Sunday, October 3, 2021

লেখক সুজিত চট্টোপাধ্যায় -এর একটি রম্য রচনা

 ছেঁড়া প্যান্ট বনাম প্যাটন ট্যাঙ্ক 



প্যাটন ট্যাঙ্ক যুগের লোকেরা জানতোনা একদিন ছেঁড়া প্যান্টের যুগ আসবে। 

ছেঁড়া প্যান্ট দিয়ে শরীরের অসভ্য জায়গা ঢেকে ঢুকে বুক চিতিয়ে বলবে,, 

এই দ্যাখ , এটা তোর চাইতে দামী। 

প্যাটন ট্যাঙ্ক যুগের স্মার্ট লোকগুলো 

হটাৎ ক্যাবলাকান্ত হয়ে গিয়ে ছেঁড়া প্যান্টের ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে থাকবে আর মনে মনে বলবে,,, 

একি?? কেন ?? 

কানের পাশে ফিসফিস করে কেউ একজন এক কানে রিং দুল পড়ে পানমশলার থুথু জমানো মুখে উচ্চারণ করে যাবে,,, 

একেই বলে সভ্যতা,, চাঁদু,,,। ফ্যাশন সভ্যতা। 


সভ্যতা কী। সহজ কথায় বলতে গেলে , 

মিছরি , সোজা হাতে ধরে খাও কিংবা বাঁকা হাতে। স্বাদ একই থাকবে , মিষ্টি । 

পাড়ার জনদরদী মিশুকে মিঠু বৌদি পেখম তোলা ময়ূরের মতো সেজেগুজে , ঝর্ণার মতো কলকল করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বান্ধবী তনু কে বললো ,,,, 

জানিস , কালকে ইউ টিউবে দারুণ একটা রান্না শিখলাম। 

__ কি রে ? উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। 

__ উচ্ছের বিরিয়ানি,, 

__ এ মা,, উচ্ছে দিয়ে,,, ভালো হবে ? 

স্বরে সন্দেহের তিতকুটে গন্ধ । 

মিঠু বৌদি ঠোঁট বাঁকিয়ে চ্যালেঞ্জ নেবার ভঙ্গিতে বললো ,,,,, 

হবেনা মানে,, ফাটাফাটি হবে। আমি তোকে ক`রে খাওয়াবো। 

এসে গেল সেই চ্যালেঞ্জিং উচ্ছে বিরিয়ানি ডে। সন্ধ্যেবেলাই মিঠু বৌদি উড়ন্ত পাখির মতো উচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে এক গামলা উচ্ছে বিরিয়ানি উপহার দিয়ে গেল। 

ডিনারের ব্যবস্থা পাকা । সুতরাং আজ তনুর রাতের রান্না নেই। সকালের চিকেন কারি ফ্রিজে রাখা আছে। গরম ক`রে নিলেই হবে। 


যথাসময়ে ডাইনিং টেবিলে ইউ টিউবের বিশেষ বিরিয়ানি পরিবেশিত হলো। হায় হায়,, একি হলো ,, ছি ছি ছি ,, এটা একটা খাদ্য ,, মানুষ খায় ? গরুও ছোঁবে না। 

তনুর স্বামী ছুটে চলে গেল বেসিনে। ওয়াক থু ওয়াক থু ক`রে ভালো করে মুখ ধুয়ে এসে বললো ,,, 

তোমার সুন্দরী বান্ধবীকে বলে দিও। দুনিয়ায় বহু খাদ্য আছে , কিন্তু তার সবই মানুষের জন্যে নয়। 

ভাগ্যিস ঘরে খানিকটা মুড়ি ছিল। চিকেনকারি দিয়ে মুড়ি , খুব একটা মন্দ নয়।

বোঝা গেল , যেখানে যা মানানসই সেটাই সভ্যতা। অন্যথায় ভোগান্তির একশেষ। 


প্যাটন ট্যাঙ্কের যুগে চোর আসতো রাতে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। 

ধরা পড়লে রক্ষে নেই। বারোয়ারী ঠ্যাঙানি। মেরে লাট করে দেবে।শেষে কেউ একজন বীরপুরুষ কাঁচি দিয়ে মাথার চুল কোপচে খামচা করে কেটে , শেষ বারের মতো শাসানি দিয়ে ছেড়ে দেবে। 

যুগাবসানে চোর আসে দিনদুপুরের মধ্যিখানে। চুল নিজেই মেল পার্লার থেকে চোরছাঁট ছেঁটে তাতে ব্রাউন কালার লাগিয়ে দেবানন্দ স্টাইলে বেঁকে বেঁকে এসে ক্লায়েন্টের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে , গালে ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে , পেটের কাছে সেই জায়গায় দেশীগান ঠেঁসে ধোরে বলে ,,, 

কী আছে বের ক`রে দে। শিগগির। 

ক্লায়েন্ট বেচারা কাঁপতে কাঁপতে ঘড়ি ওয়ালেট মোবাইল ফোন স্বহস্তে সর্বশান্ত হয়ে কেৎরে দাঁড়িয়ে থাকলো। 

