মুকুট
(৩)
মা, আমি বাবা-রে দেখছি। ভ্যানে কইর্যা আসতাছে।
তর বাবা মইর্যা গ্যাছে। অহন আর আইব না।
আমি মুখাগ্নি করছি- তাই না মা!
আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে কুসুম।
‘হ’ । একখান লঞ্চ আইতাছে।
মা, চাউল তো কেউ দেয় না।
কুসুম বলে- ঘরে ঘরে চাউলের অভাব নাই। রেশন কার্ড আছে।
আমাগো নাই!
নাই।
ক্যান মা!
একজন গঙ্গাসাগর যাত্রী কুসুমের আঁচলে সুগন্ধি চাল ঢেলে দেয়।
বাবু অর্থাৎ রাজেশের জিভে জল চলে আসে।
কতোদিন ভাত খাইনি তারা।
মা, ইন্ডিয়া আমাগো দ্যাশ না!
আমাগো দ্যাশ ‘বাংলাদেশ’। কুমিল্লা জিলা।
এবার রাজেশ বলে,
হেই যে দাদুর কাছে যাইছিলাম- ওটা কোন দ্যাশ আছিল-মা!
হেইডাও ইন্ডিয়া।
পেট পুইর্যা খাইতাম পারতি- না রাজেশ!
যাবা ‘মা’ দাদুর কাছে!
টেঁয়া লাগব তো!
সেই দ্যাশটার নাম কি মা!
শুনছি বিহার।
বুড়া বাবা কইছিলেন- আইবা যহন মন পুড়বো- চইল্যা আইব্যা।
তর বাপ বাঁইচ্যা ছিল তহন। মাঝির কাম জানতো আর রান্নাও জানতো।
আমরা চইল্যা আইলাম ক্যান!
পুড়া কপাল। তুর বাপে সপন দেইখত। আমাগো বাড়ি হবে, পাকা দালান। মানুষটা নেশায় নেশায় মইর্যা গ্যালো।
‘মুকুট’ মিষ্টি করে ডাকলেন বাবা-মশাই।
শুভ্র কেশের বৃদ্ধ মানুষটা অপরূপ দেখতে। গলার স্বরেও যেন জাদু-মাখা।
মুকুট প্রণাম করল।
তিনি বললেন- আমি তো সেই থেকে তোমার অপেক্ষায় আছি। মহাকাশ শিখবো তোমার কাছ থেকে।
মুকুট বলল- আমি তো তেমন কিছু জানি না।
বৃদ্ধ মানুষটি মুকুটকে অবাক করে দিয়ে বললেন- তুমি তো ফোটন কণা দেখতে পাও। পাও-না!
মুকুট অবাক হয়ে গেলো। সে তো ফিজিক্সের সেই টিচার ছাড়া কাউকে তেমন বলেনি।
এই সময় একজন এসে দাঁড়ালেন। বয়স প্রায় বৃদ্ধ মানুষটির সমান।
বৃদ্ধ বললেন- কেষ্ট-দা, মুকুটের অংকের ভয়টা আপনাকে কাটাতে হবে।
মুকুট স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে বলল- আমি এবার অংকে ‘৮৫’ পেয়েছি।
বৃদ্ধ বললেন- ‘১০০’ নয় কেন! ‘একশ’ পাওয়া খুব সোজা।
মুকুট ভাবলো, বাপ-রে, এটা কি কোন স্কুল! তাহলে ছুটি তো গেল।
এবার সেই কেষ্ট-দা বললেন- কোন ক্লাসে পড়ো মুকুট!
এবার ‘নাইন’ হল।
অ্যালজেব্রা শুরু হল। অংক আরো সোজা হয়ে গেল।
ঋত্বিক আর দেবলীনা বৃদ্ধ মানুষটিকে প্রণাম করলে তিনি বললেন- কেমন আছো? কতোদিন পরে এলে! এতোদিনে মনে পড়ল।
ঋত্বিক, দেবলীনা মুকুটকে নিয়ে যেন খুব পরম আত্মীয়ের বাড়ি এসেছে।
এবার সেই কেষ্ট-দা বললেন – কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরেও একটা বিন্দু রয়েছে।
বৃদ্ধ বললেন- ঘনত্বের কারণে রয়েছে।
লাঙল, বলদগুলি দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধের হাতে কাদা লাগে রয়েছে। তিনি ইঁদারায় গিয়ে সেই কাদা জল দিয়ে ধুতে লাগলেন।
কাঁসার বাটিতে মোটা দানার মুড়ি আর নারকেল এলো। তার আগে দেবলীনা, ঋত্বিক, মুকুট হাত-পা ধুয়ে নিয়েছে। ঘরটা দেখে বেশ ভালো লাগল মুকুটের। জানলা, দরজা বড় বড়। প্রচুর আলো, হাওয়া।
চন্দ্রমল্লিকা রয়েছে সামনের উঠোনে।
মুড়ি নারকেল খেতে খেতে ওরা প্রাঙ্গনে এলো। ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে হুঁকো টানছিলেন বুড়ো-বাবা।
সেই কেষ্ট-দা বলে মানুষটাও কাছের একটা চেয়ারে বসেছিলেন। মুকুটের বাবা ঋত্বিক বললেন- এবার নাকি পাট চাষ করেছেন।
বৃদ্ধ হুঁকোটা নামিয়ে রেখে বললেন- এবারও মাঠে চাষ করতে যাবে তো!
ঋত্বিক বলল- আমার ভয় কেটে গেছে।
দেবলীনা লাল পাড়ের শাড়ি পরেছে।
বলল- বাবা-মশাই, ধানসেদ্ধ করতে যাবো!
বৃদ্ধের মুখমণ্ডলে এক অপূর্ব হাসি খেলে গেল, তিনি লক্ষ্মী-মা আমার। এখন কিছু করতে হবে না।
দাদু-ভাই আসছে জেনে তরকারিতে ফুলকপি দিতে বলেছি। আর একটা ডালনা করতে বলেছি।
পাঁচফোড়ণ ছাড়া হয়েছে কড়াই-তে, চমৎকার গন্ধ নাকে এলো মুকুটের।
কেষ্ট-দার আসল নাম কথায় কথায় জানা গেলো। বিখ্যাত বিজ্ঞানী। মহাকাশ নিয়েই চর্চা করছিলেন, তারপর একদিন এখানে আসতেই আর ফিরলেন না। ভালোবেসে ফেললেন বাবা-মশাইকে।
একটা স্কুল আছে কাছে-ই। বৃদ্ধ সেখানে অনাথ বা গরীর ছেলেদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছেন। নাম রেখেছেন- ‘তপোবন’।
ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে বললেন বৃদ্ধ, ‘এক লহমায় কেষ্ট-দা বিজ্ঞানীর চাকরি ছেড়ে আমার সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন’।
কেষ্ট-দা, কি ভালো লেগেছিল আমার!
কেষ্ট-দা হেসে বললেন- বিজ্ঞানের ফলিত রূপগুলি দেখতে পাওয়া আর মানুষের কল্যাণে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
দেবলীনা বলল- বিশ্বজিৎ বাবুই ওঁকে স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিলেন!
কেষ্ট-দা হেসে বললেন- হ্যাঁ মা, ঠিক ধরেছ। মনের দিক থেকে পরিশ্রান্ত হয়ে যসিডি নেমেছিলাম।
পরদিন ভোরে কৃষিকাজে ঋত্বিক ও গেলো। ফিরে এসে তাবুতে বসলেন বুড়ো মানুষটা। এর আগে অনেক কিছু দেখতে পারেনি দেবলীনা আর ঋত্বিক। সেবার তারা এসেছিল দিগভ্রান্ত, দিশেহারা। আশ্রয়, খাওয়া-দাওয়া আর কিছু শ্রম-নির্ভর কাজ করেই তিনটে দিন কেটে গেছিল।
এবার তারা দেখল অনেকটা আশ্রমের মতোনই। তবে কোন প্রার্থনা, সাকার ঈশ্বর নেই। এখানে ঈশ্বর কাজ। ভিত্তি কৃষি।
ক্রমশ...
No comments:
Post a Comment