লেখক আশীষ কুণ্ডু -এর একটি গল্প

হরেনের রোজনামচা 




হরেন ঘোষ,ওরফে হরু, গলায় সুর আছে, টিকালো নাক, রং ফর্সা,তামাটে হয়ে গেছে রোদে পুড়ে জলে ভিজে। বৈশাখের সকাল।রোদ্দুর বেশ চড়া। হালকা চালে, 'এসো হে বৈশাখ,এসো, এসো,'গাইতে গাইতে খাড়া নাকের অহংকার নিয়ে বুক চিতিয়ে চলেছে হরেন।পাড়ার বখাটেরা উপেক্ষায় হরেনকে " নাকু" বলেও ডাকে। ছাতি তার চওড়া নয়,তবু ব্যক্তিত্বে মাত্রা আনতে হাত দুটো কাঁধ থেকে দূরত্বে ছড়িয়ে চলে সে। হরেন চলেছে বাজার, ঢোলাজামায় বেশ একটা বিস্তার নিয়ে ,তখনই ছন্দপতন। একেবারে নাকের ডগায় ফাজিল চড়াইয়ের পুরীষ।অগ্নিশর্মা হয়ে পক্ষীকুলের উদ্দেশ্যে গালিটা ছিটকে বেরোনোর মুহূর্তে- হরু, নিজেকে সামলে নাক পুঁছে, চরম বিরক্তিতে রুমাল ছুঁড়ে ফেললো  নালায়। 

মুখ কুঁচকে বাড়িতে ঢুকতেই,বৌয়ের খপ্পরে- "কি হোলো পাওনাদার বুঝি?”

‘ন-নাঃ’-এখন আবার ফিরিস্তি চাইবে বোসের বেটী , কি জ্বালা',মনে মনে এইসব ভাবনার মধ্যেই আড়চোখে হরেন দেখে তনিমা নজর রাখছে। এই ভঙ্গির তাৎপর্য জানে হরেন, ভয়ে পেটের ভিতর গুড়গুড়।কোনোমতে টয়লেটে ঢুকে হাঁফ ছাড়ে। বাইরে তনিমার তর্জন গর্জন শুরু হয়েছে। ভিতরে জল চালিয়ে দেয় হরেন, আর শুনতে হবে না ফাটা কাঁসরের শব্দ - বৌয়ের ! তনিমা কিছুক্ষণ লম্ফঝম্প করতে থাকে,"খুব বাড় বেড়েছে, আমার প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করে না, ভেবেছেটা কি?' শেষে তনিমা হরুকে জব্দ করার ফন্দি এঁটে,  রান্নার গ্যাস বন্ধ করে সোজা বেডরুমে ।বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে রান্নাঘরে হরেন বোঝে , 'আজ হাঁড়ি ঠেলতে হবে,"-মনে মনে বৌকে শাপ-শাপান্ত করলেও,ডাকার ইচ্ছে হোলো না ,নিজের নাক কাটা যাবার ভয়ে। ঘরে বাইরে এই নাক কাটার আতঙ্কে দিন কাটছে তার।ছেলে তপন সকাল থেকেই  হাওয়া।তড়িঘড়ি বাসি ভাত খেয়ে কি একটা পরীক্ষা দিতে গেছে। রান্না কোনোমতে শেষ করে হরেন। 

দুপুরের খাওয়া সুখকর হোলো না। অনুরোধ করতে তনিমা এসে খেতে বসলো বটে, কিন্তু হাজারো খুঁত কাটতে লাগলো, 'নুন বেশী',  'বিস্বাদ',-। 

রাগ হলেও বৌয়ের বাক্যবাণ সহ্য করে গেলো হরেন।পার্টির কাছে পেমেন্ট আনতে যাবার ছিলো, সেটা হোলো না। 

হরেন  অর্ডার সাপ্লায়ার। ইদানীং কারখানার একটা অর্ডার নিতে গিয়ে বড় লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। দেনা হয়ে গেছে বেশ খানিকটা । পাওনাদার নাকাল করছে।  নিত্যদিনের পূজোর শেষে ঠাকুরকে আকুল হয়ে ডাকে হরেন, "দিন ফেরাও ঠাকুর, একটা লটারী না হয় পাইয়ে দাও, তাহলেই ওই রক্তচোষা বজ্জাতগুলোর মুখে টাকাটা ছুঁড়ে ফেলা যায়, দেনার দায়ে চুল বিকিয়ে যাবার জোগাড়, একটু মুখ তুলে তাকাও ঠাকুর", কিন্তু ঠাকুরের কি অত সময় আছে তার কথা শোনার !নিত্যপূজো সেরে-সকালের দিকে অর্ডার নিতে যাওয়া ,কখনও মার্কেটে- কখনও কারখানায়, বিকেলটা তাগাদায় সময় কাটে। 

সেলুনে চুল  কাটছিল হরেন। চুল বড় হলে গরমে অস্থির লাগে, তাই আসা। আর তখনই 

রাজু ঢুকলো সেলুনে, দাড়ি ট্রিম করবে। এই অঞ্চলের একছত্র অধিপতি। ধপ করে ভারী হাতটা হরেন কাঁধে রেখে বলল, " কি হরু, চুল কাটতে এসেচিস -ভাল-- তা ঘনশ্যামের

পয়সা দিচ্চিস না কেন? " সেলুনের বাইরে 

কালো কুকুরটা তখনই বুক কাঁপিয়ে ভ-ভৌ- ভৌ করে ডেকে উঠলো। 

হরেন বিপদ বুঝে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, "দশ পনেরো দিনের মধ্যেই দিয়ে দেবো "

--"মন্-নে থাকে যেন, না হলে- কুচ করে তোর 

নাকটা কেটে নিয়ে যাববো।"

অপমানিত হরেন বাড়ী ফিরলো আষাঢ়ে মুখ 

নিয়ে। তনিমার আজ মুড ভালো, তাই মজা 

করে বললো, " কি হোলো নাকু, মুখ হাঁড়ি কেন? "বলেই নাকটা মুলে দিলো। নাকটা বরাবরই হরেনের অহং-এর জায়গা। আর তাতেই হাত। 

রাগটা জমা ছিলোই,এবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হরেন একেবারে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে বলে উঠলো, " তোমার বাবা কি এই শিক্ষা দিয়েছেন? "

আগুনে ঘৃতাহুতি। হিংস্র বাঘিনী এরপরে ঝড় তুলতে যাচ্ছিলেন।তপন,তাদেরএকমাত্র ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলো, "বাবা,আমার এইচএসের রেজাল্ট বেরিয়েছে, "ছেলের কথায় হরেনের সম্বিত ফেরে।                     "বাবা, সাইবার কাফে চলো"- -  ডাউনলোড করে দেখা গেলো তপনের প্রাপ্ত নম্বর আটানব্বই শতাংশ। কাফে থেকে বেরিয়ে, গ্রীষ্মের শুষে নেওয়া রোদ্দুরে হরেন ছেলের হাত ধরে  চলেছে। মন খুশিতে টইটম্বুর। রাস্তা শুনশান।দুপুর বারোটা।চেনা কাউকে দেখতে পাচ্ছে না হরেন,যাকে এই খবরটা দেওয়া যায় । তখনই কে যেন পিছু ডাকে, "নাকুদা গেছিলে কোথায়? "  -খুশিতে মন ভাসছে, তাই আর রাগ করলেন না, ঘুরে তাকাতেই দেখলেন পটাদাকে। পটাদাকে দেখলেই কেন  যেন মনে হয় সন্ধ্যা আসন্ন, গায়ের রং এতটাই কালো। এই সব অদ্ভুত অনুভূতি সবসময় মনে খেলা করে হরেনের। শান্ত স্বরে বলে হরেন, "ছেলের রেজাল্ট  দেখতে ",। মনে মনে হরেন চাইছে,- 'রেজাল্ট কেমন হয়েছে ' --এই প্রশ্ন উঠুক।

কিন্তু তা হোলো না, উল্টে সংক্ষিপ্ত "ওঃ" বলে কেটে পড়ে পটাদা। 

বাড়ী ফিরতে গিন্নি একেবারে গদগদ ছেলের রেজাল্ট শুনে,একটা আস্ত রসগোল্লা ছেলেকে খাইয়ে ,তাকালেন হরেনের দিকে, "তোমার তো আবার সুগার"।যাচ্চলে, সুগার, -এই খবর তো হরেনের নিজের ও অজানা । 

যতদিন যাচ্ছে রহস্যময়ী ভয়ঙ্করী হয়ে উঠছেন। সবে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো,ছেলে সামাল দিলো, "দাও, দাও,বাবাকে মিষ্টি দাও।" 

জয়েন্টে খুব ভালো করলো ছেলে। ফলতঃ চিন্তায় পড়ে গেলেন হরেন। একে মাথায় দেনা, ছেলেকে ভর্তি করাবেন কি দিয়ে? 

রাতে চোখের দুপাতা এক করতে পারেন না।তপন জেলায় প্রথম হওয়ায় কালেক্টর সংবর্ধনা দিলেন,সাথে পঞ্চাশ হাজারের চেক। ছেলেকে নিয়ে গর্বের এই মুহুর্তে, হরেনের মনে পড়ছিল, নিজের কৈশোরের কথা। সালটা 1980।মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। তখন নেট ছিলো না। পাড়ার মোড়ের দোকানে বোর্ড থেকে আনা জোড়াশ্বথতলা স্কুলের রেজাল্ট টাঙিয়েছিল পিন্টুদা। সেবার হরেন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলো। সবাই ধন্য ধন্য করছিলো।পরের দিন বাবার বন্ধু , মৃণালকাকু কলকাতা থেকে ভীম নাগের সন্দেশ এনে খাইয়েছিলেন। সবাই বলছিলো,এ ছেলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে যায় না।কিন্তু ভাগ্য কাকে কোথায় নিয়ে যায়!শেষে প্লেন বিএসসি, আর চাকরী না পেয়ে অর্ডার সাপ্লাই।  দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তপন চমকে তাকাল, "বাবা, শরীর খারাপ নাকি! 

"নাঃ , কিছু নয়"- উত্তর হরেনের। 

বাড়িতে ফিরে দেখে, তনিমা গলদঘর্ম হয়ে বসে আছে, একটা হাত ঘটিতে ঢুকিয়ে। 

"কি, হোলো?"বলতেই রণচণ্ডী হয়ে তনিমা ঘটিসমেত হাত নিয়ে হরেনের দিকে তেড়ে আসে। "নাক ফাটাবো তোমার "

"মা ,মা" আবার পরিত্রাতার ভূমিকায় ছেলে । সাহস করে হরেন বলে, "কিন্তু  তুমি ঘটিতে হাত ঢুকিয়ে রেখেছোই বা কেন? বার করো, বক্সিং প্র্যাক্টিস করছিলে নাকি!" বারুদে আগুন লাগতে যাচ্ছিল, তপন থামালো, "মায়ের হাত ঘটিতে ফেঁসে গেছে, বুঝতে পারছো না"।

এমন সময় একটা হট্টগোল শোনা গেল বাইরে, "নাকু, বাড়িতে আছো? বাইরে এসো, -ব্যাটা হরু, --ঘোষের পো, -পয়সা আজই নেবো, না হলে তোর গুষ্টির  *** যাবো"। হরেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে, পিছন পিছন তনিমা। দেখা গেলো পাওনাদাররা একসাথে এসেছে। পিছনে দাঁড়িয়ে রাজু-রজনীকান্ত- এর স্টাইলে। বিপদ দেখে হরেন হাত কচলাতে থাকে। রাজু কলার ধরতে গেলে, রণচণ্ডী তনিমা ওই ঘটিবদ্ধ হাত ধোনির হেলিকপ্টার শটের ঢঙে ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে আসে, "রাজু তোর একদিন কি আমার একদিন, আমার বরের গায়ে হাত"। রাজু পালাবার পথ পায় না। জনতা ছত্রভঙ্গ। আর ঘটিটাও তনিমার হস্তমুক্ত হয়ে সোজা ওপরে উঠে তালগাছের মাথায়। পাশের বাড়ির ডেঁপো ছোকরা, পকাই তাই দেখে দুহাত তুলে ছক্কার সাইন দেখিয়ে বললো," কাকিমা, পুরো ওভার বাউন্ডারি, আগে ক্রিকেট খেলতে নাকি!" এবারে তনিমা লজ্জাবতী  তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়েন। এই লজ্জারুণা রূপ কতদিন দেখেনি হরেন। মনে মনে গুনগুন করে, "রূপসী দোহাই তোমার "! তবে গাওয়ার সাহস হয় না, এই যা।পরের দিন সকাল।হরেন দেখে বৌ খুব খুশী। তনিমা বলে,"দেখেছো,আজ সারাবাংলা নিউজ , তোমার ছেলেকে দুলাখ দেবে, "প্রতিভার খোঁজ" বিভাগ ঘোষণা করেছে। মনটা খুশিতে ভরে যায়। কিন্তু ছেলেটা গেলো কোথায়? 

ছেলে ফিরলো দশটা নাগাদ। একটু গম্ভীর,  আনমনা। "কোথায় গেছিলি বাবা?" হরেন তাকিয়ে থাকে, ছেলের উত্তরের অপেক্ষায়। কথা এড়িয়ে তপন বলে," বাবা,চারটের মধ্যেই রেডি হয়ে থেকো, সারাবাংলা গাড়ী পাঠাবে"। -- জমকালো অনুষ্ঠান।মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন।পিঠ চাপড়াচ্ছেন তপনের--জিজ্ঞেস করলেন, " তুমি কি করতে চাও? "তপনের সংক্ষিপ্ত উত্তর,"দেশের কাজ"! হাততালি দিচ্ছে সবাই। গর্বিত হরেনও হাততালি দিতে থাকে। গাড়ী পৌঁছে দেয় বাড়ী।রাস্তায় ছেলেটা কেন যে এত গম্ভীর হয়ে থাকলো বোঝা গেলো না।নাকে হাত বুলিয়ে মাথা উঁচু করে গাড়ী থেকে নামছে হরেন।ভাবখানা এই,মুখ্যমন্ত্রীর হাত যার ছেলের মাথায় সে অন্যকে ভয় পাবে কেন?বাড়ির সামনে বিরাট জটলা।এই একটু আগে টিভি চ্যানেলে  সবাই দেখেছে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।সবাই এমন সোনার চাঁদ ছেলেকে দেখতে চায়।  পিতা হিসাবে গর্ব অনুভব করে হরেন। 

পরের দুদিন ছেলে সকালে বেরিয়ে যায় , সন্ধ্যাবেলা মুখ শুকিয়ে ফেরে।জিজ্ঞাসা করলে বলে ,"ফর্ম ভরছিলাম।" তৃতীয় দিন , ছেলের বিছানার পাশে একটা নোট , লেখা,  " বাবা, তোমার আশা পূর্ণ করতে পারলাম না,আমি দেশের কাজে যাচ্ছি। আমি জানি তোমার অনেক দেনা। আমি ইনজিনিয়ারিং পড়লে তোমার দেনা বাড়তো। আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না। তাই  মিলিটারি ট্রেনিং নিতে যাচ্ছি। দেশের সেবা সব থেকে সেরা।আমার পাওয়া টাকাগুলো তুমি নিও।টাকা বালিশের তলায় পাবে কিছুটা দেনা শোধ করো। না নিলে খুব দুঃখ পাবো।বাকিটা আমি শোধ করে দেবো ধীরে ধীরে। তুমি ও মা আমার প্রণাম নিও।আমি পোস্টিং পেলে জানাব, তার আগে খোঁজ কোরো না। "

ইতি, তপু। 

চোখে শূন্যতা-হরেনের! সামনে তনিমা কাঁদছে-ভগবানকে দোষ দেবে,না ধন্যবাদ দেবে, বুজতে পারছে না । হাতজোড় করে শূন্যের দিকে নমস্কার জানালো-- বোধহয় ছেলের উদ্দেশ্যেই হবে। 


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024