ছেঁড়া প্যান্ট স্টাইলিশ চোর যাবার আগে শেষ শাসানি দিয়ে গেল,,,, 

বেশি বাড়াবাড়ি করলে দাদাকে বলে দেবো, ম্যাঁও সামলাতে পারবিনা। তোর পুলিশ বাবা আমার জাঙ্গিয়া কেচে দেবে। যা ফোট।


মলয় মল্লিক প্রতিদিনের মতো সেদিনও তার কাজের জায়গায় যাবেন বলে সদর দরজা খুলে বাইরে পা রেখেই চমকে এবং বমকে গেলেন। স্বাভাবিক। 

দরজার সামনে চাপচাপ রক্ত , মরা মুরগির ঠ্যাং পালক ছত্রাকার হয়ে রয়েছে। 

একটি ছোকরা ছেলে , মোটা বেঁটে সাইজের কাঠের গুঁড়ির ওপর ফটাফট করে মুরগী কেটে বিক্রি করছে। 

মলয় মল্লিক রেগে কাঁই। মুরগী কাটা ছেলেটাকে তেড়ে গেলেন ,,,, 

আহাম্মক , আমার বাড়ির দরজায় মুরগী বেচার জায়গা বানিয়ে ফেললি ? যাওয়া আসায় রাস্তা । যা খুশি তাই করবি , কী ভেবেছিস কী ; হঠা,, হঠা সব এখন থেকে । এক্ষুনি সরিয়ে নে বলছি,, নইলে,, 

এইবারে মুরগী কাটা ছোকরা উঠে দাঁড়ালো। পরনে সেই ফ্যাশানের ছেঁড়াপ্যান্ট। গায়ে স্লিভলেস গেঞ্জি। সারাগায়ে রক্তের ছিটে। একেবারে নিখুঁত বুটিক ডিজাইন। 

__ নইলে কী? বেশি ভাঁজবেন না। ব্যবসা করছি। কোনও চুরিচামারি করছিনা। বেকার বাঙালির ছেলে। সৎ পথে করে খাচ্ছি। ব্যাগড়া মারবেন না। 

__ শোনো শোনো,, তোমাকে ব্যবসা করতে মানা করিনি। আমার দরজা টুকু ছেড়ে , যেখানে খুশি বসো। 

__ দূর মশাই , দরজা দেখাচ্ছে। দরজা আপনার , তাই ব'লে কি কর্পোরেশনের ফুটপাতও আপনার ? লে হালুয়া। 

কিচ্ছু সরবে টরবে না। যান তো , যা পারেন করে নিন। তারপর বুঝবেন আমি কে,,। 

লিখে রাখুন আমার নাম ডাব্বু। আট থেকে আশি সব্বাই একডাকে চেনে। 

দাদা এখানে বসতে বলেছে , ব্যাস। 

কোনও কথা হবেনা। 

ততক্ষণে লোক জড়ো হয়ে গেছে। লাগদাই সিন। এসব ক্লাইম্যাক্স সিন দেখার রসিক পাবলিক প্রচুর । 

মল্লিক মশাই এবার একটু নরম হয়ে বললেন,,, 

ঠিক আছে , বসো এখানেই বসো। ব্যবসা করো। কেউ তো মানা করছে না। তাই বলে মুরগী ? ঘরের সামনে না না এটা কীভাবে সম্ভব ? গন্ধে কেউ টিঁকতে পারবে এখানে? 

অন্যকিছু করো , ফুল বিক্রি করো। 

__ হাসালেন দাদা। এই গুড্ডু বসে বসে ফুল বেলপাতা বেচবে ? হেঁ হেঁ,,,, আপনি ফুলের গন্ধ শুঁকবেন ? হেঁ হেঁ ,,,, 

 শুনুন স্যার , ছোট মুখে একটা বড়ো কথা বলে রাখি , ভবিষ্যতে মিলিয়ে নেবেন। 

মা কালীর দয়ায় যদি এই মুরগির ব্যবসাটা জমে যায় , তাহলে আপনার পাশের বাড়িটাই আমি কিনবো। প্রতিবেশী । দুবেলা দেখা হবে। 

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে আবারও বসে পড়ে ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ করে মুরগী কাটতে শুরু করলো। 

মল্লিক মশাই রাগে ফুলছিলেন। মনে মনে বললেন ,,, 

এটা যদি আমাদের সেই প্যাটন ট্যাঙ্কের জামানা হতো , তাহলে এক্ষুনি ও-ই মুরগির জায়গায় তোকে ফেলে ঘচাং ফু করে দিতাম শালা । 


কী আর করা যাবে। সেই প্যাটন ট্যাঙ্কও নেই তার দাপুটে গর্জনও নেই। 

এখন ফ্যাশনের ছেঁড়াপ্যান্টের মুখ ভ্যাংচানো দেখার যুগ । একটু মানিয়ে নাও গুরু। সহ্যশক্তি মহাশক্তি , মহাগুনও বটে ।

 চিন্তা নেই । অনিয়ম টেঁকসই হয়না। 

দু'দিন বৈ তো নয় ।


( প্যাটন ট্যাঙ্ক একটি পুরাতন যুদ্ধাস্ত্র । বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যবহার করে অসামান্য সাফল্য পেয়েছিল ভারতীয় বাহিনী ) 



No comments: