Sunday, August 1, 2021

রামপ্রসাদ সরকারের একটি প্রবন্ধ

 হর্ষে বিষাদে স্মৃতিমেদুরতায় ভরা কলকাতা বইমেলা






বইমেলা মন ও আনন্দের উৎস। এটি আমাদের মনকে প্রসারিত করে; আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। 

মানুষের ঞ্জানের ভাণ্ডারকে  সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান হলো বই। এই প্রসঙ্গে পারস্য কবি ওমর খৈয়ামের একটি উক্তির কথা মনে পড়ে গেল। বই সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন—

“ রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়”। 

করোনার করাল গ্রাসে তিন বছর ধরে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। আমরা পুস্তক প্রেমীরা হতাশ ও খুবই মনোকষ্টে রয়েছি। পুস্তক ব্যাবসায়ি, প্রকাশন সংস্থাগুলো হতাশা গ্রস্ত।কচিকাঁচার দল নতুন বই পাবার আনন্দ ও নতুন বইয়ের মন ভরিয়ে তোলার গন্ধ থেকে বঞ্চিত। 


কলকাতা বইমেলাকে আমরা কেউই ভুলতে পারিনা। আপামর বাঙালি মজ্জায় রক্তে রক্তে জড়িয়ে আছে। তাই তো বইমেলার সময় এলে অথবা কোনো অবসর মুহূর্তে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে, চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। স্মৃতির বীনায় বইমেলার সেইসব ফেলে আসা দিনগুলো ঝঙ্কার তোলে। 

      ||দুই||


কলকাতার প্রাণকেন্দ্রের ফুসফুস কলকাতা ময়দান আপামর বাঙালির কাছে স্মৃতিমেদুরতায় ভরা এক নস্টালজিয়ার প্রতীক। বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। চর্তুদশ পার্বণটি হল ‘কলকাতা বইমেলা’। কলকাতা বইমেলার একত্রিশ বছরের স্থায়ী ঠিকানা ছিল এই কলকাতা ময়দান। তারপর সে তার ঠিকানা বদলাতে বদলাতে ২০০৯-এ থিতু হয়ে বসে মিলন মেলা প্রাঙ্গণে। অবশেষে সল্টলেকে করুণাময়ীর সেন্ট্রাল পার্কে।

কলকাতা বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি পায়। তারপর বদলেছে তার অনেক কিছু। বদলায়নি শুধু চেনা-অচেনা বইয়ের গন্ধ। যা আজও মানুষকে মেলামুখি করে তোলে এক অমোঘ আকর্ষণে। আমিও এর ব‌্যতিক্রমী নই।

আজ বয়োপ্রান্তে এসে যখন আমার মননে জড়িয়ে থাকা বইমেলার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবি তখন নস্টালজিক হয়ে পড়ি।

বইমেলার শুরুতে প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি বছর কর্মসূত্রে কলকাতার বাইরে থাকায় শত ইচ্ছে থাকলেও প্রতিবছর বইমেলায় আসতে পারিনি। ১৯৮০ সালে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাসের পর প্রতি বছর বইমেলায় গেছি। তখন টিকিট কেটে বইমেলায় ঢুকতে হত। টিকিট পাওয়া যেতো শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনের বিশেষ কাউন্টারে। আর মেট্রো স্টেশনগুলোয় বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে। কী বিরাট লাইন হতো। তাই প্রতিবারই আগেভাগে টিকিট কেটে রাখতাম। 

প্রথম প্রথম ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। তখন তাদের বাল‌্য ও কৈশোরের সন্ধিক্ষণ। বই পড়ে তারা জানতে চায় পৃথিবীটাকে, বাংলার সংস্কৃতিকে, সাহিত‌্যকে। তাই তাদের মনের খিদে মেটাতে তাদের মনোজগতের বই কিনে দিয়েছি বইমেলার স্টল থেকে— হয়তো বা নামী প্রকাশকের স্টলে ভিড়ের মধ‌্যে ঢুকে বা দীর্ঘ লাইন দিয়ে। বইগুলো হাতে নিয়ে তারা বইয়ের গন্ধ শুঁকে বইগুলো বুকে জড়িয়ে কেমন গর্বের হাসি হাসতো। তাদের সেই অনাবিল হাসি আজও আমার মানসপটে ভেসে ওঠে।

একটু বড় হতে তারা নিজেরাই বইমেলায় যাতায়াত শুরু করলো। আমি কিন্তু একা হয়ে পড়িনি। ততদিনে লেখালেখির সুবাদে বেশ কিছু পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে হৃদ‌্যতা গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে মেলায় ঘুরেছি, আড্ডা মেরেছি প্রচুর। একসময় ক্লান্ত হয়ে ময়দানের ফাঁকা জায়গায় বসে পড়েছি। ভ্রাম‌্যমান চা-ওয়ালার কাছ থেকে চা কিনে গলা ভিজিয়েছি, ঝালমুড়ি খেয়েছি। তখনকার দিনে আজকের মতো মেলার খাবারের স্টলের রমরমা ছিলনা।

আমাকে বেশি আকর্ষণ করতো লিটল ম‌্যাগাজিন প‌্যাভিলিয়ন। আমার পরিচিত বেশ কিছু লিটিল ম‌্যাগাজিনের সম্পাদকেরা এই প‌্যাভিলিয়নে তাদের পত্রিকা/বই সাজিয়ে বিক্রি করার সুযোগ পেতেন। তাদের টেলিব স্পেস ও চেয়ার দেওয়া হতো। পরিচিত সম্পাদকদের স্টল ঘিরে আমাদের আড্ডা বসতো। সাহিত‌্য নিয়ে আলোচনা করেছি, তর্কাতর্কি হয়েছে। আবার চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে যে যার পথ ধরেছি।

এই প্রসঙ্গে একজনের কথা খুবই মনে পড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের মধ‌্যমণি পরম সুহৃদ ও হিতৈষী আমাদের লিটিল ম‌্যাগাজিন সম্পাদক সমিতির সম্পাদক নবকুমার শীল মহাশয়। সদা হাস‌্যোজ্জ্বল সুদীর্ঘ ও সুপুরুষ সাদামাটা নবদা (আমরা তাঁকে নবদা বলেই ডাকতাম) মেলা চলাকালীন লিটিল ম‌্যাগাজিন প‌্যাভিলিয়ন ঘুরে সবার সুবিধে অসুবিধের খোঁজ খবর নিতেন, প্রয়োজনে প্রতিকারের ব‌্যবস্থা করতেন। তাঁর আকস্মিক অকাল প্রয়াণে আমরা যারা লিটিল ম‌্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলাম। তাঁর মৃত‌্যুর পর যতবার বইমেলায় গেছি তাঁর হাস‌্যোজ্জ্বল মুখ মানসপটে ভেসে উঠেছে।

১৯৮৩-র বইমেলা। সেদিনও সদলবলে গেছি। মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মেলার মূল মঞ্চে তখন বই প্রকাশ অনুষ্ঠান চলছে। মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনদের মধ‌্যে ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার কর্ণধার ও সম্পাদক অশোক কুমার সরকার মহাশয়। দর্শক ও শ্রোতার সংখ‌্যা নেহাত কম নয়। আমরাও উপস্থিত ছিলাম। বক্তৃতা মঞ্চে সংবাদপত্র জগতের কিংবদন্তি পুরুষ অশোক সরকার মঞ্চে উঠলেন, বক্তৃতা শুরু করলেন। মাঝপথে হঠাৎ ভারসাম‌্য হারিয়ে ডায়াসের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। আমরা সবাই হতভম্ব। ডাক্তার ছুটে এলেন, অ‌্যাম্বুলেন্স এলো। ততক্ষণে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। শোকের ছায়া নেমে এলো মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে।

হঠাৎ ভারী হয়ে উঠলো মেলার বাতাস, ভারী মানুষের মন। নিঃশ্বাস নিতে সবারই কষ্ট হচ্ছিল। অশ্রু সজল চোখে আমরা মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বিদায় নিলাম। মহীরুহ পতনের ছবি ও খবর পরের দিন সব সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে প্রকাশিত হলো। সংবাদপত্র জগত সত‌্যি একজন দরদী প্রকৃত সাংবাদিককে হারালো। 

৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭। সেদিন কোনো কারণে বইমেলায় যাওয়া হয়নি। সন্ধ‌্যে বেলায় টিভি-র পর্দায় দেখলাম বইমেলার একটা অংশ দাউদাউ করে জ্বলছে। মেলায় আগত মানুষজন দিকবিদিক জ্ঞান শূন‌্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। দমকলের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। একজনের মৃত‌্যু ঘটে।

সেদিনের মতো মেলা পরিত‌্যক্ত হয়। আমরা বইমেলা প্রিয় মানুষ মুষড়ে পড়ি। টিভির পর্দায় বই জ্বলতে দেখে মনে হচ্ছিল যেন নিজের গায়েই আগুন লেগেছে। এমনই ছিল আমাদের বই প্রীতি।

তদানীন্তন তথ‌্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী (পরবর্তী কালে রাজ‌্যের মুখ‌্যমন্ত্রী) শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ‌্যোগে তিনদিনের মধ‌্যে মেলা আবার শুরু হয়।

মেলা চালু হয়ে গেলে দু’দিন পরে মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে পুড়ে যাওয়া অংশের ধ্বংস স্তূপের সামনে থেকে একটা পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া কয়েন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। সেটি বেদনার স্মৃতি চিহ্ন হয়ে আজও আমার কাছে রাখা আছে। 

এখন আমি ‘দিনশেষের শেষ খেয়া’র অপেক্ষায় বসে আছি। তবুও বইমেলার আকর্ষণ আজও সমানভাবে অনুভব করি।

অবসর সময়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা যখন ভাবি, বইমেলা প্রাঙ্গণে কাটিয়ে আসা দিনগুলোর ছোট ছোট কোলাজ মনের ক‌্যানভাসে ভেসে ওঠে।

আমার স্বজনদের চোখ দিয়ে এখন আমি বইমেলা দেখি। আমার বই পড়ার নেশাকে, বই কেনার উচ্ছ্বাসকে তারা ব‌্যাগ ভর্তি করে এনে আমার মনোজগতে ছড়িয়ে দেয়। তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে আমার চোখে মুখে।



No comments: