লেখিকা রোকেয়া ইসলাম -এর একটি গল্প

 কুকুরের কান্না 



 

ইদানীং বেশিরভাগ রাতেই এমন হচ্ছে পারভীনের। ভয়ংকর স্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নের ভয়াবহ রেশটা থেকে যায়। দুচিন্তায় আজানা আশংকায় বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে। 

বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালাতে গিয়েও থেমে হাতটা নামিয়ে বাথরুমে ঢোকে। কমোডে বসে পড়ে থপ করে। অনেকক্ষণ ধরে জল বিয়োগ করে। 

বাথরুম থেকে বেরুতে গিয়েও বেশিনের কাছে যায়। হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে কলটা ছেড়ে দেয়। হাতে পানির ফোটা নিয়ে পানির কল বন্ধ করে ইচ্ছেমত ফেনা তুলে। কবজি ছাড়িয়ে কনুই অবধি ফেনা নিয়ে ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলে। 

বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কাপড় শুকানোর তারে ঝুলছে তোয়ালে। হাত দুখান মুছে নেয়। 

চামড়া টান টান লাগছে। একটু লোসন বা গ্লিসারিন জাতীয় কিছু মাখতে হবে। 

আনুমানেই এতোদিনের চেনা ঘরে ঢুকে বোতল খুলে পরিমাণ মত লোসন নিয়ে হাতে মাখাতে মাখাতে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। 

এতোক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখলো। মনটা সরাতে চেষ্টা করলো। তবুও মনের ভেতরের দুচিন্তা একটুও কমে না। ভেতরের ভয় জমে শক্ত হয়ে বসে গেছে।

নিচের রাস্তার দিকে তাকাতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। মিরপুর বাজারের ব্যাস্ত রাস্তা এটা। এখন সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। নেতিয়ে পড়ে থাকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া মানুসের কথা মনে পড়ে। ডাব শুকিয়ে নারকেল হয়। মানুষের বয়স হলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে উঠে। এখন নির্জন রাস্তার অন্যরকম ধরা দিচ্ছে। 


সামনের দোকানগুলোর সাটারের খাঁজে খাঁজে পুরু ধুলোর আস্তর। দুটো টংএর দোকান নীল মোটা প্লাষ্টিকের উপরটার রঙ বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার লাইটের আলো পড়ে ভেতরের নীল রঙের হালকা আভাস বোঝা যাচ্ছে। 

সামনের সু-উচ্চু ভবনের ফাঁক ফোকর এড়িয়ে দৃষ্টি কেড়ে নেয় আকাশ। ঝকঝকে আকাশে তাঁরার বাগান। দৃষ্টি ঘুরিয়ে পশ্চিম আকাশে চোখ পড়তেই সপ্তর্ষী মন্ডল তীর ধনূক উচিয়ে রাগী চোখে আকাশ পাহারা দিচ্ছে। 

আকাশ থেকে একেবারে নিষ্প্রাণ রাস্তায় চোখ যায়। ল্যাম্পপোষ্টে ঝুলছে নির্বাচনি পোষ্টার। একটা শুকনো কালো বেড়াল আস্তে আস্তে হেঁটে যায় কিছু দূর গিয়েই দেখে একটা কুকুর শুয়ে আছে। বেড়ালটার দিকে তাকায়। অন্যদিনের মত ধেয়ে আসে না। পাশ দিয়ে হেঁটে যায় খদ্দেরের খোঁজে বেশ্যা। বেড়ালটা একটু এগিয়ে গেলেই কুকুরটা কাঁদতে শুরু করে। কুকুরের বিলাপ করে কান্না শুনে পারভীনের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। 

পারভীনের দাদি বলতেন "কুকুর পরিবেশর বিরুপ অবস্থা আগেই টের পায়"।কুকুর কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ করে হে মানুষ তোমাদের সামনে ভয়ংকর বিপদ। 


ভয়ংকর বিপদ ধেয়ে আসছে বুঝতে পারছে বিশ্ববাসী। বাংলাদেশও সাথে আছে ঘোর বিপদের। অদৃশ্য শত্রু। সামান্য এক অনুবীজ। করোনা। 

চেনা জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে প্রতিশেবক আবিস্কৃত হয়নি। প্রতিরোধ করতে হচ্ছে। 

কাজের লোকসহ বাইরের মানুষ ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। স্কুল কলেজ বন্ধ। বাসার ছোটরা বাইরে যাচ্ছে না। কিন্তু পুত্র কন্যা জামাতা দায়িত্বশীল কাজে নিয়োজিত। ওরা নিয়ম মেনেই কাজে যাচ্ছে। সারাক্ষণ মনটা কাঁটা হয়ে থাকে পারভীনের। 

সারাদিন টিভির নিউজ দেখা ছাড়াও সময় সময়ে ফেবুতে বসছে। ইনবক্স ভরে যাচ্ছে বিভিন্ন খবরে। কোনটা দেখে কোনটা দেখে না। 

এখন এই রাতে বুক ধুকপুক নিয়ে বসে আছে বারান্দায়। দেখছে মৃত এক নগরীকে। 


কুকুরটা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ মনে হয় সামনের দুতিনটা খাবারের দোকান তো দীর্ঘদিন বন্ধ। তাহলে এই কুকুর বেড়াল খাচ্ছে কোথায়!! 

ক্ষুধায় কাঁদছে না তো! পারভীন ওঠে ডাইনিং রুমে যায়। ফ্রিজ খুলে আগামীকালের জন্য তৈরি করা রুটি থেকে গোটা চারেক রুটি বের করে কিচেনে ঢুকে যায়। 


কাজের ছুটা বুয়াকে আসতে মানা করেছে। ছোট একজন মেয়ে মুন্নী আছে। ওকে নিয়েই চলতে হচ্ছে। 


মুন্নী খুব বুদ্ধিমান। সকালেই ধরে ফেলবে গোণা রুটি থেকে চারটি রুটি কম। 

সহজে আর চারটে রুটি গড়তে চাইবে না। থাক পারভীন নিজে নাস্তা সারবে অন্যকিছু দিয়ে। যাতে মুন্নীর কষ্ট না হয় 


রুটি সেঁকে বারান্দায় নিয়ে আসে। কুকুর কলজে কাঁপানো কান্না কাঁদছে। 

তিনতলা থেকে ছুঁড়ে দেয় কুকুরের মুখের কাছে। বেড়ালটাকে দেখা যাচ্ছে না। 

কুকুর কাঁদতেই থাকে। 


এবার ভয়ে পারভীনের হাত পা কাঁপতে থাকে। একটা চেয়ার টেনে বসে গ্রীলে মাথা রাখতেই চোখে পড়ে বারান্দার টবে ফুটে আছে অজস্র সন্ধ্যা মালতি। আরে আগে তো দেখা হয়নি। গতবারের লাগানো গাছের বীজ পরে এই নতুন গাছ হয়েছে। 

আগের গাছের ফুলের রঙ ছিল গাঢ় গোলাপি। আর এবারের ফুলের রঙ হলুদ 

আবাক কান্ড!!গোলাপি ফুলের রঙ গোলাপিই তো হবে। হলুদ হলো কেন। 


নিচু হয়ে বসে হাত দিয়ে ফুলগুলোতেই হাত রাখতেই খুব হালকা সুবাস নাকে লাগে। নধর সবুজ পাতাগুলো যৌবন সংগীতে রত। দূরের ডালটাতে বেশ কয়েকটি ফুল ধরে আছে। হলুদ আর গোলাপি ছিটে নিয়ে সগৌরবে হাসছে। 

আবার কুকুরের কান্নার শব্দ কানে আসে। পারভীন ওঠে দাঁড়িতেই দেখে গ্রীলে ঝুলছে বেশ কয়েকটি আর্কিড। দুটো স্পাইকে বেগুনি ফুল আপন মহিমায় সমুজ্জল। আলকানন্দার স্বাস্থ্যবান পাতার কোরক থেকে পুষ্পের সম্ভাবনা। হাত বুলাতে বুলাতে কুকুরের দিকে চোখ যায়। 


কুকুর নির্বিঘ্নে রুটিগুলো মুখের কাছে টেনে নিয়ে বারান্দায় চোখ রাখে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024