Monday, August 9, 2021

লেখক ইন্দ্রনীল সাধুখাঁ -এর একটি গল্প

 ড্রপলেট



বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে।আজ তেমন কোনো কাজ নেই রূপায়ণের।নিজের থ্রি বিএইচকে এর ফ্ল্যাটের ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে রূপায়ণ।বৃষ্টি ওর ভালই লাগে, আবার এই বৃষ্টিই সামান্য বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দেয় ওর মনটাকে প্রতিবারই।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না,ঘোলা আকাশের মত তার মনটাও আজ গুমোট করে আছে।একফোঁটা বারিবিন্দু তার মোলায়েম গেল বেয়ে নেমে এসে ঠোঁট স্পর্শ করলো।বৃষ্টির জলটাও আজ নোনতা লাগছে তার।রুমে ফিরে এলো সে।

ফ্ল্যাট টা ও নিজের হাতে সাজিয়েছে খুব যত্ন করে।এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে মানুষ বলতে ও শুধু একাই থাকে।মাত্র ১৫ বছর বয়সে ঘর ছেরেছিল রূপায়ণ,নিজের স্বপ্ন,নিজের ইচ্ছা গুলোকে পূরণ করার তাগিদে।কেউ সাথ দেয়নি তার,কেউ তাকে বোঝেনি,শুধু লাবণ্য ছাড়া।লাবণ্য,রূপায়ণের ছোট বেলার বন্ধু,একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে ওরা।ওদের বন্ধুত্ব টা একটু আলাদা রকমের,ওরা দুজনেই পৃথক কিন্তু একটা জায়গাতে ওদের দারুন মিল।ওরা দুজনেই অবহেলিত।রূপায়ণ এই সমাজ,তার পরিবারের কাছে অবহেলিত আর একই ভাবে লাবণ্যও নিজের পরিবারের কাছে বিশেষ করে মায়ের কাছে অবহেলিত।লাবণ্য অনেক চেষ্টা করেছিল রূপার সাথে বন্ধুত্ব ভেঙে ফেলার,কিন্তু এই একটা মাত্র কারণের জন্য সে বারবার নিজেকে দমিয়ে দিয়েছে।লাবণ্য জানে ও ছাড়া রূপার আর কেউ নেই।আর একটা কারণেও সে রূপায়ণ কে ছেরে যেতে পারবেনা কখনোই,কারণ খুব ছোট থেকেই সে রুপাকে ভালোবাসে,কিন্তু কখনোই তাকে জানতে দেয় নি।অবশ্য একবার চেষ্টা করেছিল জানাবার,কিন্তু তাও বিফল হল।

সেদিন রূপায়ণের পনেরো বৎসরের জন্মদিন উপলক্ষে তার বাড়িতে অনেক আত্মীয় - বন্ধু উপস্থিত ছিল। লাবণ্য ও চলে এসেছিল তাড়াতাড়ি।সে রূপার ঘরে ঢুকে তার পড়ার ডেস্ক এ নিজের হাতে তৈরি করা একটা শুভেচ্ছা পত্র আর একটা চিঠি একই খামে পুরে সযত্নে রেখে দিয়েছিল আর সুন্দর করে খামের উপরে রূপায়ণের নাম লিখেছিল।রূপায়ণ তখন ঘরে ছিল না,তৈরি হচ্ছিল পাশের রুমে।সরা বাড়ি জুড়ে খুব ব্যস্ততা - কোলাহল হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল রূপার বাবার চিৎকারে।হঠাৎ করেই তিনি ঢুকে পড়েন রূপায়ণের রুমে,যেখানে রূপায়ণ ড্রেসিং টেবিলের সামনে তার মায়ের লিপস্টিক হতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আর তার ঠোঁট দুটো উজ্জ্বল লাল রঙে রঙিন হয়ে ছিল।বাবার চিৎকারে পাথর হয়ে যায় সে,পরক্ষনেই তার হাত থেকে ছিটকে পরে লিপস্টিক টা আর সঙ্গে সঙ্গেই গোটা বাড়ির লোক জড়ো হয় রুমের সামনে।সবার সামনে সেদিন দারুন অপমানিত হয়েছিল রূপায়ণ।যে ঠাকুমা তাকে এত ভালোবাসতেন তিনি সেদিন তার মুখে থুতু ছিটিয়ে বলেছিলেন, "মরার আর জায়গা পেলি না।মুখপোড়া মাগী!দুর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে।"তার বাবা তাকে সবার সামনে জুতো পেটা করে বের করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।পরিবারের সবার কাছে নানা কথা শুনতে হয়েছিলো সেদিন তাকে।এমনকি নিজের মায়ের কাছেও ছার পায়নি সে।তার সব বন্ধুরা ঠাট্টা করেছিলো সেদিন তাকে নিয়ে।লাবণ্য শুধু সবার আড়ালে দুচোখ লাল করে কেঁদেছিল সেদিন,আর তার দেওয়া খাম টা নিয়ে রূপার সাথে বেড়িয়ে এসেছিল সে বাড়ি থেকে।সেদিন থেকেই রূপা লাবণ্যর সাথে থেকেছে লাবণ্যর মামাবাড়ীতে।লাবণ্য মামাবাড়ীতেই থাকতো ছোট থেকে,কারণ খুব ছোটবেলায় তার মা মারা যান।তারপর যদিও তার বাবা একটা বিয়ে করেছিল,কিন্তু লাবণ্য ছিল সৎ মায়ের চোখের বালি।তাই ওর দিদা ওকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছেন।সেদিনের ঘটনার পরেই লাবণ্য প্রথম বুঝতে পারে যে রূপায়ণ সাধারণ নয়,ও আমাদের থেকে আলাদা,শুধু আলাদাই নয় ও আমাদের থেকে উৎকৃষ্ট।লাবণ্য বুঝেছিল যে রূপায়ণ আসলে শিবের মত অর্ধনারীশ্বর,ওর একই শরীরে নারী ও পুরুষ উভয়েরই বাস।আরো একটা জিনিস সেদিন ও বুঝেছিল,রূপায়ণের আসল পরিচয়টা হল,সে একটা উৎকৃষ্ট মানুষ।সেদিন রাতে খাম থেকে চিঠিটা বের করে নিয়ে গ্রিটিংস কার্ড শুদ্ধ খাম টা দিয়েছিল রূপার হতে।কারণ অনেক ভাবনা চিন্তার পরে সে ঠিক করেছিল কিছু কিছু কথা না বলাই ভালো,তাতে অনেক বিপত্তি এড়িয়ে যাওয়া যায়।কার্ড টা হাতে পেয়ে খুব আনন্দিত হোয়েছিল রূপায়ণ সে রাতে।সেদিনের পরে অনেক গুলো বছর কেটে গেছে ; অন ক গ্রীষ্ম এসেছে,অনেক বর্ষা চলে গেছে।আজ রূপায়ণের ৩৫তম জন্মদিন।আজকেও লাবণ্যর আসার কথা আছে এই ফ্ল্যাটে।দুবছর হয়েছে রূপায়ণ ফ্ল্যাট টা কিনেছে।বৃষ্টি তে ভেজা কাপড় ছেড়ে রেখে রূপায়ণ একটা ভালো সলোয়ার পরে সোফায় বসে আছে,তার পায়ের কাছে বিস্কুট খালি কাঁচের বোতল টা নিয়ে খেলা করছে।রূপায়ণের পোষা কুকুরটার নাম ' বিস্কুট '।আজকের বৃষ্টির আবহটা হয় তো একটু বেশীই বিষাদময়,সেটা যেন চার দেওয়াল ভেদ করে এই ঘরেও ঢুকে পড়েছে।সোফায় বসে আছে রূপায়ণ,তার হাতে ধরা বহুবছর আগের সেই খাম,জার উপর লাবণ্যর নিপুণ হাতে লেখা আছে রূপায়ণের নাম।বিষাদময় অবহাওয়ার জন্য কোয়েক ফোঁটা বৃষ্টি লবণাক্ত জল টপটপ করে খামের উপর পড়ল।রূপায়ণের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ,সে কাঁদছে।কিন্তু কেন এই কান্না?আজ সে প্রতিষ্ঠিত,নামকরা নৃত্যশিল্পী।তাকে আর রাস্তা দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে হয় না।সবাই আর তাকে নিয়ে ঠাট্টা - তামাশা করে না।কিন্তু সে জানে,এই সমাজের সিংহভাগ মানুষই আজও পিছনে পিছনে তাকে ছক্কা - হিজরা ইত্যাদি সর্বনামে সম্বোধন করে,ওর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা,সম্মান,ভালোবাসা এসবই আসলেই মেকি।এই সমাজ এখনও তাকে তার মতো করে মেনে নিতে পারেনি।এইসব সাত - পাঁচ ভেবেই আজ সে এত ভেঙে পড়েছে।নিজের কান্নাকে নিজের থেকে লোকানোর জন্য সে একটা সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে খাম টা সোফায় ফেলে রেখে নাচ তুলতে লাগলো।নাচ করতে করতে হঠাৎ বসে পরলো মেঝেতে,তার তলপেটে আর কোমরে ভীষণ ব্যথা করছে,এতটাই তীব্র সেই ব্যথা,যে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না।ব্যথার চোটে সেখানেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলো।জ্ঞান যখন ফিরলো সে তখন নিজেকে হসপিটাল এর বেড়ে আবিষ্কার করলো।দেখলো পাশে লাবণ্য দাঁড়িয়ে,সে ই ওকে হসপিটালে এনেছে।

ডাক্তারের সাথে কথা বলে লাবণ্য জানতে পারে,বহুবছর ধরে নিয়মিত ড্রিঙ্ক করার জন্য রূপা প্যানক্রিয়েটিস ডিস অর্ডার এ গুরুতর ভাবে আক্রান্ত হয়েছে।অবস্থা খুবই খারাপ।প্রায় এক সপ্তাহ হসপিটালে কাটানোর পর যেদিন রূপা বাড়ি ফিরলো সেদিন রাতেই আবার প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করতে করতে নিজের ফ্ল্যাটে সে তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল।

সমাজের কাছে - পরিজনদের কাছে লাঞ্ছনা শুনে,প্রতিনিয়ত তাদের কাছে নতুন করে অপমানিত হতে হতে মানুষটা নিজের কাছেই অবহেলিত হতে শুরু করে আর এইসবের থেকে একটু শান্তি পাওয়ার আসায় নেশা করা শুরু করে,এটা না বুঝেই যে,একটু শান্তি পাওয়ার জন্য সে যে জিনিসটাকে কাছে টেনেছে সেটাই একদিন তাকে চিরজীবনের জন্য শান্তি প্রদান করবে,অন্য কারোর শান্তি ছিনিয়ে নিয়ে।


                   

No comments: