে বলাই বাবুকে দেখুন । সামান্য লাউ কুমড়ো পটোলের আড়াই কিলোর ব্যাগ বইতে হিমসিম। সকলের পক্ষে সব কিছু সহজসাধ্য নয়। 


 কপাল ময় হাহাকারের আঁকিবুঁকি। দুর্ভাগ্যের জীবন ম্যাপ। 

নোবেল , অস্কার, ভারতরত্ন তো দূর, একটা লাগদাই সরকারি চাকরিও জুটলো না। টু পাইস ইধার উধার কামাতে না পারলে,,,,,, পানসে রে ভাই, পানসে জীবন। 

মুসুর ডাল আর বড়ির ঝাল। কোনও কোনও রোববারে , সানডে চিকেন। মানে পোলর্ট্রির পালক খসা মুরগির পেঁয়াজ রসুন দেওয়া ট্যালট্যালে ঝোল ছাড়া আর কিছুই জুটলো না। 

 জুটলো কী? বউ। 

সংসার ধর্ম বড় ধর্ম মা, তাই পারিনে ছেড়ে যেতে, 

রামপ্রসাদী গাইতে গাইতে , চান, খাওয়া , বাজার দোকান, এঁদো চাকরি আর মাঝরাতের ক্ষণস্থায়ী এন্টারটেটমেন্ট করে ব্যাটারি এখন টিমটিমে। 

নিভু নিভু। 

সেদিন, পাড়ার মুদির দোকানে বুক চিতিয়ে একজন মাঝবয়সী বীরদর্পে আস্ফালন করছিলেন,,,, জানো হে, , বিয়ে করেই ফেঁসে গেলাম। নইলে কত বাসনা ছিল , মানুষের জন্য কিছু করে যাবো। 

কিছুই হলো না। এখন এই পাঁচফোড়ন জীবন নিয়ে ন্যাটা ঝামটা হচ্ছি। 

বারফট্টাই সর্বস্ব মোড়লপনার কাল যাপন। নধর আপেলের মধ্যিখানে কালো পোকা। চেরাই না করলে আসল রুপ অধরা রয়েই যাবে। 

মানুষ চেনো হে মানুষ চেনো। 

আরে দূর মশাই,, জ্ঞান দেবেন নাতো। নিজেকেই চিনতে পারলাম না , বলে কিনা মানুষ চেনো ! 

যাক, যা বলছিলাম,,, 


হায়রে , কোথায় একটু রাজধানী কিংবা শতাব্দী এক্সপ্রেস। ঠান্ডা কামরায় ফুরফুরে জার্নি। কোথায় উড়োজাহাজের মেগা সুন্দরী লাস্যময়ী এয়ার হোস্টেসের মিষ্টিমুখ চপল হাসি। দুরদুর,, 

কপালে জুটলো লোকাল ট্রেনের ভেঁপু বাঁশি। 

রোজ সকাল আটটায় রেলস্টেশনে পালোয়ান ষাঁড়ের মনোবৃত্তি নিয়ে ট্রেনের অপেক্ষা। ট্রেন প্লাটফর্মে থামতে যা দেরী। শিং বাগিয়ে গোঁত্তা মেরে কোনক্রমে কামরায় সেঁধিয়ে যাও। ব্যস। আপদের শান্তি। আর চিন্তা নেই। মার দিয়া কেল্লা। অফিস যাত্রা সাকসেসফুল। 


বোস দা, আজকে টিফিনের কী আনলেন? 

বোস দা তিরিক্ষি মেজাজে বললো ,,, 

মণিমুক্তর চচ্চড়ি আর সোনার রুটি। কেন,, তুমি একটু চেখে দেখবে নাকি ? 

পাল দা, প্যাকেটের পানমশলার জাবর কাটতে কাটতে হেসে বললো,,,, চটছো কেন দাদা। আমোদ আহ্লাদ বলতে তো এইটুকুই অবশিষ্ট আছে। বাচ্চাদের মতো একটু ইয়ার্কি ফাজলামো। কলুর বলদের ঘানিটানা জীবন। শুধু নাজেহাল আর ন্যাজেগোবরে অবস্থা। 

রোজরোজ ওই একই রুটি চচ্চড়ি। টিফিনবাক্স খুলতেই ইচ্ছে করে না। 

বোস দা, কপাল কুঁচকে বললো ,,,,,, ভালো ভালো পছন্দসই কিমা কোর্মা মোগলাই খানা আনলেই পারো। কেউ তো মানা করেনি। 

পাল দা, বিরসবদনে বললো,,,,, ঠাট্টা তুমি করতেই পারো। কিন্তু নিজের বুকে হাত রেখে বলো দেখি,, তোমার মনে ক্ষেদ নেই , আফসোস ? 

বোস দা, ভিজে কাকের গা ঝাড়ার মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,,,,,, না, হয়না । কেন হবে শুনি। আমার যোগ্যতা কী? আমাকে যদি এই কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার করে দেয় । আমি পারবো সেই দায়িত্ব সামলাতে ? পারবো না। কেননা আমার সেই যোগ্যতাই নেই । সুতরাং আমার ওজন অনুযায়ী আমি ঠিক জায়গায় আছি। 

আচ্ছা পাল, কাল যদি তোমার এ-ই চাকরিটা চলে যায় , তুমি কী করবে ? তোমার কী তেমন কিছু যোগ্যতা আছে , যা দিয়ে তুমি আরও বেটার জায়গায় স্যাট করে ফিট হয়ে যাবে ? আছে? নেই । সোজা মোদ্দা কথা , নেই। যদি থাকতো , তাহলে এত বচ্ছর এ-ই ভাবে একই জায়গায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে না। সুতরাং আক্ষেপ করার কোন মানেই হয়না। আরে ভাই , ঘুন ধরা কাঠে ফার্নিচার হয়না। বড়জোর জ্বালানি হতে পারে। 


অতএব , নো আক্ষেপ। নো চোখ টাটানি। চোখ টাটানি থেকেই বুক টাটানি। হাসপাতাল , ডাক্তার , বাড়তি বিলের মারণ কোপ। সহানুভূতির দেনা। আত্মীয়দের অসহানুভূতির পিঠটান। বন্ধুত্ব পগার পাড়। একেই বলে সুখে থাকতে ভুতে কিলোনো। 


সেই কে যেন বলেছিল , জানালা খুলে দ্যাখো , তোমার চাইতে আরও অনেক দুঃখী মানুষ এই দুনিয়ায় মানিয়ে গুছিয়ে বেঁচেবর্তে আছে। পারফেক্ট প্রেসক্রিপশন। 

দুঃখী দেখে দুঃখ ভোলো। নইলে আতান্তরের একশেষ হতে হবে। 

সেই কথাটা মনে আছে তো ? ফ্যালো কড়ি মাখো তেল,,, ইয়েস স্যার। 

গরীবের কড়ি হলো কর্ম। মানানসই কর্ম। 

যতক্ষণ কর্ম , 

ততক্ষণ কড়ি । 

যতক্ষণ কড়ি , ততক্ষণ হরি। 

কেউ কারো নয়।

তাই যতক্ষণ বাঁচো,খোল করতাল সহযোগে, উদ্বাহু হয়ে নাচো আর গাও,,,, 

হরিবোল,,,, কড়িবোল,,,, কড়িবোল,,,, হরিবোল,,।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024